হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম সম্পর্কে তাবলীগ জামায়াতের লোকদের আক্বীদা হলো যে, দাওয়াতের কাজ বন্ধ করার কারণে আল্লাহ্ পাক হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালামকে বিপদে ফেলেছেন এবং তিনি সেখানে নিজের অপরাধ স্বীকার করে চল্লিশ দিন কাঁদা-কাটার পর আল্লাহ্ পাক তাঁর অপরাধ ক্ষমা করেন। এ প্রসঙ্গে তাদের কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে, “দাওয়াত বন্ধ করার কারণে, আল্লাহ্ পাক হযরত ইউনূছ (আঃ)কে অবশ্য গযবে ফেলিলেন ..............।” “........... হযরত ইউনূছ (আঃ) মাছের পেটে ৪০ দিন আবদ্ধ থাকিয়া নিজ ত্রুটি স্বীকার করিয়া তাওবা ..... করার কারণে বিপদ হইতে উদ্ধার পাইলেন।” (তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব, লেখক- মাওলানা ইসমাঈল হোসেন দেওবন্দী, পৃষ্ঠা ৬২ ও ৮৯) (নাঊযুবিল্লাহ্ মিন যালিক)
------------------------------------------------------------------------------------
প্রচলিত তাবলীগ জামায়েতের উপরোক্ত বক্তব্য নেহায়েতই অজ্ঞতামূলক, বিভ্রান্তিকর ও নবী-রসূল বা আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণ-এর শানের সম্পূর্ণ খিলাফ। মূলতঃ নবী-রসূল বা আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণ সম্পর্কিত ছহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য ইসলামী আক্বীদাগত অজ্ঞতা হেতুই তারা এরূপ আপত্তিকর আক্বীদা পোষণ করে থাকে।
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা যে বলে থাকে, “দাওয়াত বন্ধ করার কারণে, আল্লাহ্ পাক হযরত ইউনূছ (আঃ)কে অবশ্য গযবে ফেলিলেন” তা সম্পূর্ণ মনগড়া, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর ও কুফরীমূলক। মূলতঃ তারা নবী হিসেবে হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম-এর মর্যাদা না বুঝার কারণে এবং তাঁর সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস বা তথ্য না জানার কারণে এরূপ গুমরাহী ও কুফরীমূলক কথা বলে থাকে। নিম্নে হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস উল্লেখ করা হলো-
আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম যখন তাঁর সম্প্রদায়কে বা ক্বওমকে ঈমান ও সৎকাজের দাওয়াত দিলেন ও নছীহত করলেন, তখন তারা অবাধ্যতা প্রদর্শন করলো। এতে হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম তাদেরকে বললেন, তোমরা যদি এরূপ কর, তবে আল্লাহ্ পাক-এর আযাব তোমাদের পাকড়াও করবেন। এ কথা শুনে উক্ত ক্বওম বলল, ‘ঠিক আছে আপনি যদি পারেন তাহলে আল্লাহ্ পাক-এর আযাব আনুন।’ তখন হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম আল্লাহ্ পাক-এর নির্দেশে ৩ দিন পর আযাব আসার সংবাদ শুনিয়ে আল্লাহ্ পাক-এরই নির্দেশে নিজের অবস্থান থেকে বাহিরে চলে গেছেন। অতঃপর যখন আযাবের কিছু কিছু লক্ষণ বা আলামত প্রকাশ পেল, তখন ঐ ক্বওম কুফরী ও শেরেকী থেকে তওবা করে। আর আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই জঙ্গলে চলে যায়, সাথে তাদের চতুষ্পদ জন্তুগুলিকেও নিয়ে যায়। অতঃপর তারা নিজ নিজ বাচ্চাদেরকে মা থেকে আলাদা করে দিয়ে সকলে মিলে কান্নাকাটি শুরু করে এবং কাকুতি-মিনতি সহকারে আল্লাহ্ পাক-এর কাছে তওবা করে। আর বাচ্চারা মা থেকে আলাদা হওয়ার কারণে করুণ স্বরে কান্নাকাটি করতে থাকে। তখন আল্লাহ্ পাক তাদের তওবা কবুল করেন এবং আযাব দূর করে দেন। এদিকে ৩ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম সংবাদ পেলেন যে, উনার ক্বওম আযাবে ধ্বংস হয়নি। তখন তিনি চিন্তা করলেন যে, আল্লাহ পাক উনাকে যতটুকু সরে যেতে বলেছেন তা কি সরা হয়েছে? না কিছু বাকি রয়েছে। কারণ আল্লাহ্ পাক-এর নবী (আলাইহিস্ সালাম) যেখানে অবস্থান করেন সেখানে গযব নাযিল হয় না। তাঁর নির্দিষ্ট স্থান ত্যাগ করার পরই গযব নাযিল হয়, এ কথা চিন্তা করে তিনি আরো সরতে লাগলেন।
