শোনা যায়, রামায়ণের তুলনায় প্রাচীন মহাকাব্য আর নাই; রামচন্দ্র বিষ্ণুর অবতার, কিন্তু এই ধর্মতাত্ত্বিক পরিচয়ে সাধারণের উচ্ছ্বাস নাই, নায়কোচিত রামত্বকেই তাদের ভক্তি। আমাদের অন্তঃপুরে এক মানসপ্রতিমার জন্য ক্রন্দন আছে; কৃষ্ণদ্বৈপায়নের আখ্যানে যুধিষ্ঠিরের প্রধান্য থাক, মানুষের চোখের তারায় কিন্তু জেগে থাকে অর্জুন; এই জনপদে সংস্কারের প্রতি অনুরাগ যাদের ধর্ম, তারা নায়কমুগ্ধ দর্শক। ঢাকার ছবিতে রামের উপদ্রুব সতত সঞ্চরমান, ঢালিউডে লঙ্কাকাণ্ডের যে মহড়া নিয়ত হয় তার নেতৃত্বে থাকেন রামচন্দ্রের একালের কোনো অবতার; এদেশে নায়কের গল্প কখনো পুরাতন হয় না।
পশ্চিমে ‘ওয়েস্টার্ন জাঁর’ বলে ছবির একটি জাত রয়েছে; আঙ্গিকের বিচারে সেটি বাংলা ছবির স্বগোত্র নয়, কিন্তু ভাবের ক্ষেত্রে একটি ঐকতান আছে, দ্ইু ধারাতেই নায়কের কীর্ত্তন পাওয়া যায়। নায়কের আখ্যান পশ্চিমে দূর্লভ নয়, তবে ওয়েস্টার্ন জাঁরের কাউবয় চরিত্রটি অনন্য; দীর্ঘ গাউন আর হ্যাটের আড়ালে অশ্বারোহী সেই ক্লান্তিহীন অভিযাত্রী সীমাহীন মরূভূমিজুড়ে ছুটে বেড়ায়।
অচেতনের প্রচার করেছিলেন ফ্রয়েড, কিন্তু যৌথঅচেতন বলে তার একটি নতুন মাত্রা দিলেন ইয়ুং, সকলের ইতিহাসের ভার সেই স্মৃতিপাদে জমে থাকে, যার ভেতর প্রতিমার বসবাস; জগতের সর্বত্র এই প্রতœপ্রতিমার উদ্দেশ পাওয়া যায়। ইয়ুং-এর তত্ত্ব এখনও প্রামাণ্য হয় নাই, কিন্তু ওয়েস্টার্ন জাঁরের সিনেমায় যে নায়কের দেখা পাই, তার গোত্র-সমাজ-কালচেতনা নাই, সমাজের কল্পলোকে প্রতিমা হয়ে তার চিরন্তন অধিষ্ঠান। এখন কাউবয় নায়কটির নাম দিলাম প্রতিমা, আমাদের ভারতবর্ষে তার অন্য নাম রামচন্দ্র।
আমেরিকার মানসপটে প্রতিমারূপে কাউবয়দের অধিষ্ঠানে ঐতিহাসিক বিচ্যুতি নেই; আরণ্যক আমেরিকায় শাদালোকের কালপর্বটি সুপ্রাচীন নয়, সেখানে যাদের বাস আরো পুরাতন সেইসব আদিবাসীদের ভীড় ঠেলে নতুন যুগের পত্তন হলো, ওই পত্তনের জোয়াল যারা বয়ে নিলেন তাদের খেতাব হলো ফ্রন্টিয়ার, কাউবয় এদের পুরনো নায়ক। বৃন্দাবনের নিত্যলীলাকার কৃষ্ণ গোষ্ঠপালক ছিলেন, আর ছিলেন বাঁশরিয়া, কাউবয়দের সাথে তার ভারি মিল, তফাৎ এই যে, কাউবয়দের বেলায় বাঁশির উৎপাদ বাঁশ নয়, বিকট এক বন্দুক, যার মোহিনী সুরে আদিবাসী আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে মহাদশা লাভ করেছে। প্রতিমার শরীরে প্রতীকের ছড়াছড়ি থাকে, কাউবয় প্রতিমার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতীক হচ্ছে বন্দুক, আমেরিকার কল্পলোক বন্দুক ছাড়া পেখম মেলে না।
সিনেমায় দেখা যায়, ওয়েস্টার্ন জাঁরের এই আন্তরিক প্রতিমা অবসরের গান করে, খুব সেজেগুজে পানশালায় দাঁড়িয়ে থাকা তার বেশ প্রিয়, অলস মুহূর্তগুলো সে পোকার খেলার কোটে ঢেলে দেয়, আর উপযুক্ত পরিবেশ দেখলে সে বাঁশিটি বের করে, এবং এমন আশ্চর্য সুর তোলে যে হতভাগা কেউ মরে যায়। আহার-নিদ্রা-øানে তার মনোযোগ নেই, টাকা-পয়সা তার কাছে থাকে না; সে কিন্তু পর্যটন করে, শহর থেকে শহরে যায়, এতে কোনো যৌক্তিক বিঘœ নাই। তার দারিদ্র নাই, ঐশ্বর্য নাই- রূপকথার নায়কের মতো কেবল বীরগাঁথা নিয়ে তার কুশলধর্ম, সংসারী ক্রিয়া তার দরকার হয় না।
