যাহারা মীর মশাররফ হোসেনের 'বিষাদসিন্ধু' বা এইধরনের গ্রন্থাবলী পাঠ ও লোকমুখে শুনা ইতিহাস শ্রবণে আবেগ প্রবণ হয়ে মহরমের আশুরাকে ইমাম হুসাইনের ইতিহাসে সীমাবদ্ধ রাখতে চান তাহাদের জানা উচিৎ এগুলো উপন্যাস বৈ কিছুই নহে। এইরূপ অনেক পুস্তক রহিয়াছে, যেই পুস্তকাবলীর লেখকবৃন্দের উদ্দেশ্য নিজেদের কল্পনাকে লিখনির বাজারে প্রকাশ করা। দয়া করিয়া, এইসমস্ত পুস্তক পড়িয়া আজকের মাতমানুষ্ঠানে কেহ আসিবেন না।
উপরে একটু ব্যঙ্গাত্মক ভাবে বললাম। আসুন, এখন সহজে এ বিষয়ে আপনাদের সাথে আলোচনা করা যাক। আরবি ১২টি মাসের মধ্যে চারটি মাস বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে। ওই চারটি মাস সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, এক বছরে ১২ মাস। এর মধ্যে চার মাস বিশেষ তাৎপর্যের অধিকারী। এর মধ্যে তিন মাস ধারাবাহিকভাবে জিলক্বাদ, জিলহজ ও মহররম এবং চতুর্থ মাস মুজর গোত্রের রজব মাস। (বুখারি-৪৬৬২, মুসলিম-১৬৭৯)।
মহররম মাস সম্মানিত হওয়ার মধ্যে বিশেষ একটি কারণ হচ্ছে- আশুরা (মহররমের ১০ তারিখ)। এ পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ও হৃদয়বিদারক কাহিনী। এখানে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো। আশুরার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে- হজরত মুসা (আ.)-এর ফিরআউনের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি লাভ। এই দিনে মহান আল্লাহ তায়ালা চিরকালের জন্য লোহিত সাগরে ডুবিয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন ভ্রান্ত খোদার দাবিদার ফিরআউন ও তার বিশাল বাহিনী।
অনেকে মনে করেন, ফিরআউন নীলনদে ডুবেছিল। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী এই ধারণা ভুল। বরং তাকে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দেওয়া হয়। এ ঘটনা ইমাম বুখারি তাঁর কিতাবে এভাবে বর্ণনা করেন- 'হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.) যখন হিজরত করে মদিনা পৌঁছেন, তখন তিনি দেখলেন যে মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিনে রোজা পালন করছে।
তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, আশুরার দিনে তোমরা রোজা রেখেছ কেন? তারা উত্তর দিল, এই দিনটি অনেক বড়। এই পবিত্র দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন আর ফিরআউন ও তার বাহিনী কিবতি সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হজরত মুসা (আ.) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। তাদের উত্তর শুনে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, হজরত মুসা (আ.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি নিজে আশুরার রোজাসহ আরো একটি রোজা অর্থাৎ দু'টি রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। (বুখারি-৩৩৯৭, মুসলিম-১১৩৯)
উপরের আলোচনা থেকে বুঝা গেল, আশুরার ইতিহাস ইমাম হুসাইনের সাথে সম্পর্কিত নয়। আর এই দিনে জারি মর্সিয়া পালনের মধ্যে কোন তাৎপর্য নেই! বস্তুত মাতমানুষ্ঠান নয়, সিয়াম সাধনাই আশুরার প্রকৃত বিধান।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:৫৬