উল্লেখ্য, হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম-এর ক্বওমের মধ্যে নিয়ম ছিল যে, কেউ মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হলে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। তাই নির্দিষ্ট স্থান ত্যাগ না করার কারণে যদি তাদের প্রতি গযব না আসে এবং তাঁকে তারা মিথ্যাবাদী বলে, তবে তাদের সকলের পরকালে আরো ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, একথা চিন্তা করে তিনি আরো সরতে লাগলেন। পথিমধ্যে নদী পড়লো, হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম একটি নৌকায় আরোহণ করলেন। নৌকার লোকজন অতিরিক্ত হওয়ার কারণে নৌকা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলে, মাঝি একজনকে নৌকা থেকে নেমে যেতে হবে ঘোষণা দিল। কে নামবে তা লটারী করা হলে লটারীতে একবার দুইবার তিনবার হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম-এর নাম মুবারক উঠলো। যদিও লোকজনের ইচ্ছা ছিল না হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালামকে নামিয়ে দেয়ার। তা সত্ত্বেও তিনি অতিরিক্ত কাপড় খুলে নদীতে নেমে গেলেন। আর আল্লাহ্ পাক-এর নির্দেশে এক বিশেষ মাছ উনাকে তা’যীম-তাকরীমের সাথে পেটে ধারণ করলো এবং মাছ বললো, হে আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম! আপনি চিন্তিত হবেন না, আমাকে আল্লাহ্ পাক খাছ করে আপনার জন্য তৈরী করেছেন। আমার পেটকে আপনার জন্য ইবাদতখানা হিসেবে নির্ধারণ করেছেন এবং আমার সমস্ত শরীরে আল্লাহ্ পাক-এর যিকির জারী রয়েছে, এ কথা শুনে হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম সে মাছের পেটে আল্লাহ্ পাক-এর যিকির-আযকার ও ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল হলেন।
মূলতঃ আল্লাহ্ পাক-এর নবী, হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম মাছের পেটে প্রবেশ করার পিছনে শত-সহস্র কারণ রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো এই যে, সে যামানায় পানির নীচে যত মাছ ছিল, সমস্ত মাছ রোগাক্রান্ত হয়ে আল্লাহ্ পাক-এর কাছে সুস্থতার জন্য আরজু করছিল। আর আল্লাহ্ পাক তাদের বলেছিলেন, “অপেক্ষা কর।” যখন আল্লাহ্ পাক-এর নবী, হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম মাছের পেটে অবস্থান নিলেন, তখন আল্লাহ্ পাক মাছদেরকে নির্দেশ দিলেন, “তোমরা আমার নবী, হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম যে মাছের পেটে অবস্থান করছেন, সে মাছকে শুঁক বা ঘ্রাণ নাও। যারা তাঁকে শুঁকবে বা ঘ্রাণ নিবে, তারা সুস্থতা লাভ করবে এবং দূরবর্তী যেসব মাছ রয়েছে, যারা সরাসরি হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালামকে ধারণকৃত মাছকে শুঁকতে বা ঘ্রাণ নিতে পারবে না, সে সমস্ত মাছ যদি ঐ সমস্ত মাছ, যারা হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালামকে ধারণকৃত মাছকে শুঁকে বা ঘ্রাণ নিয়ে সুস্থতা লাভ করেছে, তাদেরকে শুঁকবে বা ঘ্রাণ নিবে, তবে তারাও সুস্থতা লাভ করবে।”
