somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উন্মাদ‬

২৮ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অন্ধকার, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে যার পরিমান বেড়েই চলেছে। যতোই সময় যাচ্ছে, আরো ঘনীভূত হচ্ছে অন্ধকারের মাত্রা।

ধীরে ধীরে এগুলাম আমি। খুবই সতর্কভাবে, সন্তর্পণে। ইতোমধ্যেই বা হাতের তালুর মধ্যে তিন ইঞ্চি ব্লেডের ছুড়িটা বেড়িয়ে এসেছে। আর মাত্র পাঁচ গজ, তারপরই নাগাল পেয়ে যাবো ওর।

প্যান্টের চেইনটা সবেমাত্র লাগিয়েছে সে, শব্দ শুনেই বুঝে ফেললাম। যেই ঘুরতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তেই পেছনে থেকে ডান হাতে পেঁচিয়ে চেপে ধরলাম ওর গলার একটু নিচে। বা হাতে ধরা ছুড়ির তীক্ষ্ণ ফলাটা ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে ওর গলার উপরিভাগে।

কিছুক্ষণ পর ওকে ছেড়ে দিতেই ধুপ করে নিজের ত্যাগকৃত তরলের উপরই পড়ে গেলো ছেলেটা। অনবরত কাঁপছে হিষ্টিরিয়াগ্রস্তের মতো। ঘরঘর শব্দ বের হচ্ছে ওর গলা থেকে। ভোকাল কর্ড কেটে গেছে, কেটে গেছে গলার অনেকটা অংশ, সেই সাথে তুমুল বেগে বের হচ্ছে রক্ত। উষ্ণ লাল রক্ত। তারপর একসময় থেমে গেলো সময় কাঁপাকাঁপি।

ওর শার্টের মধ্যে ছুড়ির ফলাটা কয়েকবার ঘষলাম আমি। তারপর ঘুরে দাঁড়ালাম।

পালাতে হবে এখান থেকে।

*******

‘খুন করেছি,’ মৃদুস্বরে বললাম আমি, ‘রায়হানকে খুন করেছি আমি।’

‘কিই?’ খেঁকিয়ে উঠলো দ্বীপ।

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মৃদু বাতাস বইছে চারদিকে। ছাদে বসে আছি আমরা দুজন। হাতে জ্বলছে সিগারেট। নিচে দু-তিনটা কুকুর ঘেউ ঘেউ শব্দে চেঁচিয়ে যাচ্ছে বেশ কিছুক্ষন ধরে। এটা বাদ দিলে সবকিছু নিরব।

‘কবে?’ প্রশ্ন করলো দ্বীপ।

‘আজ,’ মৃদুস্বরে জবাব দিলাম আমি, ‘আধঘন্টা আগে।’

রায়হান ছেলেটা আমাদের সাথেই পড়তো। একই ডিপার্টমেন্টে। একটু গুন্ডা টাইপের হওয়ায় প্রথম থেকেই ছেলেটাকে ভাল লাগতো না আমার। সবসময় নিজেকে বড় প্রমাণ করার জন্য মুখিয়ে থাকতো ও। নিজেকে সবার উপরে দেখতে চাইতো। ভাল ছাত্র হওয়ায় এটা ওর জন্য আরো সহজ হয়ে যায়।

ভার্সিটির প্রথমদিন থেকেই ফারিয়ার উপর নজর ছিল ওর। সবসময় চেষ্টা করতো ওর সামনে হিরো সাজার। কিন্তু কোন এক কারনে ছেলেটাকে এড়িয়ে চলতো ও। যদিও পরে জেনেছিলাম যে, একই স্কুল ও কলেজের ছিল ওরা দুজন। স্কুল আর কলেজেও ফারিয়াকে জ্বালাতন করতো রায়হান।

একমাস হয়ে গেছে রায়হানের গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট করেছে ফারিয়া। আর ওকে গাড়ি চাপা দিয়ে খুন করার পর পরই স্রেফ উধাও হয়ে যায় ছেলেটা। নয়দিন আগে আবার ফিরেছে সে। অবশ্য সে ফিরে আসার পর পুলিশ দুদিন আটকে রেখে জেরা করেছে তাকে, তারপর ছেড়ে দিয়েছে।

