সরকারের টিএন্ডটি বিভাগে মাঠপর্যায়ে সংযোগপ্রদান আর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতাম আমি যা কখনও করব বলে ভাবিনি। আমাকে বড় বেশী উচ্চাকাঙ্ক্ষী বানাতে গিয়ে, বাবা আমার মস্ত বড় ক্ষতি করে গিয়েছিলেন। বাকি জীবনে কোনদিন সন্তুষ্ট হতে পারিনি আমি। অনেকের জন্যে এটাই হয়ত বেশ বড় প্রেরণা। কিন্তু, সাধ্যের সর্বোচ্চ স্বল্পতা সম্পন্ন ভাগ্যবিড়ম্বিত অসন্তোষ, সবরকম প্রেরণার পথে ভীষণ রকম বিষাক্ত একটি কাঁটা! কিংবা কে জানে, এ হয়ত নিছক আত্মপক্ষ সমর্থন। আমি তো জানতাম, প্রতিটি মানুষের সৎশ্রমের ঘাম জ্বালানী হলে তবেই সভ্যতার রথ গড়ায় ভুঁয়ে। এখানে ব্যাক্তিগত উৎকর্ষ নয়, বরং সমষ্টিগত উৎকর্ষই মূলকথা। কিন্তু আমার কাজটাকে ভালবাসার জন্যে সে জানাটুকু যেন যথেষ্ট ছিল না। আমি শেষতক ঘৃণা করেছি তাকে। সন্ধ্যে হলে অপ্রিয় লোকালয়ে; যদিওবা প্রিয় বাসস্থানে, এসেছি ফিরে। বাড়ি ফিরে ক্লান্তি দূর করবার জন্যে একগ্লাস ঠাণ্ডা শরবত বা এককাপ চা এর সামান্য চাহিদাটুকুও যখন বিলাসিতা, এবং অপেক্ষাকৃত জীবনঘনিষ্ট বহু উপকরণ যোগানের পথে বাধা, তখন তাকে দিইনি প্রশ্রয়। রান্নাঘরের ভাঁড়ারে চা বা চিনির অভাবটুকু তাই বেশ আদর করে পুষেছি আমি আর নাহার।
একদিনের কথা। ছ’ মাস ট্রেনিঙের পর, নাহারের টিএন্ডটি হাসপাতালে নার্সের কাজ পেয়ে যাওয়াটা হঠাৎ করেই অনেকখানি এগিয়ে দিল আমাদের। প্রথম মাসের বেতন পাবার পর, কফির পাঁচশ গ্রামের এক ‘বিপুলায়তন’ ধারক কিনে নিয়ে এল সে আমার জন্যে। বছর না যেতেই কলোনির ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেল। স্বপ্নের মত; এক প্রিয় ছায়া মিলে গেল মাথার ওপর। নিচতলার ফ্ল্যাট। তাই সিঁড়ি বাইতে হত না। এটা ছিল আমার জন্যে বিশেষ স্বস্তির কারণ। সামনে পেছনে বিশালাকার খেলার মাঠ। বিকেলের মানবশিশু ঘটিত খেলাধুলো আর দাপাদাপির অংশটুকু, সারারাতের বাতাসের দৌড়ঝাঁপের কাছে নস্যি। দিন কেটে যেতে লাগল চমৎকার। কথায় বলে, ‘যায় দিন ভাল, আসে দিন খারাপ’। মনে হল, এ ঘোর মিছে কথা। যায় দিন ভাল, আসে দিন আরও ভাল!
