মুক্তচিন্তা ভালো। তবে তা মহান আল্লাহ ও তাঁর পবিত্র রাসুলকে গালি দিয়ে নয়।
সাইয়িদ রফিকুল হক
আপনি একজন মুক্তচিন্তক। ভালো কথা। আপনি সবসময় মুক্তচিন্তা করবেন। এটিও খুব ভালো কথা। আর আপনি সারাজীবন মুক্তচিন্তা করুন। খুব ভালো কথা। আর আপনি মুক্তচিন্তা করতে-করতে একজন বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিক ও নন্দনতত্ত্বের শিল্পী হয়ে উঠুন। এতে দেশ ও জাতির মঙ্গল হবে। আপনি মুক্তচিন্তা করতে-করতে ভাবলেন: পৃথিবীতে কোনো ঈশ্বর নাই! তাই, আপনি নাস্তিক হয়ে যাবেন বা সরাসরি নাস্তিক হয়ে গেলেন। এটি আপনার ইচ্ছা। মহান স্রষ্টার পৃথিবীতে সবাই স্বাধীন। প্রত্যেকে তার কাজকর্ম স্বাধীনভাবে করার অধিকার রাখে। মহান ঈশ্বর কাউকে বন্দী করে রাখেননি। আপনি নিজের ইচ্ছায় নাস্তিক হয়ে গেছেন। এতে কার কী এমন আসে যায়?
আপনি নাস্তিক হয়েছেন। আপনার পক্ষে অনেক যুক্তি আছে। আর যারা হাজার-হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় আস্তিক হয়ে আছেন তাদের পক্ষেও তো জোরালো যুক্তি রয়েছে। আপনি যদি নাস্তিক হয়ে কাউকে তার ধর্মপালনে বাধার সৃষ্টি করেন—তাহলে, সমাজে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে। আর এতে সংঘাত অনিবার্য। আপনি নাস্তিক—আপনি বুদ্ধিমান। তাই, আপনাকে মানতে হবে: আপনার যেমন ঈশ্বর না-মানার অধিকার রয়েছে তেমনিভাবে অন্যেরও অধিকার রয়েছে ঈশ্বর মানার। আর আপনি যে সমাজে-রাষ্ট্রে অধিকার ভোগ করতে চাচ্ছেন সেখানে আপনার কর্তব্য হলো: অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ না করা। কেননা, অধিকার ও কর্তব্য একটি আরেকটির সঙ্গে জন্মলগ্ন থেকে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। আর কর্তব্যপালনকে বাদ দিয়ে অধিকার ভোগ করা যায় না।
সমাজে-রাষ্ট্রে আজ আপনি অধিকার চাচ্ছেন? এর অর্থ হলো: আপনি কারও অধিকার ক্ষুণ্ণ করবেন না, আর অন্যে আপনার অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে না। তাই, সমাজে-রাষ্ট্রে যে-কারও অধিকার ভোগ করতে হলে তাদের অবশ্যই কর্তব্য মেনে চলতে হবে।
পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ধর্ম আছে। আর তা বর্তমানের সকল গণ্ডী অতিক্রম করে ভবিষ্যতেও থাকবে। ধর্ম কখনও শেষ হওয়ার বিষয় নয়—আর এটি সবসময় ‘Never ending process।’ ধর্ম কখনও একজন সত্যিকারের নাস্তিকের টার্গেট হতে পারে না। তার অন্য ভাবনা আছে। আর তার ভাববার বিষয় আছে।
ধর্মবিষয়ে আঘাত করে কারও হৃদয়কে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত করা সমীচীন নয়। অহেতুক কারও হৃদয়ে আঘাত করে তা ছিন্নভিন্ন কিংবা ধারালো ব্লেড দিয়ে একেবারে কেটেকুটে ফালাফালা করা মোটেই উচিত নয়।
লেখার অনেক বিষয় আছে। তবে তা কারও হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে নয়। ধর্মের ভিতরে যত রকমের ভণ্ডামি আছে, আর ধর্মের ভিতরে যত রকমের ভণ্ড লুকিয়ে আছে—এদের বিরুদ্ধে সবসময় লেখা উচিত। আর আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে: কখনওই মহান আল্লাহ ও তাঁর পবিত্র রাসুল (সা.)-কে গালি দিয়ে সাহিত্য হয় না। সাহিত্য মহৎ-বিষয়—আর অন্যকিছু।