আমি ওকে এতো সহজে পার পেতে দিইনি। আইনের হাত বন্ধ, কারন প্রমাণ নেই। কিন্তু আমার কোন প্রমাণের প্রয়োজন নেই। আমি জানি কাজটা ওর ইচ্ছেকৃত। ফারিয়াকে পটাতে না পেরে করেছে এ কাজ।

‘তোর মাথাটা,’ একটু থেমে গিয়ে আবার প্রশ্ন করলো দ্বীপ, ‘ঠিক আছে তো?’

‘মানে কি?’ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকালাম আমি, ‘কি বলতে চাইছিস?’

‘আমি বলতে চাইছি,’ পকেট থেকে সেলফোনটা বের করলো ও, ‘তোর মাথাটা একেবারেই গেছে। তুই বলছিস আধঘন্টা আগে তুই খুন করেছিস রায়হানকে। তাহলে তুই এখানে আসার মাত্র দুমিনিট আগে আমি কথা বললাম কার সাথে?’

‘এটা কিভাবে সম্ভব?’ অবাক হয়ে গেলাম আমি, ‘মাত্র পাঁচমিনিট আগে এখানে পৌচেছি আমি।’

দ্রুত ওর হাত থেকে সেলফোনটা নিজের হাতে নিলাম আমি। কললিষ্ট ঘেটে দেখলাম, ওর কথা পুরোপুরি সত্যি। কল ডিউরেশন দুমিনিট আটত্রিশ সেকেন্ড।

‘শুধু এটাই না,’ একইভঙ্গিতে বললো ও, ‘গত পড়শুও একই কথা বলেছিলি তুই। পরে আমি জানতে পারলাম যে, ও খুন হয়নি।’

‘কি বলছিস তুই?’ দৃষ্টি বিস্ফারিত হবার জোগাড় আমার, ‘গত পড়শুদিন আমি তোকে বলেছি রায়হানকে খুন করার কথা?’

‘হ্যাঁ,’ সেলফোনটা হাতে নিতে নিতে বললো ও, ‘গত পড়শুদিনও ঠিক এই সময়ে আমার এখানে এসেছিলি তুই। আজকের মতো করেই বলেছিলি যে, রায়হানকে খুন করেছিস। পরে কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করে সত্যিটা জানতে পারি আমি। ফারিয়াকে প্রচন্ড ভালবাসিস তুই। তাই তখন ভেবেছিলাম, অতিরিক্ত চিন্তার ফলে ভুলভাল বকেছিস। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, মাথাটা তোর একেবারেই গেছে।’

কপালের বামপাশের শিরাটা তিরতির করে কাঁপছে আমার, অনুভব করতে পারছি। ধীরে ধীরে কাঁপুনিটা বেড়েই চলেছে। সেই সাথে একটা চিকন ব্যাথা যেন পাঁক খেয়ে বেড়াচ্ছে মাথার ভেতর।

‘না,’ ধীরে ধীরে বলে উঠলাম আমি, ‘এ হতে পারে না। ভুলভাল আমি নই, তুই বকছিস। আমি আজ রায়হানকে খুন করেছি, আমার নিজের হাতে। তুই ভুলভাল বকছিস। তুই শুনতে ভুল করেছিস। তুই, তুই...’

মাথার বাঁ পাশের শিরাটার কম্পন বেড়ে গেছে আরো। ব্যথাটা ছড়িয়ে পড়ছে পুরো মস্তিষ্কে। আর বসে থাকতে পারছি না আমি। বুঝতে পারছি, শরীরটা ঘেমে যাচ্ছে আমার। সামনের সবকিছু যেন ঝাপসা হয়ে আসছে।

‘এ হতে পারে না,’ অনেক কষ্টে উচ্চারন করলাম কথাটা আমি।

দৃষ্টি ঘোলা হয়ে যাচ্ছে আমার। কিছুক্ষনের মধ্যেই যেন একটা কালো পর্দা নেমে এলো আমার পৃথিবীজুড়ে।

আমি কি অজ্ঞান হচ্ছি?

