(একজন বোনের থেকে পাওয়া ম্যাসেজ..)
মুসলিম আইনে স্ত্রীর ‘শ্বশুরবাড়ি’ নামক বাসস্থান বা এই শ্বশুরবাড়ি সংশ্লিষ্ট দায়-দায়িত্বের কোনই অস্তিত্ব নাই। এই ‘শ্বশুরবাড়ি কালচার’ আমাদের নিজস্ব আবিষ্কার।
বিয়ের পর স্ত্রীর ভরণপোষণ স্বামীর আইনি একইসাথে নৈতিক কর্তব্য। ভরণপোষণ বলতে শুধু খাদ্য, আর পোষাক বোঝায় না, ‘পৃথক বাসস্থান’ এবং বিশ্রামের সুযোগ ও অন্তর্ভূক্ত। বিয়ের পর স্ত্রীর জন্য পৃথক বাসস্থানের ব্যবস্থা করা স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক বা ফরয। এই বাসস্থানের অবশ্যই তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে:
১/ বাসস্থানটি স্ত্রীর জন্য নিরাপদ হতে হবে
২/বাসস্থানে স্ত্রীর নিজস্বতা বা Privacy বজায় থাকতে হবে।
৩/ বাসস্থান এমন হতে হবে যেখানে স্ত্রী স্বচ্ছন্দবোধ করবে।
'
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-
“তোমরা সামর্থ্যানুযায়ী নিজেরা যেরূপ গৃহে বাস কর, স্ত্রীদের বসবাসের জন্যও তদ্রুপ গৃহের ব্যবস্থা করে দাও। তাদের কষ্ট দিয়ে জীবন সংকটাপন্ন কর না।”
[সূরা তালাক, আয়াত- ৬]
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, স্ত্রীর জন্য স্বামীকে পৃথক বাসস্থানের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, শ্বশুরবাড়িতে বন্দোবস্ত করতে বলা হয় নি।
কুয়েত থেকে প্রকাশিত “আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়া (ফিকহী বিশ্বকোষ)” তে এসেছে- স্ত্রীর সাথে একই ঘরে পিতামাতা (বা অন্য কোন আত্মীয়) কে বসবাস করতে দেয়া জায়েয নয়। তাই স্বামীর কোন আত্মীয়ের সাথে একত্রে বসবাস করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করার অধিকার স্ত্রীর রয়েছে। আলাদা বাসাতে থাকলে স্ত্রী তার ইজ্জত, সম্পদ, নিজস্বতা (privacy) ও অন্যান্য অধিকার উপভোগ করার পূর্ণ নিশ্চয়তা পেতে পারে। সুতরাং এ অধিকার পরিত্যাগে তাকে বাধ্য করার সাধ্য কারো নেই। হানাফি, শাফেয়ি, হাম্বলি মাযহাবসহ অধিকাংশ ফিকাহবিদগণের অভিমত এটি।
'
যৌথ পরিবার ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করে- এমন বিধান ইসলামে কোথাও নাই। বরং বিপরীত ব্যবস্থার নির্দেশনা এসেছে। স্বামীর আত্মীয়দের সাথে একই ঘর বা ফ্ল্যাটে বসবাসের ফলে ইসলামের ফরজ কর্তব্য লংঘিত হওয়ার আশংকা তৈরি হয়। এমন ব্যবস্থা ইসলাম কিভাবে সমর্থন করতে পারে?
