"দীর্ঘদিনের প্রেম ছিল আমাদের। যদিও সম্পর্কে আমরা খালাতো ভাইবোন ছিলাম। কিন্তু তাতে কি? প্রেম কি আর এত আগপাছ ভেবে হয় রে পাগলা! এসব দেখে কখনো প্রেম হয় নারে! বিশ্বাস কর আমাদের প্রেমটা অনেক গাঢ় ছিল কিন্তু কোনোদিন আমরা মাত্রা অতিক্রম করিনি। এমনও কত অন্তরঙ্গ সময় গেছে যে জুঁই আমার কাঁধে মাথা দিয়ে বসে আছে আর সমস্ত বাসায় আমরা মাত্র দু'জন মানুষ তবুও আমি ঐ ধরণের কোনো কিছু করার চিন্তা ভাবনা মাথায় আনিনি। আমার জায়গায় অন্য কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক শক্তসমর্থ পুরুষ থাকলে তার পক্ষে নিজেকে সংবরণ করা নিতান্তই দুঃসাধ্য কাজ হয়ে দাড়াত বটে! কারণ আর যাই করি বুকের মধ্যে যে পুরো ত্রিশ পারা কুরআন শরীফ ধারণ করেছি এজন্যে না চাইলেও অনেক কিছু করা থেকে আপনাআপনিই নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারি।"
.
এতটুকু বলে জাইজি একটু দম নিল। জাইজি হাসান আমার রুমমেট। এতক্ষণ ধরে ও ওর এক বড় ভাইয়ের গল্প বলছিল। ক্লাস করে এসে ব্যাগটা কোনোরকম কাঁধ থেকে নামিয়ে সোজা বিছানার উপর ধপাস করে পড়ে গেছি। উঠে যে জুতা, মোজা খুলে ড্রেস পাল্টাব ততটুকু শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই। আজকে এত পরিমাণ ক্লান্ত লাগছে। পরে না পেরে ওকে বললাম যে, একটা গল্প শোনাতে। কোনোকিছু না খুলেই ঐ অবস্থায় শুয়ে শুয়ে ওর গল্প শুনছি। আমি আর জাইজি ঢাকার স্বনামধন্য একটা কলেজের স্টুডেন্ট। থাকি এক সাথেই কলেজের হাউজে। হাউজ জীবনের বন্দিত্ব ঘোচাতে আমরা প্রায়শই এমন গল্পের আসর বসিয়ে থাকি। ওর সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়। আমার দেখা সবথেকে বিস্ময়কর ও প্রাণোবন্ত এক তরুণ। কি নেই ওর মধ্যে! কোনো কিছুর কমতি আছে বলে মনে হয়না। যাহোক, ওর সম্পর্কে বিস্তারিত গল্প আরেকদিন করা যাবে। তারপর ও আবার বলতে শুরু করল।
.
"আমাদের প্রেম এভাবে চলতে লাগল বেশ কিছুদিন। তারপর হঠাৎ কেমন করে যেন বিষয়টা মোটামুটি পরিবারের সকলের নিকট ছড়িয়ে গেল। আসলে বলেনা প্রেম জিনিসটা কখনো কারো কাছ থেকে লুকানো যায় না। এক সময় না এক সময় জানাজানি হয়েই যায়, হোক সেটা অলৌকিক ভাবে বা অন্যভাবে। আমাদের বেলায়ও তাই হলো। একেক করে আমার মা থেকে শুরু করে যখন খালা তথা জুঁইয়ের মা পর্যন্ত জেনে গেল তখন খালা আমার মাকে যথারীতি শাসাতে আরম্ভ করল। ভাবটা এমন চুরিটা আমি একাই করেছি। তার মেয়ে একেবারে নিরেট সাধু! খালা আমার মাকে হুমকি দিতে লাগল এই বলে যে, দেখ আমাদের মধ্যকার বোনের সম্পর্কটা নিজের হাতে নষ্ট করিস না। তোর ছেলেকে বল সাবধান হয়ে যেতে। আর কখনো যেন আমার মেয়ের পাশে ঘেসার চেষ্টা না করে। এসব হওয়ার পরও কোনো দুঃখ পেলাম না। কিন্তু কষ্টটা লাগল তখন যখন পরদিন আমার খালা জুঁইকে আমার সামনে এনে জিজ্ঞাসা করল তোর ভাইয়ের সাথে নাকি তোর অন্য কোনো সম্পর্ক চলছে। আর উত্তরে ও যখন বলল, না মা কে বলেছে ওসব! আমি তো ভাইয়াকে একেবারে নিজের ভাইয়ের মত দেখি। ভাইয়াকে নিয়ে কখনো ঐ ধরণের ভাবনা ভাবিইনি। বরং ভাইয়া আমাকে নিয়ে এসব ভাবে। আমি তো এক মুহূর্তের জন্য পুরো পৃথিবী থেকে একেবারে নেই হয়ে গেলাম! শালা জুতোই গুঁ লাগিয়ে মুখে বাড়ি দিলেও তো এতটা অপমানবোধ করতাম না যতটা না অপমানবোধ করলাম ওর কথায়।
.
