প্রাপ্তি'র প্রথম পর্ব... (view this link)
(তিন)
স্বপ্নার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে দুশ্চিন্তা বেড়েই চলল আব্দুন নূর সাহেবের। উদগ্রীব হয়ে পরছিলেন মেয়ের অস্বাভাবিকতা উদঘাটনে। চাইছিলেন এখনই স্বপ্নার এই পুরনো ডাইরিটা খোলে দেখবেন কিন্তু এখন দেখতে গেলে যে সমস্যা। তার এই লুকিয়ে দেখার বিষয়টা স্বপ্না বুঝে ফেললে ডাইরিটা পড়তেই দিবে না, তাই আজ আর না দেখে আগামীকাল স্বপ্না কলেজে যাওয়ার পর দেখবেন বলে ঠিক করে নিজ রুমের দিকে চলে গেলেন।
রাতের এক দ্বিতীয়াংশ প্রহর চলে গেছে, তবু ঘুম আসছে না। চিন্তা এখন দ্বিগুণ। বাকি রাতটুকু বিছানায় ছটফট করলেন, কিন্তু এক বিন্দু ঘুমের দেখা মিললো না। হঠাৎ ফজরের আজানের আওয়াজ শুনে বাথরুম গেলেন। বাতরুম থেকে বের হয়ে চললেন মসজিদের দিকে। সারার মায়ের আকস্মিক মৃত্যুর পর থেকে তিনি ফজরের নামাযের নিয়মিত মুসল্লি। নামায শেষে আজ বাসায় না গিয়ে আলকাছ সাহেবের বাসার দিকে ছুটলেন। আলকাছ সাহেবের বাসার গেইট অতিক্রম করতেই আলকাছ সাহেবকে পেয়ে গেলেন। তখন আলকাছ সাহেব কাজের লোককে নিয়ে গাড়ি ধুচ্ছিলেন। হঠাৎ আব্দুন নূরে সাহেবের আগমন দেখে আলকাছ সাহেব যারপরনাই অবাক হলেন। জড়িয়ে ধরলেন একজন আরেকজনকে। আলকাছ সাহেব বাল্যবন্ধুকে বাসার ভেতর নিয়ে গেলেন, পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সাথে। আলকাছ সাহেবেরর এক ছেলে দু'মেয়ে, তার মধ্যে বড় মেয়েটা কলেজ লেভেলই সম্ভ্রমহানি হওয়ায় আত্মহত্যা করেছে। ছোট মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছেন গত বছর। বড় মেয়ের দুস্কর্মের ফল দেখে ছোট মেয়েটাকে বেশি পড়ালেখা করতে দেননি। ছেলে রিফাত ও রিফাতের মায়ের সাথে আব্দুন নূর সাহেবকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর চলল চা পর্ব। আকস্মিক এমন আগমনের কারণ জানতে চাইলে আব্দুন নূর সাহেব তার পুরনো অভ্যাস অনুযায়ী রসিকতার সুরে বলতে লাগলেন
-তোর বাসায় এসে ভালভাবে বসতে পারলাম না, রিমান্ড শুরু করে দিলে!
-আরে না! তোর রঙ তামাশা এখনো যায়নি দেখছি! তা তোর ফ্যামিলির সবাই ভাল আছে তো?
-আছে ভাই, ভালই আছে সবাই। তা তোর ছেলে রিফাত তো অনেক বড় হয়ে গেছে, সে কি শুধু পড়ালেখায় আছে নাকি পাশাপাশি অন্য কিছুও করছে?
-আরে না নূর ভাই, শুধু পড়ালেখা করলে কি আর চলে। কিছু টাকা দিয়েছিলাম সেটা দিয়ে শেয়ার ব্যবসা চালাচ্ছে। এখন হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
-এমনিতেই, তা ছেলের তো এখন বিয়ের বয়স হয়েছে, একটা বৌমা ঘরে নিয়ে আয়।
-নূর ভাই, সত্যি তর মজা করার অভ্যাস এখনো যায়নি দেখছি। আচ্ছা নূর ভাই, রিফাতের সাথে কি তোর পূর্বের কোন পরিচয় আছে? আজ হঠাৎ ওর বিয়ের বিষয় টানছিছ কেন?
-না আলকাছ ভাই, তাকে তো এখানেই প্রথম দেখলাম। তবে পাড়ার লোকদের মুখে তার কথা প্রায় শুনা যায়।
-কী শুনা যায়?
-এই যা, আমি তো তোর গোয়েন্দা হয়ে গেলাম, থাক এসব।
-না ভাই, তোকে বলতেই হবে!