উল্লেখ্য, এভাবে সমস্ত মাছের সুস্থতা লাভ করতে প্রায় ৪০ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। অতঃপর আল্লাহ্ পাক হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালামকে ধারণকৃত মাছকে নির্দেশ দিলেন যে, “তুমি আমার রসূল, হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালামকে তা’যীম-তাকরীমের সহিত নদীর পাড়ে পৌঁছে দাও।” তখন সে মাছ আল্লাহ্ পাক-এর নির্দেশে তাঁকে নদীর পাড়ে এক কদু গাছের নীচে তা’যীম-তাকরীমের সহিত পেট থেকে বের করে রাখলো।
মূলতঃ এই হচ্ছে আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম-এর ৪০ দিন যাবৎ মাছের পেটে অবস্থান করার সঠিক তথ্য বা ইতিহাস। যা তাফসীরসমূহে ও নবী-রসূল আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণের নির্ভরযোগ্য সীরাতের কিতাবে উল্লেখ রয়েছে।
অতএব, যারা বলে, দাওয়াত বন্ধ করার কারণে আল্লাহ্ পাক হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালামকে গযব স্বরূপ ৪০ দিন মাছের পেটে রেখেছেন সে কথা আদৌ সত্য নয়। কারণ, যেখানে আল্লাহ্ পাক উম্মতদের মধ্যে যারা নেককার, আল্লাহ্ পাক-এর রহ্মত তাঁদের নিকটবর্তী বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন, আল্লাহ্ পাক কুরআন শরীফ-এ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক-এর রহ্মত মুহসিনীন (নেককারদের) নিকটবর্তী।” (সূরা আ’রাফ ৫৬)
সেখানে যিনি আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, উনার প্রতি কি করে আল্লাহ্ পাক গযব নাযিল করতে পারেন? মূলতঃ নবী-রসূল আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণের উপর গযব নাযিল হওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। বরং তাঁরা যে স্থানে অবস্থান করেন, সে স্থানে সবসময় আল্লাহ্ পাক-এর তরফ থেকে রহ্মত বর্ষিত হয়। যার কারণে আমরা কুরআন শরীফ-এর অনেক স্থানেই দেখতে পাই যে, আল্লাহ্ পাক যে ক্বওমকে তাদের নাফরমানির কারণে শাস্তি দিতে ইচ্ছে পোষণ করেছেন, তখন সে ক্বওমের নবী আলাইহিস্ সালামকে সে নির্দিষ্ট স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ আল্লাহ্ পাক-এর নবী-রসূল আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণ যতক্ষণ পর্যন্ত সে নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ স্থানে আযাব-গযব নাযিল হবেনা। মূলতঃ নবী-রসূল আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণের অস্তিত্বই সার্বক্ষণিক রহ্মতের কারণ। অতএব হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম-এর গযব সম্পর্কিত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ জিহালতপূর্ণ ও গুমরাহীমূলক।
এরপর আরো বলা হয়েছে যে, “হযরত ইউনূছ (আঃ) মাছের পেটে ৪০ দিন আবদ্ধ থাকিয়া নিজ ত্রুটি স্বীকার করিয়া তাওবা ..... করার কারণে বিপদ হইতে উদ্ধার পাইলেন।” অর্থাৎ তিনি ত্রুটি করেছেন এবং ত্রুটি স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করার কারণে আল্লাহ্ পাক তাঁকে ক্ষমা করেছেন।
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের এ বক্তব্যটিও সম্পূর্ণ মনগড়া, বিভ্রান্তিকর ও হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম-এর শানের খিলাফ। কারণ তাঁরা (নবী-রসূল আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণ) আল্লাহ্ পাক-এর ওহী দ্বারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ফলে তাঁরা (নবী-রসূল আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণ) ছগীরা, কবীরা, কুফরী, শেরেকী, ভূল-ত্রুটি, এমনকি অপছন্দনীয় কথা ও কাজ হতেও পবিত্র। কাজেই এ ব্যাপারে হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম-এর কোন ত্রুটি ছিল না। বরং তা ছিল, আল্লাহ্ পাক-এর নির্দেশেরই অন্তর্ভূক্ত।