আমাদের ছোট্ট ছেলেটা বড় হতে লাগলো। একদিন কারও বাসা থেকে এসে জিদ ধরল, একটা কার্টুন দেখার ‘মেশিন’ তার না হলেই নয়। এ ব্যাপারটা একদমই গড়পড়তা। শরীরের ক্ষুৎপিপাসাচিন্তা এখনও যাদের স্পর্শ করেনি, মনের তৃষ্ণাজলের অভাব তাদেরই প্রকট। নাহারকে বললাম, ‘শুনেছ!’ সে হাসল আর আকাশজোড়া বিশ্বাসের জোলো মেঘ ছড়িয়ে দিল। আমি তাতে নাঈলাম। পরদিন ফেরার পথে নীলক্ষেতে গিয়ে কিছু কমিক বই কিনে ফেললাম। আধছেঁড়া, পুরনো এবং মলিন। টাকাটা পুষিয়ে নিতে সেখান থেকে কলোনি অবধি হেঁটে এলাম। তিন ঘণ্টা লেগেছিল মোটে। সে রাতে, ছেলেটা আধছেঁড়া কার্টুন ছবি আঁকা বইগুলো বুকে নিয়ে ঘুমোলো। কেউ যেন একটা সরু ধাতব সূচ গেঁথে দিল আমার নাকের নরম হাড়ে। চোখের জলগুলো গড়িয়ে পড়তে দিইনি তবুও। আমার আর নাহারের মাঝখানে দিব্যি ঘুমোতে লাগলো আমাদের ভালবাসার ফুল। হঠাৎ বললাম, ‘নাহার, তুমি সমুদ্র দেখেছ?’ সে বলল, ‘না’। বললাম, ‘দেখতে ইচ্ছে করেনা?’ সে ফের বলল, ‘না’। আমি বললাম, ‘আমারও না’। নাহার বলল, ‘জিজ্ঞেস করলে যে তবে?’ বললাম, ‘এমনি। আজ হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, আমরা দুজনাই দক্ষিণ দিকের মানুষ, অথচ সমুদ্র দেখিনি কোনদিন। মানুষ কি বলবে? হা হা হা!’ আবছা আলোছায়ায় দেখলাম হাসছে নাহার। খানিক বাদে আবার বললাম, ‘আচ্ছা, এই যে সবাই বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমায় যায়, আমাদের তো যাওয়া হল না আজও’। সে বলল, ‘তুমি হঠাৎ এসব কি বলছ? এসো, তোমাকে মধুচন্দ্রিমা দেখাই। দেখ, নিমগাছটার ডালে ঝুলে আছে একটা শুভ্র রাকা! আর তাতে কি সুন্দর এক ছবি আঁকা! দেখতে পাচ্ছ?’
আমি পেছন ফিরে চাঁদটার দিকে তাকালাম। বললাম, ‘তাইতো!’
নাহার বলে গেল, ‘ছবিটা এমন, যেন একটা শিশুকে কোলে নিয়ে বসে আছে এক মা! ঝুঁকে তাকিয়ে আছে বাচ্চাটার আদুরে মুখের দিকে! উঠোনে সারাক্ষণ সুবাস ছড়াচ্ছে তোমার হাতে রোঁয়া রঙ্গন, আমার হাস্নাহেনা। তুমি আছ পাশে। ভেবে দেখ, এমন যদি হত, তোমাকে থাকতে হত সিলেট-দিনাজপুর-চট্টগ্রাম-খুলনা বা রাঙ্গামাটি, জীবিকার তাগিদে একা, আর আমাদের থাকতে হত এখানে, কি ভয়ানকটা হত! এমনটা হতেই পারত, কিন্তু হয়নি। আল্লাহ আমাদের ভালবাসার অখণ্ড অবসর দিয়েছেন। এই তো আমাদের মধুচন্দ্রিমা! তুমি তাকে কোন সাগরের তীরে খুঁজে বেড়াচ্ছ?’ তার অপার্থিব কণ্ঠস্বর সম্মোহিতের মত শুনে গেলাম আমি।
হঠাৎ কি হল, এক অপূর্ব কল্পমধুচন্দ্রিমার রাতে দেখতে পেলাম, নাহারের চুলে জ্যোৎস্নার শাদা রঙ! আমাদের ভালবাসার ফুলটাও আর দুজনের মাঝে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে নেই। নিজেদের সকল আকাঙ্খা আহ্লাদ কালের জলে ভাসিয়ে দিয়ে, আমরা দুটি প্রাণী কি করে যেন যৌবনের দেউড়ি মাড়িয়ে প্রৌঢ়পুকুরের জলে ডুব দিয়ে এসেছি! শুনতে পেলাম সে বলছে, ‘ছেলেটা ভালভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেছে। এবার ভাল একটা চাকরি করবে। দেখেশুনে ওকে একটা বিয়ে করিয়ে দেব। তারপর ওদের হাতে সংসার তুলে দিয়ে, ঝাড়া হাতপা হয়ে, আমরা দুজন সমুদ্রে যাব। কেমন? সময়ের কাছ থেকে কড়ায় গণ্ডায় ক্ষতিপূরণসহ আদায় করে ছাড়ব সব’। বার্ধক্যশীর্ণ হাতে আমি তাকে কাছে টেনে বললাম, ‘বাহ! তুমি দেখছি স্বপ্নকে দিব্যি খাঁচায় পুষতে পার!’
