কলেজের জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে গেল জয়া। তাদের সংসারটা কি এবার তাহলে আর টিকবেই না? সবাই কি বলবে তখন তাকে? মা বাবা কি খুব শান্তিতে থাকবে তখন? তারা তো প্রায়ই বলে কবেই নাকি তারা আলাদা হয়ে যেত শুধু নাকি জয়ার মুখের দিকে তাকিয়েই আলাদা হয়নি। নিজেকে তাদের গলার কাটা মনে হয় তখন । মনে হয় তার করনেই আটকে আছে দুটো মানুষের জীবন। ভাইয়্যা কে অবশ্য কখনো এই কথা বলে না। বাসার অশান্তি ভাইয়্যা কে কখনো স্পর্শ করে বলে মনে হয় না। মা বাবা, জনি আর জয়া এই তাদের সংসার। রাতের পর রাত চোখের জলে জায়নামাজ ভিজিয়ে টিকিয়ে রাখা সংসার।
মা বাবাকে বাসায় একা রেখে কথাও বেড়াতে যেতেও ভয় হয় জয়ার। এই বুঝি খুনাখুনি হয়ে যায়। এরি মধ্যে ফোন আসে রিন্টুর। মনে কষ্ট চেপে আল্লাদি স্বরে কথা বলে সে। ‘'তোমাকে না বল্লাম পাসওয়ার্ড টা দিতে, এখনো দিচ্ছ না কেন? নিশ্চই কোন কাহিনী আছে, হুম।'' ছেলেটার অনেক ধৈর্য। তাকে সবসময় কড়া নজরে রাখে জয়া। কোন মেয়ের দিকে তাকালো কিনা, ফোন ওয়েটিং কেন, ওই মেয়ে তোমার ছবিতে কমেন্ট করলো কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। রিন্টু যদিও এটা কে ভালবাসার আধিক্য ভাবে এটা আসলে জয়ার নিরাপত্তাহীনতা থেকে আসে। রিলেশনশিপে কিছুতেই বিশ্বাস আনতে পারে না সে। বিয়ের নাম শুনলেই ভয় হয় তার। মা-বাবাকে দেখে সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গেছে তার।
জনির কানে সারাদিন ফোন, তার সাথে বাসার কারো কথা বলার জো নেই। মেয়েদের পটানোর অভাবনিয় প্রতিভা নিয়ে সে জন্মেছে। মেয়েদের কাছ থেকে এই গিফট সেই গিফট আসতেই থাকে, তার ফোনে টাকা ও ভরা লাগে না, মেয়েরাই তাকে ফোন দেয়। ইদানিং তার মধ্যে একটা চেইনঞ্জ আসছে। কীভাবে জানি সে খুব ভাল একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। তার পর থেকে সিগারেট ছাড়লো, এখন পড়ার টেবিলেও বসে, কীভাবে জানি একটা পার্ট টাইম জবও জুটিয়ে ফেলেছে । সেদিন সে জয়াকে কিছু কসমেটিক দিয়ে বলল সাবা গিফট করেছে। আজ পর্যন্ত ভাইয়্যার অন্যকোন প্রেমিকা তা করেনি। থ্যাংকস দিতে ফোনে কথা হয় তার মেয়েটার সাথে। খুব মিস্টি কন্ঠ, একটু পর পর খিলখিল করে হাসে, জয়াকে ননদিনী বলে ডাকে, তাকে বলে ভাবী ডাকতে। সংকচে কথা বলতে পারে না জয়া।ঘরের গুমোট পরিবেশে থাকতে থাকতে জয়া কেমন চাপা স্বভাবের হয়ে গেছে আর জনি হয়েছে চাপাবাজ স্বভাবের।
