উনি এভবেই হাসেন। অত্যন্ত বিশ্রীভাবে। অপটু শিল্পীর আঁকা দুর্বল ছবির মতো। আমি ছিলাম এই হাসির একনিষ্ঠ দর্শক। উনি যখন হাসতেন একদমই ভালো লাগত না। মনে হত আশেপাশে প্রচণ্ড বজ্রপাত হচ্ছে যা আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না অথবা গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহের মতো যন্ত্রণাময়। যে কেউই আমার সামনে হাসলে আমি অপ্রতিভ হয়ে যাই। কিন্তু উনি বারবার সেটাই করতেন। খুব পরিচিত তিনি ছিলেন না। এনজিওতে চাকরী করার দরুন পরিচয়। দুজনের নির্বাসিত স্বভাবের কারণে অনেকদিনপরও আমরা অপরিচিত ছিলাম।
.
অফিসের কাজ শেষে ক্যাফেতে প্রায় উনার দেখা পেতাম। চোখ পড়লেই উনি সেই বিখ্যাত হাসি হাসতেন। চোখ ফিরিয়েও নিতে পারতাম না। নৈশব্দের হাসি,গতিহীন,নিস্তরঙ্গ-যেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা! অথচ তীব্র অস্বস্তিকর! আমি চোখ ফিরিয়ে নিতে চাইতাম,কিন্তু বেশি সময়ের জন্য পারতাম না । গোটা ব্যাপারটাই ছিল অভ্যাসের মতো।
এ ব্যাপারটা অপ্রীতিকর হওয়ার অন্যতম কারণ হয়তো আমি তেমন হাসতে পারতাম না। যতবারই সেই হাসি দেখতাম আমার বুকে রুদ্রের কবিতা ঘুরপাক খেত,'কতোটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে এতো গান,এতো হাসি নিয়ে বুকে নিশ্চুপ হয়ে থাকি।'
.
সেটা ছিল শীতকাল। ডিসেম্বর মাসের ঘন কুয়াশা-যেন আকাশের মেঘেরা পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। আমাদের অফিসে যাওয়ার সময় কিছুটা পিছিয়ে গেল। কিন্তু উনি যাচ্ছেন না,অফিসেই যাচ্ছেন না। কুয়াশার নিচে চাপা পড়ে গেলেন? আমার মনের বিপন্ন কৌতুকপ্রবণ এলাকা মনে করল,শীতকালে ঠোঁট ফেটে গেছে,অমন করে হাসতে পারবেন না তাই অফিসে আসছেন না।' মানুষের মন যে কত কিছু নিয়ে কতভাবে কৌতুক করতে পারে,অদ্ভুত! অবশ্য বেশিদিন কৌতুক করতে তিনি দেননি। নতুন ক্যালেন্ডারের জানুয়ারি মাসে হাজির হলেন লাস্যময়ী। পরনে নীল কার্ডিগান, বিলুপ্ত প্রাণীদের মতো দেখাচ্ছিল। এসেই অফিস প্রধানের রুমে গেলেন। কাজ শেষ করে দ্রুতই বাইরে বেড়িয়ে আসলেন। আমার গতিহীন জীবনে এমন দ্রুততা আমি কমই দেখেছি। আমি কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম তিনি একদিন আসবেন,হাসবেন এমন আমাকে পুনরায় অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলবেন।
.
উনি এবার হাসলেন না। আমি তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। নাহ,একই নির্লিপ্ত ভঙ্গি। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা এগিয়ে এলেন। অবসন্ন কণ্ঠে জানালেন পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে যাচ্ছেন,সেখানে একটা জবের জন্য এপ্লাই করেছেন।আমার খুব বলতে ইচ্ছা করছিল,'নীল কার্ডিগান পরে আর আসবেন না আপনি?' কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকাতে আমি ভাবলাম এবার নিশ্চয়ই হাসবেন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার। তিনি কাঁদছেন! উনার চোখ থিকরে পানি বেরুচ্ছে। হাসি দেখতে দেখতেই আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ কান্না দেখে আমি আরো অবাক হলাম। ভিতরে একটা অজানা অস্বস্তিও তৈরি হল।