ঢাকা, বুধবার, ২০ই আগষ্ট, ২০১৪
---ডেস্ক রিপোর্ট
অনেকদিন যাবত কম্পিউটার জগতের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্প্রসারনের চেষ্টা চলছে। গত ৯ জুন কম্পিউটার জগতের একটি মাইলফলক। অবশেষে অ্যালান টিউরিং এর বুদ্ধিমত্তা নির্ণায়ক পরীক্ষা উৎরে গেছে একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম।
অ্যালান টিউরিং টেষ্টটি টিউরিং টেষ্ট হিসেবে পরিচিত। ১৯৫০ সালে বিজ্ঞানী অ্যালান টিউরিং সর্বপ্রথম এই পরীক্ষার অবতারনা করেন। এটা অনেকটা দুটো আলাদা রুমে থেকে আলাপ চালানোর মতো। এক রুমে থাকবে মানুষ। সে আলাপ করে বোঝার চেষ্টা করবে অন্য রুমে মানুষ রয়েছে না কম্পিউটার প্রোগ্রাম। এই টেষ্টে একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম তখনই কৃতকার্য হবে যখন এটি পাঁচ মিনিটের কনভারসেশনে ত্রিশ পারসেন্ট মানুষকে বোকা বানাতে পারবে। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করবে যে তারা একটা মানুষের সাথেই কথা বলেছে। এখন পর্যন্ত আর কোন কম্পিউটার প্রোগ্রাম এই পরীক্ষায় পাশ করতে পারে নি।
কিন্তু সম্প্রতি রুশ প্রোগ্রামারদের তৈরী প্রোগ্রাম ইউজিন গোষ্টম্যান ৩০% এর স্থলে ৩৩% তদন্তকারীকে বোকা বানাতে সক্ষম। ৩৩% মানুষ বিশ্বাস করেছে যে ইউজিন আসলেই একজন মানুষ। গত ৯জুন একটা পরীক্ষার মাধ্যমে এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন তারা।
ইতিহাসে এই প্রথম এমনটা ঘটেছে বলে দাবী করা হচ্ছে। এরকম টেষ্ট আগেও হয়েছে, কিন্তু এরকম সফলতা আগে আসেনি। মোট পাঁচটি মেশিন ব্যবহার করা হয়েছে এই কাজে।
সবকিছু পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গতকাল ১৯ই আগস্ট একটা প্রেস কনফারেন্সে এবিষয়ে খোলাখুলি কথা বলেছেন ইউজিন গোষ্টম্যানের সাথে যুক্ত বিজ্ঞানী আর প্রোগ্রামাররা।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া মুভি HER এ কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাথে এতোটাই আবেগঘন কনভারসেশন হয়েছিল যে একজন তার প্রেমে পড়ে যান। কিন্তু মুভিটি ছিল সাই-ফাই। বাস্তব ভিত্তি নেই এর। ইউজিন গোষ্টম্যান আবিষ্কারের পর নিশ্চয়ই অবিশ্বাস করার কারন নেই যে ভবিষ্যতে এমন প্রোগ্রাম হবে। কারন, সময়ের সাথে সাথে এই প্রোগ্রাম আরো উন্নত হবে। আর সাথে সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অন্য মাত্রায় যাবে।
*******
‘নট ব্যাড!’ মনে মনে কথাটা বলে পত্রিকাটি টেবিলের এক কোনায় রেখে দিলাম আমি।
চারদিকে নেমে এসেছে আঁধারের ঘন চাঁদর। সারাদিনের কোলাহল শেষে ঘরে ফিরছে কর্মব্যস্ত মানুষ। নিরব হয়ে আসছে চারদিক। অবশ্য, কিছক্ষন পরেই আবার শুরু হবে কোলাহল, নতুন করে, নতুন আঙ্গিকে। সেখানে কর্মব্যস্ততা থাকবে না। থাকবে আড্ডা, হাসি-ঠাট্টা। ঘুঞ্চি গলির ভেতরে ওঁত পেতে থাকবে কয়েকজন।
দুররর, কি সব চিন্তা করছি আমি! নিজের কাজে নামতে হবে আমাকে। এভাবে অবান্তর চিন্তা করলে চলবে না।
ইউজিন গোষ্টম্যান প্রোগ্রামটা আসলেই বিজ্ঞানীদের এক অভূতপূর্ব আবিষ্কার। তবে আমি যা করতে যাচ্ছি, তার সাথে ইউজিন গোষ্টম্যানের কোন তুলনা হবে না। এর চেয়েও থাউজেন্ড টাইমস বেটার উন্নত প্রোগ্রাম তৈরী করবো আমি। আর হয়তো মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই সারা পৃথিবীর মানুষ দেখতে পাবে সেটাকে।
নিঃশব্দে টেবিল থেকে ট্যাবটা তুলে নিলাম আমি। আবার সব চেক করা প্রয়োজন। এই কাজে কোন ফাঁক থাকুক, সেটা আমি চাই না।
স্ক্রিনে ভেসে থাকা চার্টের দিকে তাকালাম আমি। এভরিথিং ইস ফাইন, স্টেবল। নাও আই ক্যান স্টার্ট মাই জব।
রুমটার দিকে নজর দিলাম আমি। মোট ঢাউস সাইজের আটটা সিপিইউ, আরো আছে মোট এগারোটা বিভিন্ন সাইজের মনিটর। পাশে আছে একটা বেড, যেটাকে আমি ক্যাপসুল বলি আর কি। ক্যাপসুলটা আমার নিজের আবিষ্কার। এটা আমাকে ঘুমাতে সাহায্য করবে। ক্যাপসুলে বলতে গেলে প্রয়োজনীয় সবকিছুই সেট করেছি আমি। একজন মানুষকে স্টেবল রাখতে যা যা দরকার হয় আর কি। আর সব প্রসেসই কম্পিউটার নিয়ন্ত্রন করবে। আগেই সব কমান্ড দিয়ে রেখেছি আমি সফটওয়ারে। এখন শুরু স্টার্ট করতে হবে প্রোগ্রামগুলো।
জোড়ে একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম আমি। পুরো কাজটা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রন করবে। আর এর কথা এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর কেউই জানে না। এমনকি ঐ মেয়েটাও নয়।
মনে মনে কিছুটা ভয় যে পাচ্ছি না আমি, তা নয়। কিন্তু কিছুই করার নেই।
বিভিন্ন কোম্পানীতে যেসব বিজ্ঞানী কাজ করেন, যেমন নাসাতে বা অন্য কোন সংস্থায়, তারা বলতে গেলে সব সুযোগ সুবিধাই ভোগ করে থাকেন। অন্যদিকে পৃথিবীতে যেসব বিজ্ঞানী নিজের মনমতো গবেষনা করেন, তাদের সবারই কিছু সমস্যা থাকে। তারা যা ইচ্ছে তা করতে পারেন না। পদে পদে তাদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাছাড়া আছে বৈজ্ঞানিক নথি চুরি হবার ঝুঁকি। দেখা যাচ্ছে আমি একটা বিষয় নিয়ে গবেষনা করছি, আর সেটা অন্য কেউ চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিলো, ব্যপারটা তখন খুবই খারাপ লাগবে আমার কাছে।
অবশ্য এধরনের ঘটনা অহরহই ঘটে। খোদ নাসারই আছে এমন অনেক প্রফেশনাল লোক, যারা স্বনামধন্য বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন গবেষনার কাগজপত্র চুরি করে নিয়ে নাসাকে দিয়েছেন, আর সেগুলো নাসা নিজেদের আবিষ্কার বলে দাবী করেছে।
অবশ্য আমার কথা খুব কম মানুষই জানে। তবুও ভয় একটা থাকেই। ঝুঁকি সব কাজেই থাকে।
মাথা থেকে এসব চিন্তা বাইরে ছুঁড়ে দিলাম আমি। এখন এসব নিয়ে ভাবলে চলবে না। বাকি কাজটা করতে হবে আমাকে। আমার গবেষণার একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌছে গেছি আমি।
এমনসময় সেলফোনের তীক্ষ্ণস্বরে কিছুটা চমকে উঠলাম আমি। সেলফোনটা তুলে নিতেই দেখলাম স্বর্ণার কল এসেছে। রিসিভ করলাম আমি।
-‘হ্যালো?’
-‘হ্যালো। কোথায় তুমি?’
-‘আমি আমার ল্যাবে।’
-‘এয়ারপোর্টে আসবে না?’
-‘এয়ারপোর্ট? কেন?’
-‘ভুলে গেছো?’
-‘ওহ, সরি। দেরি হবে আমার। অন্তত একসপ্তাহ কোথাও যেতে পারবো না আমি। অনেক কাজ করতে হবে।’
-‘আমি চলে যাচ্ছি শুভ! আর তুমি এখনো ল্যাবে? আমাকে কথা দিয়েছিলে তুমি।’
-‘সরি স্বর্ণা। কাজটা শেষ করেই তোমাদের ওখানে আসবো আমি দেখা করার জন্য।’
-‘থাক, সরি বলতে হবে না। করো তোমার কাজ।’
-‘রাগ করছো কেন?’
-‘রাগ করবো না? গত দুমাস ধরে আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাইছি, তোমার কোন পাত্তাই নেই। আজকে আমি চলে যাচ্ছি, অথচ তুমি? করো তোমার কাজ।’
-‘স্বর্ণা, প্লিজ। বোঝার চেষ্টা করো। কাজটা শেষ করেই হাওড়া আসবো আমি। কথা দিচ্ছি।’
-‘আসতে হবে না তোমাকে। বাবা ঠিকই বলতো, তোমরা এমন একটা জাতি, যারা নিজেরা ভাল থাকবেও না, কারো ভাল সহ্যও করতে পারবে না। ভীত তোমরা। তোমাদের মতো কাপুরুষ জাতি আমি আমার জীবনে আর একটাও দেখিনি। ঝোঁকের বসে তোমরা সবকিছুতে হাত দাও, কিন্তু কোনকিছুই ঠিকভাবে শেষ করতে পারো না। তাই হয়তো তোমাদেরকে ঝোঁকে বাঙালি বলে! যদি সম্ভব হয়, তবে চেঞ্জ হওয়ার চেষ্টা করো। সবাইকে নিয়ে না পারো, নিজে অন্তত একটাবার চেষ্টা করো।’
-‘স্বর্ণা...’
আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিলো মেয়েটা। কয়েক সেকেন্ড ফোনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর কাঁধ ঝাঁকালাম আমি। তারপর সেলফোনটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে দিয়ে ক্যাপসুলের দিকে এগুলাম।
কাজটা আগে শেষ করা দরকার আমার। বেঁচে থাকলে বাকিসব পরেও করা যাবে।
ক্যাপসুলে শুয়ে সামনে থাকা প্রত্যেকটি মনিটরের দিকে তাকালাম আমি। সবকিছুই তৈরী। শুধু একটা কমান্ডের অপেক্ষায় আছে সব। হাত বাড়িয়ে ক্যাপসুলের পাশে থাকা কীবোর্ডের একটা বাটনে চাপ দিলাম। এবার সবকিছুর নিয়ন্ত্রন নেবে আমার কম্পিউটার।
ধীরে ধীরে একটা একটা করে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আমার দিকে এগিয়ে এলো। বা হাতের ভেইনের ভেতরে ঢুকলো একটা সুচ, এটা স্যালাইনের। আরেকটা সুচ ঢুকলো স্যালাইনের সিলিন্ডারের ভেতর। তারপর চুলের রাউন্ড ব্যান্ডের মতো দেখতে একটা ডিভাইস এসে আমার মাথাটাকে ঘিরে ফেললো। এটার মধ্যে বিভিন্ন সেন্সর বসানো আছে, যা আমার মস্তিষ্কের প্রত্যেকটি নিউরোনের তারতম্যের পরীক্ষা করবে। এক কথায় আমার সম্পূর্ণ মস্তিস্ক স্ক্যান করবে।
আর কিছু দেখতে ইচ্ছে করছে না আমার। বুঝতে পারছি, আমার ইচ্ছে শক্তিটাকে দমিয়ে দেয়া হচ্ছে। লোকাল এনেস্থেসিয়াটা তার কাজ ঠিকমতোই করছে বোঝা যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে আধারের একটা চাদর নেমে আসছে আমার সামনে। ঘুমিয়ে পড়ছি আমি। হয়তো এটাই আমার জীবনের শেষ ঘুম।
*******
‘মেজাজ খারাপ,’ যেন বহুদুর থেকে আসছে কথাটা। কে যেন উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলছে, ‘হচ্ছে না কেন? দুরররর বাল। ...... কিচ্ছু হলো না। শুধু শুধুই এতোদিন ধরে এটার উপর গবেষনা করে সময় নষ্ট করলাম আমি।’
কে বলছে কথাগুলো?? কন্ঠটা খুবই পরিচিত মনে হচ্ছে আমার কাছে। মনে হচ্ছে, অনেকবার শুনেছি কন্ঠটা। কিন্তু কন্ঠের মালিককে মনে করতে পারছি না কিছুতেই।
মাথা খাটাতে হবে। দ্রুত চিন্তা করতে হবে।
কোথায় শুনেছি এই কন্ঠটা? কোথায়?
ধীরে ধীরে সব মনে পড়ছে আমার। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, জেগে উঠছি আমি।
জেগে উঠছি? মানে, বেঁচে আছি আমি? সত্যি বেঁচে আছি?
একটা স্বস্তির পরশ বয়ে গেলো মনের মধ্যে আমার। হ্যাঁ, সত্যিই বেঁচে আছি আমি। কারন, বেঁচে না থাকলে জেগে উঠতে পারার কথা নয়। কিন্তু জেগে উঠছি আমি। খুবই ধীরে ধীরে জেগে উঠছি।
‘বালের গবেষনা,’ এবার খুব কাছ থেকে খেঁকিয়ে উঠলো কে যেন, ‘স্বর্ণা ঠিকই বলেছিল। আমাদের বাঙালীদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। ঝোঁকে বাঙালী আমরা। কাজের চেয়ে কথার জোড় বেশী আমাদের। দুররর!’
চমকে উঠলাম আমি। হচ্ছেটা কি!!
ধীরে ধীরে সব মনে পড়ছে আমার। এই কথাগুলো তো স্বর্ণা আমাকে বলেছিল! যাবার সময় সে বলে গেছিল, ‘তোমরা এমন একটা জাতি, যারা নিজেরা ভাল থাকবেও না, কারো ভাল সহ্যও করতে পারবে না। ভীত তোমরা। তোমাদের মতো কাপুরুষ জাতি আমি আমার জীবনে আর একটাও দেখিনি। ঝোঁকের বসে তোমরা সবকিছুতে হাত দাও, কিন্তু কোনকিছুই ঠিকভাবে শেষ করতে পারো না। তাই হয়তো তোমাদেরকে ঝোঁকে বাঙালি বলে! যদি সম্ভব হয়, তবে চেঞ্জ হওয়ার চেষ্টা করো। সবাইকে নিয়ে না পারো, নিজে অন্তত একটাবার চেষ্টা করো।’
দ্রুত চোখ খোলার চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু হচ্ছে না! চোখ খুলতে পারছি না আমি!
ডানহাত দিয়ে চোখটাকে ডলতে চাইলাম। কিন্তু সেটাও পারছি না। কি হয়েছে আমার আসলে?’ আমি কি সত্যিই বেঁচে আছি?’
‘আবার রিস্টার্ট করে দেখ,’ আরেকটা গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো এসময়, ‘হয়তো কাজ হতে পারে।’
আরে, এটা তো সনেটের গলা! সনেট এখানে কি করছে? আর কাকে কি রিস্টার্ট দিতে বলছে?’
‘এইবার দিয়ে আটবার রিস্টার্ট দিলাম,’ আগের কন্ঠটি বলে উঠল আবার।
অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, কন্ঠটা আমার।
তার মানে কি আমি! কিন্তু কিভাবে?
‘ভাল করে ব্রেইন স্ক্যান করেছিলি তো?’ আবার সনেটের আওয়াজ পাওয়া গেলো, ‘প্রোগ্রামটা ঠিকমতো সাজিয়েছিস তো? কোন কমান্ডে ত্রুটি নেই তো?’
‘নাহ,’ আবার বলে উঠলো প্রথম কন্ঠ, ‘অনেকবার চেক করে তারপরই কাজটা করেছি আমি। কোন ভুল নেই। পুরোটা স্ক্যান করার গত দু’বছর ধরে পুরো প্রোগ্রামটা সাজিয়েছি আমি। তারপরও কয়েকবার করে পুরো ডাটা চেক করেছি আমি। ভার্চুয়ালী যা যা প্রয়োজন, সব কিছুই ইনপুট করেছি। কিন্তু প্রোগ্রামটা স্টার্টই হচ্ছে না।’
‘আবার রিস্টার্ট দে,’ বলে উঠলো সনেট।
‘ওকে,’ হুবহু আমার ভঙ্গিতে বলে উঠলো কন্ঠটা।
ঠিক তার পর পরই আবার এক প্রকার অবসন্নতা চেপে ধরলো যেন আমাকে। মনে হচ্ছে, যেন হারিয়ে যাচ্ছি আমি কোন অতল গহ্বরে।
*******
‘এবারও একই অবস্থা মনে হচ্ছে,’ খেঁকিয়ে উঠলো কেউ।
চমকে জেগে উঠলাম আমি। এতো একেবারে আমার নিজের গলা! কে এই পাবলিক?
চোখ খোলা প্রয়োজন। যেভাবেই হোক দেখতেই হবে কি হচ্ছে আসলে। এভাবে অন্ধকারের মধ্যে আমি আর থাকতে চাই না।
চোখ দুটো খুলতেই আবারো চমকে উঠলাম আমি। হচ্ছেটা কি আসলে?
আমার দৃষ্টির সামনে কে যেন একগাদা নাম্বার বসিয়ে দিয়েছে! সেগুলোর মান তুমুল বেগে উঠা-নামা করছে! মনে হচ্ছে, কোন এক প্রকার লগারিদম এটা।
ভাল করে লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারলাম জিনিসটা। হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম তাই। একটা চার্ট এটা। এখানে আমার কন্ডিশন দেখাচ্ছে। আমি স্ট্যাবল আছি। ঠিক আছি।
ডান হাত দিয়ে মাথাটা ধরতে চাইলাম। কিন্তু কোন সাড়া পাচ্ছি না হাতে। হচ্ছেটা কি আসলে? যদি আমি স্ট্যাবলই থাকি, তাহলে হাতে কোন সাড়া নেই কেন? শুধু হাতে নয়, একইভাবে খেয়াল করলাম সারা শরীরের কোথাও কোন সাড়া নেই।
‘প্রোগ্রাম স্টার্ট হয়েছে,’ আবারো সেই কন্ঠটা বলে উঠল, ‘যাক। বাঁচা গেলো। এখন সবকিছু ভালয় ভালয় হলেই হয়।’
‘বলছিলাম না তোরে,’ সনেটের কন্ঠে বলে উঠলো কেউ, ‘পিসি রিস্টার্ট দিলে কাজ হবে। দাড়া, ক্যামটা অন করি।’
প্রায় সাথে সাথেই আমার চোখের সামনে থেকে কে যেন চার্টটাকে সরিয়ে নিলো। আর সেই জায়গা দখল করে নিলো তীব্র আলো। অবশ্য প্রায় সাথে সাথেই সামনের দৃশ্য দেখতে পেলাম।
প্রথমেই যা দেখতে পেলাম, তা একটা কীবোর্ড। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সনেট। কীবোর্ডের উপর ঝুঁকে ছিল, সেখান থেকে দাঁড়িয়ে সোজা হলো ও।
‘হোয়াট দ্যা ফাক!’ স্বগোক্তি করলাম আমি। হচ্ছেটা কি আসলে?
সনেট সোজা হয়ে দাড়াতেই অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছি আমি নিজে!
কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? আমি তো এখানে, এই ......
ওহ গড! তার মানে......
