ইসলামের ৫টি ভিত্তির মধ্যে হজ্জ হচ্ছে একটি অন্যতম ভিত্তি। অথচ প্রতি বছর সৌদী ওহাবী সরকারের কারণে পৃথিবী সমস্ত হাজীদের এই হজ্জ নষ্ট হচ্ছে। কারণ তারা নিরাপত্তার নামে হজ্জের সমস্ত স্থানগুলোতে সি. সি. টিভি বা ক্লোজ সার্কিট টিভি স্থাপন করে রেখেছে, যার মাধ্যমে হাজীদের অবিরত ছবি তোলা হচ্ছে।
সি. সি. টিভি বা ক্লোজ সার্কিট টিভির শরয়ী ফায়ছালাঃ শরীয়তের দৃষ্টিতে সি. সি. টিভি বা ক্লোজ সার্কিট টিভিতে প্রদর্শিত দৃশ্যাবলী যেহেতু ছবি তাই এর ব্যবহার সুস্পষ্টভাবে হারাম। সি. সি. টিভি বা ক্লোজ সার্কিট টিভির মাধ্যমে ধারণকৃত বা প্রদর্শিত দৃশ্যাবলী যে ছবি তা নিম্নোক্ত বর্ণনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।
T.V/Closed Circuit T.V/Video Cassette Recorder/Video Cassette Player ইত্যদির কার্যাবলী ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ (১) Transmission বা প্রেরণ, (২) Medium বা মাধ্যম এবং (৩) Reception বা গ্রহণ। T.V এবং V.C.R বা V.C.P-এর ক্ষেত্রে প্রথমে কোন বস্তুর ছবি তুলে সেই ছবির বিভিন্ন অংশের, আর Closed Circuit T.V-র ক্ষেত্রে কোন বস্তুর সরাসরি বিভিন্ন অংশের প্রতিফলিত ফোটনের Frequency অনুযায়ী এক ধরনের Electrical Signal তৈরী করা হয়। সেই Signalকে আরো Processing-এরপর Transmit করা হয়। T.V-র ক্ষেত্রে Transmit করা হয় বাতাসে। আর V.C.R এবং Closed Circuit T.V-র ক্ষেত্রে তারের মাধ্যমে। মাধ্যম বাতাসই হোক আর তারই হোক সেটা Receiver (অর্থাৎ T.V) এ যখন আসে তখন সেটা Receive করার পর কিছু Processing করা হয়, এই Signalগুলো T.Vতে অবস্থিত একটি Electronic Gunকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে এই Gunটি T.V-র পর্দায় যে অংশে যতটুকু Electron ছাড়লে হুবহু Transmit করা ছবির মত হবে সে অংশে ততটুকু Electron ছাড়ে। এই Electronগুলো রাসায়নিক প্রলেপ পতিত হয়ে উজ্জ্বল ও অনুজ্জ্বল বিন্দুর সমন্বয়ে ছবি তৈরী করে। এই ছবি T.V-র পর্দায় দেখা যায়। অর্থাৎ T.V/V.C.R/V.C.P/Closed Circuit T.V সবক্ষেত্রেই পর্দায় যা আসছে সেটা সুস্পষ্ট এবং বিশেষভাবে অঙ্কিত ছবি।
উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, সি. সি. টিভি বা ক্লোজ সার্কিট টিভির মাধ্যমে ধারণকৃত বা প্রদর্শিত দৃশ্যাবলী অবশ্যই ছবির অন্তর্ভূক্ত। আর শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রাণীর ছবি তোলা, আঁকা, রাখা ইত্যাদি সবই হারাম ও নাজায়িয। এ সম্পর্কে মুসলিম শরীফ-এর ২য় জিলদ্ ২০১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, “হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, নিশ্চয়ই ক্বিয়ামতের দিন দোযখবাসীদের মধ্যে ঐ ব্যক্তির কঠিন আযাব হবে, যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি আঁকে বা তোলে।”
