“সৌদী ওহাবী সরকার কর্তৃক চাঁদের তারিখ হের-ফের করার প্রমাণ”-বিষয়টি তুলে ধরার পূর্বে নিচের বিষয়গুলো আলোচনা করা একান্ত জরুরী বিধায় তা তুলে ধরলামঃ
New Moon আসলে নতুন চাঁদ নয়ঃ ইংরেজিতে অমাবস্যাকে New Moon বলে। New Moon এর অভিধানিক অর্থ অমাবস্যা হলেও সাধারণ মানুষ এর অর্থ মনে করে থাকে নতুন চাঁদ। বিভিন্ন অনুবাদ গ্রন্থেও New Moon এর অর্থ নতুন চাঁদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই New Moon শব্দটির পরিবর্তন হওয়া একান্ত প্রয়োজন। অনেক মহাকাশ বিজ্ঞানী কখনো কখনো New Moon এর পরিবর্তে No Moon, Black Moon ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রকৃতভাবে এ শব্দগুলোও সঠিক অর্থ বহন করেনা। যেমনঃ “No Moon”-এর অর্থ “চাঁদ নেই”, প্রকৃতপক্ষে অমাবস্যায় চাঁদের উপস্থিতিতো অবশ্যই থাকে কিন্তু তা দৃশ্যমান হয়না। আবার “Black Moon” এর অর্থ “কালো চাঁদ”, কিন্তু তাও সঠিক নয় কেননা পৃথিবীর দিকে চাঁদের যে অংশটুকু থাকে তা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে বলে দৃশ্যমান হয়না। কিন্তু সূর্যের দিকের অংশটুকু আলোকিতই থাকে।
Zero Moon মানে অমাবস্যাঃ বস্তুত অমাবস্যাকে New Moon এর পরিবর্তে Zero Moon হিসেবে আখ্যায়িত করা উচিৎ। কেননা অমাবস্যার সময় চাঁদ, পৃথিবী এবং সূর্যের মাঝে অবস্থান করে এবং সে সময় চাঁদ দৃশ্যমান হয়না।
অমাবস্যা সংঘটনের চিত্র
সে সময় চাঁদের বয়স ধরা হয় শূন্য ঘন্টা, শূন্য মিনিট। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতে, অমাবস্যার পর চাঁদ নিদিষ্ট বয়সে (সাধারণত তা ১৮-২১ ঘন্টা) পৌঁছালে এবং চাঁদের বয়সের পাশাপাশি আরো কিছু শর্ত পূরণ হলে চাঁদ পৃথিবী থেকে দেখা যায়। এ যাবৎ কালে মুসলিম গবেষকরা চাঁদ দেখার যে শর্তদি আবিষ্কার করেছেন সেগুলো হলঃ (১) চাঁদের বয়স, (২) চাঁদ ও সূর্যের কৌণিক দুরত্ব, (৩) দিগন্ত রেখার উন্নতি কোণ, (৪) সূর্যের লাল আভা বিকিরণের বিস্তৃতি এবং স্থায়ীত্ব, (৫) চাঁদের তীর্যক পথ ও খাড়া পথে গমন, (৬) চাঁদের আলোকিত অংশ বা চাঁদের পুরুত্ব, (৭) পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব, (৮) সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব।
মহাকাশ বিজ্ঞানীরা অমাবস্যার সময় চাঁদের বয়স শূন্য ধরেই তাদের সকল গণনার কাজ করেন। ফলে অমাবস্যার পর যখন চাঁদ দৃশ্যমান হয় তখন উল্লেখ করা হয় এভাবে যে ২০ ঘন্টা, ২২ ঘন্টা বা ৩৬ ঘন্টার চাঁদ দৃশ্যমান হয়েছে। সুতরাং গণনার সময় চাঁদের বয়স যেহেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং চাঁদের উপস্থিতি যেহেতু সবসময়ই থাকে তাই No Moon অথবা Black Moon না বলে Zero Moon বলাই যুক্তিসঙ্গত।
অমাবস্যার চাঁদ বুঝাতে New Moon শব্দটি বিভ্রান্তিমূলকঃ ইংরেজীতে অমাবস্যার চাঁদকে New Moon বলার পেছনে কারণ হচ্ছে অমাবস্যার পর থেকেই চাঁদ আবার ধীরে ধীরে পৃথিবীর চারপাশ প্রদক্ষিণ করে বিভিন্ন দশায় পৌঁছে এবং শেষে আবার পৃথিবীর আড়ালে চলে যায়। সে সময় পৃথিবীর চারপাশে চাঁদের একবার প্রদক্ষিণ শেষ হয়। এছাড়া ইহুদীরা অমাবস্যার চাঁদকে New Moon বা নতুন চাঁদ হিসেবে ধরে তাদের ক্যালেন্ডার রচনা করে থাকে। ফলে অমাবস্যার চাঁদ তাদের কাছে মাসের নতুন চাঁদ তথা New Moon। মুসমানদের কাছে গণনার দিক থেকে এই অমাবস্যার চাঁদের কোন গুরুত্ব নেই।