হায়! সময় কত দ্রুত চলে যায়! শরীরটা বুড়িয়ে যায় মনের বয়েসের তোয়াক্কা না করেই। বেয়াড়া একটা! কাকেই বা বলব বেয়াড়া? এতো অনটন আর স্বপ্নচুরির মাঝেও মনটা আমাদের বুড়োলো না। আসল কালপ্রিট তো ওটাই। অফিস থেকে ফেয়ারঅয়েল নিয়ে মিষ্টি হাতে বাড়ি ফিরলাম একদিন। ছেলের চাকরি পাবার মিষ্টি তখনও বিলোতে পারিনি। দেশের অবস্থা জানি। জানি, আমার ছেলে বেকারত্বের দীর্ঘ সারিটিকে কিঞ্চিৎ দীর্ঘতর করছে মাত্র। তবুও, নিজের সন্তান বলে কথা। কোন এক শুভদিনের আশায়, দিন গুনে যেতাম আমরা।
বড় স্যার জানতে চেয়েছিলেন, পেনশনের টাকা পেয়ে কি করব। বলেছিলাম, নাহারকে নিয়ে একবার হজ্জ করে আসব। খোদা সাক্ষী, আমার চাওয়ায় কোন খাদ ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই বহু দিনের নিস্তরঙ্গ জীবন এক ঝোড়োতাণ্ডবে তছনছ হতে শুরু করল। বুড়ো এ দেহসৈনিকটা অর্ধশতাব্দীপ্রাচীন অনিয়মতান্ত্রিকতার কাছে খুব অল্প সময়ের ব্যাবধানে একেরপর এক বেশ ক’টি যুদ্ধে হেরে গেল। আমার বহুদিনের কৃচ্ছতার ত্রাণাকাঙ্ক্ষা এক সান্ধ্য বাদুড় হয়ে উড়ে গেল সায়াহ্নে, মৃত্যু ফলের ঘ্রাণে! পেনশনের দশ লাখ টাকার আধেকটা দিয়ে হৃদযন্ত্রে জটিল অস্ত্রোপচার করতে হল। পুরনো আরও শত্রু ছিল যত, একেএকে ফিরে এল সব। বৃক্ক পরিশোধনের জন্যে পেটে নল বসানো হলে জট পাকিয়ে গেল তা অন্ত্রের সঙ্গে। ফের হাতে বসানো হল তা। আমার সারাজীবনের সঞ্চয় জলের মত বেরিয়ে যেতে লাগল মর্ত্যের বুকে আর অল্প ক’টা দিনকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে। ছেলেবেলায় বন্ধু মানিক একবার বোকা বানিয়েছিল দুই আর তিন সমান প্রমান করে দিয়ে। সে বোকা বনে যাওয়াটা ছিল ক্ষণিকের। পর মুহূর্তে হৈ হৈ করে উঠেছিলাম, ‘চলক ছাড়া সমীকরণ হয় নাকি! লজিক ভুল!’ মনে হচ্ছিল ওর লজিকটাই ঠিক। আমারটাই বরং ভুল। জীবন ও মৃত্যুর সমীকরণ চলকবিহীনই বটে। এখানে দুই আর তিনের তফাৎ নেই কোন। দেখতে দেখতে চিকিৎসার কুৎসিত সব যন্ত্রপাতি আমার বাসা অবধি হানা দিল। আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো অদ্ভুত সব নল আমাকে কুৎসিত এক রোবটে পরিনত করে দিল যেন! নাহার আর ছেলেটা কষ্টের চূড়ান্ত করল আমার জন্যে। আমায় নিয়ে ওদের কষ্ট দেখে নিজেরটুকু এড়িয়ে যেতে ইচ্ছে হত। ওদের প্রশ্নের উত্তরে বলতাম, ‘বেশ আছি’। একদিন আমার ছেলের এক বন্ধু, আমায় দেখতে এসে যমযম কুপের পানি নিয়ে এল। নাহারকে ডেকে বললাম, ‘দেখো! ঐ পাত্রটিতে দেখছ যা, সব আমার চোখের জল’। নাহার কাছে এসে চোখ মুছে দিয়ে বলল, ‘ভরসা হারিয়ো না। আল্লাহ আছেন!’ আমি তার হাতটা ধরলাম। হায় নাহার! কারাবন্দি কত স্বপ্ন তোমার! এবার তার একটিকে অন্তত ছুটি দাও!
