সোয়াম্প ফরেস্ট’ বা জলাবন মানে হচ্ছে এমন বন যেখানে সবসময় বা বছরের কোনো একটা সময় পানি থাকে৷ বাংলাদেশের এমনই একমাত্র বন সিলেটর সোয়াম্প ফরেস্ট বা জলাবন রাতারগুল যা সিলেটের সুন্দরবন’ নামে খ্যাত। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত এ বনের আয়তন প্রায় ৩৩২৬ একর। ১৯৭৩ সালে বনের ৫০৪ একর বন্য প্রাণী সংরক্ষণ এলাকা ঘোষণা করা শীতে এ বনের পানি শুকিয়ে গেলেও বছরের বাকী সময়গুলো জলমগ্ন থাকে পুরো বনটি৷রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট মূলত একটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য৷ এ বনের বাসিন্দাদের বড় একটি অংশ সরীসৃপ৷ এখানে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ দেখা যায়৷রাতারগুল মাছেরও অভয়ারণ্য৷এ বনকে কেন্দ্র করে এর আশপাশে বেশ কিছু জেলে পরিবার বসবাস শুরু করেছে৷রাতারগুল জলাবনে বসবাস করে বেশ কিছু রেসাস বানর৷ জলে ডোবা এ বনের ডালে ডালে বিচরণ তাদের৷ তবে এক শ্রেণির পর্যটকদের উৎপাতের কারণে এ প্রাণীটি দিন দিন কমে যাচ্ছে ।
রাতারগুল বনে জলসহিষ্ণু চার প্রজাতির গাছ বেশি দেখা যায়৷ এগুলো হলো হিজল, বরুণ, করচ আর মুর্তা৷ তিন ধরনের গাছ জলের উপরে থাকলেও বর্ষা মৌসুমে মুর্তা গাছ জলে ডুবে থাকে৷ এই মুর্তা দিয়েই তৈরি হয় সিলেটের বিখ্যাত শীতল পাটি৷রাতারগুল জলাবনের গড় গভীরতা প্রায় ১৫ ফুট৷ তবে এ বনের কোথাও কোথাও গভীরতা ৩৫ ফুটেরও বেশি৷রাতারগুল, বাংলাদেশের একমাত্র মিঠা পানির বন বা বনাঞ্চল । অর্থাৎ জলের বন বা সোয়াম্প ফরেস্ট ।যে বনের গাছ পালা পানিতে ডুবে থাকে । সারা পৃথিবীতে এরকম বন দেখা যায়, যেমন : আমাজান, মিসিসিপি, বাংলাদেশের সুন্দরবন। তবে সুন্দরবন হল লোনা পানির বন বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট।বনের সমস্ত গাছ পানিতে ডুবে থাকে, দেখতে খুবই ভাল লাগে। এ যেন বনের মধ্যে বন্যা ।
বন বিভাগ থেকে প্রাকৃতিক বনের পাশাপাশি হিজল, কদম, বেত, করচ, মুর্তাসহ আর জলপোযোগী গাছ লাগানো হয় ।সিলেট শহর থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে অবস্থিত এই বনাঞ্চল মারাত্মক ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। সোয়াম্প ফরেস্টের মূল আকর্ষণ পানিতে ডুবে থাকা গাছ-গাছালির বাহার। জীব-জন্তুর মাঝে বেশ কিছু পাখি, সরীসৃপ ও বানর বিদ্যমান। ভাগ্য ভালো হলে দেখাও পেতে পারেন বানরের সাথে।বাংলাদেশের সব বনের থেকে রাতারগুল একেবারেই আলাদা। ঘন গাছের সারি। কিন্তু গাছগুলোর নিচের অনেকটাই ডুবে আছে পানিতে। গাছের মধ্যে করচই বেশি। হিজলে ফল ধরে আছে শয়ে শয়ে। বটও চোখে পড়বে মাঝেমধ্যে, মুর্তা গাছ কম। তবে রাতারগুলের বেশ বড় একটা অংশে বাণিজ্যিকভাবে মুর্তা লাগিয়েছে বন বিভাগ। মুর্তা দিয়ে শীতল পাটি হয়। মুর্তা বেশি আছে নদীর উল্টো পাশে। ওদিকে শিমুল বিল হাওর আর নেওয়া বিল হাওর নামে দুটো বড় হাওর আছে।বড়ই অদ্ভুত এই জলের রাজ্য। কোন গাছের হাঁটু পর্যন্ত দুবে আছে পানিতে।