*******

‘জ্ঞান ফিরছে মনে হচ্ছে,’ যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে কারো গলা, ‘ওদেরকে ডাকো।’

ধীরে ধীরে চোখদুটো খুললাম, সাথে সাথেই যেন একটা উজ্জ্বল সাদা আলো ঝাঁপিয়ে পড়লো আমাকে লক্ষ্য করে। চমকে উঠলাম আমি। মুখ কুঁচকে আবারও চোখ বন্ধ করলাম।

কিছুক্ষণ পর কপালের উপর কারো হাতের ছোঁয়া অনুভব করলাম আমি। এবার আরো ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালাম। প্রথমে প্রায় কিছুই দেখতে পেলাম না, তারপর ধীরে ধীরে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে এলো। আমার মাথার কাছে বসে আছে দ্বীপ।

পুরো রুমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম আমি। অনেকেই এসেছে। সবাই আমাদের ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়ে। যেন অনেক বড় ফাঁড়া কেটে গেছে, এমনভাবে তাকিয়ে আছে ওরা আমার দিকে।

‘কি হয়েছিল আমার?’ দ্বীপের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।

‘তেমনকিছু না,’ মৃদুহেসে বললো ও, ‘অতিরিক্ত টেনশনের কারনে মাথা ধরেছিল। অজ্ঞান হয়ে গেছিলি হঠাত করে।’

‘ওওও,’ দুর্বলভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম আমি।

‘খাওয়াদাওয়া না করলে এমনই হবে,’ মেয়েলি কন্ঠের কথাগুলো শুনে ফিরে তাকালাম আমি। কথাটা বলেছে স্মৃতি, আমার বান্ধবী, ‘শরীরটা তো মাশাআল্লাহ বিশাল, কিন্তু সেই পরিমান না খেলে তো এমনই হবে।’

‘নিজের দিকে খেয়াল দে,’ মৃদুকন্ঠে বললাম আমি, ‘নিজে তো তাল পাতার সেপাই। আর আমাকে বলতে এসেছিস তুই!’

আরো কিছুক্ষণ বক বক করার পর আবারও কিছুটা মাথা ব্যথা শুরু হলো আমার। তখন এক নার্স এসে সবাইকে বাইরে যেতে বললো। মৃদু হেসে সবাই বাইরে চলে গেলো আবার। ওর চলে যাবার পর নার্স কি একটা ইঞ্জেক্ট করতেই আবারও নেতিয়ে পড়লাম আমি।

প্রচন্ড ঘুম আসছে আমার।

*******

‘সমস্যাটা মানসিক,’ ধীরে ধীরে বলে উঠলেন ডাক্তার ফজলে রাব্বি, ‘মন আর ব্রেইনের উপর অত্যধিক চাপ পড়ার ফলে এদুটোর ব্যালেন্স বিগড়ে গেছে, আর তার প্রভাব পড়েছে শরীরের উপর।’

‘মানে?’ পাশের চেয়ার থেকে প্রশ্ন করলো দ্বীপ।

‘এটাকে বলে,’ একটা প্যাড টেনে এনে সেটা খুললেন ডাক্তার, ‘ইন্টেগ্রেশন ডিজঅর্ডার। গতদুদিনে ওর কেসটা নিয়ে আপনাদের সব বন্ধুবান্ধব এবং সেই সাথে এক সাইকোলজির প্রফেসরের সাথে কথা বলেছি আমি। নিজের মনের উপর ক্রমাগত চাপ ফেলার ফলে বিভ্রম বা হ্যালোসিনেশনের শিকার হয়েছে ও। ফারিয়ার এক্সিডেন্টের পর ঘটনাটা ওর মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে বারবার। এটা ঠিক যে, এক্সিডেন্টটা রায়হান ঘটিয়েছিল, কিন্তু সেটা ইচ্ছেকৃতভাবে নয়।’

‘ফারিয়াকে খুন করেছে ও,’ দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলাম আমি, ‘এবং সেটা ইচ্ছেকৃতভাবে।’

‘কি বলিস এইগুলা?’ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায় দ্বীপ, ‘ফারিয়াকে খুন করেছে কে?’

