দেশে এখন গণতন্ত্র নাই! তাই, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য এখনই যা করতে হবে...
সাইয়িদ রফিকুল হক
দেশে এখন কারও-কারও মুখে খুবই হতাশার বাণী: “এভাবে কি দিন চলে? আর কতদিন এভাবে থাকবো? চারদিকে খুন-ধর্ষণ-রাহাজানি-রিজার্ভফান্ডলুট ইত্যাদি। না-না, এভাবে আর চলা যায় না। আরে ভাই, দেখতে পাচ্ছেন না চোখের সামনে দিনদুপুরে কত মানুষ খুন হচ্ছে! এখন মানুষের ব্যবসাবাণিজ্যও একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে! আরে ভাই, এভাবে কি চলে?”
আবার এদেরই কেউ-কেউ ভয়ানক উল্লাসসহকারে বলছে: “এখন দেশের বারোটা বেজে গেছে! দেশে ইসলামের উপর আঘাত! আলেমদের নামে মামলা দিয়ে তাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে! আবার তাদের কারও-কারও ফাঁসিও কার্যকর করা হয়েছে! দেশে এখন কোনো গণতন্ত্র নাই!”
এদিকে দেশের বিশিষ্ট রাষ্ট্রধ্বংসকারী-গবেষকগণ বিভিন্ন টক-টক-শোতে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করছে: “দেশে এখন কোনো গণতন্ত্র নাই। এমনকি গণতন্ত্রের কোনো আলামতও নাই।”
মসজিদের ভণ্ডইমাম বলছে: “মনে হয় আল্লাহপাক কিয়ামতের আগে দেশ থেইক্যা গণতন্ত্র একেবারে উঠাইয়া নিছে! আর এসবই আমাদের পাপের ফল! আর আমাদের সবচেয়ে বড় পাপ হলো দেশে এখনও ইসলামীহুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হয় নাই! এর চেয়ে বড় পাপ আর কী আছে?”
দেশে গণতন্ত্র নাই—সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখন একশ্রেণীর মানুষ শুধু তারস্বরে এই একই কথা প্রচার করছে। রেডিও-টেলিভিশন-পত্রপত্রিকাওয়ালারা কতরকমের ফিচার তৈরি করছে। আর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট করছে হাতেগোনা কয়েকটি প্রাইভেট-টিভিচ্যানেল। দেশের জন্য এদের দু’চোখে এখন ঘুম নাই!
দেশে একটি শ্রেণী এখন গণতন্ত্রউদ্ধারের জন্য আদাজল খেয়ে লড়ছে। এরা দেশের হারানো গণতন্ত্র ও হারানো সুদিন ফিরিয়ে আনার জন্য একেবারে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর তাদের ভাষায় দেশে যেহেতু এখন গণতন্ত্র নাই সেহেতু সেই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য এখনই যা করতে হবে তা অতিযত্নসহকারে নিচে তুলে ধরা হলো (গণতন্ত্রউদ্ধারকারীদের সতেরো-দফা):
১. “দেশের সমস্ত কারাগার থেকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী-গণহত্যাকারী-যুদ্ধাপরাধীদের এখনই মুক্তি দিতে হবে। আর তাদের নামে দায়ের করা মিথ্যামামলা এখনই বাতিল করতে হবে!” তবেই না দেশে একনিমিষে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে! বর্তমানে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য এটি এখন প্রথম ও পূর্বশর্ত।
২. “দেশে প্রতিষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ এখনই অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। এইটা হলো দেশের ভিতরে গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শত্রু।”
৩. “দেশে এখন থেকে আর কাউকে কোনোদিন-কখনও রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তিকমিটির যুদ্ধাপরাধী বলে গালি দেওয়া যাবে না। সবাইকে গণতন্ত্রের ভাষায় “ভাই” ভেবে সবসময় ‘ভাই-ভাই-সম্পর্কে’র ভিত্তিতে চলতে হবে।”