'
অবশ্যই পিতা-মাতার দেখাশোনা করা, তাদের ভরণপোষণ করাকে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে- সন্তানের জন্য বাধ্যকরী করেছে। কিন্তু এই দায়িত্ব শুধুই সন্তানের উপর; স্ত্রীর উপরে নয়। সেই দায়িত্ব পালনে স্ত্রীসহ মা-বাবার সাথে এক বাসায় বসবাস করতে হবে- এমন নয়। কাছাকাছি বাড়িতে থেকেও এই দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করা সম্ভব এবং সেটিই করা উচিত। স্ত্রী স্বেচ্ছায়, সাগ্রহে স্বামীর আত্মীয়দের সাথে এক বাড়িতে থাকতে সম্মত হলে সেটি ভিন্ন কথা। এর ফলে স্ত্রী তাঁর ‘Separate Residence’ এর অধিকার ত্যাগ করে বটে কিন্তু তাতে তাঁর অধিকার স্থায়ীভাবে ‘forfeited’ বা বাতিল বলে গণ্য হবে না- পরবর্তীতে যে কোন সময় স্ত্রী এই অধিকার দাবি করার অধিকারী।
'
একজন স্ত্রী শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের দেখা-শোনা করতে আইনত বাধ্য নন। তাই একজন স্বামী স্ত্রী কে শ্বশুরবাড়ি তে আত্মীয়দের সাথে বসবাস করতে কিংবা শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের (হোক উনি স্বামীর মা-বাবা, ভাই/বোন) সেবা করতে বাধ্য করতে পারে না। স্ত্রীর ‘শরয়ী’ দায়িত্ব ও ‘নৈতিক’ দায়িত্ব ভিন্ন- গুলিয়ে ফেলা অনুচিত। শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গে একত্রে বসবাস স্ত্রীর জন্য ফরজ নয়। এমনকি সুন্নাত বা মুস্তাহাব পর্যন্ত নয়। এটি ‘মুবাহ’ মাত্র। ‘মুবাহ’ হচ্ছে সেই কাজ সমূহ যা করতে ইসলাম কোন নির্দেশ দেয়নি, চুপ থেকেছে। কোন স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় স্বামীর মা-বাবা ও আত্মীয়দের সাথে একত্রবাস ও সেবা-যত্ন করে সেটি স্ত্রীর ‘দয়া’ বা ‘ইহসান’ মাত্র- দায়িত্ব নয়, এই কাজে স্ত্রী ‘সওয়াব’ পাবেন, এটি পালন না করলে বা পালনে অস্বীকার করে শ্বশুরবাড়ির লোকদের থেকে আলাদা থাকতে চাইলে তাতে তাঁর গুনাহ হবেনা, অপরাধ বা বেআইনি তো নয়ই।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পারিবারিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তিনি তাঁর স্ত্রী বা আমাদের ‘উম্মুল মুমিনীন’দের প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা বাসস্থান নির্মাণ করেছিলেন এবং প্রত্যেকে তাঁর নিজ নিজ গৃহে কর্তৃত্ব বজায় রেখে নিজস্বতা ও স্বাছন্দ্য নিশ্চিত করেছেন। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার দোহাই দিয়ে শ্বশুরবাড়ি নামক যৌথ পরিবার গঠন করে স্ত্রীদের পৃথক বাসস্থানের স্বাচ্ছন্দ্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ করেন নাই।
বাংলাদেশের ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন,২০১৩’ তেও পিতা-মাতার ভরণপোষণ ও দেখাশোনার আইনি দায়িত্ব সন্তানের উপর অর্পণ করা হয়েছে- পুত্রবধূদের উপরে অর্পণ করা হয়নি। তাই পুত্রবধূ কর্তৃক শ্বশুরশাশুড়ির ভরণপোষণ ও খেদমত করার আইনি কোন বাধ্যবাধকতা নাই। তবে এই আইনের ধারা- ৫(২) অনুযায়ী কোন স্ত্রী/স্বামী অপরপক্ষের পিতা-মাতার ভরণপোষণে বাধা-প্রদান করলে সেটি দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
তাই, ভারতের আদালতের রায় শুনেই বগলদাবিয়ে ফেসবুকে ফূর্তি প্রকাশ না করে স্ত্রীর জন্য পৃথক বাসস্থান ও ভরণপোষণের আইনি ও ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করুন। তা করতে অসমর্থ হলে নিদেনপক্ষে ‘শ্বশুরবাড়ি’ তে আপনার মা-বাবা-ভাই-বোন-আত্মীয় স্বজনের সাথে একত্রে বসবাসে সম্মত হওয়া ও প্রতিদিন তাদের খেদমতে নিয়োজিত আপনার দয়ালু স্ত্রীর প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন।
সুখে থাকুন। ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:১৪