এখন কেউ বলতে পারে যদি আল্লাহ্ পাক-এর নির্দেশেই হয়ে থাকে আর হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম-এর যদি কোন প্রকার ত্রুটিই না থাকে, তবে তিনি এ কথা কেন বললেন যে, لآَ اِلٰهَ اِلاَّ اَنْتَ سُبْحَانَكَ اِنِّيْ كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِيْنَ
অর্থঃ “আপনি পবিত্র, আল্লাহ্ পাক ব্যতীত আর কোন ইলাহ্ নেই। আর আমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা আম্বিয়া ৮৭)
এটার ব্যাখ্যা এই যে, হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম মাছের পেটে প্রবেশ করার পর চিন্তিত হলেন যে, আমার তো স্বাভাবিকভাবে যমীনের উপর অর্থাৎ পানির উপর চলার কথা ছিল। কারণ আমি তো রসূল আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণের অন্তর্ভুক্ত। আমি তো জালিমের অন্তর্ভুক্ত নই। কিন্তু আমি মাছের পেটে প্রবেশ করলাম, এর হাক্বীক্বত কি? তখন তিনি উপরোক্ত দোয়া করতে লাগলেন। তখন আল্লাহ পাক জবাবে বললেন, فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَالِكَ نُنْجِي الْمُؤْمِنِيْنَ
অর্থঃ “আমি উনার (হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম-এর) আহবানের জবাব দিলাম এবং উনাকে নাযাত দিলাম দুশ্চিন্তা থেকে। আমি এমনিভাবে মুক্তি দিয়ে থাকি মু’মিনদেরকে।” (সূরা আম্বিয়া ৮৮)
অর্থাৎ আল্লাহ্ পাক হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালামকে জানিয়ে দিলেন যে, আপনি মাছের পেটে প্রবেশ করার কারণে যে চিন্তায় মশগুল আছেন, আপনাকে সে চিন্তা থেকে নাযাত দেয়া হলো। অর্থাৎ আপনি রসূল আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণের অন্তর্ভুক্ত এবং আপনি কখনই জালিমদের অন্তর্ভুক্ত নন।
এখানে স্মরণযোগ্য যে, আল্লাহ্ পাক তাঁর বান্দাদেরকে মুছীবতের দ্বারা পরীক্ষা করে থাকেন, তার কয়েকটি অবস্থা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক বলেন, “নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো কিছু বিষয় দ্বারা, যেমন- ভয়, ক্ষুধার দ্বারা, মাল ও জানের ক্ষতি করে এবং ফসল ও ফলাদি নষ্ট করার মাধ্যমে এবং সুসংবাদ দান করুণ সবরকারীদেরকে, যখন তারা মুছীবতে পতিত হয়, তখন তারা বলে নিশ্চয়ই আমরা সকলেই তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করবো। তাঁরাই ঐ সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহ্ পাক-এর অফুরন্ত রহ্মত রয়েছে এবং তাঁরাই হিদায়েতপ্রাপ্ত।” (সূরা বাক্বারা ১৫৫-১৫৭)
এই আয়াত শরীফ-এর ব্যাখ্যায় হাদীছ শরীফ-এ উল্লেখ রয়েছে, বান্দাদেরকে ৩ কারণে মুছীবতগ্রস্থ করা হয়।
(১) নাফরমানীর কারণে গযব নাযিল হয়। (২) গুণাহ্ মাফ করার জন্য মুছীবতগ্রস্থ করা হয়। (৩) মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য মুছীবতগ্রস্থ করা হয়।
আর এ ৩ প্রকার মুছীবতের ৩টি লক্ষণ রয়েছে। যার দ্বারা প্রত্যেক বান্দার জন্যই বুঝা সহজ হয়ে যায় যে, এ মুছীবত কোন কারণে পতিত হয়েছে।
(১) যখন কোন বান্দার প্রতি অতিরিক্ত নাফরমানীর কারণে গযব নাযিল হয়, তার লক্ষণ হলো- সে আল্লাহ্ পাককে অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজ করতে থাকে। (২) যখন কোন বান্দার গুণাহ্ মাফ করার জন্য মুছীবতগ্রস্থ করা হয়, তার লক্ষণ হলো- সে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকবে। (৩) যখন কোন বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য মুছীবতগ্রস্থ করা হয়, অথচ বান্দা গুণাহ্গার নয়, এক্ষেত্রে তার লক্ষণ হলো- সে মুছীবতগ্রস্থ হয়ে বেশী বেশী ইস্তিগ্ফার করতে থাকে। (সমূহ তাফসীরের কিতাব)