‘কে আবার,’ পূর্ণদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম আমি, ‘রায়হান।’

‘মাথাটা তোর আসলেই গেছে,’ বিরক্তভঙ্গিতে মাথা নাড়ায় ও, ‘ফারিয়া খুন হবে কেন?’

‘কেন মানে?’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি, ‘রায়হান পছন্দ করতো ওকে তা জানিস না তুই? আর ওর প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ফারিয়াকে খুন করেছে রায়হান।’

‘ফারিয়া খুন হয়নি,’ শান্তভঙ্গিতে বললো দ্বীপ, ‘এটা জাষ্ট একটা ছোট্ট এক্সিডেন্ট ছিল। রায়হান ওর নতুন গাড়ির টেষ্ট ড্রাইভ করার সময় সামনে এসে পড়ে ও, আর ব্যালেন্স সামলাতে না পেরে ওর পায়ের উপর দিয়ে উঠিয়ে দেয় চাকা। পায়ের হাড়ে হালকা ফ্র্যাকচার হয়েছিল, ব্যস। ডাক্তার কিছুদিন রেষ্ট নিতে বলেছিল ফারিয়াকে, আর এই কারনেই বাড়ি চলে গিয়েছে ফারিয়া।’

‘মানে কি?’ অবাক হলাম আমি, ‘ফারিয়া খুন হয়নি?’

‘না,’ একইভঙ্গিতে বলে উঠলো দ্বীপ।

হচ্ছেটা কি আসলে!

এবার মুখ খুললেন ডাক্তার, ‘আমি মনে হয় বুঝতে পেরেছি আপনার বিষয়টা। ফারিয়ার এক্সিডেন্টের জন্য দায়ী রায়হান, অন্যদিকে আপনি তাকে একদমই সহ্য করতে পারেননা। বিষয়টা আপনার ব্রেইনের উপর বিশাল চাপ ফেলে। তাই আপনার মস্তিষ্ক আপনাকে স্টেবল রাখার জন্য অন্য রাস্তা বেছে নিয়েছে। আপনাকে বিশ্বাস করিয়েছে যে ফারিয়া মারা গেছে, আর ওর তার খুনী রায়হান। একই কারনে বারবার রায়হানকে খুন করার স্পৃহা জেগে উঠছে আপনার মধ্যে। আসলে, পুরো ব্যাপারটাই আপনার মস্তিষ্কের সৃষ্টি, হ্যালোসিনেশন আর কি। ফারিয়া মারা যায়নি, আপনিও বাস্তবে কাউকে খুন করেননি।’

‘এ কি করে সম্ভব?’ নিচু গলায় স্বগোক্তি করলাম আমি, ‘আমার নিজের হাতে আমি খুন করেছি রায়হানকে। কারন ফারিয়াকে...’

‘বললামই তো,’ প্যাডের মধ্যে খস খস করে কিছু একটা লিখছেন ডাক্তার, ‘পুরোটাই আপনার হ্যালোসিনেশন। তবে ভয়ের কিছু নেই, সেরে যাবে এটা। এখানে কিছু ঔষধ দিচ্ছি আমি, এগুলো নিয়মিত নেবেন। আর, কিছুদিন পূর্ণ বিশ্রাম দরকার আপনার। আগামীকাল ছেড়ে দিচ্ছি আমরা আপনাকে।’

ডাক্তারের চেম্বার থেকে আবারও কেবিনে ফিরে এলাম আমরা। সেখানে স্মৃতি বসে আছে।

‘কি বললো ডাক্তার?’ শান্তভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো স্মৃতি।

ওকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বললো দ্বীপ। সবকিছু শোনার পর চিন্তিত মনে হলো ওকে। মাথা নিচু করে কি যেন ভাবতে লাগলো।

‘কি হলো?’ ওর পাশে গিয়ে বসলাম আমি, ‘মুখ পেঁচার মতো করে ফেললি কেন?’

