(এক)
সারা আব্দুন নূর সাহেবের সর্বকনিষ্ঠা মেয়ে। এখনো চঞ্চল্যতা ও দুষ্টুমিতে সেরা। এবছর কলেজে ভর্তি হয়েছে মাত্র। আব্দুন নূর সাহেবের তিন মেয়ে ও এক ছেলে ছিল। ছেলেটি শিশুকালেই মারা যায়। সারার জন্মের পর ব্লাড ক্যান্সারে তার মা মারা যান। তাই সারাদের পরিবার বলতে তারা তিন বোন ও তাদের বাবা আব্দুন নূর সাহেব। মোট চারজনের সুন্দর এক ছোট পরিবার। আব্দুর নূর সাহেব অনেক কষ্টে মেয়েগুলোকে শিক্ষিত করে তুলছেন। বড় মেয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষে, তার ছোটটা সবে অনার্স প্রথম বর্ষে উঠল। আর সবার ছোট সারা এখন এইচএসসিতে ভর্তি হয়েছে মাত্র। সারা আজ এক সাপ্তাহ হল নিয়মিত তার নতুন কলেজে আসা-যাওয়া করছে। কলেজে যাওয়ার পর থেকে সারার হাস্যমুখে যেন সবসময় মেঘের ঘনঘটা লেগেই থাকে। এই পরিবর্তনটি আব্দুর নূর সাহেবের দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করতে পারে নি। অনেক চেষ্টার পরও আব্দুন নূর সাহেব এর কারণটা ঠিক উদঘাটন করতে পারছেন না। তিনি মেয়েদের সাথে খুব বেশি ফ্রি; অন্যান্য বাবাদের চেয়ে একটু বেশিই হয়ত। তাদেরকে কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। সারার এ অবস্থা আব্দুন নূর সাহেবকে মোটেও শান্তি দিচ্ছিল না। তাই তিনি সারাকে একান্তে নিয়ে বসলেন। বাসার ছাদে সারার বড় বোন স্বপ্না তৈরি করেছিল এক মনোমুগ্ধকর বাগান। আব্দুন নূর সাহেব মেয়েকে নিয়ে এখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। উভয়ের দৃষ্টি দূরের ব্যস্ত রাস্তার দিকে।
আচ্ছা মা, আমি কি কখনো তদের কষ্ট দিয়েছি?
আকস্মিক এমন প্রশ্ন শুনে বাবার হাত শক্ত করে চেপে ধরে সারা পালটা প্রশ্ন করলো,
কেন বাবা হঠাৎ এমন কথা বলছো কেন?
না মা, এমনিতেই জিজ্ঞেস করছি। আজকাল তর মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে বুঝি?
না বাবা, তুমিই তো আমাদের মা-বাবা। তবে এখন মায়ের কথা মনে করিয়ে দিলে।
স্যারি মা, আমি এমনটা বলতে চাইনি।
তাহলে কী বলতে চাচ্ছ শুনি!
তুই কী অসুস্থ? তর বউমা (ডাঃ সুলতানা)কে ডাকবো?
না বাবা, আমি অসুস্থ না। অসুস্থ হলে আমিই বউমার বাসায় চলে যেতাম। কাকাকেও দেখে আসতাম।
তকে একটা প্রশ্ন করবো, উত্তর দেবি?
এতক্ষণ তো তুমি প্রশ্ন করেই আসছ, আমি কি উত্তর দেই নি?
এই তো তুই রাগ করলি, আচ্ছা বলতে হবে না
রাগ করলাম কই, তুমি বল সমস্যা নেই
না আজ থাক, আরেকদিন বলি
না আজকেই বলতে হবে!
আব্দুন নূর সাহেব জানেন, এখন উল্টাপাল্টা কিছু করলে খবর আছে! তাই মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
কলেজে ভর্তি হলি এক সাপ্তাহ হল। প্রতিদিন তো কলেজে যাচ্ছিস। তা কলেজ কেমন লাগছে?
ভালই তো। তুমি যে রফিক স্যারের কথা বলছিলে, উনাকে তোমার কথা বলায় প্রতিদিন আমার খবর নেন। উনি অনেক ভাল।
হ্যা, রফিক আর আমি একসাথেই পড়া-লেখাসহ অনেক কিছু(!) করেছি। সে আমার খুব কাছের বন্ধু। তর মা থাকতে সে প্রায়ই আসতো। একদিন তাকে আমাদের বাসায় আসতে বলিস।
হু বলব বাবা। বাবা, আমি এখন আসি?
তকে তো আসল কথা জিজ্ঞেস করাই হয়নি। লক্ষ্য করলাম, কিছুদিন থেকে তর মনের অবস্থা খুব একটা ভাল না, কারণ কী মা?
বাবার এ প্রশ্ন শুনেই সারার চেহারা কালো হয়ে গেল, অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল
না বাবা, তেমন কিছু না!
আরে মা, তুরা না বলিস, আমি তোদের মা-বাবা। তাহলে আমার কাছে লুকোচ্ছিস কেন?
না বাবা, এটা কোন সমস্যা না। তুমি কোন চিন্তা কর না তো!
কোন জিনিষটা কোন সমস্যা না? তুই আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছিস। বলতো মা, তুই কি চাস কেয়ামতের সময় আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞাসিত করুক?
না বাবা, তা আমি কখনো চাই না!
তাহলে বলনা কী হয়েছে?
আসলে বাবা, তেমন কিছু হয়নি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আপুর কলেজে পড়ুয়া এক ছেলে প্রতিদিন আমার পিছুপিছু বাসার গেইট পর্যন্ত আসে। তাকে দেখে আমার খুব ভয় হয়।
ঐ ছেলেটার নাম জানিস?