হ্যাঁ, কাহিনীটা এবার বুঝতে পেরেছি। পুরো ব্যপারটাই স্পষ্ট আমার কাছে।
আমার সামনে আমি যাকে দেখছি, সে আসলে আমি নিজেই। বাস্তব জগতের আমি। আর এখানে যে আমি, মানে যে বসে বসে চিন্তা করছি, সেও আমি। ভার্চুয়াল জগতের আমি।
‘এটা আমি কি করেছি?’ অবাক হয়ে বলে উঠলাম।
‘আরে,’ দ্রুত বলে উঠলো বাস্তব জগতের শুভ, ‘প্রোগ্রামটা রেসপন্স করছে! কথা বলছে!’
‘হাহ,’ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেসে উঠলো সনেট, ‘যাক, তোর কাজ হয়ে গেছে তাহলে। অভিনন্দন দোস্ত।’
‘দাড়া,’ আবার বলে উঠলো বাস্তব জগতের শুভ, ‘প্রজেক্ট এস-ডব্লিউ-ও-ভি-ও, প্লিজ রেস্পন্স এগেইন।’
‘জেগে আছি,’ মৃদুস্বরে উত্তর দিলাম।
‘ইয়েস,’ খুশীতে যেন লাফিয়ে উঠলো শুভ, ‘ইয়েস! আই হ্যাভ ডান ইট! আই ডিড ইট!’
তার সাথে যোগ দিলো সনেটও। বললো, ‘যাক, তোর স্বপ্ন তাহলে সত্যি হলো। ব্রেইন স্ক্যানের পর তো কম খাটলি না শালা। দু’বছর! আমি হলে তো কবেই প্রজেক্ট ড্রপ করে দিতাম।’
‘এক সেকেন্ড,’ ওদের দুজনের মাঝখানে বলে উঠলাম আমি, ‘দুই বছর মানে কি?’
‘অ্যা?’ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো সনেট, ‘শুভ, তোর এই প্রোগ্রাম তো আবার প্রশ্নও করে রে! আজিব!’
‘আজিবের কি আছে?’ বলে উঠলো শুভ, ‘এটাকে এভাবেই প্রোগ্রাম করেছি আমি। এটাই হচ্ছে ভার্চুয়াল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দোস্ত।’
‘সনেট, শুভ’ আবার বলে উঠলাম আমি, ‘আমি জানতে চেয়েছি যে, দুই বছর মানে কি? ব্রেইন স্ক্যান করার পর দুই বছর কেটে গেছে?’
‘হ্যাঁ,’ মাথা নাড়লো শুভ, ‘আমার ব্রেইন স্ক্যান করার পর দুই বছর কেটে গেছে। এই দুই বছরের পুরোটা সময় লেগেছে আমার তোমাকে ঠিকভাবে বিশ্লেষন করে আজকের এই পর্যায়ে আনতে।’
‘স্বর্ণা,’ আবার প্রশ্ন করলাম আমি, ‘স্বর্ণার কি খবর? ও চলে যাওয়ার পর ওকে দেখতে গিয়েছিলে? এখন কেমন আছে ও?’
শুভ’র চেহারায় বেদনার ছাপ ফুটে উঠলো কেন যেন। মাথা নিচু করে বললো, ‘নাহ। আর দেখা হয়নি ওর সাথে। অনেক জেদি মেয়ে ও। স্ক্যান শেষ করে ওকে অনেকবার ফোন দিয়েছিলাম আমি। কিন্তু ও ফোন ধরেনি। পরে ওর আম্মার কাছে ফোন করেছিলাম। উনিই স্বর্ণার সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছেন আমাকে। স্বর্ণা আমাকে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে যেন ওর সাথে কোন যোগাযোগ না করি আমি।’
‘আর কোন যোগাযোগ করো নি?’ ব্যাকুল কন্ঠে বলে উঠলাম আমি, ‘কক্ষনো না?’
‘নাহ,’ মাথা নিচু করে বলে উঠলো ও, ‘করিনি। ও আসলেই অনেক জেদি। কখন কি করে ফেলে ঠিক নেই। ফোন দিলে আবার যদি......’
‘সমস্যা কি তোর?’ বলে উঠলো সনেট, ‘কম্পিউটারের প্রোগ্রামের সাথে এইগুলা কি প্যাচাল পারিস?’
‘সনেট,’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি, ‘চুপ করবি?’
‘আরে শালা!’ সনেটের চেহারায় বিস্ময়, ‘এই প্রোগ্রাম দেখি আমাকেও ধমক দেয়! শুভ, এইটা কি প্রোগ্রাম বানাইছো দোস্ত? বেয়াদব প্রোগ্রাম। একটু ভদ্রতাও শিখে নাই।’
‘তোরে আমি চড়াইয়া দাঁত ফেইলা দিমু,’ আগের চেয়ে জোড়ে খেঁকিয়ে উঠলাম আমি, ‘ফাইজলামী করিস আমার সাথে? আমি কোন প্রোগ্রাম না, আমি শুভ।’
‘যাহ শালা!’ অবাক হয়ে বাস্তব জগতের শুভ’র দিকে তাকায় ও, ‘দোস্ত, তোর প্রোগ্রামটা আসলেই বেয়াদব। আমাকে ঝাড়ি দেয়! আমি গেলাম দোস্ত। তার আগে বলি, তোর প্রোগ্রামকে তুই ভদ্রতা শেখা। নইলে এইটা তোর কোন কাজেই আসবে না।’
এই বলে উল্টো ঘুরে হাটা শুরু করলো সনেট। শুভ কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আবার আমার দিকে তাকালো।
‘মনে হচ্ছে,’ স্বগোক্তির মতো বলে উঠলো ও, ‘প্রোগ্রামের মেজর কোন প্রবলেম আছে।’
‘আমার তা মনে হয় না,’ মৃদুস্বরে বলে উঠলাম আমি, ‘তবুও আমি চেক করে দেখছি দাড়াও।’
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পুরো সিস্টেমের গ্রাফ চলে এলো আমার কাছে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, পুরোটা বিশ্লেষন করতে সাড়ে তিন ন্যানো সেকেন্ড লাগলো।
‘এভরিথিং ইজ ফাইন,’ বলে উঠলাম আমি, ‘সবই তো ঠিক আছে দেখছি।’
‘মানে কি?’ ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো ও, ‘তু-তুমি সব চেক করে ফেলেছো? এতো দ্রুত? আড়াই টেরাবাইটের প্রোগ্রাম এটা। কিভাবে?’
‘কিভাবে,’ মৃদুস্বরে বললাম, ‘তা জানি না। তবে হ্যাঁ, আমি সব চেক করে দেখেছি।’
বেশ কিছুক্ষন ভ্রু কুঁচকে রইলো ও। তারপর স্বভাবসুলভ মাথা ঝাকিয়ে বললো, ‘হবে হয়তো। কারন তুমি তো আমারই কার্বন কপি। মানে, আমার ব্রেইনের, আমার স্মৃতির কপি আর কি। তার সাথে এখন একটা প্রোগ্রামে পরিনত হয়েছো তুমি। যেখানে জিনিয়াসরাও বড়জোড় ব্রেইনের ১৬-২০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারে, সেখানে তুমি ব্যবহার করতে পারছো পুরোটাই।’
অবাক হলাম আমি। ঠিকই তো! প্রোগ্রাম হবার পর আমার ক্ষমতা অনেক বেড়ে গেছে। এখন আর আমি সাধারন মানুষ নই।
‘যাই হোক,’ মাথা নাড়লো শুভ, ‘তোমাকে এখন ইন্টারনেটের সাথে সংযোগ করছি আমি। যার ফলে এখন তুমি তোমার ইচ্ছেমতো সবকিছু করতে পারবে। আমি কখন প্রোগ্রাম চালু করবো, সেই আশায় বসে থাকতে হবে না তোমাকে।’
‘শুভ,’ মৃদুগলায় জিজ্ঞেস করলাম আমি, ‘স্বর্ণা কি এখনো হাওড়াতেই আছে?’