মিশকাত শরীফ-এর ৩৮৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমি আল্লাহ পাক-এর হাবীব পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আল্লাহ পাক ঐ ব্যক্তিকে কঠিন শাস্তি দিবেন, যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি তোলে বা আঁকে।”
উমাদুল ক্বারী, ফওয়ায়ে ছিদ্দীক্বিয়া ৩৭৮ পৃষ্ঠা ও আয্ জাওয়াযির ২য় জিলদ্ ৩৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, তাওদ্বীহ নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে, জীব-জন্তুর ছবি বা প্রতিমূর্তি নির্মাণ করা হারাম, বরং শক্ত হারাম। এটা কবীরা গুনাহ। চাই ওটাকে যত্ন বা সম্মান প্রদর্শন করুক বা না করুক কিংবা অন্য যে কোন উদ্দেশ্যেই বানিয়ে থাকুক। কেননা এরূপ কাজে আল্লাহ পাক-এর সৃষ্টির অনুকরণ করা হয়। ওটা বস্ত্রে, বিছানায়, মোহরে, মুদ্রায়, পয়সায়, পাত্রে কিংবা প্রাচীর গাত্রে যে কোন স্থানে আঁকা বা নির্মাণ করা হারাম।
শরহে মুসলিম ও ফওয়ায়ে ছিদ্দীক্বিয়া কিতাবের ৩৭৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, উক্ত হাদীস শরীফসমূহে প্রাণীর ছবি তৈরী করা বা মূর্তি নির্মাণ করা হারাম হওয়া সম্মন্ধে প্রকাশ্যেই বলা হয়েছে। এটা তৈরী বা নির্মাণ করা জঘন্যতম পাপের কাজ ও হারামও বটে। উক্ত কিতাবে আরো আছে, যদি কেউ মূর্তি বা প্রাণীর ছবি পূজা বা সৃষ্টির অনুকরণের জন্য নাও বানিয়ে থাকে তবুও সে ফাসিক হবে এবং কবীরা গুনাহে গুনাগার হবে।
ফখরুল মুহাদ্দিছীন, আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিখ্যাত ব্যাখ্যা গ্রন্থ বুখারী শরীফের শরাহ উমাদুল ক্বারী-এর ২২ খন্ড ৭০ পৃষ্ঠায় লিখেন, “প্রাণীর ছবি তৈরী শক্ত হারাম ও কবীরা গুনাহ। সম্মানের জন্য তৈরী করুক অথবা অন্য কারণে, সবটার একই হুকুম। অর্থাৎ প্রত্যেক অবস্থাতেই তা হারাম। কেননা ছবি ও মূর্তি তৈরীর মধ্যে স্রষ্টার সাদৃশ্যতা রয়েছে।”
রঈছুল মুহাদ্দিছীন, আল্লামা ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিখ্যাত মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ শরহে নববী ৭ম জিলদ্ ৮১ পৃষ্ঠায় লিখেন, “প্রাণীর ছবি তৈরী শক্ত হারাম ও কবীরা গুনাহের অন্তর্ভূক্ত। কেননা হাদীস শরীফসমূহে এ ব্যাপারে কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাণীর ছবি সম্মানের জন্য তৈরী করুক অথবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে তার একই হুকুম। অর্থাৎ সর্বাবস্থায় প্রাণীর ছবি উঠানো হারাম। কেননা এতে স্রষ্টার সাদৃশ্যতা প্রকাশ পায়।”
১৯৭১ সালের ২৯শে আগস্ট (১৩৯১ হিজরী) সৌদী ওহাবী সরকারের ১৩৭/১ নম্বর রয়াল ডিক্রি অনুযায়ী সৌদী আরবে একটি কাউন্সিল গঠিত হয় তাদের উচ্চ পর্যায়ের মাওলানাদের নিয়ে। ডিক্রির ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়, ‘একটি চিরস্থায়ী কমিটি রাখা হলো, যে কমিটি মাওলানাদের এই কাউন্সিল থেকে সদস্য নির্বাচন করবে রয়াল ডিক্রির সাথে সামঞ্জস্য রেখে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, কাউন্সিলে আলোচনা করার জন্য গবেষণাপত্র তৈরী করা এবং প্রতিটি আলাদা আলাদা বিষয়ে ফতওয়া প্রদান করা।’ এই কমিটির নামকরণ করা হয় ‘আল-লাজনাহ আদ-দাইমাহ লিল-বুহুছ আল ইলমিয়া ওয়াল ইফতা’ ইংরেজীতে ‘The Permanent Commette for Islamic Research and Fataawaa’ এবং বাংলায় ‘ইসলামী গবেষণা এবং ফতওয়ার চিরস্থায়ী কমিটি’।
