নিরাপত্তার অজুহাতে সি.সি.টিভি লাগানো শরীয়তে নাজায়িযঃ কেউ কেউ সি. সি. টিভি বা ক্লোজ সার্কিট টিভিকে জায়িয করতে গিয়ে বলে থাকে যে সি. সি. টিভিতে ফায়দা রয়েছে। কারণ সি. সি. টিভি মানুষের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে থাকে। (নাঊযুবিল্লাহ)
তাদের উক্ত বক্তব্যের জবাবে প্রথমত বলতে হয় যে, কোন কিছুর মধ্যে ফায়দা থাকলেই যে তা শরীয়তে গ্রহণযোগ্য ও বৈধ হবে তা নয়। বরং শরীয়তের ফায়ছালা হলো যা হারাম তার মধ্যে বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতই ফায়দা থাকুক না কেন তা সুস্পষ্ট হারাম। মহান আল্লাহ পাক নিজেই কালামুল্লাহ শরীফ-এ এর ফায়ছালা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “(হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনাকে প্রশ্ন করা হয়, মদ ও জুয়া সম্পর্কে। আপনি বলে দিন, এ দু’টির মধ্যে রয়েছে কবীরা গুনাহ। এবং মানুষের জন্য ফায়দাও রয়েছে। তবে ফায়দার চেয়ে গুনাহই বড়।” (সূরা বাক্বারা ২১৯)
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, আল্লাহ পাক নিজেই স্বীকার করেছেন যে, মদ ও জুয়ার মধ্যে দুনিয়াবী ফায়দা রয়েছে। মদ পান করলে স্বাস্থ্য ভাল হয়, জুয়া খেললে রাতারাতি অনেক টাকা পাওয়া যায়। তথাপি এগুলোর মধ্যে ফায়দার চেয়ে গুনাহ বেশী বলে এগুলোকে হারাম করা হয়েছে। সুতরাং মদ ও জুয়ার মধ্যে উপকারীতা থাকা সত্ত্বেও এগুলো গ্রহণযোগ্য নয়, এগুলো হারাম। মদ ও জুয়ার মধ্যে উপকারীতার জন্য কেউ যদি এটাকে জায়িয মনে করে, তবে সে কুফরী করলো। তদ্রুপ ছবির মাধ্যমে নিরাপত্তার বিষয়কে কেউ যদি জায়িয মনে করে তবে সেও কুফরী করলো।
সুতরাং ক্লোজ সার্কিট টিভির মধ্যে যতই ফায়দা থাকুক না কেন, যেহেতু তার মূলই হলো ছবি যা স্পষ্টতই হারাম ও নাজায়িয। তাই সমস্ত মুসলমানদের জন্য ক্লোজ সার্কিট টিভিও সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নাজায়িয।
দ্বিতীয়ত বলতে হয় যে, সি. সি. টিভি বা ক্লোজ সার্কিট টিভি নিরাপত্তা দান করে একথা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। কারণ কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা বস্তু কাউকে নিরাপত্তা দিতে পারে না বা হিফাযতও করতে পারে না। বরং নিরাপত্তা দেয়ার ও হিফাযত করার মালিক হচ্ছেন মহান আল্লাহ পাক। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “মহান আল্লাহ পাক হচ্ছেন উত্তম হিফাযতকারী। নিরাপত্তাদানকারী এবং দয়ালু ও করুণাময়।”
যেমন মহান আল্লাহ পাক মক্কা শরীফকে ধ্বংস করতে আসা হস্তিবাহিনীকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়ে নিজেই নিজের কা’বা শরীফকে হিফাযত করেছেন। অনুরূপভাবে বাদশা নূরুদ্দীনের সময় শিয়ারা যখন নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জিস্ম মুবারক চুরি করতে আসে, তখন আল্লাহ পাকই তাদেরকে কুদরতীভাবে ধরিয়ে জিস্ম মুবারক হিফাযত করেন।
পক্ষান্তরে সি. সি. টিভির নিরাপত্তা দান করার বা হিফাযত করার কোন ক্ষমতাই নেই। কারণ একটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরিত হলে এরূপ হাজার হাজার সি. সি. টিভি নিমিষেই উড়ে যাবে। এমনটি নয় যে, সি. সি. টিভি বোমা বিস্ফোরণ ঠেকাতে পারবে। তাহলে সি. সি. টিভি যে নিজেই নিজের নিরাপত্তা দিতে পারে না, সে অন্যের নিরাপত্তা দিবে কিভাবে?