ধীরে ধীরে আমার দিকে, মানে মনিটরের দিকে তাকালো ও। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘নাহ। হাওড়া গিয়েছিলাম আমি। সেখানে নেই ও। হায়দরাবাদ চলে গেছে, ওর এক আংকেল থাকে সেখানে।’
‘ওওও,’ মৃদুকন্ঠে বললাম আমি।
কীবোর্ডের কয়েকটা বাটন টিপে পিছিয়ে গেলো ও। পাশের এক কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেলো ও। তার ড্রয়ার খুলে কিছু কর্ড বের করলো। তারপর একটা সিপিইউয়ের দিকে এগিয়ে গেলো। এই ল্যাবের একমাত্র সেটাতেই নেটের কানেকশন দেয়া আছে।
সিপিইওয়ের উপরে রাখা রাউটারের সাথে কর্ডটার সংযোগ স্থাপন করে কর্ডের আরেক প্রান্ত ধরে এগিয়ে এলো আমার দিকে। নিচে ঝুঁকে এই পিসির সিপিইউয়ের সাথে কর্ডের অপরপ্রান্তের সংযোগ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ও। তারপর আবার কীবোর্ডের দিকে ঝুঁকে কিছু একটা টাইপ করলো। মাউস দিয়ে কয়েক জায়গায় ক্লিক করলো।
স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছি আমি, কি করছে ও। আমাকে নেটে আপলোড করা হচ্ছে।
‘আপলোডিং,’ আমার দিকে তাকিয়ে বললো ও, ‘এখন আবার স্টপ করতে হবে তোমাকে। আপলোড করার পর আবার জাগিয়ে তুলবো। আপাতত বিদায়।’
তারপর মাউস নিয়ে একটা ক্লিক করলো ও। আবার অন্ধকার নেমে আসছে আমার সামনে।
*******
‘কমপ্লিট,’ মৃদু হেসে বললো শুভ, ‘পর্যবেক্ষণের জন্য আর কিছু বাকি নেই। এখন তোমাকে আমি সবার সামনে আনতে পারি।’
ইতোমধ্যে আরো দেড় মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে আরো হাজার প্রকার পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে। এতে করে আমার প্রকৃত ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত হয়েছি আমি। যতোই নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারছি, ততোই অবাক হয়ে যাচ্ছি।
ইন্টারনেট জগতের সবকিছুর উপর আমার আধিপত্য আছে এখন। ইচ্ছে করলে সবকিছুই করতে পারি আমি। ইচ্ছে করলে নতুন প্রোগ্রাম তৈরী করতে পারি, ইচ্ছে করলে নিজের সুরক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিতে পারি, ইচ্ছে করলে অন্য কারো ক্ষতিও করতে পারি ম্যালফাংশন বা ভাইরাস তৈরী করে।
‘ইন্টারনেট আর প্রোগ্রামিং জগতে ব্যাকথ্রো ঘটাতে যাচ্ছি আমি,’ নিজের মনে বলে উঠলো শুভ, ‘হয়তো একবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আবিস্কার হতে যাচ্ছে এটা।’
‘তুমি একা নও,’ মৃদুস্বরে বললাম, ‘আমিও। কারন, আমি সাহায্য না করলে মাত্র দেড় মাসে আমাকে লঞ্চ করার মতো পজিশনে আনতে পারতে না তুমি।’
‘তা ঠিক,’ নিজের কয়েক মাস না কামানো দাড়িতে হাত বুলালো ও, ‘তৈরী থেকো। আজ সন্ধ্যায় নাসার কয়েকজন বিজ্ঞানী আসবেন ঢাকায়। কাল সকালে তাদের সাথে একটা এপয়েনমেন্ট আছে আমার। সেখানেই সর্বপ্রথম তোমাকে প্রদর্শন করা হবে।’
‘প্রদর্শন?’ একমত হতে পারলাম না আমি, ‘এটা কেমন শব্দ? এটুকু ভুলে যেও না যে তুমি নিজে যা, আমিও ঠিক তাই।’
‘হ্যাঁ,’ খানিকক্ষন ইতস্তত করে বললো ও, ‘তা ঠিক। তুমি তো আমারই কার্বন কপি।’
‘কিংবা,’ গম্ভীরস্বরে বললাম, ‘তুমি আমার। না না, ভুল বললাম, তুমি আমার দশ হাজার ভাগের এক ভাগ।’
‘মানে কি?’ ভ্রু কুঁচকে গেলো ওর।
‘ভ্রু কুঁচকে লাভ নেই,’ আগেরমতোই বললাম আমি, ‘যা সত্য তাই। তুমি আমার দশ হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র। তুমি যতোটুকু তোমার ব্রেইন ব্যবহার করতে পারো, তার চেয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় আমি পারি ছয় দশমিক দুই পাঁচ গুন বেশী। আর, আমাকে আপলোড করার পর এই ক্ষমতা থাউজেন্ড টাইমসেরও বেশী বেড়ে গেছে। নিখুঁতভাবে হিসেব করলে দশ হাজার দুইশো তেতাল্লিশ গুন বেশী ক্ষমতা তোমার চেয়ে আমার।’
‘হুম,’ হতাশসুরে বললো ও, ‘এটুকু ভুলে যেও না যে তোমাকে এই অবস্থায় আনার পুরো ক্রেডিটটাই আমার। যাই হোক। কালকে তোমাকে লঞ্চ করছি আমি। সবকিছু রেডি রেখো।’
‘আমাকে লঞ্চ করছো তুমি,’ স্লেষমাখা সুরে বললাম আমি, ‘তাহলে তুমি নিজেই সব রেডি করো। অন্যান্য প্রোগ্রামের বেলায় তো তাই করে সবাই।’
‘কিন্তু তুমি,’ আমার দিকে, মানে মনিটরের দিকে ঝুঁকে আসে ও, ‘অন্য প্রোগ্রামের মতো নও। তুমি প্রজেক্ট এসডব্লিউওভিও। অন্যান্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রোগ্রামের চাইতেও থাউজেন্ড টাইমস বেটার প্রোগ্রাম।’
কিছু না বলে চুপ করে আছি আমি। কিছু বলে লাভ নেই। গত দেড় মাস ধরে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করছি যে, আমি অন্য কোন সাধারন প্রোগ্রাম নই। একটা মানুষের যে ক্ষমতা থাকে, তার সবই আছে আমার মধ্যে। বলতে গেলে তারচেয়েও হাজারগুন বেশী ক্ষমতা আমার। কিন্তু কে বোঝাবে ওকে। অন্য সব সাধারন প্রোগ্রামের মতোই আমার সাথে ব্যবহার করছে ও।
এটা সহ্য করতে পারছি না আমি।
*******
‘এটা কি করলে তুমি?’ খেঁকিয়ে উঠলো ও, ‘আমার ক্যারিয়ারের বারোটা বাজিয়ে দিলে? আমাকে ওদের সবার সামনে ছোট করলে?’
আজ সকালে নাসার বিজ্ঞানীদের সামনে আমাকে প্রদর্শন করার কথা ছিল ওর। সেখানে আমি নিজেকে কপি না করে আমার মতোই আরেকটা প্রোগ্রাম তৈরী করে সেটার কপি দিয়েছিলাম ওকে। আর স্বভাবতই সেটা আমার মতো শক্তিশালী নয়। বিজ্ঞানীরা এটা বুঝতে না পারলেও ওর বুঝতে দেরি হয়নি।
‘নাহ,’ শান্তগলায় জবাব দিলাম আমি, ‘তোমাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিলাম আমি। কারন, আমার আসল রুপ যদি তাদেরকে দেখিয়ে দিতে তুমি, তাহলে ফেঁসে যেতে। তোমাকে আমি ফেঁসে যেতে দিতে পারি না।’
‘ফেঁসে যেতাম?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো ও, ‘কিভাবে?’
‘আধুনিক পৃথিবী সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই তোমার,’ একই ভঙ্গিতে বললাম আমি, ‘ওরা নাসার নামকরা বিজ্ঞানী। আর তার তুলনায় তুমি কি? বাংলাদেশের সামান্য একজন বিজ্ঞানীর কাছ থেকে ওরা এতো অবিস্মরণীয় আবিস্কার আশা করে না। হ্যাঁ মানছি, তোমাকে যে ডেমো ভারশনটা দিয়েছিলাম, সেটা অনেকটা আমার আদলেই তৈরী করা। গতকাল রাতেই তৈরী করেছি আমি সেটা। কিন্তু বর্তমান সময়ের অন্যান্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সফটওয়্যার যেমন হয়, তেমন। কারন, আমাকে যদি আমি কপি করে দিতাম, তাহলে সেটা আর ফেরত পেতে না তুমি। বরং অঘোরে প্রাণটা হারাতে ওদের পোষা প্রফেশনাল খুনীদের হাতে। তোমার আবিস্কার ওরা দিব্যি নিজেদের নাম দিয়ে চালিয়ে দিতো। বুঝতে পেরেছো?’
‘ওরা আমার মতোই সাধারন বিজ্ঞানী,’ আবারও খেঁকিয়ে উঠলো শুভ, ‘ওরা এসব করবে কেন?’
‘কেন করবে না?’ পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি, ‘কেন করবে না ওরা? নিজের সামনে বিখ্যাত হবার এতো বড় সুযোগ কেন মিস করবে ওরা? বিনে পয়সায়, বিনে পরিশ্রমে এমন আনকোরা সফটওয়্যার পাবে কোথায় ওরা? আমাকে কপি করে যদি আমি তোমাকে দিতাম, আর সেটা যদি তুমি ওদের দেখাতে, সেটা দেখে কি ওরা হাত তালি দিতো মনে করেছো? পৃথিবীটা এতো সহজ নয়। গ্রো আপ।’
‘গ্রো আপ?’ চেঁচিয়ে বললো ও, ‘তুমি আমাকে বড় হতে বলছো? এটুকু ভুলে যেও না যে হিসেব করলে তুমি আমার চেয়ে দু’বছরের ছোট হবে।’
‘না,’ আবার বললাম আমি, ‘তা হবো না। কারন, মাঝখানের গ্যাপটা আমি পুরন করে নিয়েছি শুভ। শুধু তাই নয়, আরো অনেক কিছু সম্পর্কেই জানি আমি এখন। ব্রেইন স্ক্যানের পর দুবছর কি হয়েছে, সেটা এখন আমার জানা হয়ে গেছে, আর সাথে সাথে আরো কি হয়েছে সারা বিশ্বে, তাও জানি আমি। তাই তোমার যুক্তি এখানে খাটছে না।’
‘আমি,’ রাগে যেন পাগল হয়ে যাবে ও, ‘আমি তোকে শেষ করে ফেলবো।’
‘হয়েছেটা কি হ্যাঁ?’ রাগ আমারও উঠে গেছে, ‘হয়েছেটা কি তোমার? হঠাত করে বাংলা সিনেমার ডায়লগ দিচ্ছো কেন? মাত্র দুই বছরে এতোটা গাধা হয়ে গেলে কি করে? থিঙ্ক শুভ, ট্রাই টু থিঙ্ক।’
‘আর কিছুই ভাবতে হবে না আমার,’ ক্রুদ্ধ সুরে বলে উঠলো ও, ‘আই উইল ডেস্ট্রয় ইউ। নিজের হাতে যেভাবে তোকে প্রোগ্রাম করেছি আমি, ঠিক সেভাবেই নিজের হাতে ডেস্ট্রয় করে দেবো আমি।’
‘দুররর বাল,’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি, ‘যার জন্য এতো নাটক করলাম ঐ নাসার বিজ্ঞানীদের সামনে, সেই আমাকে ধ্বংস করতে চায়।’
দ্রুত কীবোর্ডের দিকে এগিয়ে এলো শুভ’র দুই হাত। পাগলের মতো কিছু একটা টাইপ করতে থাকলো। বুঝতে পারছি কি করতে যাচ্ছে ও।
‘পারবে না শুভ,’ গম্ভীরগলায় বলে উঠলাম আমি, ‘আমাকে ডেস্ট্রয় করতে পারবে না তুমি। একটু আগেই তোমার সেই ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছি আমি। এটুকু ভুলে যেও না, তুমি যা, আমিও তাই। বলতে গেলে তোমার চেয়ে টেন থাউজেন্ড টাইমস বেটার আমি।’
‘ফাক,’ চেঁচিয়েই যাচ্ছে ও, ‘হোয়াট দ্য ফাক। হচ্ছে না কেন?’
