শাহবাগ। বেশ অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম, বাস আসছিলো না। শীত পড়ছিলো গতকালের প্রায় দেড়গুণ। ল্যাম্পোস্টর নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম আরো জনাবিশেক মানুষের সঙ্গে। অনেক বাস সবেগে চলে যাচ্ছিল, থামছিল না, তবে তাদের একটিও মিরপুরগামী নয়, উত্তরা বা এসব দিকের। মিরপুরের বাস নাকি সব মিন্টো রোড ধরে যাচ্ছে। তা যাক, বাস ধরার জন্য মৎস ভবন পর্যন্ত হাঁটার কোন আগ্রহ দেখালাম না। কিছুক্ষণ বাদেই তার ফল পেলাম, একটা ভাঙাচোরা মিনিবাস এসে থামলো। গায়ে লেখা ইটিসি, কোনভাবে পড়া যাচ্ছে বটে, কিন্তু কোথাও কোন রং বলতে গেলে নেই, উঠে গেছে। দরজাটা ভাঙা, একপাশে ঝুলছে। আর সে দরজা ধরে ঝুলছে শীর্ণকায়া হেলপার। আধখাওয়া মাংসল যন্ত্রটা কাছে এসে থামতেই সবাই পিরানহার মত ছেঁকে ধরল, ঝপাঝপ উঠে পড়লো। ভাগ্যগুণে ছিলাম সবার সামনে, তাই জনস্রোতের ভাল একটা বল ও তার ঘাত অনুভব করলাম, বাসের একেবারে পেছনে পাঠিয়ে দিলো। হলুদ আলো। সিটগুলো ভেঙে কোনটা সামনে হেলে পড়েছে. কোনটা পেছনে পড়েছে ঝুলে। সিট কভার নোংরা, ছেঁড়া, ভেতরের ফোম মগজের মত বেরিয়ে আছে। বসার সিট-পিসগুলো সিটের ফ্রেমের চেয়ে ছোট, কাঁটার মত কাঠামো বেরিয়ে আছে। পায়ের নিচে নড়বড়ে রূপালি মেঝে, শরীরের ভর বদলের সাথে সাথে মেঝেও ওঠানামা করে। সব মিলিয়ে বোঝা গেল, এটাকে যে পোড়ানো হতে পারে সে ব্যাপারে বাস কর্তৃপক্ষের টনটনে জ্ঞান রয়েছে। বাসের বয়স অন্তত কুড়ি বছর, দাম বহু আগেই উঠে গেছে, পুড়ে গেলে কোন অসুবিধে নেই, ভাবটা এমন। যাহোক, পেছনের সিটে দেখি এক যুবক বসে আছে, মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক। অসম্ভব আঁটো তার টিশার্ট, জিন্সের প্যান্টও তাই, চোখে মুখে একটা সতর্কতার ছাপ। পেশি টানটান হয়ে আছে ডিসকোবোলাসের মত। আমার দিকে তাকালো এবং চোখে একটা অপ্রস্তুতভাব খেলে গেল, চোখ এড়ালো না। আমি হাবাগোবা এবং গোঁয়ার টাইপ মানুষ, যে কারণে কেউ যা তা বুঝিয়ে যেতে পারে, এবং একবার কোন এক ব্যাপার মাথায় ঢুকে গেলে আর বেরোয় না সহজে। সেই ছেলে তার চোখেমুখের ত্রস্ততা, অস্থিরতা দিয়ে আমাকে কিছু বোঝাতে চাইলো, আমি তার কিছুটা বুঝলাম কিছুটা বুঝলাম না; কিন্তু সে আমার চোখে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো যখন, তখন আমার মাথায় একটা কথা ঢুকে গেল, যেটা আর তাড়ানো গেল না। মনে হল, এ ব্যাটা তো তক্কে তক্কে আছে! পত্রিকায় পড়েছি, বাসের ভেতর থেকে আগুন দেয়া হলে আগুনদাতা নাকি সবচেয়ে পেছনের সিটে, জানালার পাশে বসে। এর স্থানাঙ্ক তো সব মিলে গেছে! এবার? আমি তার দিকে ঠায় তাকিয়ে রইলাম। সে নড়ে চড়ে বসল। মনে হল তার অণ্ডকোষের কাছে একটু কিছু লুকিয়ে রেখেছে সে, আমার ভুলও হতে পারে। সেখানে হাত দিয়ে একটু মুচড়ে আবার আমার দিকে তাকালো। মুখের সার্জিক্যাল মাস্ক একটু ফুলছে, আবার চুপসে যাচ্ছে, হয়ত তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। তুমি তো গভীর জলের আরশোলা হে যুবক! তোমাকে তো ছাড়া যাবে না! চোখে চোখে তাকিয়ে রইলাম, সে চোখ সরিয়ে নিল, মাস্ক সরালো না। একবার ভাবলাম, জিজ্ঞেস করি,
কী ভাই, মুখোশ পরে আছেন কেন, এলার্জি? নাকি মানুষ চিনে ফেলবে!
পরে ভাবলাম, থাক, এক্সট্রিমিস্ট হয়ে উঠতে পারে। কারণ আহত-ভীত এবং ক্ষুধার্ত মাংসাশী জীব সবচেয়ে ভয়ানক। বাস এদিকে চলেছে সবেগে, এত বেগে যে পারলে নিজের হেডলাইটের আলোকে ছাড়িয়ে যায়। আগারগাঁও পেরোলে পাশের লোক উঠে যাওয়া মাত্র আমি যুবকের পাশে বসে পড়লাম। গত আধমাস ধরে ব্যবহার করা আধোয়া চাদর ভালই গন্ধ ছড়াচ্ছিল, আমি বাতাসে চাদর নেড়েচেড়ে ব্যাটাকে গন্ধ খাওয়ালাম। শ্যাওড়াপাড়া আসতেই সে উসখুস করতে লাগলো, আমি বললাম, কী ভাই, নামবেন? সে কিছু বলল না, নিরবে হাঁটু দিয়ে আমার পা ঠেলতে লাগলো, নামতে চায়। আমি নামতে সুযোগ দিলাম, তথাপি তার দিকে কড়া নজর রাখলাম, তাকিয়ে থাকলাম তার অণ্ডকোষ যেখানে থাকতে পারে সেখানে, যদিও আমার সেদিকে তাকিয়ে থাকার কোন ইচ্ছে ছিল না। আমার চোখ তাকে আগাগোড়া মেপে মেপে যাচ্ছিল। বাসের মাঝামাঝি পৌঁছে ফিরে আমার দিকে তাকালো যুবক, একদম চোখে চোখ পড়ে গেল। তারপর মুখ ফিরিয়ে দ্রুত নেমে গেল বাস থেকে। খুব সম্ভব, মিশন অসম্পন্ন রেখেই নামলো সে, কেউ জানতেও পারলো না।