কাজেই সি. সি. টিভি হিফাযত করে বা নিরাপত্তা প্রদান করে একথা বলে তারা সাধারণ মুসলমানদের আক্বীদাকে বিনষ্ট করছে। অর্থাৎ আল্লাহ পাকই যে প্রকৃত হিফাযতকারী বা নিরাপত্তা প্রদানকারী এ আক্বীদা-বিশ্বাস থেকে মানুষকে সুকৌশলে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে।
তৃতীয়ত বলতে হয় যে, হাক্বীক্বতেও সি. সি. টিভি কোন প্রকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং কোন প্রকার নিরাপত্তা দিতে পারে না। নিম্নোক্ত তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা থেকে তা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়।
বর্তমানে অনেক মানুষ মনে করে সি. সি. টিভি একটি শক্তিশালী অপরাধ নিয়ন্ত্রক। কিন্তু সি. সি. টিভির উপর অনেক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে যে, অপরাধের মাত্রা কমানোর ক্ষেত্রে এর কোন প্রভাব নেই। উদাহরণতঃ ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার অপরাধ দমন বিভাগের এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, অপরাধ দমনের অস্ত্র হিসেবে সি. সি. টিভি কোন গুরুত্ব বহন করে না। আরো দেখা গেছে যে, যেখানে সি. সি. টিভি রয়েছে সে জায়গা থেকে যেখানে সি. সি. টিভি নেই সেখানে অপরাধের মাত্রা কম। আবার যেখানে সি. সি. টিভি নেই সেখানে সি. সি. টিভি স্থাপন করার পর অপরাধের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। এটা সুস্পষ্ট যে, সি. সি. টিভি ক্যামেরা কখনই অপরাধ প্রতিরোধ করতে পারে না। শুধু তাই নয়, সি. সি. টিভি ক্যামেরা বোমার বিস্ফোরণ প্রতিরোধেও সক্ষম নয়। বরং সমস্ত ক্যামেরাগুলোই বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায়। সি. সি. টিভিগুলোর নিজের যেখানে কোন নিরাপত্তা নেই সেখানে কি করে মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারে?
পৃথিবীর মোট সি.সি.টিভির ২০% ব্যবহৃত হয় বৃটেনে। এর পিছনে বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ড খরচ হচ্ছে বলে সেদেশে এ নিয়ে আলোচনা ও গবেষণাও হয়েছে অনেক। কিন্তু কোন গবেষণাতেই এর ব্যবহারে কোন উপকারীতা দেখা যায়নি। এ গবেষণা হয়েছে সরকারী এবং বেসরকারী উভয় পর্যায়ে। বৃটেনের পুলিশ বিভাগের গবেষণাতেও ধরা পড়েছে সি.সি.টিভি ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য কোন উপকার নেই।
বিভিন্ন পত্রিকা বা সংস্থাতেও বিভিন্ন শিরোনামে সি.সি.টিভি’র উপর গবেষণার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। যেমন-
উপরে উল্লেখিত প্রতিটি শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় সি.সি.টিভি ব্যবহারে আদৌ কোন উপকার নেই। প্রাইভেসী ইন্টারন্যাশনাল ওয়েব সাইট (http://www.privacyinternational.org) এর মাধ্যমে পাওয়া ৩টি সন্ত্রাস সম্পর্কিত প্রতিবেদনে সি. সি. টিভির কার্যকারীতা নিয়ে প্রচলিত চিন্তাধারার সমালোচনা করা হয়েছে। ‘দ্য স্কটিশ সেন্টার ফর ক্রিমিনোলজী’-র পরিচালক যুক্তি দিয়ে বলে যে, সি. সি. টিভির মাধ্যমে অপরাধ দমনের দাবী ফ্যান্টাসী ছাড়া আর কিছুই নয়। অদক্ষ এবং স্বপ্রণোদিত আইনজীবী দ্বারা স্ট্রেথক্লাইড ইউনিভার্সিটি ‘দ্য ব্রিটিশ জার্নাল অব ক্রিমিনোলজী’ শিরোনামে এক পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। যাতে বলা হয়েছে, সি. সি. টিভি খুব সামান্যই অপরাধকে দমন করতে পারে। এখানে প্রমাণ করা হয়েছে যে, রাস্তার বাতির আলো সি. সি. টিভি থেকেও অনেক বেশী অপরাধের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
