১
শীতের প্রকোপে রাস্তায় বসে কাঁপছে জমিরা বেগম। বয়স পঞ্চাশের সীমা পার করেছে।মিরপুরের একটা বস্তিতে থাকে।মহিলার চেহারা জীর্ণ-শীর্ণ কাজেই রাত আর জমিরা বেগমের মুখ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।তার একটিমাত্র ছেলে রাসেল।বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ হবে।নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুইদিন হল বিছানার সাথে বন্ধুত্ব করেছে। তার চেহারা বর্ণনা করার জন্য দিন-রাত কোনটিই যথেষ্ট নয়,সে ক্ষমতাও আমার নেই।
২
শীতের প্রকোপ আস্তে আস্তে আরো বাড়ছে।আশেপাশে অনেক মানুষ মাছির মতো ভিড় করেছে।কিন্তু সবাই অদ্ভুত রকম নীরব।শীত,যেন পুরো এলাকাটাকে একটা ঘোরের মধ্যে রেখেছে। একটু পড়েই কম্বল বিতরণ কার্যক্রম শুরু করবেন এলাকার বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী সালেহ আহমেদ। কম্বল এসে পড়েছে,সালেহ সাহেব এলেই বিতরণ শুরু হবে।উপস্থিতি লোকের পোশাক-আশাক দেখলে অবশ্য বুঝা যায় না শীত এসে গেছে।কম্বলগুলোও যেন ওদের উপহাস করছে। শত শত মানুষ পিঁপড়ার লাইন ধরে দাঁড়িয়েছে।লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়েছে জমিরা বেগম। নিজের শাড়ির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ছেলের কথা ভাবছে,কখনো কখনো মশার জীবন বিপন্ন করছে।
৩
কিছুক্ষনের মধ্যে সালেহ সাহেব এসে পড়লেন। জমিরা বেগমের চোখের তারা জ্বলে উঠল। রাসেলের শরীর খুব খারাপ।শীতে ছেলেটা কতো কষ্ট পাচ্ছে। এখনই একটা কম্বল খুব দরকার। সালেহ আহমেদের লোকদের কাছে গিয়ে বলল,আমারে একটা কম্বল আগে দেওন যাইবনি? পোলাডার অসুখ,শীতে মরি যাইব।
কম্বল দেখলেই নিতে ইচ্ছা করে।যাহ! এখন দেওয়া যাইবনা।সাংবাদিক আইব,ছবি তুলব।এরপর.........
আর কয়েকবার অনুনয় করেও লাভ হলো না জমিরা বেগমের।
জমিরা বেগম একবার ভেবেছিল চলে যাবে। ছেলেটার জানি কী অবস্থা! বাড়িতে তো কেও নেই,কিন্তু কম্বল পেলে তো রাসেলের কষ্ট কমবে-তা ভেবেই রয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সাংবাদিক এসে গেল।কম্বল বিতরণ শুরু হলো।জমিরা বেগমের কম্বল পেতে খুব দেরি হয়ে গেল।
৪
রাতে বাড়িতে ফিরছে জমিরা বেগম।কম্বল পাওয়ার খুশিতে মনটা ভালো হয়ে গেছে।যাক! ছেলেটা আর কষ্ট পাবে না।আরো আগে পেলে ভালো হতো,ছেলেটা এতক্ষণ কত কষ্ট পেয়েছে!বাড়ির প্রায় কাছে চলে এসেছেন তিনি।বস্তির কয়েকটি কুকুর বিদ্রোহী সুরে ডাকাডাকি করছে। বাড়ির দরজা খুললেন তিনি।ছেলে নিথর হয়ে শুয়ে আছে।এই মুহূর্তে ছেলেটাকে একটা মূর্তির মতো মনে হয়েছিল তার,কিন্তু সাথে সাথেই সেই চিন্তা দূর করে ছেলেকে ডাকাডাকি শুরু করলেন।
রাসেল,ও রাসেল।কই রে? কম্বল আনছি তোর লাইগা।তোর আর কষ্ট হইত না।
রাসেল নীরবতা ভঙ্গ করল না।তা দেখে জমিরা বেগম কম্বলটা বাইরে রেখেই রাসেলের কাছে গেলেন।রাসেলের হাত- পা সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আছে।কোন কথা নেই,কোন নড়াচড়া নেই।
'ওই,রাসেল,উঠতি না? ওই.........আল্লাহ...আল্লাহ।
বাইরে থেকে জমিরা বেগমের কান্না আর করুন চিৎকার শুনে প্রচুর মানুষ আসতে লাগল এই ঘরটিতে। ঘরটির ভেতরে একটি লাশ আর তার মা,দরজার বাইরে এখনও কম্বলটি পড়ে আছে,সেটিও লাশের মতো। উৎসুক মানুষরা ঘরে ঢুকার সময় সে কম্বলটির দিকে একটুও তাকাচ্ছে না।কম্বল পা দিয়ে মাড়িয়েই সবাই ঘরে প্রবেশ করছে