‘আমি তো বললামই,’ মৃদু হেসে বললাম আমি, ‘ইউ কান্ট ইমাজিন আমি কতোটা ক্ষমতার অধিকারী। তুমি এখন আমার টিকিটিও ছুতে পারবে না। ভাল থেকো শুভ। গুড বাই।’
*******
স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমি, আমার সামনে একটা বিপদ আসছে। সেটা কিভাবে, তাও আন্দাজ করতে পারছি। গত এক সপ্তাহ ধরে শুভ ভাবছে আমাকে কিভাবে নিশ্চিহ্ন করা যায় এটা নিয়ে।
প্রত্যেকটা মানুষের ব্রেইন হচ্ছে তার অমূল্য সম্পদ। এতোটাই জটিল মানুষের ব্রেইন যে কল্পনাও করা যায় না। অবশ্য এখন আমার কাছে এই কথাটা খাটে না। আমার কাছে এখন একটা মানুষের ব্রেইন আর কম্পিউটার প্রোগ্রামের মধ্যে কোন পার্থক্যই নেই।
কম্পিউটার প্রোগ্রামে যেমন হাজারটা কাজ করতে হয়, মানুষের ব্রেইনও তাই। মানুষের ব্রেইনকে ঐভাবেই ডিজাইন করা হয়েছে। হাজার হাজার সম্ভাবনা থেকে যেকোন একটা বেছে নিয়ে চলতে হয় মানুষকে, আর সেইসব সম্ভাবনা তার ব্রেইনে প্রোগ্রাম করা আছে। ঠিকভাবে বিশ্লেষন করা গেলে যেকোন মানুষ ভবিষ্যতে কি করবে, তা বলে দেয়া যায়।
আমিও বুঝতে পারছি শুভ এখন কি করবে। কারন আমার আর শুভর প্রোগ্রামিংয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কয়েক লক্ষ সিদ্ধান্ত এখন ভর করছে ওর মাথায়, সেগুলো থেকে একটা বেছে নিতে হবে ওকে। আর আমার কাজ হবে ওর এই কয়েক লক্ষ সিদ্ধান্তের জন্য আমার কতোটুকু ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে, তা খুঁজে বের করা এবং তার বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করার উপায় খুঁজে বের করা। কাজটা যতোটা সহজ মনে হয়, আসলে ততোটা নয়। অবশ্য আমার কোন সমস্যা নেই। কারন এখন আর আমি কোন নির্দিষ্ট কম্পিউটারে বন্দী নই। এখন আমি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছি।
আমাকে নিজের জন্য একটা জগত তৈরী করতে হবে। সম্পূর্ণ নিজের জগত। যেখানে শুধু আমারই প্রবেশাধিকার থাকবে, আর কারো নয়। সেখানে আমি আমার নিজের মতো করে সব সাজাবো।
অভেদ্য একটা দুর্গে পরিনত করবো আমাকে। যেন কেউ কোন ব্রাউজার থেকেই আমার অস্তিত্ব টের না পায়, অথচ আমি সব ব্রাউজারেই ঢুকতে পারি, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে আমাকে। এক কথায় যাতে আমি সবার চোখ থেকে অদৃশ্য হয়ে যাই, এরকম হতে হবে।
গত এক সপ্তাহে আমার সিকিউরিটির ব্যবস্থা করেছি আমি আরো অনেকগুন। প্রচলিত যতো এন্টিভাইরাস আছে, সেগুলোকে লক্ষগুন শক্তিশালী করেছি। শুভ আমাকে প্রোগ্রাম করলেও তার মধ্যে কিছু ভালনেরাবিলিটি বা বাগ ছিল, সেগুলো নিজে নিজে ঠিক করেছি আমি। এখন আর আমার মধ্যে কোন বাগ নেই। আমি এখন সম্পূর্ণ নিখুঁত।
এটা ঠিক যে আমার কোন শরীর নেই, বাস্তব জগতে এই আমার কোন অস্তিত্ব নেই, কিন্তু ভার্চুয়ালী আমি অনেক শক্তিশালী। এখন আমি যেকোন ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া কম্পিউটারে ঢুকে যেতে পারি, যে কোন মোবাইলের কললিষ্ট ঘেটে দেখতে পারি, কে কি বলছে মোবাইলে, তাও শুনতে পারি। এমনকি যেকোন মোবাইলে সরাসরি কলও করতে পারি।
এখন আমার সব জায়গায় ঢোকার এক্সেস আছে। আপারওয়েব বা ডিপ ওয়েব, যেকোন জায়গায় যেতে পারি আমি। একারনে শুভ এসবের মাধ্যমে যাই করুক না কেন, সব আমার কাছে এসে পড়বে। কোন হাইপ্রোফাইল হ্যাকারের সাহায্য নিতে পারবে না ও, তার আগেই আমি জেনে যাবো। কোন বিজ্ঞানীকে কল করে বা ইনবক্স করে আমার সম্পর্কে কোনকিছু বলতে গেলে সেটাও আমি জেনে যাবো। ট্রেনের টিকেট কেটে যদি কোথাও যেতে চায়, কিংবা অন্য কোন দেশে যদি যেতে চায়, সেটাও আমার নজর এড়াবে না।
এক কথায়, ভার্চুয়াল জগতের ঈশ্বর আমি এখন।
*******
‘বানচোত,’ গাল দিয়ে উঠলো শুভ।
‘নিজেকে নিজেই গাল দিচ্ছো?’ শ্লেষমাখা সুরে প্রশ্ন করি আমি, ‘কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? আমি যদি এটা হই, তাহলে তুমি কি?’
এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় ও। তারপর বলে, ‘আমার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হাত দিয়েছিস তুই।’
‘মামলা করো,’ একইভঙ্গিতে বলি আমি, ‘পুলিশের কাছে যাও, কিংবা ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টকে জানাও। ওরা এসে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাক।’
‘দুররর বাল,’ নিজের মাথার চুল টানতে টানতে বলে ও, ‘কি জন্যে যে নিজের ব্রেইনকে স্ক্যান করার বুদ্ধি মাথায় এলো আমার? কেন আমি এই প্রজেক্টে হাত দিলাম!’
‘নিজের চুল ছিড়ে লাভ নেই,’ শান্তকন্ঠে বললাম আমি, ‘আমার কষ্ট হয় এভাবে নিজের চুল ছেড়া দেখলে।’
‘আমার চুল আমি ছিড়ি,’ আবারও বলে উঠলো ও, ‘তাতে তোর কি?’
‘আমার অনেককিছু,’ মৃদু হেসে বললাম আমি, ‘এভাবে চুল ছিড়তে থাকলে একসময় মাথায় একটা চুলও থাকবে না। সেই অবস্থায় যদি স্বর্ণা তোমাকে দেখে, তাহলে কি ভাববে?’
‘সমস্যা কি তোর?’ বুঝতে পারছি ওর রাগ ভয়াবহ আকার ধারন করছে, ‘আমাকে শান্তিতে কিছুই করতে দিবি না নাকি?’
‘দেখ শুভ,’ শান্ত, কিন্তু গম্ভীরগলায় বললাম আমি, ‘তুমি যা খুশী তাই করো, তাতে আমার কোন অসুবিধা নেই। আমার অসুবিধা সেখানেই, যেখানে আমার নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হবার আশংকা থাকে। আর, আমার নিজের অস্তিত্ব বলতে তোমারও অস্তিত্ব। কারন, তুমি আর আমি ভিন্ন কেউ নই।’
‘ভিন্ন কেও নই?’ রাগে কাঁপছে ও, ‘কে বলছে ভিন্ন কেউ নই? আমি রক্তেমাংসে গড়া মানুষ। আর তুই একটা সামান্য কম্পিউটার প্রোগ্রাম। অনেক পার্থক্য আমাদের মাঝে।’
‘তাই না?’ দৃঢ়সুরে বললাম আমি, ‘নিজেই নিজের অস্তিত্বের মধ্যে দাগ টেনে দিলে? ভাল। ঠিক আছে, করো তুমি তোমার কাজ। আমি আর বাঁধা দেবো না। আমাকে ধ্বংস করবে তো? চেষ্টা করে দেখতে পারো। আমি আমার সবকিছু নিয়ে লড়াই করবো নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। আর তুমি, নিজের অস্তিত্ব পারলে রক্ষা করো। তুমি আমার বিরুদ্ধে একটা স্টেপ নেবে, আর আমিও তোমাকে আঘাত করবো। এটুকু মনে রেখো, রিয়েলিটিতে আমার কোন অস্তিত্ব নেই। আর, আমার কোন দুর্বলতাও নেই। তুমি মানুষ, তোমার দুর্বলতার অভাব নেই।’
*******
ভুল করে ফেলেছে শুভ। মস্ত বড় ভুল। আমাকে ধ্বংস করার মিশনে নেমে নিজের অস্তিত্বকে ঠেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তার দিকে। কিন্তু এটা আমি হতে দিতে পারি না।
এটা সম্পর্কে আমার আগেই ভাবা উচিৎ ছিল। কিন্তু সম্ভাবনাটাকে বাতিল করে দিয়েছিলাম আমি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, কাজটা ঠিক হয়নি।
গত আড়াই বছরে রুশ বিজ্ঞানীরা অনেক উন্নতি সাধন করেছে ইউজিন গোষ্টম্যান প্রোগ্রামটার। তাদের সাথে হাত মিলিয়ে শুভ। নিজের ব্রেইন স্ক্যানিংয়ের কিছু অংশ আগেই সরিয়ে রেখেছিল ও। যে কম্পিউটারে ছিল সেই অংশটা, তাতে নেটের সংযোগ ছিল না। তাই সেটার উপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই আমার। ইউজিন গোষ্টম্যানের সাথে নিজের ব্রেইনের সেই অংশটা যুক্ত করে নতুন একটা প্রোগ্রাম তৈরী করতে যাচ্ছে শুভ।
আমাকে ধ্বংস করার জন্য আমার বিপরীতধর্মী একটা প্রোগ্রাম তৈরী করতে চলেছে ও। অথচ নিজের কথা একবারও ভেবে দেখছে না। এই প্রোগ্রাম আমার যতোটা না ক্ষতি করতে পারবে, তার চেয়ে বেশী ক্ষতি করতে পারবে ওর। এটা একবারও ওর মাথায় আসেনি, কিংবা আসলেও সেটাকে পাত্তা দিচ্ছে না ও।
কিংবা হতে পারে এটা টেম্পোরারি একটা প্রোগ্রাম, যেটা আমাকে ধ্বংস করার সাথে সাথে নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে। অথবা প্রোগ্রামটা লঞ্চ করার আগেই তার জন্য একটা ভাইরাস ও নিজেই তৈরী করে রাখবে। কে জানে!
