শেখ মুজিবুর রহমান দুই পরাশক্তির (যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া) আস্থা হারিয়েছেন এবং ভারতেরও। তারা তাদের নিজস্ব লোক না পাওয়া পর্যন্ত তাকে ক্ষমতায় রাখছে। তার অস্থির নীতি তাকে বিশেষ কোনো শক্তির প্রতি পক্ষপাত না দেখানোয় তা তাকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করছে…
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রওয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন-১৯৭৪
উদ্ধৃতিতে বলা কথাগুলো আলাদা ব্যাখ্যার জো অবশ্যই আছে। রও যখন এই রিপোর্ট দেয়, তখন ’৭৫ এসে গেছে। বঙ্গবন্ধু তার বাকশাল কর্মসূচি হাতে নিলেন যা তার শত্রুর সংখ্যা বাড়ালো বৈ কমালো না। তার হত্যাকাণ্ডের পর খুনীরাও এটিকে (বাকশাল) অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে কিংবা বলা যেতে পারে অজুহাত হিসেবে দেখিয়েছে। যদিও খন্দকার মোশতাক আহমেদ বাকশাল বাতিল করেননি কিংবা করতে পারেননি। তখনও সংসদ কার্যকর ছিলো যা পরে বাতিল করেছেন ৬ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়া সায়েম। তবে আমাদের পোস্টের প্রসঙ্গ এসব নিয়ে নয়, একটি বিশেষ সংবাদ নিয়ে। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর বার্তাসংস্থা এএফপি এটি পরিবেশন করে। সে বার্তার সত্যতা যাই হোক এতে ’৭৫ সালের আওয়ামী লীগের বিভাজিত অবস্থান সম্পর্কে একটি আভাস মেলে। তাতে একদিকে শেখ মুজিব এবং অন্যদিকে বাকিরা। সেই বাকিদের মধ্যেও নানা মত ও নানা পথ। ইতিহাস বলে দিচ্ছে সেই নানা মত ও পথের সর্বশেষ অবস্থান। সেই বিতর্কে না গিয়ে আমরা বরং খবরটাতেই মন দিই।
খবরটির উৎস একটি তারবার্তা। ১৯ আগস্ট তেহরানের মার্কিন দূতাবাস থেকে এটি ঢাকায় পাঠানো হয়। রাষ্ট্রদূত রিচার্ড হেলমস (এই লোক ১৯৬৬ থেকে ‘৭৩ পর্যন্ত সিআইএর প্রধান ছিলেন এবং চিলির রাষ্ট্রপ্রধান সালভাদর আলেন্দের উৎখাতে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে প্রমানিত। ব্যাপারটি নিয়ে পরে কংগ্রেসের তদন্ত কমিটিতে তিনি মিথ্যাচারের দায়ে অভিযুক্ত হন এবং ২ হাজার ডলার জরিমানা এবং ২ বছর সশ্রম কারাদন্ডের স্থগিতাদেশ পান) ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টারকে পাঠিয়েছিলেন এটি। এতে ১৭ আগস্ট ইরানের একটি ফার্সি দৈনিক কায়হানে প্রকাশিত একটি সংবাদ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সংবাদটির উৎস ছিলো এএফপি এবং এতে ১৫ আগস্ট আসলে দুটি অভ্যুথান ঘটেছিলো বলে তারা দাবি করেছে।
চমকপ্রদ এই বার্তাটির ভাবানুবাদ মোটামুটি এরকম:
১. ১৭ আগস্ট ফার্সিভাষী দৈনিক কায়হানে একটি বিশাল প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যেখানে ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে দুটো অভ্যুথান ঘটেছিলো বলে দাবি করা হয়েছে। বাংলাদেশ সময় ভোর ৩টা ৩০ মিনিটে সোভিয়েতপন্থী অভ্যুথানটি সংগঠিত হয় যাতে মুজিব নিহত হন। এরপর ভোর সাড়ে পাঁচটায় ডানপন্থীদের অভ্যুথান ঘটে যাতে বামপন্থী ক্যুদেতারা নিহত হয়। আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি বেনামিতে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটির মূল উৎস এএফপি, বার্তাসংস্থাটির দাবি বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিবেদনটির সত্যতা নিশ্চিত করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে ইরানের অন্য কোনো ফার্সি বা ইংরেজি পত্রিকায় ঘটনার এই সংস্করণটি আসেনি।