আমার বাবা রবীন্দ্রনাথের ‘কণিকা’র একটি কবিতা প্রায়ই আওড়াতেন।
‘অদৃষ্টেরে চিরদিন শুধালেম পিছে,
অমোঘ নিষ্ঠুর বেগে কে মোরে ঠেলিছে?
সে কহিল, ফিরে দেখ। দেখিলাম থামি,
সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি’।।
আসলেই কি তাই? আমার সন্দেহ জাগে! সম্মুখের এই আমিটিকে চিরকাল পশ্চাতের আমিটির চেয়েও শক্তিমত্ত হাতে কেউ একজন ঠেলে দিয়েছে তার ইচ্ছেপথে। অথবা, আমারই বোঝার ভুল। কবিগুরু তো আর না ভেবে লেখেননি!
মাঝে একদিন, মিষ্টি করে এক মেয়ে এল আমায় দেখতে। চেহারার আলগা লালিত্যটুকু গাঢ় স্বরে ঘোষণা করছিল তার আভিজাত্য। সে আমাকে ডাকল ‘বাবা’ বলে। নাহারের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, মেয়েটির সাথে করে নিয়ে আসা সৌন্দর্য, পবিত্রতা আর বিনয়ের দ্যুতিটুকু তার বেশ লাগছে। আমি আশীর্বাদ করে দিলাম তাকে। নাহার একদিন জিজ্ঞেস করল আমাকে, ‘নাযাতকে কেমন লেগেছে তোমার?’ বললাম, ‘ভয় লেগেছে। প্রথমবার যখন ওর কথা শুনেছিলাম, তখন একটু যেন মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম। ছোট একটা আশা ছিল, ইঞ্জিনিয়ার ছেলেকে ডাক্তার মেয়ে বিয়ে করাবো। এমনটা একজন বাবা ভাবতেই পারেন। পারেন না বল?’ নাহার বলল, ‘পারেন তো বটেই’। আমি বললাম, ‘সেটাকে বেপথু হতে দেখেই মনটা একটু বিষণ্ণ হয়েছিল। জীবনে তুমি আর ছেলেটা ছাড়া আর কোন উপহার, কোন অর্জন নেই আমার। স্বপ্নভঙ্গ তো নৈমিত্তিক ব্যাপার। আরও একটি স্বপ্নভঙ্গের ভয় যোগ হয়েছিল তাই। কিন্তু, মেয়েটিকে সেদিন চোখের সামনে দেখে পূর্বের ভাবনার জন্যে বেশ সঙ্কোচ হল আমার। আর, ভয় পেলাম আরও একবার। এবারের ভয়ের সঙ্গে আগেকার ভয়ের যোজন তফাৎ’। এতসব বলতেই সে হেসে উঠল খুব। কেন? হয়ত, আমার এসব ভাবনা তার কাছে ছেলেমানুষি। ব্যাপারটা হয়ত এতটা গভীর নয় কিছু, যতটা ভেবেছি আমি।