আগে তো বিভিন্ন মেয়ের সাথে চাপা মেরে পটাতোই। এখন সাবার সঙ্গে পর্যন্ত চাপা মারে। সেদিন জয়া শোনে ভাইয়্যা ফোনে বলছে, '‘আমাদের পরিবারটা অনেক সুন্দর, আমরা সবাই অনেক ফ্রেন্ডলি"! একদিন বলে "আজ মা-বাবার ম্যরিজডে এর জন্য বাবা এত্তবড় একটা ফুলের তোড়া নিয়ে বাসায় এসেছে।মা বাবার জন্য শার্ট কিনে রেখেছে।" অথচ জয়ার মা বাবা কখনোই কোন বিশেষ দিন পালন করে না। আর তাদের বাড়ীতে এসবতো স্বপ্ন ।একদিন বলছে "আমাদের মা বাবাদের যুগে যেমন প্রেম ছিল তেমন প্রেমতো আজকাল দেখাই যায় না!" জয়া দেখে ফেললে ফোন রাখে জনি বলে- সাবার মা নাকি বলেন "যে পরিবারে মা-বাবার মধ্যে সম্পর্ক ভাল, বাবা মাকে সম্মান করে সেই ছেলের সাথেই নাকি মেয়ে বিয়ে দিবে। তাহলে নাকি সে বউকে ভালবাসতে জানবে।"তাই এই পন্থা অবলম্ববন। আবার জয়া ভাইয়্যার কথা শোনে আর ভাবে আহা সত্যিই যাদি তাদের পরিবারটা এমন হতো।
একদিন ভাইয়া জয়াকে বলে তারাতারি তৈরি হয়ে নে, সে বোনকে নিয়ে কখনো কোথাও ঘুরতে নিয়ে গেছে এমনটা তো কোনদিনও হয়নি। নিয়ে গেল সাবার বাসায়। সেখানে তার মা তাদের অনেক আপ্যায়ন করলো। বিষেশ করে সাবার তাকে কি খাতির যত্ন, ব্যপারটা এমন যে শশুড়বাড়ী যাওয়ার আগে থেকেই ননদদের কে হাত করে রাখছে। ড্রেসিং টেবিল খুলে বলে "কোন লিপিস্টিক টা, কোন লেইলপালিশ টা তোমার পছন্দ বল, নিয়ে যাও।" বাসায় ফেরারর সময় জয়াকে আইস্ক্রিম কিনে দেয় ভাইয়্যা। আর বলে বাসায় কিছু না বলতে।
-তুইকি ওকে বিয়ে করবি?
-হুম ফাইনাল।
-তোর তো পড়াশোনা এখনো শেয হয়নি,মা-বাবা যাদি রাজি না হয়?
-ওদের কথায় কি আসে যায়?
- উফফ তার মানে তুই আবার আরেকটা অশান্তি না বাধিয়ে ছাড়বি না। আমাদের বাসায় আমাদেরই থাকতে দম বন্ধ হয়ে যায়। নতুন একটা মেয়ে এসে কীভাবে থাকবে আল্লাহ যানে।
-ওএখানে থাকতে যাবে কেন?
-মানে?
-এই পরিবেশে আমার থাকতে আর ভাল্লাগে না। আমি বাসা খুজছি। ওকে কোন ভাবে পড়ায় পালায় বিয়ে করে বাসায় তুলবো। শোন আমার বাসার যা কন্ডিশন মা বাবা জিবনে কোন কিছুতেই একমত হবে না, আর এমন ঘরে কেউই তার মেয়েকে দিবে না, তেইলে আর বিয়ে করা লাগবে না জিবনে।
ভাইয়্যার কথায় পুরা স্তব্ধ হয়ে যায় জয়া। ভাইয়্যা চলে গেলে তো।আরো বেশি একা হয়ে যাবে সে।আর ভাইয়্যা পালিয়ে বিয়ে করলে এই নিয়ে শুরু হবে এক নতুন অশান্তি বাবা মাকেই দোষ দিবে সে মায়ের বেশি আদরের বলে।
জয়ার বাবার আরেকটা বউ আছে বলে গুজব আছে। এটা সত্যি কিনা জানে না জয়া। এদিকে মায়ের ফোনে একটা রং নাম্বার আসলেও ভয় লাগে তার। বাবার সাথে ঝগড়ার পর প্রায়ি মা বলে সে নাকি সব ছেড়ে চলে যাবে। সত্যিই যদি চলে যায়? মা বাবা দুজনে পুরো দুই জগতের মানুষ। কেউ কাউকে বুঝতেও চায় না বোঝাতেও চায় না। তারা দুজনের খুব সম্ভ্রান্ত পরিবারের। সমাজে তাদের একটা সুনাম আছে। শুধুমাত্র এই কারনে তারা একবাড়ীতে থাকেন, তাও এই ভাঙ্গে তো এই ভাঙ্গে করে করে কোমায় আছে এত কাল ধরে। এখনতা অসহ্যের পর্যায়ের চলে গেছে।