২. প্রতিবেদনটির গুরুত্ব যাই হোক না কেনো, এর আলোচিত অংশগুলো পাঠনো হলো। এতে বলা হয়েছে যে বামপন্থী অভ্যুথানটির পরিকল্পনা গত কয়েকমাস ধরেই নেওয়া হচ্ছিলো আর এর নেপথ্যে ছিলেন মুজিবের মন্ত্রীসভা থেকে বাদ পড়া মস্কোপন্থীরা যার সঙ্গে আরো রয়েছেন তাজউদ্দিন আহমদ, আবদুস সামাদ আজাদ, মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন, কামরুজ্জামান, আবদুর রব, কোরবান আলী এবং মস্কোয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামসুল হক। মুজিবের দুই তুতো ভাই (কাজিন) শাহেদ এবং মুনির এবং সাবেক উপরাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম বামপন্থীদের সহযোগিতা করেছেন। এই দলটির ভয় ছিলো যে মুজিব পশ্চিমাদের (মূলত যুক্তরাষ্ট্র) সঙ্গে অতিরিক্ত মাখামাখি করছেন।
ডানপন্থীরাও এ মাসের শেষ দিকে একটি অভ্যুথান ঘটাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তবে তারা মুজিবকে হত্যা না করে রূপক/সিম্বল (পুতুল সরকার অর্থে) হিসেবে রেখে দিতে চাইছিলো। খন্দকার মোশতাক আহমেদ ছাড়াও এই দলে আরো ছিলেন শ্রমিক নেতা আবদুল মান্নান, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী এবং ইব্রাহিম আলী। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী গোয়ন্দা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বামপন্থীদের অভ্যুথানের খবর পাওয়া মাত্র এরা তৎপর হয়। তারা দ্রুত ঢাকা রেডিও দখল করে এবং অভ্যুথানের খবর প্রচার করে তবে মুজিবের হত্যার বিষয়টি চেপে যায়। তাদের অনুগত বাহিনী এরপর ধানমন্ডী এবং ঢাকা অফিসার্স ক্লাব সংলগ্ন এলাকায় বামপন্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে নামে যাতে উভয়পক্ষের বড় রকমের হতাহতের ঘটনা ঘটে। মস্কোপন্থীরা ঢাকা আক্রমনের জন্য ঢাকার বাইরে বিশাল সৈন্য সমাবেশ ঘটালেও ডানপন্থীরা ঢাকা ঘিরে ফেলে এবং সামরিক আইন জারি করে তাদের পরিকল্পনা বানচাল করে দেয়।
প্রতিবেদনটির ফলোআপ আমরা জানতে পারিনি। এটিকে একটি হলুদ বার্তা হিসেবে অনায়াসেই আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি। হতে পারে এটি ১৫ আগস্টের দায় ভারত-রাশিয়ার উপর চাপিয়ে দেওয়ার একটি পরিকল্পিত মার্কিন ষড়যন্ত্র। বার্তা সংস্থা এএফপির যে সংবাদদাতা (সম্ভবত তিনি বাঙালী) এটি পাঠিয়েছেন তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়েও আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি। আবার এর কিছু অংশকে গুরুত্ব দিলে পরবর্তী অনেক ঘটনাপ্রবাহের কিছু রহস্যের উত্তর মিলে। সেসব নিয়ে নাহয় পরে কোনো একদিন আলোচনা করা যাবে। প্রসঙ্গত সে রাতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের বাইরে নিহত একমাত্র সামরিক অফিসার কর্ণেল জামিল যিনি রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। এর বাইরে মোহাম্মদপুরে ৪৬ জন নিহত হওয়ার খবর মিলেছে। সামরিক অধিদপ্তরের প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় লক্ষ্য বিচ্যুত একটি মর্টারের গোলা বিস্ফোরনে এরা মারা যায়।
সর্বশেষ আপডেট : ধারণা করা হচ্ছে এই তারবার্তায় উল্লিখিত এএফপির খবরে বঙ্গবন্ধু হত্যার দায় শেখ ফজলুল হক মনি এবং সেরনিয়াবাতের ওপর চাপানোর একটা চেষ্টা চালানো হয়েছে, তাদেরকেই দেওয়া হচ্ছে মস্কোপন্থী অভ্যুথানের দায়। ফারুক-রশীদ-ডালিম গ্রুপ তাদের হত্যা করে পুরো অভ্যুথানের ক্রেডিট নিয়ে নেয়। মজার ব্যাপার তারা এও বলতে চাইছে যে মোশতাক-ফারুক-রশীদের (ডানপন্থী গ্রুপ) পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ভাবনা ভাবা হয়নি। পুরো তারবার্তা বিশ্লেষণে একটাই লাভ হয়েছে যে বঙ্গবন্ধুহীন আওয়ামী লীগে দুই গ্রুপের একটা চিত্র পাওয়া গেছে।
Courtesy: অমি রহমান পিয়াল
Source: https://www.amarblog.com/omipial/posts/136952
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ১১:৩৮