শরীর আরও মিশে গেল বিছানায়। নাহারের চোখের দিকে তাকাতেই বোঝা যেত, আমাকে বাঁচিয়ে তোলার তার কারাবন্দী স্বপ্নটুকু কি ভীষণ ছটফট করছে পালিয়ে যাবার জন্যে। প্রতিদিন একটু একটু করে নিজের ওপর বিশ্বাস হারাচ্ছিল সে। যে কোনদিন ভেঙে যেতে পারে বাঁধ। ছেলেটা সারাক্ষণ কাছে কাছে থাকতো। তার নির্জল চোখে তাকালে দেখতে পেতাম এক যৌবনসুলভ রোখ। যেন আমাকে কোথাও যেতে দেবে না! বেশ লাগত। নাহারকে ডেকে বললাম একদিন, ‘দারুণ এক স্বপ্ন দেখেছি কালরাতে!’ সে বলল, ‘ভাল দেখেছ। কি দেখলে?’ আমি বললাম, ‘দেখেছি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে, বেলাভূমি ধরে হাঁটছি আমরা চারটি মানুষ। সৈকতটা কক্সবাজারের বলে চিনতে পেরেছি, কারণ ছেলের ঘরের ক্যালেন্ডারের ছবিগুলোর সাথে ওখানকার দৃশ্য ঠিকটি মিলে যায়। আমাদের চেয়ে কিছুটা সামনে হাত ধরে হাঁটছিল ওরা দুজন; আমাদের ছেলে, আর নাযাত। একটু পেছনে হাঁটছি আমরা। প্রচুর বাতাস বইছে। মাঝসাগরের পাহাড়প্রমান ঢেউগুলো তীরে এসে মিনতির মতন পা ছুঁয়ে যাচ্ছে। যখন হাঁটতে শুরু করেছিলাম, তখন জলের রঙ ছিল কালচে ধূসর। হঠাৎ পাখির ডাকে চমকে ফিরে দেখি, জলের রঙ ঘন নীল! যে তোমার কোমল হাত আমার হাতের রূক্ষতার মাঝে গলে গলে যাচ্ছিল, সে তুমি আজকের শীর্ণত্বকবিবর্ণকুন্তলা নও। বরং পূরযৌবনালাবণী! আমার কানের কাছে মুখ এনে বললে- কেমন, এবার হল তো? বলেছিলাম তোমাকে আমি!’
অবশেষে আমাদের ছেলে চাকরীর সুখবর নিয়ে ঘরে এল। বাবার মুখে বেহেশতের ফুলফলের গল্প শুনে যেমন মন নেচে উঠত, বহুদিন পর তেমনই নেচে উঠল মন। মনে হল, বেহেশত আজ গৃহস্থ হয়েছে! তবে সে শর্ত দিয়েছে, থাকতে হবে মৃত্যুর এপারে- ওপারে নয়। শুয়ে থেকেই ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, ‘চল্ সবাই মিলে ইবনে বতুতা হয়ে যাই! আমার বাবা আছে না! মানুষ ভিন্ন হলেও, বাবা তো বটেই! হা হা হা!’ মনে হল বিড়ম্বিত ভাগ্যগুলোকে ডেকে জড় করে ‘তবে রে’ বলে বিকট স্বরে হেঁকে দিই তাড়িয়ে! নাহারকে বললাম, ‘সুখের সময়গুলো বড্ড কাছিয়ে এসেছে নাহার। কি হল। একটা কিছু তো বল?’