জয়া ভাবে ভাইয়্যা পারে সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে চলে যেতে, আমি কেন এমনটা ভাবতে পারি না? ছোট থেকে এগুলা কেমন গা সওয়া হয়ে যেতে যেতেও সওয়া হয় না। ভাইয়্যা দিব্যি প্রেম চালাচ্ছে, আমি কেন পারি না, আমার মন খারাপ প্রভাব পড়ে আমার আর রিন্টুর সম্পর্কে। মা-বাবা অশান্তিতে থাকলে আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারি না।
এসব ভাবতে ভাবতে আরিফের আইডী তে লগইন করে জয়া। ওরে বাবা ফ্রেন্ডলিস্টে এত্ত মেয়ে! দাঁড়াও তোমার বারটা বাজাচ্ছি। সব মেয়ে ডিলিট করে দেয় দিচ্ছি।আবার যে সসব গ্রুপ ছবিতে মেয়েরা আছে সেগুলো ডিলিট করে দেয়।
একটু পর রিন্টু রেগে গিয়ে ফোন দেয় । আমার সব মেয়ে কাজিন গুলাকে তুমি ডিলিট করেছ। ওরা আমার উপর রেগে আছে সব। আমার কলেজ লাইফের সব স্মৃতিময় ছবি গুলা ডিলিট করলা। কি চাও তুমি? বিস্বাস না করলে কি ভালবাস তুমি? অনেক সহ্য করেছি আর না।
জয়া বুঝতে পারে তার ভূল হয়েছে। সে অনেক কেঁদেকেটে সরি বলে। বলে আর এমন করবে না। খুব রিকুয়েস্ট করে কাল বিকালে যেন দেখা করে। তারপর সে না চাইলে আর দেখা করবে না।
জয়া রিন্টুর পছন্দের লুচি- মাংস রান্না করে। ভাবে তাও যদি একটু মন গলে। এই ছেলেটা ছাড়া তার আর কেউ নেই মন খুলে কথা বলবার মত। ধরে রাখতে গিয়ে সবসময় বাড়াবাড়ি টাই করে ফেলে সে। বাসার অশান্তি ও তার উপর ঝারে। অনেক অনুরোধের পর আসতে রাজি হয় রিন্টু।
মার শাড়ী পড়ে সেজেগুজে বের হবে, দরজা খুলতেই সামনে পড়ে ভাইয়্যা আর সাবা। বিয়ে করে ফেলেছে ওরা !
মা বাবা ঘরেই ছিল। তার পর যা হবার তাই হল। রেগে আগুন বাবার মুখের উপর ভাইয়্যা বলে আমরা শুধু সালাম করতে এসেছি। এখানে থাকতে না। তাও যখন দিলে না তাহলে চললাম। আর আসবনা এই বাড়ীতে।
রাগে কাঁপতে কাঁপতে বাবা জ্ঞ্যন হারায়। পাশের ফার্মেসি থেকে ডাক্তার ডাকা হলে বলে স্ট্রোক সম্ভবত। হাস্পাতালে নিতে ভাইয়্যাকে ফোন দিতে গিয়েও দেয় না জয়া।
রিন্টুকে ফোন দিতে যাবে, এমন সময় এসএমএস আসে, "মানুষের সভ্যতা ভদ্রতা আসলে ফ্যামিলি থেকে আসে। এত কিছুর পর যখন আমি আসতে রাজি হলাম তখন তুমি এলে না। টিউশনি ফেলে এসেছিলাম। ফোন করে না জানালা, এত্তবার ফোন দিলাম, ফোন টা ধরলেও না। তোমার আসলে পারিবারিক শিক্ষার অভাব। "
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:১৮