[ বিশ্বায়নের ডামাডোলে বিশ্বজুড়ে আজ চলছে ভোগবাদ দর্শনের প্রচন্ড দাপট। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর মনন আজ "ভোগেই তৃপ্তি"- এ বেদবাক্যে উজ্জীবিত। চারদিকে 'চাই, চাই আরো চাই" ধ্বনি। খোদ আমেরিকা থেকে শুরু করে পৃথিবীর গরীবতর দেশ এ বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একাংশ পর্যন্ত এই ভোগবাদ দর্শনকে ক্রমান্বয়ে করে নিচ্ছে জীবনের ব্রত। এ ভোগবাদ দর্শনের স্বরূপ উন্মোচনের লক্ষ্যেই এ লেখার অবতারণা। কয়েকটি পর্বে এ লেখাটি সম্পন্ন হবে। বিষয়টি সম্পর্কে আপনাদের মন্তব্য কাঙ্খিত। ]
তৃতীয় পর্ব: Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব: Click This Link
প্রথম পর্ব: Click This Link
চতুর্থ পর্ব
সমগ্র বিশ্ব এখন কমবেশী ভোগবাদ দর্শনে অধ:পতিত -- সার্বিক বিশ্লেষণে একথা নি:সন্দেহে প্রতীয়মান। ভোগবাদ হচ্ছে কর্পোরেট সংস্কৃতির মূল প্রতিপাদ্য মুক্তবাজার অর্থনীতির বর্জ্য স্বরূপ। বিশ্বায়নের সূযোগে মুক্তবাজার অর্থনীতি ক্রম প্রসারিত এবং সেইসাথে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই কর্পোরেট সংস্কৃতিতে আক্রান্ত। আর এই কর্পোরেট গুলোই তাদের ব্যবসার স্বার্থে বিশ্বজুড়ে ভোক্তাদের নিমজ্জিত করছে ভোগবাদী অপদর্শনে।
ভোগবাদী অপদর্শনের প্রতিক্রিয়া বহুমাত্রিক। ভোগবাদের প্রতিক্রিয়ায় উদ্ভূত কতিপয় সংকট সম্পর্কে নিম্নে আলোচিত হলো -
ক) গ্রীণ হাউজ এফেক্ট- গ্রীণ হাউজ এফেক্ট বা বায়ু মন্ডলের ওজোন স্তরে ফাটলের কারণে বিশ্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। এই ওজোন স্তরের ফাটলের ফলে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা প্রতিবছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আশংকা করা হচ্ছে যে নিকট ভবিষ্যতেই মেরু অঞ্চলের বরফ গলে পৃথিবীর একটা বড় অংশ প্লাবিত হয়ে জলাভূমিতে পরিণত হবে এবং এর মধ্যে থাকবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বড় একটি অংশ, যা বাংলাদেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ।
এই ওযোন স্তরের ফাটলের বড় কারণ হচ্ছে CFC গ্যাস, যা নির্গত হয় উন্নত বিশ্বে মাত্রতিরিক্ত রেফ্রিজিরেশন উৎপাদন এবং ব্যবহারের কারনে।
খ) পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা- ভোগ্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে প্রতি বৎসর বনাঞ্চল ধ্বংস করে বসানো হচ্ছে নতুন নতুন শিল্প-কল-কারখানা। এতে করে সার্বিকভাবে বিশ্বের পরিবেশের উপর পড়ছে বিশাল চাপ। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় পৃথিবীর জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারনে প্রাণীজগতের প্রায় ৩৭% প্রজাতি বিলুপ্ত হতে চলছে। উল্লেখ্য, পৃথিবীর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রতিটি প্রজাতিই বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাণী জগতের বিভিন্ন প্রজাতির এই বিলুপ্তি বিশ্ব পরিবেশের জন্য বড় এক হুমকি একথা নি:সন্দেহে বলা চলে। এছাড়া শিল্প-কারখানায় বর্জ্যও বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তির অন্তরায় সৃষ্টি করছে। ইতোমধ্যে বিশ্বময় দুষণমুক্ত বিশুদ্ধ পানির অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে এবং জাতিসংঘ এটিকে পৃথিবীর বড় একটি সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেছে
গ) ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বৃদ্ধি- ভোগবাদী বিশ্বে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমশ: বেড়ে চলছে। নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানে জানা যায় পৃথিবীর মাত্র ২০% জনগোষ্ঠী, যারা উন্নত বিশ্বের বাসিন্দা উৎপাদিত ভোগ্যপণ্যের ৮৬% ব্যবহার করে থাকে। অন্যদিকে গরীবতম ২০% জনগোষ্ঠীর ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার মাত্র ১.৩%।
নয়াদিল্লীর ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের ৫% ধনী জনগোষ্ঠী বিশ্বের মোট আয়ের ৮৭.৭% অর্জন করে থাকে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর প্রায় ৮০% জনগোষ্ঠী বাস করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এবং তাদের ব্যবসা বাণিজ্যে অংশগ্রহণের শতকরা হার মাত্র ১৭% । এই হতাশাব্যঞ্জক চিত্র ক্রমশ:ই বাড়ছে এবং এর বড় কার্যকারন ভোগবাদ দর্শনের মাঝেই নিহিত রয়েছে।
বহুজাতিক কোম্পানীগুলো মূলত: বিশ্বের ধনী দেশগুলোরই মালিকাধীন। এই কোম্পানীগুলো বর্তমানে বিশ্বব্যাপি মুক্তবাজার অর্থনীতিকে হাতিয়ার করে একচেটিয়া ব্যবসা করছে। বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর রয়েছে বিশ্বব্যপি বিশাল বাজার এবং এ কারণে এরা যে কোন পণ্য অনেক বেশী পরিমানে উৎপাদন করে থাকে। এতে করে তাদের একক পরিমাপে পণ্যের উৎপাদন খরচ অনেক কম পড়ে। অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশীয় উৎপাদনকারীর পক্ষে বাজার সীমিত থাকায় পণ্য উৎপাদনের পরিমান বাড়ানো সম্ভব হয় না সঙ্গত কারণেই। এতে করে তাদের পণ্যের একক উৎপাদন খরচ অনেক বেশী পড়ে থাকে। সূতরাং তৃতীয় বিশ্বের দেশী কোম্পানীগুলো পণ্যবাজারে বহুজাতিক কোম্পানীর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এছাড়া তৃতীয় বিশ্বের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির সুবিধা নেয় এই বহুজাতিক কোম্পানীগুলো, বিশেষত: স্বল্প শুল্কে বাণিজ্য করার সুবিধা। বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর এই একচেটিয়া পণ্য বাজারে অংশগ্রহণের কারণে তাদের অর্জিত মুনাফার হার ক্রমশ: বাড়ছে এবং বিশ্বব্যাপি ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ছে সেই সাথে।
ঘ) বিজ্ঞাপণ নিয়ন্ত্রিত ক্রেতাগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি- ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় কেনাকাটার ক্ষেত্রে মানুষের স্বাধীনতা সীমিত - সে হয়ে পড়ে বিজ্ঞাপণের ক্রীড়ণক। সত্যিকার প্রয়োজনে নয় বরং মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর আওতাভূক্ত অনেকেই আজকাল পণ্য কিনে থাকের বিজ্ঞাপণের লোভনীয় প্ররোচনায়। পণ্যের গুণাগুণ বিচার এখন ব্র্যান্ড নির্ভর। মূলত: বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর 'ব্র্যান্ড' সৃষ্টির বড় হাতিয়ার হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপণ ।
চলবে ......