যে স্বপ্নটার কথা তাকে বলেছিলাম, তার একটা ছোটো অংশ খুব যত্নে এড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি। স্বপ্নে সৈকতে সবাই মিলে হাঁটছিলাম যখন, তখন হঠাৎ চোখে পড়েছিল, তীরের নরম বেলাভূমিতে সবার পায়ের ছাপ পড়ছে, সেখান থেকে উঠে আসছে বাতাসের ছোটো ছোটো বুদবুদ, কিন্তু কোথাও আমার পায়ের কোন ছাপ পড়েনি। বারবার এক পায়ে ভর দিয়ে দেখছিলাম আমি। নরম মাটিতে পা দেবে যাওয়ার অনুভূতি হচ্ছিল । কিন্তু পায়ের কোন ছাপ পড়ছিল না বেলাভুঁয়ে। এর চেয়ে সহজ সংকেত আর কি হতে পারে? নাহার! সুখের সময় কাছিয়ে এসেছে সত্যি। কিন্তু তার কুশীলব হয়ে ওঠা বোধয় আর হলনা আমার।
মাত্র আমাকে খাইয়ে দিয়ে পাশের ঘরে গেল সে। শেষ মুহূর্তে তার হাতটা ধরতে গিয়েও পারিনি। সেও বুঝতে পারেনি কিছু। খাবার ঘর থেকে টুং টাং শব্দ আসছে। বাইরে সন্ধ্যা নামছে। হঠাৎ, আমার পিঠ ভিজে গেল ঘামে। ক্রমে চারপাশের সভ্যতার যত ঠোকাঠুকি দূর থেকে দূরে চলে যেতে লাগল কেন যেন। কেন? বইয়ে পড়েছিলাম, মৃত্যুর আগে প্রথম নিষ্ক্রিয় হতে শুরু করে শ্রবণেন্দ্রিয়! সন্ধ্যের সাথে সাথে কি মৃত্যুও ঘনিয়ে আসছে তবে? যদি তাই হয়, তবে সন্ধ্যা আর মৃত্যু- এ দু দুটো সায়াহ্নের এক হয়ে যাওয়ার অভিনবত্বটুকু মুগ্ধ করল আমাকে! এ প্রাচীন জীবনটার সকল মুগ্ধতার সাথী নাহার। আমি তাকে ডাকতে চেষ্টা করলাম। শক্তি পেলাম না। আমার ছেলেটা কাজ শেষে এখনও বাড়ি ফেরেনি। তাকে কি শেষবারের মত আর দেখতে পাব না? তাকে বলা হল না, আমার বাবা আর তার মাঝে নিজেকে রেখে, স্বপ্নের চিরায়ত নিরবচ্ছিন্নতাকে রক্ষা করে আমি তাকে প্রবাহিত হতে সাহায্য করেছি মাত্র। কঠোর এ জগদ্ধাত্রের বুকে, এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা আমার ছিল না। সে যেন একে বয়ে নিয়ে যায়। আর বাড়িয়ে তোলে আরও। সেই অধ্যাপকের বাণীটি তো নিরেট সত্য! ‘মানুষ তার আশার সমান বড়!’ স্বপ্নই তো আশা- আশাই তো স্বপ্ন!
কি আশ্চর্য! মনে হচ্ছে আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! আমি যেন অফিসের ভাঁড়ার ঘরের সেই কিশোর আরশোলাটি হয়ে গেছি! ঘরটার নিরেট দেয়ালের এক কোণে ছিল ছোট্ট একটি ছিদ্র, কালো। দরজাটা একটুখানি ফাঁক হলেই দেয়ালের ওপর এক ফালি আলো এসে পড়ত, আর চারপাশে ইতস্তত বেড়াতে থাকা আরশোলাশিশুর দল হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ত ছিদ্রটার ভেতর। একদিন, শিশুগুলোর সঙ্গে আকৃতিতে কিছুটা বড় এক কিশোরকে দেখা গেল। হঠাৎ গায়ের ওপর আলো এসে পড়ায় সবাই সুড়সুড় করে ছিদ্রটিতে ঢুকে পড়লেও, পারল না কেবল ঐ কিশোর আরশোলাটি। সে তার অপেক্ষাকৃত বড় শরীরটিকে বারবার ঠেসে ধরছিল ছিদ্রটির মুখে। আর ফিরে আসছিল ব্যর্থ হয়ে! নিজেকে আমি সেদিনের সে আরশোলাটির ভূমিকায় দেখতে পেলাম, যে কিনা অচেনা কিছু একের কাছ হতে ছুটে পালাতে চাইছিল প্রাণপণে, কিন্তু পারছিল না কোন ক্রমেই। সেদিন সে দরজাটি ভিজিয়ে দিয়ে ফের আঁধার তৈরি করে আমি তাকে ত্রাণ দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমার জন্যে কোথাও কোন ত্রাণছত্র নেই।
অথবা, কে বলতে পারে, হয়ত এ-ই সেই ত্রাণ! ধ্রুব ভীতির অন্তরালে, চির ঈপ্সিত নির্বাণ!