পাড়ার লোকেরা তাকে রিফাত বলে ডাকতে শুনেছি।
আচ্ছা মা, তুই চিন্তা করিস না। ইনশাআল্লাহ সে আর এমনটা করবে না।
বাবা, তুমি কিছু বলতে যেও না প্লিজ!
আব্দুন নূর সাহেব মুচকি হেসে বললেন
আরে মা, তুই যা, এ বিষয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। তুই না কোথায় যেতে চাইছিলি, যা তুই তর কাজে যা।
রাত্রে মেজো মেয়ে রূম্পা চা দিয়ে যাওয়ার পর আব্দুন নূর সাহেব বড় মেয়ে স্বপ্নাকে ডাকলেন, স্বপ্না আসলে তাকে বসতে বললেন।
বাবা, যা বলার দ্রুত বল, টমেটোর তরকারিটি এখনো বাকি আছে
তর ভার্সিটির কী অবস্থা?
এই তো ভাল। হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন বাবা?
সারাকে দেখেছিস, ক'দিন যাবত দেখছি খুব মনমরা হয়ে থাকে মেয়েটা।
আমিও লক্ষ্য করেছি, কিন্তু সু্যোগ করে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। আজ রাতে ঘুমানোর সময় জিজ্ঞেস করে নেব
না, আজ জিজ্ঞেস করিসনে। আচ্ছা, আমাদের পাড়ার রিফাত নামের একটা ছেলে তদের কলেজে পড়ে। চিনিস ওকে?
হ্যা, চিনি তো। ও তো আমার ডিপার্টমেন্টেই পড়ে। আলকাস সাহেবের বড় ছেলে।
ও আচ্ছা, সে তো আমাদের আলকাইচ্ছার পুলা। আচ্ছা তুই যা।
কেন বাবা, হঠাৎ তার কথা জিজ্ঞেস করলে কেন? কোন সমস্যা?
নারে কোন সমস্যা না। তুই তর কাজে যা।
স্বপ্না কী যেন চিন্তা করতে করতে রান্নাঘরে ডুকলো।
(দুই)
রাত দ্বিপ্রহর। বিছানায় রূম্পা ও সারা ঘুমুচ্ছে। স্বপ্না শেল্ফ থেকে চারবছর পূর্বের পুরনো ডাইরি বের করলো। ২৩-৭-২০১৪ -এর পৃষ্ঠা খুলতেই তার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো "আজ ২৩ জুলাই ২০১৪, রাত ৪.৪৬। এখনো আমার চোখে ঘুম আসেনি। লাইট অফ করলে বা বাহিরের দিকে চাইলেই আমি আঁতকে উঠি। অন্ধকার আমার জন্য ভয়ঙ্কর জাহান্নাম। বাসার সবাই ঘুমুচ্ছে, আমার চোখে ঘুম নেই, নেই শান্তি। নিজেকে এখন পৃথিবীর সর্বনিকৃষ্ট মানুষ বলে মনে হচ্ছে। নিজেকে শেষ করতে পারছি না বাবার জন্য। ছোট বোন দু'টির জন্য। এই বাবা ও বোনগুলো কি আমার খবর নিচ্ছে? আমি কোথায় আছি? আমার শরীর মন কি ভাল আছে? আমি কি সুস্থ আছি? আমার খবর কে নেবে? কেউ নেয় না, কেউ নেই নেয়ার। কারও কাছে বলতেও পারবো না। কারণ, বললে তখন আর বাঁচতেও পারবো না। বাবাকে বললে বাবা পাগল হয়ে যাবে, আর ওরা বাবাকে মেরে ফেলবে। বোনগুলোকে তো কখনো বলাই যাবে না। বড় ভাইয়াকে সেই শিশুকালে মৃত্যুর কুলে ডলে পড়তে দেখেছি। দেখেছি মাকেও। এখন আমার কেউ নেই এই পৃথিবীতে। যারা আছে, আমি তাদের জন্য কিছুকাল পর বুজা হয়ে যাব, যখন বুজা হব তখন না হয় আত্মহত্যা করবো। কিন্তু আমার এ কষ্ট আমি কোথায় জায়গা দেব? ঐ রিফাত নরপশুটা আমার সব কেড়ে নিয়েছে। আমি ঐ পশুগুলোকে কিছুই করতে পারলাম না, হয়ত পারবোও না। কিন্তু না, আমি যদি সুযোগ পাই, ঐ নরপশুদের একটা একটা করে শেষ করে দেব। যারা আমার সব শেষ করে দিয়েছে পৃথিবীতে তাদের থাকার অধিকার নেই! আজ আর লিখতে ভাল্প লাগছে না, সারারাত কেঁদেকেটে কাটিয়েছি। নিজের রক্তাক্ত শরীর দেখে আমি যে আঁতকে উঠি..... "
স্বপ্না আর পড়তে পারলো না, ভয়ে তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় অঝোর ধারায় অনেক্ষণ কাঁদলো। বিছানায় এসে শুয়ে-শুয়ে ভাবতে লাগলো বাবা কেন আজ রিফাতের কথা জিজ্ঞেস করলেন।,আর সারার মন খারাপের প্রসঙ্গ কেনই বা উঠলো। কী সম্পর্ক থাকতে পারে এখানে। ভাবতে ভাবতে স্বপ্না ঘুমিয়ে পড়লো।
এদিকে সারাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকায় আব্দুন নূর সাহেবেরও ঘুম আসছিল না। হঠাৎ তিনি কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে স্বপ্নার রুমে গিয়ে তাকে কাঁদতে দেখে অবাক হলেন।
(পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটার সমূহ আশঙ্কায় আর দীর্ঘ না করে আগামী পুস্টেই শেষ করবো। আশাকরি সবাই সাথে থাকবেন।)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৪৩