বাঁকা চাঁদের শরয়ী ব্যাখাঃ কুরআন শরীফ-এ আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন, “(হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনাকে বাঁকা চাঁদ সম্পর্কে প্রশ্ন করে, আপনি বলুন এটি মানুষের (আরবী মাস এবং ইবাদতের) সময় এবং হজ্জের সময় নির্ধারণ করার মাধ্যম। ” (সূরা বাক্বরা ১৮৯)
আবার হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা চাঁদ দেখে রোজা শুরু কর এবং চাঁদ দেখে ঈদ কর। আর যদি ২৯শে শা’বান চাঁদ দেখা না যায় তবে শা’বান মাস ত্রিশ দিনে পূর্ণ কর।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)
কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ যে চাঁদের বর্ণনা করা হয়েছে তা বাঁকা চাঁদ বা হিলাল যা অমাবস্যার পরে পৃথিবীতে দৃশ্যমান হয়। এই বাঁকা চাঁদ বা হিলালকে বলা হয় Crescent Moon যা শরীয়তের নতুন চাঁদ। আর অমাবস্যার চাঁদ হচ্ছে Zero Moon যার বয়স শূন্য ঘন্টা, শূন্য মিনিট এবং তা কখনোই দৃশ্যমান হয় না।
যারা মনে করে অমাবস্যায় নতুন চাঁদের জন্ম হয় ফলে জন্মের পরেই চাঁদ দৃশ্যমান হবে এমন ধারণা সঠিক নয়। অমাবস্যায় নতুন চাঁদের জন্ম হয় সত্য তবে তা দেখতে পাবার জন্য কমপক্ষে ১৮-২১ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। অনেকে বিষয়টিকে এভাবে অপব্যাখ্যা করে যে, এই নতুন যাত্রার চাঁদই হচ্ছে শরীয়তের নতুন চাঁদ। তাদের কাছে চাঁদ দেখতে পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং নতুন মঞ্জিলে চলাটাই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এরকম ব্যাখ্যা শরীয়তসম্মত নয় কারণ কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এ বাঁকা চাঁদ বা হিলাল বা Crescent Moon-এর কথা বলা হয়েছে।
সুতরাং, অমাবস্যার চাঁদ বুঝাতে New Moon শব্দটি বিভ্রান্তিমূলক বলে তা পরিত্যাজ্য। New Moon শব্দের পরিবর্তে Zero Moon শব্দটির ব্যাপক প্রচার জরুরী। ইহুদী-মুশরিকদের কাছে অমাবস্যার চাঁদের গুরুত্ব রয়েছে, কিন্তু মুসলমানদের কাছে নয়। মুসলমানদের কাছে New Moon হচ্ছে অমাবস্যার চাঁদ। আর অমাবস্যার পরপরই চাঁদ দৃশ্যমান হয়না। অমাবস্যা অনুযায়ী আরবী মাস গণনা করা কখনোই শরীয়ত সমর্থিত নয়।
আরবী মাস ও ইহুদীদের মাস গণনার তুলনামুলক চিত্র
উপরের চিত্রে দেখানো হয়েছে যে, ইহুদীরা চাঁদ দেখে মাস গণনার ক্ষেত্রে যে New Moon থেকে মাস গণনা করা হয় সেটা আসলে আরবী মাস গণনার ক্ষেত্রে Zero Moon বা অমাবস্যা। অর্থাৎ ইহুদীরা অমাবস্যা থেকে মাস গণনা শুরু করে।
এবার মূল বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করা যাক।
সৌদি আরবের চাঁদ দেখা নিয়ে ষড়যন্ত্রঃ সৌদী ওহাবী সরকার চাঁদের নতুন তারিখ ঘোষণার ক্ষেত্রে বর্তমানে উম্মুল কুরার ক্যালেন্ডারে যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তাতে বলা হয়েছে যদি কোন আরবী মাসের ২৯তম দিনের সন্ধ্যায় নিচের ২টি অবস্থা পূর্ণ হয় তবে সন্ধ্যার পর থেকে হবে নতুন মাসের ১ম তারিখ গণনা করা হবে।
ক) যদি জিওসেন্ট্রিক অমাবস্যা সূর্যাস্তের পূর্বে ঘটে।
খ) যদি চাঁদ, সূর্য অস্ত যাবার পরে অস্ত যায়।
এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয় যে, উভয় শর্ত পূর্ণ হলেও সেক্ষেত্রে চাঁদটি Zero Moon বা অমাবস্যা হতে পারে। কারণ অমাবস্যা সংঘটিত হওয়ার পর থেকে চন্দ্র অস্ত যাওয়ার মধ্যবর্তী সময় যদি ১৮ ঘন্টার কম হলে চাঁদটি Zero Moon হবে ফলে চাঁদটি দৃশ্যমান হবেনা। নিচের চিত্রে তা দেখানো হলঃ
উম্মুল কুরার শর্তে ত্রুটি
এই বছর (১৪৩০ হিজরী) হজ্জ নষ্টের প্রমাণঃ এ বছর সৌদি ওহাবী সরকার যিলহজ্জ মাসের তারিখ হের-ফের করার কারণে হজ্জ নষ্ট হবে। নিচে প্রমাণ গুলো তুলে ধরা হলঃ
(১) সৌদি ওহাবী সরকার যেদিন (১৮ নভেম্বর ২০০৯) যিলহজ্জ মাসের এক তারিখ ঘোষণা করে, সেদিন তাদের পত্রিকাগুলোতে তারিখের গড়মিল লক্ষ্য করা গেছে। যেমনঃ অন্যান্য পত্রিকাগুলি (যেমনঃ Saudi Gazette ) যিলহজ্জ মাসের এক তারিখ দেখালেও ASHARQ AL-AWSAT পত্রিকাটি ৩০শে যিলক্বদ দেখায়। এমনকি সোদি প্রেস এজেন্সী (SPA) এর website এ ইংরেজী এবং আরবী ভার্সনে গড়মিল লক্ষ্য করা গেছে।
(২) যেহেতু সৌদি আরব যেদিন (১৮ নভেম্বর ২০০৯) যিলহজ্জ মাসের এক তারিখ ঘোষণা করে ঠিক সেদিন ইসরাঈলের পত্রিকাগুলোতে কিসলভ মাসের এক তারিখ (Kislev ) দেখায়। ইহুদীরা যেহেতু চাঁদ দেখে তাদের মাস গণনা করে (তাদের অমাবস্যার দিন এক তারিখ) সুতরাং সৌদি ওহাবী সরকার চাঁদ না দেখেই অমাবস্যার দিন এক তারিখ ঘোষণা করেছে বলে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল। লিংকটি দেখুন
(৩) এছাড়া বাংলাদেশের যুগান্তর পত্রিকায় ১৯শে নভেম্বর সৌদি ওহাবী সরকার কর্তৃক চাঁদের তারিখ হের-ফের করার খবর উল্লেখ করেছে।
(৪) ১৭ই নভেম্বর ২০০৯ ঈসায়ী, মঙ্গলবার সৌদি আরব চাঁদ দেখার মিথ্যার দাবি করে ১৮ই নভেম্বর, বুধবার থেকে পবিত্র যিলহজ্জ মাস গণনা শুরু করেছে। অথচ মহাকাশ বিজ্ঞানের গণনা অনুযায়ী এবং সউদী আরবের উম্মুল কুরার তথ্য অনুযায়ী প্রমাণিত হয়, ১৭ই নভেম্বর, মঙ্গলবার চাঁদ দেখার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। যেখানে সূর্যাস্তের সময় দিগন্তরেখার উপর চাঁদ ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি উপরে থাকলে এবং পাশাপাশি চাঁদ দেখার অন্যান্য মান অনুকূলে থাকলে চাঁদ দৃশ্যমান হয় সেখানে ১৭ই নভেম্বর, মঙ্গলবার সউদী আরবে চাঁদ মাত্র ৩ ডিগ্রির কিছু বেশি উচ্চতায় ছিল। যে উচ্চতায় খালি চোখে তো নয়ই বরং বাইনোকুলার এবং টেলিস্কোপ দিয়েও চাঁদ দেখার সম্ভাবনা ছিল না। সুতরাং মিথ্যা সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে আরবী মাস শুরু করলে তা শরীয়তে গ্রহণযোগ্য হবে না। সউদী আরবে পবিত্র যিলহজ্জ মাস চাঁদ না দেখে একদিন পূর্বে শুরু হওয়াতে অকুফে আরাফা অনুষ্ঠিত হবে ৯ই যিলহজ্জের পরিবর্তে ৮ই যিলহজ্জ। ফলে হজ্জের একটি ফরয আমল আদায় না হবার কারণে পবিত্র হজ্জ বাতিল হবে। সূত্রঃ দৈনিক আল-ইহসান
উপরোক্ত দলীল ভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এ বছর আরবী মাসের তারিখ চাঁদ না দেখে ইহুদীদের ক্যালেন্ডার অনুসরণে যিলহজ্জ মাসের শুরু করে কোটি কোটি হাজীর হজ্জ বরবাদ করছে। এদের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের তীব্র প্রতিবাদ জানানো উচিৎ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১২:২৫