২০০৫ সালের জুলাই মাসে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জন স্টেনহোপ বলেছিলেন, “শহরে আরো সি. সি. টিভি ক্যামেরা স্থাপনের চেয়ে আরো পুলিশ নিয়োগ দেয়া আমি বেশী পছন্দ করি।”
২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব ক্রিমিনোলজীর প্রতিবেদনে বলা হয়, সি. সি. টিভি পদ্ধতি স্থাপন করা, নিয়ন্ত্রণ করা ও তা পরিচালনা করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
সি. সি. টিভি স্থাপনের খরচ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে কিন্তু পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া পরিচালনা করা আরো বেশী ব্যয়বহুল। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ক্যামেরা স্থাপনের সার্বিক খরচের শতকরা ৭০ ভাগ খরচ হয় পর্যবেক্ষণকারী ব্যক্তিদের জন্য। ২০০৪ সালে হজ্জের সময় হজ্জের প্রশাসনিক সুবিধাদি বৃদ্ধি করতে গিয়ে মোট খরচ হয়েছিলো ১৪০কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে অনেক অর্থই খরচ হয়েছে হজ্জের সময় সি. সি. টিভি স্থাপন এবং তা পরিচালনা করতে। এছাড়া সি. সি. টিভির ফুটেজে অনুমতিহীনভাবে যা সংরক্ষণ করা হয় তার জন্য খুব কমই আইন রয়েছে। একটি জরীপে দেখা গেছে, শতকরা ৯০ভাগ সি. সি. টিভি তথ্য সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ব্যবহৃত হচ্ছে না। বিভিন্ন জায়গায় সিসিটিভি স্থাপনের ফলে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা কমে যাচ্ছে। বর্তমানে ইংল্যান্ডের হিথ্রু বিমানবন্দরের ৪র্থ টার্মিনালে এমন একটি স্ক্যানিং মেশিন দিয়ে বিমান যাত্রীদের পরীক্ষা করা হয় যা দ্বারা একজন মানুষের পরিহিত কাপড়ের ভিতরের শরীরকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। (নাঊযুবিল্লাহ) এই ধরণের পরীক্ষা কি মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়ে তাদের অবাঞ্চিত প্রবেশ নয়? বর্তমানে সৌদী ওহাবী সরকারও সীমালংঘন করে মুসলমানদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় অবৈধ হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছে। এটা সুস্পষ্টভাবে অন্যায় চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে, প্রকৃত উদ্দেশ্যকে গোপন করে ছবি তোলার বিষয়টি এমনই হয়ে গেছে যে সৌদী ওহাবী সরকার যখন যা চায় তাই করে যাচ্ছে। আজকে অনেক মুসলমান তাদের সাজানো এই প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে তাদের কার্যক্রমকে মেনে নিচ্ছে।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, যারা দাবী করে থাকে যে, সি. সি. টিভি অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে বা নিরাপত্তা প্রদান করে তাদের এ দাবী সম্পূর্ণই মিথ্যা ও অবান্তর। কাজেই, নিরাপত্তার ফায়দার অজুহাতে সি. সি. টিভি ব্যবহার অর্থের অপচয়, অপরের ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর অবৈধ হস্তক্ষেপ ও পাপ বা হারাম কাজের বিস্তার বৈ কিছুই নয়। তাছাড়া যেখানে নিরাপত্তার বৈধ ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে হারাম পদ্ধতিতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা কি করে শরীয়তসম্মত হতে পারে? মূলকথা হলো নিরাপত্তার অজুহাতে হোক আর সাধারণভাবেই হোক সর্বাবস্থায় মুসলমানদের জন্য সি. সি. টিভি ব্যবহার করা সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়িয। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০০৯ বিকাল ৩:৫৬