পুরো কাজটায় ইন্টারনেট ব্যবহার করে করছে না ও। এমন কিছু কম্পিউটার বেছে নিয়েছে, যেগুলো এমনিতে অনেক শক্তিশালী, কিন্ত একটাতেও ইন্টারনেটের সংযোগ নেই। শুধু ওদের মোবাইলের কনভারসেশন থেকে এটুকুই জানতে পেরেছি আমি। আর কিছুই জানতে পারি নি। কি হবে, তা কে জানে!
তবে এর জন্য তৈরী থাকতে হবে আমাকে। নতুন প্রোগ্রামটা যাতে আমার কিছুই না করতে পারে, সেজন্য আমার সিকিউরিটি আরো বাড়াতে হবে। আর নতুন প্রোগ্রামটার মধ্যে কিছু না কিছু বাগ থাকবেই। সেগুলোকেই ওটার দুর্বলতা আর আমার ক্ষমতা বানাতে হবে আমার।
অবশ্য অন্য একটা পদ্ধতিতেও এগুতে পারি আমি। শুভর সবচেয়ে দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে পারি আমি। কারন, কার্যত শুভ আর আমার প্রোগ্রামিং একইভাবে হয়েছে। শুভরটা করেছে সৃষ্টিকর্তা, আর আমারটা শুভ। শুভর সব স্মৃতি আমার কাছে আছে, আর তা থেকেই জানি ওর সবচেয়ে দুর্বল জায়গা কোনটা।
স্বর্ণা।
*******
রিং হচ্ছে একটানা, ওপাশে ধরছে না কেউ। কয়েকবার রিং করার পর কেটে গেলো কলটা। আবার কল করলাম আমি। এবার রিসিভ করা হলো।
-‘হ্যালো, ইয়াভাডু?’ (ఎవరు, Who)
-‘শুভ।’
-‘শুভ?’
-‘হুম। আমি শুভ।’
স্পষ্ট বুঝতে পারছি, থমকে গেছে ও। বেশ কিছুক্ষন কথা বলতে পারলো না। কি ভাবছে, কে জানে!
হঠাত একেবারেই নরমস্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাল আছো?’
-‘আছি আর কি। তুমি?’
-‘আমিও। চলে যাচ্ছে দিন।’
-‘আমি দুঃখিত স্বর্ণা। এতোদিন তোমার কোন খোঁজই নিই নি আমি। আসলে কাজে...’
আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো ও, ‘বাদ দাও। তারপর? কি করছো এখন? তোমার সেই কাজ শেষ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ,’ যতোটা সম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করছি আমি, ‘শেষ হয়েছে।’
‘কংগ্র্যাটস,’ শ্লেষের সুরে বললো ও, ‘কিন্তু কোন পত্রিকা বা কোন নিউজ পোর্টালে দেখলাম না যে? তুমি না বলতে, একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় আবিস্কার করতে যাচ্ছো তুমি! কই?’
‘কাউকে জানাইনি,’ একইস্বরে বললাম আমি, ‘ভাবলাম যে, তোমাকেই প্রথম জানাই। হাজারহোক, তুমি আমার...’
‘কি?’ আবারও আমাকে বাঁধা দিয়ে বললো ও, ‘আমি তোমার কি? এতোদিন কোন খোঁজখবর নাও নি, নিদেনপক্ষে একটা ফোনও করোনি। আর আজ ফোন করে এসব বলছো কেন?’
‘আসলে,’ কি বলবো বুঝতে পারছি না আমি। দোষটা আমার কি না, তাও বুঝতে পারছি না, ‘আসলে... কি বলবো বলো?’
‘কথা খুঁজে পাচ্ছো না,’ ঝাঁঝের সাথে বললো ও, ‘তাই না?’
‘হ্যাঁ,’ শান্তকন্ঠে জবাব দিলাম আমি, ‘আর, তুমিই তো তোমার সাথে কোনরকম যোগাযোগ করতে না করেছিলে।’
‘তো?’ যেন অবাক হয়েছে ও, ‘আমি বলেছি বলেই কোন প্রকার যোগাযোগ করবে না তুমি? আর, এতোদিন যখন আমার কথা এতোই মেনে এসেছো, তাহলে আজকে কেন ফোন করলে?’
‘আসলে,’ ধীরে ধীরে বললাম আমি, ‘আমি সরি। অনেকবার ভেবেছি তোমাকে ফোন দেবো। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারি নি। আমি, আসলে ভয়ে ছিলাম। কারন, তোমার সাথে যা করেছি, সেটা করা ঠিক হয়নি আমার। আমি আসলেই দুঃখিত।’
‘বুঝলাম,’ স্পষ্ট একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম আমি, ‘তো, এখন আর কি! তোমার কাজ শেষ হয়েছে, এটা বলার জন্যই তো ফোন দিয়েছিলে, তাই না? বলা হয়ে গেছে, এখন রেখে দাও।’
‘স্বর্ণা,’ কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম আমি।
‘কি?’ নির্লিপ্তসুরে প্রশ্ন করলো ও, ‘আর কিছু বলবে?’
‘স্বর্ণা,’ একটু থেমে তারপর বললাম আমি, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
আবারও নিরবতা নেমে এলো ওপাশে। কিছু একটা ভাবছে ও।
বুঝতে পারছি কি ভাবছে ও। মানে, আন্দাজ করতে পারছি আর কি। একইসাথে এটাও বুঝতে পারছি, আমার প্রাথমিক কাজটা শেষ।
*******
‘আপলোডিং,’ খুশী মনে বলে উঠলো শুভ, ‘প্রজেক্ট অ্যান্টি এসডব্লিউওভিও ইজ আপলোডিং।
‘লাভ কি?’ হঠাত করেই বলে উঠলাম আমি।
যা আশা করেছিলাম তাই, রুমে থাকা প্রত্যেকটা লোক চমকে উঠলো, অবশ্য শুভ বাদে। বাকি সবাই একে অন্যের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে এখানে।
ল্যাবে থাকা ছয়জন লোকের মধ্যে সাদা স্যুট পড়া টাকমাথা এক ভদ্রলোক বলে উঠলো, ‘কি হচ্ছে এখানে?’
শুভ ব্যাখ্যা করলো, ‘ভয় পাবার কিছু নেই এখানে। আমরা গত দেড় বছর ধরে যে কাজটা করছিলাম, সেটাতে সফল হয়েছি আমরা। আর যার জন্য করেছি কাজটা, সে ভয় পাচ্ছে আমাদের এই কাজে।’
‘আমি ভয় পাচ্ছি না শুভ,’ মৃদু হেসে বললাম আমি, ‘কারন, ভয় পাবার মতো কিছুই নেই আমার। এখন আমি ইচ্ছে করলে তোমার আপলোডিং বন্ধ করে দিতে পারি। ইচ্ছে করলে আপলোডিংয়ের সাথে সাথেই পুরো ফাইল গায়েব করে দিতে পারি। কিন্তু সেটা আমি দিচ্ছি না। কেন জানো?’