-বলতে যখন হবেই, তখন হালকার মধ্যে ঝাপসা বলে কি লাভ; স্পষ্টই বলি, আমাদের রিফাত বাবা রাস্তায় মেয়েদের উত্যক্ত করে বলে লোকজন কানাঘুষা করছে। তোর ছেলে মানে তো আমারই ছেলে। সেটা আমাকে খুব আঘাত করছে তাই তোকে বললাম, তুই আবার অন্য কিছু ভাবিস না।
-ও আচ্ছা, সেই কথা! এখানে ভাবার কী আছে! এই বয়সে একটু এরকম করবেই। তোর কি স্মরণ নেই আমাদের সময়কার কথা। তুই আর আমি মিলে আমাদের পাশের বাড়ির মিলির সাথে কী করেছিলাম! ভাগ্যিস, সে কাউকে বলেনি। এর এক মাসের মধ্যে যদি তার বিয়ে না হত, তবে তো আমরা ফেঁসে যেতাম। এখন অবশ্য এগুলো মনে হলে নিজের কাছে অপমানজনক মনে হয়।
-কিন্তু আলকাছ ভাই, আমাদের সময় এখন আর নেই। এখন নারীদের অধিকার সম্পর্কে সবাই সচেতন। সবকিছুর পর কথা হল, আমরা এখন আমাদের অতীত নিয়ে লজ্জিত, তাই চাই না আমাদের পরবর্তী জেনারেশন সেই রোগের রোগী হোক। সেজন্যই তোর কাছে আসলাম।
-ঠিক আছেরে ভাই, আমি আজই থাকে সতর্ক করে দেব। আর এ নিয়ে তকে কোন দুশ্চিন্তা করতে হবে না। ইনশাআল্লাহ সে ভাল হয়ে যাবে।
আরো বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার পর আব্দুন নূর সাহেব বাসায় ফিরে আসলেন। স্বপ্না ভার্সিটি চলে গেছে দেখে সোজা চলে গেলেন স্বপ্নার রুমে। কালো ডাইরিটা হাতে নিয়ে বের করলেন ফিতায়-চিহ্নিত সেই পৃষ্ঠা। চোখের সামনে ভেসে উঠলো কালো রক্তে লেখা,
"আজ ২৩ জুলাই ২০১৪, রাত ৪.৪৬। এখনো আমার চোখে ঘুম আসেনি। লাইট অফ করলে বা বাহিরের দিকে চাইলেই আমি আঁতকে উঠি। অন্ধকার আমার জন্য ভয়ঙ্কর জাহান্নাম। বাসার সবাই ঘুমুচ্ছে, আমার চোখে ঘুম নেই, নেই শান্তি। নিজেকে এখন পৃথিবীর সর্বনিকৃষ্ট মানুষ বলে মনে হচ্ছে। নিজেকে শেষ করতে পারছি না বাবার জন্য। ছোট বোন দু'টির জন্য। এই বাবা ও বোনগুলো কি আমার খবর নিচ্ছে? আমি কোথায় আছি? আমার শরীর মন কি ভাল আছে? আমি কি সুস্থ আছি? আমার খবর কে নেবে? কেউ নেয় না, কেউ নেই নেয়ার। কারও কাছে বলতেও পারবো না। কারণ, বললে তখন আর বাঁচতেও পারবো না। বাবাকে বললে বাবা পাগল হয়ে যাবে, আর ওরা বাবাকে মেরে ফেলবে। বোনগুলোকে তো কখনো বলাই যাবে না। বড় ভাইয়াকে সেই শিশুকালে মৃত্যুর কুলে ডলে পড়তে দেখেছি। দেখেছি মাকেও। এখন আমার কেউ নেই এই পৃথিবীতে। যারা আছে, আমি তাদের জন্য কিছুকাল পর বোঝা হয়ে যাব, যখন বুজা হব তখন না হয় আত্মহত্যা করবো। কিন্তু এখন আমার এ কষ্ট কোথায় জায়গা দেব? ঐ রিফাত নরপশুটা আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে, আমাকে রক্তাক্ত করেছে। আমি ঐ পশুগুলোকে কিছুই করতে পারলাম না, হয়ত পারবোও না। কিন্তু না, আমি যদি সুযোগ পাই, ঐ নরপশুদের একটা একটা করে শেষ করব। যারা আমার সব শেষ করে দিয়েছে; পৃথিবীতে তাদের থাকার অধিকার নেই! আজ আর লিখতে ভাল লাগছে না, সারারাত কেঁদেকেটে কাটিয়েছি। নিজের রক্তাক্ত শরীর দেখে আমি যে আঁতকে উঠি......."
গল্পটি এখানেই সমাপ্ত কিন্তু সমাজে এমন ঘটনা কখনো সমাপ্ত হয় না!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৪০