একটু ছোট যেগুলো, সেগুলো আবার শরীরের অর্ধেকই ডুবিয়ে আছে জলে।কোথাও চোখে পড়বে মাছ ধরার জাল পেতেছে জেলেরা। ঘন হয়ে জন্মানো গাছপালার কারণে কেমন অন্ধকার লাগবে পুরো বনটা। মাঝেমধ্যেই গাছের ডালপালা আটকে দিবে পথ। হাত দিয়ে ওগুলো সরিয়ে তৈরি করতে হবে পথ। চলতে হবে খুব সাবধানে। কারণ রাতারগুল হচ্ছে সাপের আখড়া।বর্ষায় পানি বাড়ায় সাপেরা ঠাঁই নেয় গাছের ওপর।
সাপের মধ্যে রয়েছে অজগর, গুইসাপ, গোখরা, জলধুড়াসহ বিষাক্ত অনেক প্রজাতি। বর্ষায় বনের ভেতর পানি ঢুকলে এসব সাপ উঠে পড়ে গাছের ওপর। বনের ভেতর দাঁপিয়ে বেড়ায় মেছোবাঘ, কাঠবিড়ালি, বানর, ভোদড়, বনবিড়াল, বেজি, শিয়ালসহ নানা প্রজাতির বণ্যপ্রাণী। টেংরা, খলিশা, রিঠা, পাবদা, মায়া, আইড়, কালবাউস, রুইসহ আরো অনেক জাতের মাছ পাবেন এখানে। শুকনো মৌসুমে পানি কম থাকে বলে অনেক সময় ছোট ছোট মাছগুলো লাফ দিয়ে ডিঙ্গিতে উঠে যায়। তাছাড়া ও বনে সাদা বক,কানা বক,মাছরাঙ্গা,টিয়া, বুলবুলি,ঢুপি,পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিলসহ নানা জাতের পাখিও আছে ।
হাওরের স্বচ্ছ পানির নিচে বনগুলো দৃশ্যমান থাকায় বর্ষাকালে অনেক পর্যটকের সমাগম ঘটে এখানে। আবার শীত মৌসুমে ভিন্নরূপ ধারণ করে এ বন। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে জেগে ওঠে মূর্তা ও জালি বেতের বাগান। সে সৌন্দর্য আবার আবার অন্য রকম! বন এভাবে জলে ডুবে থাকে বছরে চার থেকে সাত মাস। বর্ষা কাটলেই দেখা যাবে অন্য চেহারা। তখন বনের ভেতরের ছোট নালাগুলো পরিণত হবে পায়ে চলা পথে। সেই পথ দিয়ে হেঁটে অনায়াসে ঘুরে বেড়ানো যায়।নদীর চারপাশের দৃশ্যের সঙ্গে উপরি হিসেবে দেখবেন দূরে ভারতের উঁচু উঁচু সব পাহাড়।সিলেট এয়ারপোর্টের পেছনে সালুটিকর এলাকা থেকে উত্তরে প্রবাহমান 'সিংয়ের /চ্যাংয়ের খাল' নামে খাল হলে ও আদতে বেশ বড় নদী। এই নদী যেখানে গিয়ে 'গোয়াইন' নাম নিয়েছে সেখানে পূর্ব দিক থেকে এসে মিশেছে নদী 'কাফনা' ।
অরণ্য, নদী, ওপাড়ের বিস্তীর্ণ মাঠ আর মেঘালয় পাহাড়ের হাতছানি- সব মিলিয়ে রাতারগুল।বনে ঘোরার একমাত্র মাধ্যম ডিঙ্গি নৌকা। তবে বর্ষা এবং ‘কোমর পানির’ মৌসুমে ঘোরার মধ্যে পার্থক্যটা এই দুই সময়ে এখানে না আসলে বোঝা মুশকিল। ডিঙিতে চড়ে বনের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে দেখা যাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:০১