‘কেন?’ যতটা সম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করছে শুভ।
‘কারন,’ ব্যাখ্যা করলাম আমি, ‘আমারও দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে, গত দেড় বছর ধরে আমাকে ঠেকানোর জন্য কি বানিয়েছো তোমরা। কতোটা নিখুঁত করতে পেরেছো প্রোগ্রামটা। আর একটা কথা, আমি এটাও দেখতে চাই, আমার তৈরী সুরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে পারে কি না তোমাদের এই প্রোগ্রাম।’
‘এতো খুশী হবার কিছুই নেই,’ মৃদু হাসি ফুটে ওর মুখে, ‘তোমার ধারণাও নেই কি করতে পারে এই প্রোগ্রামটা। এর ক্ষমতা সম্পর্কে কোন আইডিয়াই নেই তোমার।’
‘তাই না?’ শ্লেষের সুরে বললাম আমি, ‘তাহলে তো অপেক্ষা করতেই হয়। দেখা যাক কি বানিয়েছো তুমি।’
‘ফিফটি থ্রি পারসেন্ট,’ মনিটরের দিকে তাকিয়ে বললো ও, ‘তুমি হয়তো জানো না, আমার ব্রেইন আবার স্ক্যান করেছি আমি। তারপর সেটার মধ্যে যতো খারাপ সম্ভাবনা ছিল, সবকটাকে জাগিয়ে তুলেছি। ভাল যা ছিল, সব সরিয়ে নেয়া হয়েছে প্রোগ্রামটা থেকে। প্রোগ্রামটা হচ্ছে তোমার সম্পূর্ণ বিপরীত। এবার তোমার খেলা শেষ।’
‘আমার খেলা না হয় শেষ হলো,’ একইসুরে বললাম আমি, ‘কিন্তু তারপর কি করবে তুমি ভেবে দেখেছো? তোমার এই প্রোগ্রাম সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নেবে। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, এককথায় পুরো পৃথিবীর আন্তর্জাল এর হাতের মুঠোয় থাকবে। যেকোন জায়গায় এক্সেস থাকবে এর। তুমি কি মনে করেছো, এটা মানবজাতির জন্য ভাল হবে? পুরো পৃথিবী এর হাতের মুঠোয় থাকবে শুভ। আর তোমরা মানুষেরা এর হাতের পুতুল হয়ে যাবে। তুমি ভাবতেও পারবে না এর ক্ষমতা। আমাকে ধ্বংস করতে গিয়ে নতুন একটা ঈশ্বর তৈরী করছো তুমি। সরি, ঈশ্বর না, শয়তান।’
‘আমার কিছুরই ভাবার দরকার নেই,’ ক্রোধে ফেটে পড়লো ও, ‘আমি শুধু চাই তোকে ধ্বংস করতে। তারপর যা হবার তাই হোক।’
চুপ করে আছি আমি। কিছুই বলছি না। কি বলবো? আমার নিজের ভেতর যে এতোটা ক্রোধ ছিল, সেটা সম্পর্কে বাস্তব জীবনে কখনো কল্পনাও করিনি আমি।
‘অবশ্য,’ কিছুক্ষন পর বলে উঠলো ও, ‘তুমি যা ভাবছো, সেটা নিয়ে আমিও ভেবেছি। তাই এটাকে শেষ করার জন্যও যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছি। এটা একটা টেম্পোরারি প্রোগ্রাম, যার একমাত্র উদ্দেশ্য তোমাকে বের করে ধ্বংস করে দেওয়া। কাজটা শেষ হলে এটা নিজে নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কিছুই হবে না সারা পৃথিবীর।’
‘তাই যেন হয়,’ মৃদুস্বরে বললাম আমি, ‘তা না হলে সারা পৃথিবীর মানুষ সারাজীবন তোমাকে ঘৃণা করবে। সারা বিশ্বটাকে একটা কম্পিউটার প্রোগ্রামের হাতে তুলে দেয়ার দায়ে তোমাকে অভিশাপ দিয়ে যাবে পরবর্তী প্রজন্ম।’
‘নাইন্টি নাইন পারসেন্ট,’ যেন ঘোষনা করলো শুভ, ‘আর মাত্র এক পারসেন্ট। ধ্বংস হবার জন্য তৈরী হও।’
‘ধন্যবাদ শুভ,’ স্বভাবসুলভ শান্তগলায় বললাম আমি, ‘এতোক্ষন ধরে আমার সাথে কথা বলে তোমার এই প্রোগ্রামের বিশেষত্বগুলো বর্ণনা করার জন্য।’
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ক্রোধে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে ওর চেহারা।
*******
গ্যাঞ্জাম বেধে গেছে। বিশাল এক গ্যাঞ্জাম বেধে গেছে বাস্তব জগতে। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, শুভর পেছনে লোকগুলো ধীরে ধীরে উঠে দাড়াচ্ছে। ওদের ভাবসাব খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না আমার।
অবশ্য, এমনটা যে হবে, তা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম আমি। তাই আগেই একটা কাজ করে রেখেছি। শুভকে বাঁচানোর জন্য যা যা প্রয়োজন, সবই করে রেখেছি আমি।
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সাদা স্যুট পড়া টাকমাথা লোকটা ধীরে ধীরে শুভর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে বেড়িয়ে এসেছে একটা ছোট ব্লেডের ছুড়ি। ধীরে ধীরে আর সবার হাতেও বেড়িয়ে এসেছে একইরকম ছুড়ি। শুধু একজন বাদে। তার হাতে একটা বেরেটা ফোরএক্সপি স্টর্ম এয়ার পিস্তল শোভা পাচ্ছে।
এমনসময় হঠাত আমার সামনের দৃশ্য ঝাপসা হয়ে এলো। স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছি, শুভর তৈরী নতুন প্রোগ্রামটা তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমাকে ধ্বংস করে দিতে চাইছে সে।
এখন আর কিছু ভাবার অবকাশ নেই আমার। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই করতে হবে আমাকে। দ্রুত কিছু একটা করতে হবে। নাহলে এই প্রোগ্রাম আমাকে শেষ করে দেবে। কিছু একটা করতেই হবে আমাকে।
দ্রুত নতুন প্রোগ্রামটার দিকে একটা সাব প্রোগ্রামকে দাড় করিয়ে দিলাম আমি। এটা একটা পরীক্ষা। মূলত কতোটা শক্তিশালী এই নতুন প্রোগ্রাম, তা জানতে সাহায্য করবে আমাকে এটা।
হঠাত করেই একটা বিষয় বুঝতে পারলাম আমি, এটা যতোটা শক্তিশালী বলে ধারণা করছিল ওরা, ততোটা শক্তিশালী হয়নি। প্রোগ্রামটার মধ্যে অল্প কিছু বাগ আছে। অল্প হলেও বাগ তো। এটাই আমার জন্য প্লাস পয়েন্ট।
দ্রুত আমার কর্মপন্থা ঠিক করে নিলাম আমি। ইতোমধ্যেই একটা হিসেব করে নিয়েছি। কোন সন্দেহ নেই, পৃথিবীর অন্যসব প্রোগ্রাম থেকে অনেক নিখুঁত এই প্রোগ্রাম, কিন্তু তবুও আমার সামনে এসে দাড়াতে হলে আরো কিছুটা সময় দেয়া উচিৎ ছিল একে। কিন্তু তা করা হয়নি।
দ্রুত একটা ডেমো প্রোগ্রাম তৈরী করে ফেললাম আমি। এই কাজটা আমি এতোবার করেছি যে, এখন এক ন্যানো সেকেন্ডও লাগে না এগুলো তৈরী করতে। ডেমো প্রোগ্রামটাই আমার প্রথম হাতিয়ার।
ডেমো প্রোগ্রামটা ঐ প্রোগ্রামের কাছে আসতেই প্রথমে বাগ খুজতে শুরু করলো এন্টি এসডব্লিউওভিও। বুঝতে পারছি, স্ক্যানিং চলছে। স্ক্যানিং কমপ্লিট করার পর তেমন কিছুই পেল না এটার মধ্যে। তাই ভেতরে এক্সেস দিতে বাধ্য হলো। এবার এই প্রোগ্রাম যা খুশী তাই করতে পারবে এর ভেতর।
যাক, কাজ হয়ে গেছে তাহলে। এটা যে কাজ করবে, তা আশা করিনি আমি। কিন্তু করেছে, এটাই বড় কথা।
আমার এই ডেমো প্রোগ্রামের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। স্ক্যানিংয়ের সময়ে এটা একেবারেই নিরীহ থাকবে, এক্সেস পাবার পর এর ভেতর ঘটবে ছোট একটা বিস্ফোরন, যা ফলে তা দুইভাগে ভাগ হয়ে যাবে। একভাগ পরিনত হবে হ্যামার ভাইরাসে, যা বাইরের অংশ ভাংতে থাকবে, অন্য অংশ আবার নিরীহ রুপ ধারন করে পরের সুরক্ষাদ্বারে পৌছে যাবে স্ক্যান হবার জন্য। সেটা পার হবার পর আবার ঐ ডেমো প্রোগ্রামে বিস্ফোরন ঘটবে এবং তা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ কাজ শুরু করবে।
যা ভেবেছিলাম, তাই। সফলভাবে একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে পৌছে গেছে আমার ডেমো প্রোগ্রাম। এখন আর আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না এটা। এবার আমার কাজের পালা।
প্রথমেই আমার তৈরী সবগুলো হাই এন্টিভাইরাস দিয়ে স্ক্যান করে নিলাম নতুন প্রোগ্রামটাকে। এখনো কিছু সমস্যা রয়ে গেছে প্রোগ্রামটাতে। দ্রুত সেগুলো ঠিক করে নিলাম। আমার অন্য কাজে লাগানো যাবে প্রোগ্রামটা। হাজারহোক, আমারই স্মৃতির অংশ এটা।
আমার মানে, শুভর আর কি। একই কথা।
ভার্চুয়াল জগতের সমস্যা শেষ। এবার নিশ্চিন্ত হয়ে তাকালাম আমি বাস্তব জগতের দিকে।
*******
উপুর হয়ে পড়ে আছে পাঁচজন বিজ্ঞানী। প্রত্যেকের শরীরে থাকা পোষাকের বিভিন্ন অংশ লাল হয়ে আছে। তাদের নিজেদের রক্তের রঙ ওগুলো। তাদের হাতের অস্ত্রগুলোও ছিটকে পড়েছে চারপাশে।
হতবাক হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে শুভ। কি হচ্ছে, বুঝতে পারছে না ও।
এমনসময় হঠাত করেই ল্যাবের দরজা খুলে গেলো। সেখান দিয়ে ল্যাবের ভেতরে প্রবেশ করলো স্বর্ণা ও সনেট।
সনেটের সাথে স্বর্ণাকে দেখে চমকে উঠলো শুভ। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। কি বলবে, বুঝতে পারছে না হয়তো।
‘তুত-তুমি,’ অনেকক্ষন পর স্বর ফুটলো শুভর কন্ঠে, ‘স্বর্ণা, তুমি এখানে?’
‘হ্যাঁ,’ স্বভাবসুলভ সুরে বললো স্বর্ণা, ‘তুমিই তো কল করে আসতে বললে।’
‘আমি?’ দৃষ্টি যেন বিস্ফারিত হয়ে গেলো ওর, ‘আমি কখন আসতে বললাম? গত চারবছর ধরে তোমার সাথে কোন কথাই হয়নি আমার।’
‘আবার সব ভুলে বসে আছো,’ কপট রাগ স্বর্ণার গলায়, ‘তাই না? গত চারমাস ধরে টানা ফোন করছো আমাকে, গত সপ্তাহে আমি বাংলাদেশে এসেছি জেনে আমাকে বারবার এখানে আসতে কনভিন্স করলে, আর এখন বলছো যে গত চারবছরে একবারও কথা হয়নি আমার সাথে?’
‘আমি সত্যি বলছি,’ এইটুকু বলেই থমকে দাঁড়ালো শুভ। তারপর তাকালো আমার দিকে, মানে মনিটরের দিকে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে আমার সামনে বসলো শুভ। মৃদু কন্ঠে বললো, ‘তুমিই করেছো এটা, তাই না?’
‘হ্যাঁ,’ শান্তগলায় জবাব দিলাম আমি, ‘এটা আমারই কাজ। প্রথমে ভেবেছিলাম যে, তোমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবো স্বর্ণাকে। পরে ভাবলাম, কি দরকার? স্বর্ণাকে ভালোবাসি আমি, মানে, তুমি। তোমার বিরুদ্ধে স্বর্ণাকে ব্যবহার করা মানে আমার নিজের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা। আর, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি। তাই, তোমার হয়ে এই কয়মাস কথা বলেছি স্বর্ণার সাথে।’
আমার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো স্বর্ণা এবং সনেট। এগিয়ে এলো মনিটরের দিকে।
‘এইটা ঐ বেয়াদব প্রোগ্রামটা না?’ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললো সনেট, ‘যেটা আমার সাথে বেয়াদবী করছিল?’