উল্লেখ্য যে, সমস্ত আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণ কোন মুছীবতগ্রস্থ হলে, বেশী বেশী ইস্তিগ্ফার করতেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণের প্রতি যে সকল মুছীবত এসেছে, তা তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধিরই কারণ। স্বয়ং আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও আকাশ একটু অন্ধকার দেখলেই মসজিদে প্রবেশ করে ইস্তিগ্ফার করতেন। তদ্রুপ আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম মুছীবতগ্রস্থ হয়ে ইস্তিগ্ফার করেছেন, তাও উনার মর্যাদা বৃদ্ধির কারণেই, কোন গুনাহ বা ত্রুটি করার কারণে নয়। এই ইস্তিগ্ফার করার অর্থ এই নয় যে, গুণাহ্ বা ত্রুটি রয়েছে।
বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ-এর হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত রয়েছে, ‘স্বয়ং আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিদিন সত্তর থেকে একশত বার ইস্তিগ্ফার করতেন। অর্থাৎ অসংখ্যবার ইস্তিগ্ফার করতেন। এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে যে, “আল্লাহ্ পাক-এর শপথ! আমি প্রতিদিন আল্লাহ্ পাক-এর দরবার-এ সত্তর বারেরও বেশী ইস্তিগ্ফার ও তওবা করে থাকি।” (বুখারী শরীফ, উমাদাতুল ক্বারী, ফতহুল বারী, ইরশাদুস্ সারী, তাইসীরুল ক্বারী)
অথচ আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কোন গুণাহ্ বা ত্রুটি কিছুই ছিল না বরং তা উম্মতকে তালিম দেয়ার জন্য তিনি ইস্তিগ্ফার করেছেন।
এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে, বিশ্বখ্যাত কবি, বিশিষ্ট ছূফী সাধক, হযরত মাওলানা জালালুদ্দীন রূমী রহ্মতুল্লাহি আলাইহি যখন তাঁর পীর ছাহেব, হযরত শাম্স তাবরীজী রহ্মতুল্লাহি-এর নিকট বাইয়াত হওয়ার আরজু করলেন, তখন হযরত শাম্স তাবরীজী রহ্মতুল্লাহি মাওলানা রূমী রহ্মতুল্লাহি আলাইহিকে কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলেন। তার মধ্যে একটি হলো- তিনি বললেন, হে মাওলানা রূমী (রহ্মতুল্লাহি আলাইহি)! বলতো দেখি, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে প্রতিদিন সত্তর থেকে একশত বার ইস্তিগ্ফার করতেন, তার কারণ কি? তাঁর কি কোন গুণাহ্খাতা ছিল? জবাবে মাওলানা রূমী রহ্মতুল্লাহি আলাইহি বললেন, না, তাঁর কোন গুণাহ্খাতা ছিল না। বরং উম্মতকে তা’লীম দেয়ার জন্য ও রফ্য়ে দারাজাত বা মর্যাদা বৃদ্ধির ফলে তিনি ইস্তিগ্ফার করতেন।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, নবী-রসূল আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণ যে ইস্তিগ্ফার বা তওবা করেছেন, তা বিনয় প্রকাশ করার জন্য করেছেন। কাজেই যদি বলা হয়, হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম ভুল বা ত্রুটি করার কারণে তওবা করেছেন, তবে বলতে হবে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বেশী ভুল বা ত্রুটি করেছেন, যার কারণে তিনি প্রতিদিন সত্তর থেকে একশত বার ইস্তিগ্ফার করতেন। (নাঊযুবিল্লাহ্ মিন যালিক)
মূলতঃ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেরূপ ভুল বা ত্রুটি করার কারণে তওবা করেননি, বরং বিনয় প্রকাশ বা মর্যাদা বৃদ্ধির ফলে করেছেন, তদ্রুপ হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালামও ভুল বা ত্রুটি করার কারণে তওবা করেননি, বরং বিনয় প্রকাশার্থে ও মর্যাদা বৃদ্ধির কারণেই তওবা করেছেন।
