রাত প্রায় একটা । চাঁদটাকে অনেক দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ।অন্ধকার অদ্ভুতভাবে চাঁদটাকে ঘিরে রেখেছে । চাঁদের আলো আর এক টুকরো মেঘ স্বর্গীয় পরিবেশ তৈরি করেছে ।যদিও এ উপগ্রহটির সৌন্দর্যে কিছু যায় আসে না উসমান আর মাহমুদের। না যাওয়াই ভালো । গরীবের সৌন্দর্যবোধ আনন্দের চেয়ে দুঃখই বেশি দেয় । দুজনে আজ নির্বিচারে মদ গিলেছে । অভাব আর খুদা থেকে বেঁচে থাকার আর কোনো ভালো ঔষুধ সম্ভবত ওদের জানা নেই । হয়তোবা কেও জানতে দেয়নি ।সবাই সবকিছু জানে না ,জানা ঠিকও না । দুইজনই কথা বলতে বলতে হাঁটছিল ।তারপর চুপ ।আবার নীরবতা ভেঙে উসমান মাহমুদের দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীনভাবে বলে উঠলো ,
- আইজকা মদ পেটের ভিতর বেশি ঢাইলা ফেলছি ।
- হ্। খুদা বেশি মদও বেশি ।
-খুদা হেইডা তো শুধু মদের লগেই গিলন যায় ।
-ঐ দেখ ! দেখ! পুলিশ আইতাছে ।
-ঊহ ! ঠিকমতো রাস্তায়ও হাডা যাইত না ।হালা মনে হয় আজকে বেশি ঘুষ পায় নাই ।
রাইতে ঘুষের লাইগা ঘুরে ।
- চল দৌড় দিবি ?
- নাহ ।শরীর আর চলে না । আমারে একলা থুইয়া যাইছ না ।
- নাহ। আমরা তো একি গ্লাসের মাতাল ।তরে থুইয়া যামু কেমনে ?
পুলিশের নাম আলম ।আজকে রাতে ডিউটি পড়েছে । এসেই দুই মাতালকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে ফেললো ।
উসমান বলল, মাহমুদ তুই কথা কইছ না । তুই যে মাতাল এইডা চোখ বন্ধ করে কইয়া দেওন যাইব । আমি শামাল দিতাছি ।
আলম এগিয়ে আসছে । এসে চড়া গলায় প্রশ্ন করল ,তবে প্রশ্নটা কাকে করল বুঝা যায়নি ,
- ওই ! এতো রাইতে কি করছ ? বাড়ি-ঘর নাই?
- বাড়ি তো কওন যায় না । তবে ছোট একখান আছে ।কিন্তু বাড়িতে শান্তি নাই ।
- তাহলে রাস্তায় কি? রাস্তায় শান্তি আছে ?
- না ।তবে অশান্তি নাই ।
আলমের এবার মাহমুদের দিকে দৃষ্টি গেলো ।দেখেই বুঝে গেলো সে মাতাল । এবার আর ক্রুদ্ধ হয়ে প্রশ্ন করল ,
- কিরে ? মদ খাইছস ?
এবার মাহমুদ বলে উঠলো ,জ্বী, প্রতিদিনই খাই ।
- কেন খাছ ?
- খুদা ,অভাব । ভালা লাগে ।এজন্যই খাই ।
-মদের টাকা দিয়া তো ভাত কিনা যায় ।
- ভাত খাইলে খুদা কমে কিন্তু কষ্ট কমে না ।
- হালা । তরে আজকে জেলে ভরমু ।
এবার কথা বলে উঠলো উসমান ।মাঝরাতে তার কর্কশ গলা দিয়ে যেন আর্তনাদ বেরুলো ,
-অনেকেই তো মদ খায় । আমগো কি দোষ ? চুরিও করিনাই , ডাকাতিও করিনাই ।
- চুপ !শালা বজ্জাত ! বেশি কথা কইলে মাইরা পিড ফাডাইয়া লামু ।
- বুক তো জন্মের থেইক্যাই ফাডা । এখন পিডটাও ফাডান ।আমগোরে ভালারাও মারে খারাপেরাও মারে ।হগলেই মারে ।
ইতোমধ্যে মধ্যে আলমের কল এসেছে ।সেই কিছুক্ষণ দূরে গিয়ে কথা বলল। এখন তাকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে । সে এবার উসমান আর মাহমুদের দিকে ফিরে আসছে ।
এবার তিনজনই নীরব ।কোন কথা বলছে না ।মাহমুদই প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করল ।
- স্যার আমনে মদ খাননা ? মাহমুদ প্রশ্নটা করেই ভয় পেয়ে গেলো ।আসলে এমন প্রশ্ন মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে । কিন্তু আলমও ভয় পাওয়ার মতো কোনো উত্তর দিল না ,
- হ্যাঁ ।খাই, তয় মাঝে মইধ্যে ।
- ক্যান ? আমনের ও কি দুঃখ আছে?
- হ্যাঁ ।দুঃখও তো সবারই আছে । আর এ বেতনে কি সংসার চলে ?
- হুনছি পুলিশেরা নাকি ঘুষ খাইয়া ম্যালা টাকা কামায় ?
- চুপ! হালার পুত ! এ কথা কবি না ।ঘুষ,চুরি এগুলার ওস্তাদ হইলো গিয়া বড়লোক মানুষ । ছোডলোকেরা চুরিও ঠিকমতো করতে পারে না ।
-ছোডলোকেরা সব করলেই দোষ । তা হইলে ভালা কাম কোনডা ?
অনেকক্ষণ নীরব ছিল উসমান । এবার সে নীরবতা ভেঙে বলল , বাইচা থাকাই গরীবের ভালা কাম ।
মাহমুদ আর আলমও সে কথায় সায় দিল । অনেকক্ষণ সিগারেট খায়নি মাহমুদ । পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা নিলো । উসমানকেও একটা দিল । আলমকে সাধলে প্রথমে নিতে না চাইলেও পড়ে রাজি হোলো ।
তিনজনই একই সাথে সিগারেট ধরাল । জীবনটাও এমনই ।তিনজন একই আগুনে জ্বলছে । শুধু তিনজন না আরো অনেকে অনেকে । সিগারেটের এক একটি টান এক একটি দীর্ঘশ্বাস । তিনজনের সিগারেটের ধোঁয়াই একসাথে মিলে ঊড়ে যাচ্ছে আকাশের দিকে । তা উসমান ,মাহমুদ অথবা আলম কেও দেখেনি । আকাশ দেখেছে ।
আকাশ অনেক কিছুর সাক্ষী ।।