ঐ দিন খালা আমার মাকে জুঁইয়ের বিয়ের অগ্রীম দাওয়াত দিয়ে গেল। আর বলে গেল আমার থেকে শতগুণ ভালো কোনো ছেলের সাথে জুঁইয়ের বিয়ে দিবে। শুনে আমিও খুশি হলাম। অন্তত আমার কাছে থাকলে যেমন থাকত তার থেকে জীবনের বাকি সময়টা অন্য কারো কাছে থেকে ভালো কাটবে। এটা জেনেই আমার মনের মধ্যে এক প্রকার সুখ অনুভূত হতে লাগল। তার ক'দিন বাদেই ওর বিয়ে হয়ে গেল। ছেলে কি করে বা ছেলে দেখতে কেমন, কেমন বিত্ত-বৈভবের মালিক তা জানিওনা আর জানারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি। তবে এতদিনে বুঝলাম মেয়েরা সুনিপুণ ভাবে মিথ্যা বলার অপার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। যা বড় বড় কাজ্জাবদেরকেও ক্ষেত্র বিশেষ হার মানায়। ভাবলাম আমারও বিয়ে করা দরকার। এ পরিস্থিতিতে অবিবাহিত থেকে নিজেকে কষ্ট দেয়ার কোনো মানে হয় না! বাবা মাকে জানালাম। তারাও সাঁই দিলো আমার কথায়। পাত্রী দেখা শুরু হলো।
.
প্রথমে একটা পাত্রীর খোঁজ পাওয়া গেল। মেয়ের পরিবার মোটামুটি বেশ বিত্তশালী আর ধার্মিকও বটে। কিন্তু সমস্যাটা বাঁধল আরেক জায়গায়। আমরা রাজী কিন্তু মেয়েপক্ষ রাজী না। কারণ হিসেবে দেখাল ছেলে শুধুমাত্র হাফেজ তাছাড়া আর কিছু করেনা এ কারণে তারা তাদের মেয়েকে এমন একটা ছেলের হাতে তুলে দিতে ভরসা পাচ্ছে না। কিন্তু আমার যে আরও অনেকগুলো ব্যবসা আছে সে বিষয়টা ওদেরকে বললাম না। শুনতে অদ্ভূত লাগলেও এটাই সত্যি। মেয়েকে বিয়ে দিলে শুধুমাত্র হাফেজ এই যোগ্যতা দেখেই বিয়ে দিতে হবে না হলে না। যদি সম্ভব হয় তাহলে মেয়ে বিয়ে দেন না হলে রাস্তা মাপেন। একেবারে সোজা হিসেব। এ নিয়ে পানি অনেকদূর গড়ানোর পরে মেয়ে পক্ষ রাজী হলো। নির্দিষ্ট দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করলাম। বিয়ের আগে মেয়ে পক্ষ ভেবেছিল ছেলে তো শুধুমাত্র হাফেজ তাছাড়া আর কোনো কিছু করে না। বিয়ের দেনমোহরও হয়ত দিতে পারবে না ঠিকমত। কিন্তু বিয়ের সময় দেখা গেল দেনমোহর তো ঠিকমত দিলামই নগদে, উপরন্তু কনেকে আরো লাখটাকার গহনা ও অঙ্গসজ্জার জিনিসপাতি কিনে দিলাম। এমনকি বিয়ের যাবতীয় খরচ সব আমিই বহন করলাম। মেয়ে পক্ষের একটি টাকাও খরচ করতে হয়নি।
.
এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। বিয়ের দিন সবাই উপস্থিত আমাদের বাড়িতে। আমি সহ বাসার সবাই গোছগাছ করতে ব্যস্ত। বিয়ে পড়ানো হবে মেয়ের বাড়িতে। সকাল সকাল গুছিয়ে যেতে হবে সেখানে। এমন সময় জুঁই ফোন করল শশুর বাড়ি থেকে। সবাই আসলেও ও আসেনি। ওর স্বামী নাকি ওকে আসতে দেয়নি। ফোন ধরতেই কান্নার আওয়াজ। ওপাশ থেকে হুহ করে কেঁদে ওঠল জুঁই। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে উঠল ভাইয়া তুই আমাকে এসে নিয়ে যা। আমাকে আসতে দিচ্ছে না ওরা। আমি তখন ওর কথা শুনে আস্তে করে ফোনটা রেখে দিলাম। এ মুহূর্তে বিয়ের সাজ ছেড়ে ওকে গিয়ে তো আর আমার পক্ষে আনা সম্ভব না। যদিও আমার খারাপ লাগছিল ও আসতে পারছিল না বিধায় কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না এখানে। বিয়ে করে যখন বউ নিয়ে বাড়িতে ফিরছি। সেই মুহূর্তে আরেকটা ফোন আসল জুঁইয়ের শশুর বাড়ি থেকে। খবর আসল জুঁই আত্নহত্যা করেছে!"
.
এতক্ষণ আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জাইজির কথা শুনছিলাম। শেষের কথাটা শুনে চোখের পলকে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। কি শুনলাম এ আমি! এটা তো কোনো বাংলা সিনেমার গল্প নয়। জাইজির ভাইয়ের সত্য কাহিনী! কারণ আমি জানি ও কখনো মিথ্যে কথা বলেনা। বাস্তবেও এমন হওয়া সম্ভব? ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। এবার গল্পের বাকিটুকু বলার জন্য রুমে আরো যারা ছিলাম আর ওর গল্প একত্রে শুনছিলাম সকলে মিলে পীড়াপীড়ি করতে লাগলাম।
.
জাইজি আবার বলতে লাগল ওর ভাইয়ের বরাত দিয়ে, " জুঁই আত্মহত্যা করেছে এটা শুনে নিছক ইয়ার্কি মনে হতে লাগল আমার কাছে। কেন আত্মহত্যা করতে হবে কেন? বিয়েতে ওর স্বামী আসতে দেয়নি বলে? পরে মায়ের কাছ থেকে শুনলাম জুঁইকে নাকি ওর স্বামী প্রায়শই অত্যচার করত বিভিন্ন ছলছুঁতোয়। কিন্তু এটা আমার খালার পরিবার কৌশলে এড়িয়ে গেছে আমাদের কাছ থেকে। আমার বিয়ের দিন যখন ওকে আসতে দেয়া হবে না জানার পর হয়ত ও অনেক বেশিমাত্রায় কষ্ট পেয়েছিল। কিন্তু কি কারণে সেটা স্পষ্ট করে বলার কোনো উপায় নেই। আমার সাথে করা ইতিপূর্বের ধূর্ত আচরণের জন্য আফসোস হওয়ার কারণে? নাকি আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এটা ও সহ্য করতে পারছিলো না তাই? কোনটা কে জানে! তবে যাই বলিস জাইজি আমি যে মেয়েটাকে বউ হিসেবে পেয়েছি তার কোনো তুলনা হয় না! জীবনে আর কিছু পাই বা না পাই অন্তত ওর মত একজন স্ত্রীকে পেয়ে আমি ধন্য। মাঝে বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলাম। একেবারে শয্যাশায়িত অবস্থায়। সে সময় আমি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ও একটা রাতও ঘুমায়নি। প্রতিটা রাত আমার শিয়রের ধারে বসে জেগে ছিল। আরও কত গুণের কথা আছে যেগুলো বলে শেষ করা যাবে না। তবে জুঁইয়ের ব্যাপারে আমার কোনো আফসোস নেই। কারণ পরবর্তীতে আফসোস করার মত কোনো কাজ আমি করিনি ওর সাথে। ওর কপাল ও নিজেই পুড়িয়েছে"
.
জাইজি এ পর্যন্ত বলে ওর গল্প শেষ করতে যাচ্ছিল। কিন্তু সে সময় আমরা আবার সবাই ছেঁকে ধরলাম ওর ভাইয়ের খালার শেষ ভাষ্যটা কেমন ছিল এটা জানার জন্য। অহংকারী মহিলার অনুভূতিটা কেমন ছিল না জানলে সুখ হচ্ছে না! জাইজির ভাইয়ের সাথে বিয়ে হলে তো অন্তত যেমনই থাকুক জানে বেঁচে থাকতে পারত কিন্তু এখন যে মারাই গেল তাহলে লাভটা হলো কি? জাইজি বলল, পরে আর তার ভাইয়ের খালার কথা জানা যায়নি। তবে যাই হোক, মহিলা নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। এখন আফসোস করে করে জীবনের বাকি সময়টা পার করুক। সেদিনের গল্পের আসর তখনকার মত ওখানেই শেষ হলো।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ৮:৫৬