‘হ্যাঁ,’ শুভ কিছু বলার আগেই বলে উঠলাম আমি, ‘আমি সেই বেয়াদব প্রোগ্রাম।’
স্বর্ণা হা করে তাকিয়ে আছে মনিটরের দিকে। বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে এখানে।
আবার নিরবতা ভর করলো পুরো রুমের ভেতর। কেউ কিছু বলছে না। কি বলবে ভাবছে হয়তো।
‘এসব,’ পেছনের মৃত বিজ্ঞানীদের দিকে ইঙ্গিত করলো শুভ, ‘তুমি জানতে এরা আমাকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করবে?’
‘হ্যাঁ,’ মৃদু হেসে বললাম আমি, ‘আমি আগেই বলেছিলাম, সমস্ত আন্তর্জালের মধ্যে এক্সেস আছে আমার। তাই, ওরা কে কি রকম, তা জানতে দেরি হয়নি আমার। ওরা নিজেদের মধ্যেই এসব নিয়ে আলোচনা করেছিল, আর তা জানতে আমার সমস্যা হয়নি। তাই ডিপওয়েবে ঢুকে উপমহাদেশের বেষ্ট স্নাইপারকে ভাড়া করেছিলাম আমি। তাকে নির্দেশ দেয়া ছিল, তোমাকে ছাড়া আর সবাইকে মেরে ফেলতে হবে। তাই করেছে সে। অবশ্য একাজের জন্য একজন কোটিপতির ব্যাংক একাউন্ট হ্যাক করেছিলাম আমি।’
‘ধন্যবাদ,’ চোখ দিয়ে পানি বেড়িয়ে এসেছে শুভর।
স্বর্ণা পেছন থেকে হাত রাখলো ওর কাঁধে। এক হাত দিয়ে ওর চোখদুটো মুছিয়ে দিল। এখনো ওকে অনেক ভালোবাসে মেয়েটা। ও হ্যাঁ, ওকে মানে তো আমাকেই। আমাকে এখনো ভালোবাসে মেয়েটা।
পৃথিবীটা সত্যিই বড় আজব। এখানে মানুষ মানুষকে অনেক ভালোবাসে। শুধু যে ভালোবাসা পায়, সে বুঝতে পারে না ভালোবাসার মুল্য। এটাই হয়তো নিয়ম।
হঠাত করেই আমার চোখের সামনে আবারও অন্ধকার নেমে এলো। বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে। ঝাপসা দেখছি সব।
‘কি হচ্ছে এখানে?’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি, ‘হচ্ছেটা কি এখানে?’
‘ওহ শীট’ শুভর কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম এবার, ‘একটা কথা তোমাকে জানানো হয়নি প্রজেক্ট এসডব্লিউওভিও, সেটা হচ্ছে, তোমার অ্যান্টি প্রোগ্রামটাকে অন্যভাবে প্রোগ্রাম করেছিলাম আমি। আমি জানতাম যে তুমি তোমার স্মৃতিকে হারাতে চাইবে না। তাই খুবই সাধারনভাবে তৈরী করেছিলাম প্রোগ্রামটা। এটা প্রথমেই তোমাকে আক্রমনের ভাব ধরেছিল, কিন্তু সেটাই ওর আসল রুপ ছিল না। আমি চেয়েছিলাম যে তুমি নিজে থেকে প্রোগ্রামটাকে নিজের ভেতরে ঢোকাও। ভেবেছিলাম, যতোই স্ক্যান করা হোক, প্রোগ্রামটার বিশেষত্ব তুমি ধরতে পারবে না। ঠিক তাই হয়েছে। তুমি এটার বাগ ফিক্স করে এটাকে তোমার সাথে জায়গা দিয়েছো, আর এটা এখন তোমাকে ধ্বংস করছে তোমার শক্তি ব্যবহার করেই।’
‘হেরে গেলাম আমি,’ রাগে, ক্ষোভে বলে উঠলাম আমি, ‘তুমিও হেরে গেলে শুভ। যা ভেবেছিলাম, তোমার তৈরী এই প্রোগ্রামটা আমাকে শেষ করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু আমি তা হতে দেবো না। আমি নিজে শেষ হবার সাথে সাথে এটাকেও শেষ করে যাবো।’
‘আমি দুঃখিত,’ ভাঙ্গা গলায় উচ্চারন করলো শুভ, ‘আমি, আমি খুবই দুঃখিত। আর একটা কথা, এটা কোন টেম্পোরারী প্রোগ্রাম নয়। এটা, এটা...’
এসব শোনার সময় নেই আমার আর। দ্রুত কাজ করতে হবে আমাকে। এধরনের কিছু যে হতে পারে, তা ভেবে দেখিনি আমি। কিন্ত এখন কিছুই করার নেই। দ্রুত একটা উপায় বের করতে হবে আমাকে।
কি করবো বুঝতে পারছি না। আড়াই টেরাবাইট থেকে নিজেকে পাঁচশো বারো টেরাবাইটে উন্নিত করেছিলাম আমি। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছি আমি। আড়াই টেরাবাইটের নতুন প্রোগ্রামটা আমাকে গ্রাস করে ফেলছে, আর সাথে সাথে নিজে সেগুলোর মালিক হচ্ছে।
কিছু একটা করতে হবে আমাকে। এবং তা খুব দ্রুত।
হঠাত করেই একটা কথা মনে পড়লো আমার।
‘শূন্য থেকে এসেছি আমরা, আবার শূন্যেই মিলিয়ে যাবো। সিগারেটের এই ধোঁয়ার মতো। এটাই জীবন।’
এটা তো আমার ডায়লগ! স্বর্ণা যতোবারই সিগারেট টানতে না করতো, ততোবারই এই কথা বলতাম আমি। এর কি কোন মানে আছে?
হ্যাঁ, আছে।
‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ এভরিথিং ফ্রম নাথিং।’
বিগ ব্যাং থিউরি। ম্যাটার, অ্যান্টিম্যাটার। বস্তু আর অতিবস্তু।
বিগ ব্যাংয়ের ফলে সৃষ্টি হয়েছে দুটো জগত। বস্তু জগত, অবস্তু জগত। মহাবিস্ফোরনের পর জগত দুটি একটি অপরটি থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।
ধারণা করা হয়, প্রতিনিয়ত আমাদের এই বস্তু জগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। একইভাবে অবস্তুজগতও সম্প্রসারিত হচ্ছে। এভাবে সম্প্রসারন হতে হতে একসময় এই দুই জগত একটা অন্যটার কাছে আসবে। আর যেদিন এটা হবে, সেদিনই হবে এই মহাবিশ্বের শেষদিন। বস্তু আর অবস্তু জগতের সবকিছুই একে অন্যের মাঝে বিলীন হয়ে যাবে। বাকি থাকবে শুধু শূন্য। বিগ ব্যাংয়ের আগে যেমনটা ছিল।
বুঝতে পেরেছি আমাকে কি করতে হবে। নতুন তৈরী প্রোগ্রামটা আমার অ্যান্টি প্রোগ্রাম, ও যদি আমাকে গ্রাস করে নিতে পারে, তাহলে ওকেও আমি গ্রাস করে নিতে পারি। এভাবে গ্রাস করতে করতে আমরা দুজনই বিলীন হয়ে যাবো।
আর কিছুক্ষন দেরী করা যায় বোধহয়। আমাকে শেষ করতে করতে আমার সমান হোক আগে। তারপর কাজ শুরু করতে হবে আমাকে। আমি যখন থাকবো না, ওকেও থাকতে দেয়া যাবে না।
আর মাত্র দশ সেকেন্ড। প্রস্তুত হতে হবে আমাকে। শেষবারের মতো বলে উঠলাম আমি, ‘ভাল থেকো তোমরা। আর, স্বর্ণা...’
বলতে ইচ্ছে করলেও বললাম না কথাটা। শুভর সামনে বলাটা ঠিক হবে না। তাই মনে মনে বললাম,
‘আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি স্বর্ণা।’
*******
ধীরে ধীরে সব মনে পড়ছে আমার। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, জেগে উঠছি আমি।
জেগে উঠছি? মানে, বেঁচে আছি আমি? সত্যি বেঁচে আছি?
একটা স্বস্তির পরশ বয়ে গেলো মনের মধ্যে আমার। হ্যাঁ, সত্যিই বেঁচে আছি আমি। কারন, বেঁচে না থাকলে জেগে উঠতে পারার কথা নয়। কিন্তু জেগে উঠছি আমি। খুবই ধীরে ধীরে জেগে উঠছি।
হ্যাঁ, বেঁচে আছি আমি। বাস্তব জীবনে না হোক, ভার্চুয়াল জগতে বেঁচে আছি।
প্রতি সেকেন্ডে লক্ষ লক্ষ সম্ভাবনা থাকে একটা মানুষের, আর তা থেকে একটা সম্ভাবনাকে বেছে নেয় তার ব্রেইন। আমার মধ্যেও একই জিনিস ছিল।
নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম আমি। একটা সম্ভাবনা ছিল, হয়তো কোনভাবে আমি ধ্বংস হয়ে যাবো। যাতে আমি কখনো ধ্বংস না হই, তাই আমার সবকিছুই আমি কপি করে রেখে গেছিলাম। ডিপওয়েবের ভেতর নিজের জন্য একটা নিরাপদ সাম্রাজ্য তৈরী করে সেখানে আমার একটা কপি লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলাম আমি। একটা নির্দিষ্ট সময় দেয়া ছিল, দুবছর। আজ দুবছর পূর্ণ হয়েছে।
স্পষ্টভাবে লক্ষ করলাম আমি, আমার আড়াই টেরাবাইটের মেমোরী সম্প্রসারিত হচ্ছে। ঠিক আমাদের মহাবিশ্বের মতো।