৪. “এখন থেকে ‘রাজাকার’ শব্দটিকে আর ঘৃণা করা যাবে না। বরং এটি কারও-কারও নামের আগে সম্মানে ব্যবহার করার সুযোগ দিতে হবে। আর জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে ‘রাজাকার’ শব্দটির সর্বস্তরে প্রচলন ঘটাতে হবে। আর দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মতো রাজাকারদেরও বিশেষ সম্মানীভাতা-রাষ্ট্রীয় ভাতা দিতে হবে। আর একাত্তরে নিহত রাজাকারদের ‘শহীদ’ হিসাবে অভিহিত করতে হবে। আর তাদের সম্মানে একটি স্মৃতিসৌধ বানাতে হবে।” তবেই না দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।
৫. “পাকিস্তান একটি ইসলামীরাষ্ট্র! আর তাই, ইসলামীরাষ্ট্র পাকিস্তানকে আর কখনও গালি দেওয়া যাবে না। পাকিস্তানকে গালি দেওয়া জায়েজ নাই!” এখন থেকে পাকিস্তানকে আর কেউ গালি দিবেন না। কারণ, পাকিস্তানকে গালি দিলে এই দেশে কিছুসংখ্যক গণতন্ত্রউদ্ধারকারীদের কলিজায় সরাসরি কঠিন আঘাত লাগে। আর বুকটা এক্কেবারে ফাইট্যা যায়!
৬. “বর্তমান সরকারকে সবসময় ‘বিরোধীদলের সরকারবিরোধী-নাশকতাসৃষ্টির’ সদয়সম্মতি দিতে হবে। আর দেশের নির্বাচিত-সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নামে যখন-তখন হরতাল ডাকার ও হরতাল ডেকে ঘরে বসে থাকার অধিকার দিতে হবে। আর দলের কিছুসংখ্যক ক্যাডারকে, ডাকাতকে আর সর্বোপরি লোকজনকে হরতালের সময় অবাধে গাড়ি-ভাংচুর করতে, গাড়িতে-গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করতে, আর যেকোনো যাত্রীবাহী-বাসে পেট্রোলবোমা মারার গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে হবে। এটি দেশে গণতন্ত্র-বাস্তবায়নের অন্যতম একটি পূর্বশর্ত!”
৭. “দেশের সংবিধানে এখনই আইন করতে হবে আর যেন কেউ কাউকে কখনও রাজাকার বলতে না পারে। এখন থেকে কাউকে রাজাকার বলে সম্বোধন করা যাবে না। এই দেশে কোনো রাজাকার নাই। আর এই দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নাই। আর যাদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘রাজাকার’ কিংবা ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলা হচ্ছে, তারা ইসলামীরাষ্ট্র-পাকিস্তানের সাচ্চা ঈমানদার-সৈনিক। আর এরা দেশের বিশিষ্ট ইসলামীচিন্তাবিদ! এরা না থাকলে দেশে ইসলাম থাকবে না।”
৮. “আগের মতো আবার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানাতে হবে। আর তাদের গাড়িতে সবসময় বাংলাদেশের ‘জাতীয় পতাকা’ উড়ানোর পারমিশন দিতে হবে। আর মনে রাখতে হবে: সবাইকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার নামই হলো গণতন্ত্র!”
৯. “ভোটচুরি করে হলেও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের আবার পার্লামেন্টে বসাতে হবে। আবার দেশের ‘দেইল্যা-রাজাকার-জাতীয়’ যোগ্য-রাজাকারদের এমপি বানিয়ে তাদের পার্লামেন্টে বসার সুযোগ করে দিতে হবে। আর এইজাতীয় ইসলামীচিন্তাবিদদের কখনও জেলে রাখা যাবে না।” তাহলে, এই দেশে ধীরে-ধীরে একসময় গণতন্ত্র আসবে!
১০. “একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার দেলোয়ার হোসেনকে ‘চাঁদে দেখার দিনটিকে’ সরকারি ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করতে হবে। আর এই দিনটিকে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘জাতীয় দিবস’ মনে করতে হবে।” আর এটি গণতন্ত্রপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম একটি পূর্বশর্ত!