উল্লেখ্য, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ ফরমান, “তোমরা হযরত ইউনূছ ইবনে মাত্তা আলাইহিস্ সালাম-এর উপর আমাকে প্রাধান্য দিওনা।”
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, “আমি বলিনা যে, নিশ্চয় কেউ হযরত ইউনূছ ইবনে মাত্তা আলাইহিস্ সালাম থেকে অধিক উত্তম।” (মায়ারিফুল কুরআন)
হাদীছ শরীফ-এ এ প্রসঙ্গে আরো ইরশাদ হয়েছে যে, “হযরত আবূ হুরায়রাহ্ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কারো জন্য একথা বলা উচিৎ হবে না যে, আমি হযরত ইউনূছ ইবনে মাত্তা আলাইহিস্ সালাম হতে উত্তম।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, ফতহুল বারী, উমাদুল ক্বারী, ইরশাদুস্ সারী, তাইসীরুল ক্বারী, শরহে নববী, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, তা’লীকুছ্ ছবীহ্, শরহুত ত্বীবী, মুযাহিরে হক্ব, মিরআতুল মানাযীহ্)
অর্থাৎ আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বা অন্য কোন নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে যেন হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালামকে হীন বা খাট না করা হয়।
উল্লেখ্য, আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবীদের নবী, রসূলদের রসূল। তিনি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন। কোন নবী আলাইহিস্ সালামকে নুবুওওয়াত দেয়া হয়নি এবং কোন রসূল আলাইহিস্ সালামকে রিসালত দেয়া হয়নি, তাঁর প্রতি ঈমান আনা ব্যতীত, যা আল্লাহ্ পাক সূরা আল ইমরান-এর ৮১তম আয়াত শরীফ-এ উল্লেখ করেছেন। সেই আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেখানে হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম-এর মর্যাদা হীন বা খাট করতে নিষেধ করার সাথে সাথে তা’যীম-তাকরীম করতে আদেশ করেছে, সেখানে উম্মতে মুহম্মদীর পক্ষে আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম-এর মর্যাদা হানিকর উক্তি করা, যেমন- তিনি আল্লাহ্ পাক-এর নির্দেশ ব্যতীত দাওয়াত বন্ধ করেছেন, তাঁকে গযবে ফেলা হয়েছে, তিনি ত্রুটি করেছেন, অতঃপর তওবা করার পর মাফ করা হয়েছে ইত্যাদি মন্তব্য করা বা আক্বীদা পোষণ করা কি করে জায়িয হতে পারে? এবং তা কতটুকু গুরুতর অপরাধ হতে পারে তা বিশেষভাবে অনুধাবনীয়।
মূলতঃ হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম সম্পর্কিত উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ আপত্তিকর, বিভ্রান্তিমূলক, নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের শানের খিলাফ, আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াত-এর আক্বীদার সম্পূর্ণ বিপরীত, যা স্পষ্টতঃ কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভূক্ত এবং যা থেকে তওবা করে বিরত থাকা ফরয।
সুতরাং হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালামসহ সকল আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণ সম্পর্কেই সঠিক ও শরীয়তসম্মত আক্বীদা পোষণ করতে হবে। এটাই বিশ্বাস করতে হবে যে, সমস্ত আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণই সর্বপ্রকার গুণাহ্, পাপ, লগজেশ, ভুল-ত্রুটি ইত্যাদি থেকে পবিত্র। যারা আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণের শানে আপত্তিকর বক্তব্য পেশ করে তাদের সে বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল, মনগড়া, দলীলবিহীন ও কুফরীমূলক।
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের ভ্রান্ত আক্বীদা ও তার খন্ডন (৮)