মুক্তচিন্তা মানে চিন্তার ক্ষেত্রে মুক্তি বা স্বাধীন বা উন্মুক্ত বা সর্বপ্রকার কুসংস্কারমুক্ত হয়ে নিজের ধারণা ব্যক্ত করা। আর এই মুক্তচিন্তার ভিতরে অবশ্যই রাষ্ট্রের আইনকানুন রয়েছে। আপনি যদি এগুলোকে কুসংস্কার মনে করেন—তাহলে তো চলবে না। কারণ, সমাজে-রাষ্ট্রে অনেক মানুষের কাছে এর বিরাট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। মানুষ আইনকানুন মানতে অভ্যস্ত। আপনার একটি কথায় সমাজের বা রাষ্ট্রের সব মানুষ একনিমিষে নাস্তিক হয়ে যাবে না। আবার পৃথিবীর সব মানুষই কখনও আস্তিক হবে না। পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত আস্তিক ও নাস্তিক দুইটি সত্তা বিরাজমান। আগে তো কখনও নাস্তিক ও আস্তিকের মধ্যে সংঘাতসৃষ্টি হয়নি। বরং যারা আগে নাস্তিক ছিলেন বা এখনও সত্যিকারের নাস্তিক রয়েছেন তারা কখনও কারও ধর্মকে কটাক্ষ করেন না কিংবা ঈশ্বর বা তাঁর প্রেরিত নবী-রাসুলদের বা কোনো ধর্মের অবতারকে গালি দেন না। তারা যথার্থ নাস্তিক। তারা সমাজ-রাষ্ট্রের সভ্য-নাগরিক।
আর আপনি হঠাৎ করে একদিনে নাস্তিক হয়ে তার পরদিন থেকে মহান আল্লাহ ও তাঁর পবিত্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালি দিতে শুরু করলেন! এটি কোন মানসিকতা? আপনি ধর্মের ভিতরে প্রচলিত নানারকম গরমিলের সমালোচনা করতে পারেন। আপনি ধর্মকেন্দ্রিক ভণ্ডদের বিরুদ্ধে লড়াই করুন। আর তা না করে আপনি সরাসরি মহান আল্লাহ ও তাঁর পবিত্র রাসুলদের গালি দিতে আরম্ভ করে আর তাকেই জীবনের একমাত্র আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করলেন! আসলে, আমাদের সমাজে-রাষ্ট্রে যারা সত্যিকারের নাস্তিক তারা কোনো সমস্য নয়—সমস্যা হচ্ছে: যারা আজকাল কোনোকিছু না বুঝে হুজুগে নব্যনাস্তিক হচ্ছে তারা। আর এই ভূঁইফোঁড় নব্যনাস্তিকরাই এখন নাস্তিক্যবাদের ধারণা পাল্টে দিতে আর তাদের জনপ্রিয়তাসৃষ্টির কাজে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে বেছে নিয়েছে। কিন্তু কেন? কারণ, এরা কেউই আসল নাস্তিক নয়। এরা নিজেদের স্বার্থে ও সুবিধার্থে সমাজে-রাষ্ট্রে নাস্তিক হয়েছে।
আপনি একজন নাস্তিক হয়ে প্রকাশ্যে বলতে পারেন: “আমি এই পৃথিবীতে কোনো স্রষ্টা বা ঈশ্বর মানি না। আর কোনোদিন তা মানবো না।” এতে কারও কোনো আপত্তি নাই। কোনো মুসলমানই আপনাকে আক্রমণ করতে পারবে না। কারণ, মহান আল্লাহ তার অস্বীকারকারীদের হত্যার আদেশ দেননি। কিন্তু আপনি যখন কারও ঈশ্বর বা আল্লাহকে বা তাঁর রাসুলকে বা কোনো অবতারকে গালি দিবেন, তখন তো আপনি অন্যের অধিকার স্বীকার করলেন না। আবারও বলছি: আপনার অধিকার আছে নাস্তিক হওয়ার। আর অন্যের অধিকার রয়েছে আস্তিক হওয়ার। আর তাই, সবসময় মনে রাখুন: নিজের অধিকার ভোগ করতে চাইলে আপনাকে অন্যের প্রতি কর্তব্যপালন করতে হবে অন্যের অধিকাররক্ষায়। তাহলে, আপনার অধিকারে আর কেউ হস্তক্ষেপ করার সাহস পাবে না।
আমি প্রার্থনা করি: আপনি অনেক বড় মুক্তচিন্তাবিদ হন। আর আপনি চিন্তা করতে-করতে সবসময় চিন্তাসাগরে ভাসতে থাকুন। আপনি হয়ে উঠুন সমাজ-রাষ্ট্রের প্রভাবশালী এক গবেষক কিংবা চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব। কিন্ত দোহাই লাগে: আপনি কোনো ধর্মকে কিংবা মহান আল্লাহ ও তাঁর পবিত্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কখনও আক্রমণ করবেন না কিংবা তাঁদের গালি দিবেন না। আর সবসময় মনে রাখুন: নিজের অধিকার ও কর্তব্যের প্রতি। এতে আমাদের সমাজ হয়ে উঠবে সহনশীলতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
বি.দ্র. যারা নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে ব্লগারদের ‘নাস্তিক’ অপবাদ দিয়ে হত্যা করছে, তারা মূঢ় ও বিভ্রান্ত। পবিত্র ধর্ম ইসলামে কোনো সন্ত্রাস, নাশকতা ও বাড়াবাড়ি নাই।
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২৫/০৪/২০১৬