তার মনোজগতের চিত্রটি করুণ; লোকটি নিঃসঙ্গ আর বিষণœ, যার অনুপ্রাস সমস্ত ছবিতে ছড়ানো। ক্লিন্ট ইস্টউডের খ্যাতির শুরু হয়েছিলো ‘ম্যান উইথ নো নেম’ গোছের এক চরিত্র থেকে, কোনো বংশলতিকা নেই, ওয়েস্টার্ন জাঁরের টিপিক্যাল নায়কদের মতোই সে এক ‘আউট ল’ বা ‘আউট কাস্ট’; তার কোনো রিশ্তা নেই, প্রিয়জন নেই, কেবল অজাতমৃত্যুহীন এক পৌরাণিক বাজপাখির মতো সে মরূভূমি চষে বেড়ায়। কখনো তাকে হাসতে নেই, সে কাঁদবে না, কেবল তার ঋজু শরীরের একটি অসতর্ক অবকাশে দেখা যাবে, সেখানে ফণা তুলে ধ্যান করছে বিষণœতা। সাংখ্য দর্শনে প্রকৃতির তিনটি গুণের স্বীকৃতি আছে; হলিউড যে প্রতিমা বেঁধেছে তার চারিত্র তামসিকতায় পোড়ে নাই, সাত্ত্বিক আর রাজসিক গুণেই সে সর্বাঙ্গবিভূষিত।
রূপার পর্দায় যে কাউবয় নিত্যলীলা করেন ধূলোমাটির কাউবয়দের সাথে তার কুটুম্বিতা সামান্যই, আমেরিকান কাউবয়দের জীবন রূপকথার আবেশে চলে না, তার গেরস্থালি আছে, ঘোড়া গবাদিপশু নিয়ে তার কারবার পৌরাণিক নয়, সেটা কৃষিকাজ। সিনেমার কাউবয় চাষাভূষো নয়, সে এক ফ্রেমে বাঁধা ছবি, দেশকালের সেখানে ভেদ নেই। ছবির পটদেশ অভিন্ন ঘূর্ণাবর্তে টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা অথবা মেক্সিকো, পটকাল আঠারোশো সত্তর। আশ্চর্য ব্যপার হলো, বনসাই গোছের এই ‘আঠারোশো সত্তর’ সালের সাথে প্রকৃত তারিখটির সঙ্গতি বিশেষ নাই; আর তখনকার আমেরিকাও ছবিতে দেখানো হয় না, ছবির জগতটি আসলে এক পূর্ণদৈর্ঘ্য আমেরিকান স্বপ্নের অপেরা।
হলিউড অসীম যতেœ যে প্রতিমা পর্দায় টাঙিয়ে দিলো তার নিমিত্তকারণ অহৈতুকী ভক্তিরাগ নয়। আমেরিকান প্রতিমাদর্শনে ছবিমন্দিরে যাদের ভিড় হয় তারা নিুবিত্ত শ্রেণীর, আমাদের ঢালিউডি ছবির সাথে গৌড়জনের যে বিচ্ছেদ আছে সেই অভিন্ন সুর আমেরিকাতেও শোনা যায়। শ্রীমতি পশ্চিম যে আধুনিকতা প্রণয়ন করেছে সেখানে রাজনৈতিক ব্যাকরণের কিছু হেরফের ঘটেছে; দেহবল প্রান্তিক হয় নাই, কিন্তু তার নতুন সঙ্গী হয়েছে সাংস্কৃতিক নির্মাণ; সেই রাজনীতির ছকে প্রতিমা বা প্রতীকের দামটি অসামান্য। পৌরাণিক আখ্যানে সকলের মতি থাকে না, মহাভারতের অমৃত কথা যার দহলিজে শুনতে পাই সেই পূণ্যবানের পরিচয় জগতের সর্বত্র প্রায় অভিন্ন, সে আবদুল বা হরিদাস, জগতের প্রান্তিক হতভাগ্য। প্রতিমার এইটি এক দিক, পূণ্যবানের দুর্বল সামর্থহীন জগতে অতীন্দ্রিয় সন্ধ্যারাগের মূর্ছনা তৈরি করা; আরেকদিকে সে অসংখ্য প্রতীক আর ব্যঞ্জনা তৈরি করে, যার সৃষ্টিকৌশল যৌথঅচেতনের মতো দৈবক্রমে চলে না, তার সমস্ত জারিজুরির পেছনে রাজনৈতিক সিদ্ধি আছে।