‘তোর প্রবলেম হয়ে গেলো মনে হয়,’ মৃদুস্বরে বলে উঠলো স্মৃতি।

‘কেন?’

‘কারন,’ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললো ও, ‘ফারিয়া ফিরে এসেছে আজকে। এসেই রায়হানের সাথে ঘুরতে বেড়িয়েছে। সুপ্তির কাছে শুনলাম, ওদের দুজনের নাকি প্রেম হয়ে গেছে।’

‘কি বলিস এসব?’ মাথাটা যেন ফাঁকা লাগছে আমার, ‘ফারিয়া আর রায়হান? এটা কিভাবে সম্ভব? ফারিয়া তো রায়হানকে দেখতেই পারে না।’

‘জানি না,’ মাথা নেড়ে বললো ও, ‘জাষ্ট যা শুনলাম, তাই বললাম তোকে।’

সত্যিই প্রবলেম হয়ে গেলো দেখি!

*******

‘আমি একটু বাথরুম থেকে আসি,’ দ্বীপের কাঁধে হাত রেখে বললাম আমি।

‘ঠিক আছে,’ সংক্ষেপে উত্তর দিলো ও, তারপর সবার দিকে তাকালো।

একমাস কেটে গেছে ইতোমধ্যেই। স্মৃতি সত্যিই বলেছিল, সত্যিই ফারিয়া আর রায়হানের মধ্যে প্রেম হয়ে গেছে। ফারিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে আজকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টে একটা বড়সড় পার্টির আয়োজন করেছে রায়হান। আর সেই পার্টিতে এটেন্ড করার জন্যই সমবেত হয়েছি আমরা সবাই।

একেই বলে ভাগ্য! যাকে এতোটা ভালোবাসি আমি, আজ তার জন্মদিন উপলক্ষে তারই বয়ফ্রেন্ডের দেয়া পার্টিতে হাজির হতে হয়েছে আমাকে। এর চেয়ে মেজাজ খারাপ করা কাজ আর কি হতে পারে!

ধীরে ধীরে বেসিনের সামনে দাঁড়ালাম আমি। আয়নায় আমার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। যেন আমাকে ব্যঙ্গ করছে সে।

সমস্ত চিন্তাভাবনাকে একপাশে সরিয়ে দিলাম আমি। এসব নিয়ে ভেবে আর লাভ নেই। যা হবার তা হয়ে গেছে। এসব নিয়ে ভাবলে শুধু কষ্টই পেতে হবে, সেইসাথে আফসোস হবে। আমি আফসোস করতে চাই না।

কলটা ছেড়ে দিয়ে দুহাত ভরে নিলাম পানিতে। নিজের চোখেমুখে ঝাপ্টা দিচ্ছি। ধীরে ধীরে মুখ বেয়ে নামছে পানির ধারা।

আমার কষ্টগুলো যদি এভাবেই পানির মতো চুইয়ে চুইয়ে বেড়িয়ে যেতো আমার ভেতর থেকে!

‘শুভ যে,’ হঠাত পেছন থেকে বলে উঠলো কে যেন। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলাম, রায়হান এসে দাঁড়িয়েছে, ‘কি খবর? পার্টি এনজয় করছো তো?’

‘হুম,’ সংক্ষেপে উত্তর দিলাম আমি।

‘আচ্ছা,’ বেসিনের কাছে এসে কল ছেড়ে দিলো ও, ‘শুনেছিলাম, তুমি নাকি একটা অদ্ভুত রোগে ভুগছিলে? কি যেন ডিজঅর্ডার? ওটার খবর কি?’