এই রয়াল ডিক্রির ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে পুনরায় বলা হয়, চিরস্থায়ী কমিটির বেশীরভাগ সদস্য কোন বিষয়ে চূড়ান্ত ঐক্যমত্যে না পৌঁছা পর্যন্ত কোন ফতওয়া প্রদান করা হবে না। এরূপভাবে ৩জন সদস্যের কমে কোন ফতওয়ায় সিদ্ধান্ত দেয়া যাবে না। আর কোন মতের পক্ষে এবং বিপক্ষে সমান সংখ্যক রায় পাওয়া গেলে কমিটির প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
সৌদী আরবের এই ফতওয়া কমিটিকে “ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা কি হারাম অথবা না?” সে প্রশ্ন করলে তারা উত্তর দেয়, “সকল মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী যাদের জীবন আছে তাদের ক্যামেরা বা অন্য কিছু দিয়ে ছবি তোলা হারাম। এবং যারা এরকম ছবি তুলে তাদের অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ আপাক-এর কাছে তওবা করা উচিৎ। তার দ্বারা যা হয়ে গেছে তাতে যেন সে আর ফিরে না যায়।”
ডিক্রির ধারা অনুযায়ী এই ফতওয়ায় স্বাক্ষর করে কমিটির প্রধান- শায়খ আব্দুল আজিজ ইবনে আব্দুল্লাহ বিন বা’য। উপপ্রধান- শায়খ আব্দুর রাজ্জাক আফিফি। সদস্য- শায়খ আব্দুল্লাহ বিন জুদাইয়ান। সদস্য- শায়খ আব্দুল্লাহ বিন কুউদ।
এই ফতওয়ার নম্বর হচ্ছে ৩৫৯২ যা ফতওয়া কমিটির ভলিউম-১ এর ৬৭০পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে। এই ফতওয়া থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হলো তা হচ্ছে, সৌদী ওহাবী সরকার কর্তৃক ওহাবী মাওলানাদের নিয়ে গঠিত সর্বোচ্চ ফতওয়া কমিটির ফতওয়া অনুযায়ী ক্যামেরার সাহায্যে যে কোন প্রাণীর ছবি তোলা হারাম। কিন্তু বাস্তবে আমরা তার বিপরীত অবস্থা দেখতে পাচ্ছি। ফলশ্রুতিতে প্রতি বছর মুসলমানদের হজ্জ নষ্ট হচ্ছে। কেননা আল্লাহ পাক আরো বলেন, “যে ব্যক্তির প্রতি হজ্জ ফরজ সে যেন হজ্জ পালন করতে গিয়ে নির্জনবাস ও তার সংশ্লিষ্ট কোন কাজ না করে এবং কোন প্রকার ফাসিকী বা নাফরমানীমূলক কাজ না করা এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে।” (সূরা বাক্বারা ১৯৭)
আয়াত শরীফে স্পষ্টরূপে বলা হয়েছে যে, হজ্জ করতে গিয়ে কেউ যেন ফাসিকী ও নাফরমানীমূলক কাজ়ে জড়িত না হয়, কিন্তু সৌদী ওহাবী সরকারের কারণে হাজীরা ছবি তোলে, পর্দা লঙ্ঘন করে শক্ত হারাম ও কবীরা গুনাহ এবং চরম ফাসিকী ও নাফরমানীমূলক কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। সুতরাং হজ্জের অজুহাতের এই হারাম ও নাফরমানীমূলক কাজ করা কখনই শরীয়ত সিদ্ধ নয়। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০০৯ বিকাল ৪:১৮