ওয়েস্টার্ন জাঁরের প্রতিমাকে তাই আরো নিবিড়ভাবে বীক্ষণ করা দরকার। কীসের বাণী সে প্রচার করে? তার জগতে সঙ্কোচ নাই, বিস্তীর্ণ প্রদেশজুড়ে তার বিচরণ; ক্যামেরায় ঘনঘন লংশট আর ক্লোজ আপের মহড়া। বিশাল ল্যান্ডস্কেপের ভেতর তার প্রস্থান যেন এক অসীম বিচ্ছেদের ব্যঞ্জনা, এজমালি সমাজ ভেঙে গেছে, মানুষ মানুষ থেকে কতোদূরে চলে গেছে তার প্রতীকী আয়োজন। ক্লোজ আপ শটের বেলায় সর্বলোক বিচ্ছিন্ন একটি মুখের অভিব্যক্তি তার হাসি-কান্না-অনুভবের কথা জানায়, ছবির প্রতিটি অক্ষর জানিয়ে দেয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র একালের চরিত্র। ছবির কাহিনির মর্মস্থলে থাকে ব্যক্তির বিকাশের নামতা, তার সঙ্কট তার সিদ্ধান্ত। ওয়েস্টার্ন জাঁরের এই নিঃসঙ্গ নায়ক আজ পৃথিবীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের প্রতীক।
সভ্যতার শ্লোগানে অ্যাপোলিনীয় বৃত্তির প্রশস্তি আছে, নিৎশে তাতে খুব আহত হয়েছিলেন। বিশ্বযুদ্ধের আগেই তিনি উন্মাদ হয়েছিলেন, দুঃখলাঘবের অমন মুহূর্তগুলো হয়তো তাকে ফাঁকি দিয়েছে, কিন্তু দায়ানোসিসীয় দেবতা প্রয়াত হন নাই, সভ্যতার মধুর শ্লোগান যে জলে হাওয়ায় ভাসে, সেই জলবায়ু তেজষ্ক্রিয়তায় পুড়ছে। ওয়েস্টার্ন ছবির দর্শকের রিক্ত মুহূর্তগুলো ভরে ওঠে সহিংসতার জন্য প্রিয় উৎকণ্ঠায়; নায়কের অস্ত্রমহড়া সভ্যতার ভণ্ডামিকে দ্রষ্টব্য করে তোলে, দর্শকের সেই অভিজ্ঞ চোখে শান্তিসংঘের সভাশ্রাদ্ধ ভারী কৌতুককর লাগে। তার অস্ত্রের একটি নিশানা জানিয়ে দেয় ‘আলটিমেট লিগ্যাসি’ কার। ভায়োলেন্স তার জগতে একটি স্বীকার্য প্রপঞ্চ, সে এবং আমরা সবাই বাস করি একটি ভায়োলেন্সের জগতে।
সে কিন্তু বিপ্লবী চরিত্র নয়, তার ভায়োলেন্সের জগতে কৌমের আসন নাই; ওই ভায়োলেন্সের ঘটক হিসেবে হাজির থাকে একনামপদ। অনুক্ষণ জীবনপ্রদীপটি হাতে করে ঝড়ের ভেতরে তার ছুটোছুটি কোনো সামাজিক কৃচ্ছতাসাধন নয়, তার ভায়োলেন্স হলো মানবিক প্রবৃত্তির স্বীকৃতি। এই ভায়োলেন্সের কোনো গৌরব নেই, মৃত্যুর পর সে শহীদ হবে না; কুরোসাওয়ার ‘সেভেন সামুরাই’ ছবিতে এক ভীষণা যুদ্ধে যারা প্রাণ দিলেন তাদের শবদেহ নিয়ে সমাধি গড়ে উঠলো; আর ওয়েস্টার্ন ছবির ভায়োলেন্স জেহাদ-ক্রুসেড-রেভ্যোলুশন কোনোটাই না, সেটা কেবল এক দানবীয় ব্যক্তিত্বের জীবনসঙ্গীত। আদিপুস্তকের সাথে সঙ্গতি রেখে চলে না তার নৈতিকতার পুস্তক, ভালোমন্দের যে সাধারণ ভেদজ্ঞান আছে তাতে তার ঈমান নাই, যে মূল্যবোধ তাকে আলোড়িত করে সেটা ভালোমন্দের বাইরে। কেবল আন্তরসংঘের সমস্ত প্রথা সে ভক্তিভরে মেনে নিয়েছে, যুদ্ধের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত তার রিভলবার হোলস্টারেই সুপ্ত থাকে, হয়তো তার এক মুহূর্তের প্রথা লঙ্ঘনে কোনো শহর লুপ্ত হয়ে যাবার ফাঁড়া কেটে যাবে, তখনও এই গোঁয়াড় লোকটি প্রথার অঙ্গহানি করবে না।
কাউবয় কে? আমার অনুমান, সে আমেরিকা রাষ্ট্রের প্রতœঅভিপ্রায়; প্রমাণ বিশেষ নাই, তবে দৃষ্টান্ত আছে: দাঙ্গাবাজ বুশ আমেরিকাবাসীর প্রিয় রাজপুত্তুর, টাইম ম্যাগাজিন তার পররাষ্ট্রনীতির অভিধা করেছে ‘কাউবয় ডিপ্লোম্যাসি’, আর ইউরোপের কাগজগুলো তাকে আদর করে ডাকে ‘কাউবয়’।
[email protected]