কোথাও অন্ধকার এক সুড়ঙ্গ দিয়ে একটি উন্মাদ লোক ছুটে চলেছে। হাতে একটি কাচের বোতল, বোতলে জল, জলে সবুজ ডাঁটা ডুবিয়ে রাখা একটি লাল গোলাপ ফুল। সুড়ঙ্গটির মেঝে অসমান, রুক্ষ- ছোটবড় গ্রানাইটের টুকরো আর হঠাৎ সৃষ্ট চোখের কোটরের মত গর্তে পূর্ণ ।
উন্মাদ লোকটি তবুও দুরন্ত বেগে ছুটে যাচ্ছে। গ্রানাইটের পাথরগুলোর সংঘর্ষে তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ উপড়ে এলো, রক্ত বেরুচ্ছে। গর্তে পড়ে তার বাঁ পা-ও মচকে গেলো। কাচের বোতল থেকে জল ছলকে পড়ে গেছে অনেকখানি। গোলাপের সবুজ ডাঁটার শেষপ্রান্ত জলে ডুবে আছে কোনভাবে। উন্মাদ লোকটি দাঁত বের হাসছে।
সুড়ঙ্গটা নিকষ অন্ধকার, নীরব মহাকাল ছাড়া কোন দর্শক নেই। লোকটার হাসি, রক্তের ফোঁটা, গোলাপ, কাচের বোতল, বাড়ন্ত জল- কিছুই দেখার নেই কেউ।
উন্মাদ হঠাৎই এ সুড়ঙ্গে এসে পড়েছে, তার আর কোন পূর্ব স্মৃতি নেই। যেহেতু সে শ্বাস নিতে পারছে, সেহেতু ভেবে নিলো, নিশ্চয়ই কোন বাতাস আসার প্রশস্ত পথ আছে। সে ছুটতেই থাকলো। হঠাৎ পাথরে পা লেগে প্রথমবারের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো সরু সুড়ঙ্গের মেঝেতে। গ্রানাইটের দেয়ালে মাথা ঠুকে গেলো, রক্তে ভিজে উঠলো কপাল আর চুলের গোড়া। খানিক বাদেই এক জলভরা গর্তে পড়ে উপুড় হয়ে পড়লো আবার। এবার নট্ করে তার নাকের তরুণাস্থি ভেঙে গেলো, ভিজে উঠলো কালো দাড়িগোঁফ, হাসতে হাসতে বেরিয়ে পড়া দাঁতের ওপরের পাটিতে ছড়িয়ে গেল রক্ত। লোকটা তবুও ছুটতে থাকলো।
বহুক্ষণ পর হঠাৎ দূরে আলো দেখতে পেলো। মনে হলো যেন আলোর পর্দার ওপাশে সবুজাভ জলছায়া। লোকটা হেলতে দুলতে ছুটতে ছুটতে ভাঙতে ভাঙতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চললো সেদিকে।
সুড়ঙ্গ শেষ। দেখা গেলো এটা আসলে বিশাল এক কুয়োর মতো মস্ত গহ্বর। খোলা মুখ থেকে কিছু দূরে, ভূমি থেকে ওপরে উঠে গেছে মাটির দেয়াল, দেয়ালের চুড়ো থেকে শুরু হয়ে ক্রমশ সামনে এগিয়ে গেছে উজ্জ্বল অরণ্য, সুড়ঙ্গের মুখে দাঁড়িয়ে বোঝা যায়, দেখা যায় সামান্যই। কিন্তু চোখের সামনে যা স্পষ্ট, তা হলো মাটির দেয়াল ফুঁড়ে ভৌতিক হাতের মত বেরিয়ে থাকা অসংখ্য বৃক্ষের শেকড় কংকাল। কেউ যদি চায়, হাঁচড়ে পাঁচড়ে ওপরে উঠে যেতে পারবে।
লোকটা হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে, কাচের বোতলে ফাটল ধরেছে। কিন্তু গোলাপটা এখনও খুব তাজা, রোদ পড়া নতুন লাল মখমলের মত লাগছে ওটাকে।
খোলা বাতাসে একবার শ্বাস নিয়ে, লোকটা ঘুরে আবার সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে দৌড়োতে শুরু করলো। আর কেউ হলে, পথ পেলেই মুক্তি নিতো প্রথম, ভাবতো- যথেষ্ট হয়েছে। আর এমনটা করলো না বলেই সে উন্মাদ। কোথাও রক্ত দেখার কেউ নেই, কোথাও সৌন্দর্য দেখার জন্যে কেউ ছিল না। তারপরও তার পণ, গোলাপের পাপড়ি অক্ষত আছে যতক্ষণ, ততক্ষণ সে দৌড়োবে সুড়ঙ্গ পথে।
১ কোটি, ১২ লাখ, ৩৫ হাজার, ৮১৩ বার সে সুড়ঙ্গ থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে পেলো। কিন্তু বেরিয়ে যেতে পারলো না। কারণ তখনও গোলাপ অক্ষত, নতুন পরিণতিশূন্য। কাচের বোতলটা ভেঙে গিয়েছিল, গোলাপটাকে সে হাতেই ধরে রেখেছিল।
ফুলটা যে মূলত তার হাত থেকেই পুষ্টি নিয়ে বেঁচে ছিল, তা বুঝতে সে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সময় নিলো। অতঃপর অনুভব করলো, পাপড়ির পরিণতি সে দেখে যেতে পারবে না, কারণ তা ঘটবে তার মৃত্যুর পর।
অন্ধকার গ্রানাইটের সুড়ঙ্গে উন্মাদ লোকটা মরে গেলে তার শরীর তাজা সোনালু গাছের ছোট ৯টি পাতাসহ ৮টি শাখার একটি ডাল হয়ে গেল। আর তার অগ্রে, সেই লাল গোলাপ ফুটে থাকলো আরও ১ হাজার ৯শ’ ৮৭ বছর।
১. ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১:১০ ০