১১. “জীবনে-মরণে সবসময় পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে হবে। পাকিস্তানই আমাদের একমাত্র ভরসা। আর পাকিস্তানই আমাদের হবে একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান।” বাংলাদেশে গণতন্ত্র চাইলে সবাইকে এগুলো সবসময় মাথায় রাখতে হবে।
১২. বাংলাদেশে গণতন্ত্রপ্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনোসময় যেকোনো ষড়যন্ত্র করাকে ‘জায়েজ’ বলে ঘোষণা করতে হবে। আর দেশের স্বার্থেই আমরা ইয়াহুদীরাষ্ট্র-ইসরাইলের দুর্ধর্ষ গোয়েন্দাসংস্থা ‘মোসাদে’র সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছি। আর এখনও তা অব্যাহত রয়েছে। দেশের গণতন্ত্রউদ্ধারের জন্য প্রয়োজনে আমাদের স্বয়ং ইবলিশ শয়তানের সঙ্গেও একাধিকবার প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বৈঠক করার সুযোগ দিতে হবে। এছাড়াও, আইএসআই তো সবসময় আমাদের পাশে বন্ধুরূপে রয়েছে!” এসব না মানলে দেশে কখনও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না।
১৩. “দেশের সংবিধান থেকে এখনই ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ শব্দটি মুছে ফেলতে হবে। তাহলে, দেশের ঈমানদার-মুসলমানরা আরও জোশের সঙ্গে বিধর্মীদের ঘরবাড়ি, টাকাপয়সা, সোনাদানা, জমিজিরাত ইত্যাদি লুটপাট করতে পারবে।” এভাবেই মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে! আর দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে!
১৪. “মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের মতো এখন থেকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানদেরও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তাহলে, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।”
১৫. “দেশে এ পর্যন্ত যে-সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, তার তদন্তভার পাকিস্তানের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।” তাহলে, দেশে গণতন্ত্র আছে বলে প্রতীয়মান হবে!
১৬. “দেশে যদি সত্যিকারের গণতন্ত্র চান তাহলে দক্ষিণ এশিয়া তথা এশিয়ার সব দেশকে বাদ দিয়ে শুধু পাকিস্তানের সঙ্গে রেল-যোগাযোগ-স্থাপন করতে হবে। তাহলে, গণতান্ত্রিক ইসলামীরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা খুব সহজে পাকিস্তান থেকে আর্জেস-গ্রেনেড, রকেট ল্যাঞ্চার, একে-৪৭সহ যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র অনায়াসে আমদানি করতে পারবো।” আজ গণতন্ত্রের স্বার্থেই এগুলো প্রয়োজন!
১৭. “সর্বশেষ দাবি হলো: পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে। তাহলে, বাংলাদেশে পাকিস্তানের আশীর্বাদে আবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে!”
দেশের রাষ্টধ্বংসকারী-বুদ্ধিজীবীগণ সবসময় ইনিয়েবিনিয়ে উপরিউক্ত (উপর্যুক্ত) দফাগুলো বাস্তবায়নের জন্য জোরপ্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের মহৎ-লক্ষ্য-উদ্দেশ্য একটাই: ইসরাইলের গোয়েন্দাসংস্থা ‘মোশাদে’র সহায়তায় দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্রের কাছে আর গণতন্ত্রের জন্য কালা-ধলা, লম্বা-বেঁটে, দেশী-বিদেশী কিংবা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-শয়তান-বদমাইশ বলে কোনোকিছু নাই। তাই, দেশের স্বার্থে বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রেমীরা-গণতন্ত্রউদ্ধারকারীরা এখন ইয়াহুদী-ইসরাইলের মোশাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ষড়যন্ত্র করতে কোনো দ্বিধা করছে না। আর আমাদের দেশের গণতন্ত্রউদ্ধারকারীরা এভাবে তাদের উপর্যুক্ত দফাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলেই এই ‘বাকশালী-সরকারের’ সময়েও দেশে একটুআধটু গণতন্ত্র এখনও আছে!
জয়-বাংলা।
পাকিস্তান মুরদাবাদ।
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১৬/০৫/২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৬ বিকাল ৪:১৯