‘ভাল,’ মাথা নেড়ে বললাম আমি, ‘সেরে গেছে পুরোপুরি। ঔষধগুলো ভাল কাজ দেখিয়েছে।’

‘গুড,’ মৃদু হেসে বেসিনের দিকে তাকাল ও। তারপর হাতে পানি নিয়ে নিজের মুখে ঝাপ্টা দিতে লাগলো।

এই সুযোগ!

মাথার মধ্যে এলার্ম বেজে উঠলো যেন। শরীরে মৃদু একটা কাঁপুনি অনুভব করলাম আমি। বুঝতে পারলাম, একটা ক্রোধ দানা পাকিয়ে উঠছে আমার ভেতরে।

দ্রুত বসে পড়লাম আমি। তারপর ডান পায়ের কেডসের দিকে তাকালাম। দুহাতে ঝটপট লেসটা খুলে নিয়েই আবার উঠে দাঁড়ালাম। দুহাতে লেসটার দুপ্রান্ত জড়িয়ে নিয়েছি ইতোমধ্যেই। রায়হান এখনো নিজের মুখে পানির ঝাপ্টা দিচ্ছে।

পেছন থেকে ওর গলার মধ্যে বাংলা ৪ এর মতো করে আটকে নিলাম লেসটা, তারপর উল্টো ঘুরে দুহাতে টান দিলাম লেসের দুপ্রান্ত ধরে। একটা উবু হতেই উঠে পড়লো ও আমার কাঁধের উপর। পুরো কাজটা করতে এক সেকেন্ডও লাগেনি।

ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছোটানোর চেষ্টা করছে ও। আমিও আরো শক্ত করে টেনে ধরছি লেসের দুইপ্রান্ত। কিছুতেই ওকে ছুটতে দেবো না।

‘ফারিয়াকে ভালবাসতাম আমি,’ দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলাম আমি, ‘আর তুই ওকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিস। কেড়ে নিয়েছিস ওকে আমার কাছ থেকে। আমি যখন ওকে পাবো না, তখন তোকেও পেতে দেবো না। মরবি তুই। আজ, এখনই মরবি তুই শালা।’

আরো বেশ কিছুক্ষন জোড়াজোড়ি করলো ও, তারপর নেতিয়ে পড়লো। তবুও সতর্কতাবশত মিনিটখানেক একই অবস্থায় রাখলাম আমি ওকে, তারপর ফেলে দিলাম পিঠ থেকে। ওর বুকের উপর হাত রাখতেই বুঝলাম, মারা গেছে ও।

‘রায়হান?’ হঠাত করেই কে যেন ডেকে উঠলো বাথরুমের বাইরে থেকে। দ্রুত রায়হানের দিকে তাকালাম আমি। ওর পকেটে একটা কলম দেখা যাচ্ছে। দ্রুত নিজের হাতে তুলে নিলাম সেটা।

‘রায়হান,’ দ্বিতীয়বার ডাকটা কানে পৌছতেই ঘুরে তাকালাম আমি। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করছে ফারিয়া, ‘কি হয়েছে এখানে?’

‘কিছু না,’ কলমটাকে নিজের পেছনে আড়াল করে রেখেছি আমি, ‘মাল একটু বেশীই পেটে পড়েছে ওর। বমি করে অজ্ঞান হয়ে গেছে। কিন্তু তুমি হঠাত জেন্টস টয়লেটে?’

‘রায়হানকে খুঁজতে এলাম,’ রায়হানের পাশে হাটু গেড়ে বসলো ও।

‘জেন্টস টয়লেটে খুঁজতে?’ ভ্রু নাচালাম আমি, ‘নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল?’

‘কি যে বলো,’ মুখ ঝামটা দিলো ও, তারপর হাত রাখলো রায়হানে ঘাড়ে, ‘এ কি!’

ভয় পেয়ে এক পা পেছাতে চাইলো ও, কিন্তু উঁচু হিলসহ হড়কে গেলো মেঝের মধ্যে। বসে পড়েছে মেঝেতে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

‘তুত-তু,’ দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে গেছে ওর, ‘তুমি ওকে, রায়হানকে খুন করেছো?’

একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলাম আমি। তারপর ঝুঁকে এলাম ওর দিকে, ‘আমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। এখানে কি করছো তুমি?’

‘তুমি ওকে খুন করেছো?’ একইভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো ও।

দ্রুত কলমটার ক্যাপ খুলে ফেললাম আমি। তারপর সেটা গেথে দিলাম ওর গলায়। একপাশ থেকে আরেকপাশে জোড়ে টান দিলাম একটা।

‘হ্যাঁ,’ দাঁতে দাঁত চেপে বললাম আমি, ‘খুন করেছি আমি রায়হানকে। কোন সমস্যা?’

গলগল করে রক্ত বেড়িয়ে আসছে ওর গলা বেয়ে। নেতিয়ে পড়ছে ও। একহাতে ওর শরীরটা জাপ্টে ধরলাম আমি।

‘কেন এমন করলে?’ ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, ‘তুমি তো জানতে যে, তোমাকে ভালবাসতাম আমি। তারপরও কেন এমন করলে? আমার বুঝি কষ্ট হয়না?’

ওর চোখদুটো নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে। মারা গেছে ও। খোলা চোখদুটোতে কোন দৃষ্টি নেই, তবে সেখানে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে আমার প্রতি ঘৃণা আর একরাশ ভয়।

ধীরে ধীরে ওর শরীরটা মেঝেতে নামিয়ে রাখলাম আমি। তারপর উঠে দাঁড়ালাম। বেড়িয়ে যেতে হবে এখান থেকে।

ঘুরে দাঁড়াতেই চমকে উঠলাম আমি। ঠিক আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দ্বীপ। আমি কিছু করার আগেই ওর একটা হাতকে ছুটে আসতে দেখলাম আমার দিকে। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, ওর হাতের পাশটা এসে লাগলো আমার কানের একটু নিচে। আর তার সাথে সাথেই একটা কালো চাঁদর নেমে এলো যেন।

*******

‘সরাসরি ওকে এখানে এনে ভাল করেছেন,’ কে যেন বলে উঠলো জরুরীসুরে, ‘আগেই পুলিশকে খবর দিলে ওর ডিজঅর্ডারের ব্যাপারটা তাদেরকে বোঝানো যেতো না। তাতে ওর ক্ষতি হয়ে যেতো।’

ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালাম আমি। এটা সম্ভবত একটা ক্লিনিক। দরজার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, আমার ধারণা ঠিক। ডাক্তার ফজলে রাব্বির সাথে কথা বলছে দ্বীপ।

‘দু-দুটো খুন,’ হড়বড় করে বলে চলেছে দ্বীপ, ‘ঘাবড়ে গেছিলাম আমি। তাই সরাসরি এখানে নিয়ে এসেছি সবাইকে।’

‘ভাল করেছেন,’ দ্বীপের কাঁধে একটা হাত রেখে বলে উঠলেন ডাক্তার, ‘এখন পুলিশকে সব ব্যাখ্যা করা যাবে সহজেই। আপনি আমার সাথে আসুন। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। তাছাড়া পুলিশে খবর দিতে হবে।’

কথা না বাড়িয়ে ডাক্তারের পিছু নিলো দ্বীপ।

ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসলাম আমি। ডান হাতে একটা স্যালাইনের লাইন লাগানো আছে আমার। একটানে খুলে ফেললাম সেটা। তারপর বেডের পাশে রাখা স্ট্যান্ডে স্যালাইনের টিউবের গা থেকে অন্য প্রান্ত খুলে পকেটে ভরে ফেললাম। কাজে লাগতে পারে এটা।

দ্রুত পালানো দরকার এখান থেকে। একবার পুলিশে খবর দেয়া হলে আর কোন আশা নেই আমার। দু-দুটো খুন করেছি আমি, সহজে ছাড়া হবে না আমাকে।

প্রচন্ড দুর্বল লাগছে নিজেকে। শরীর সাড়া দিতে চাচ্ছে না, কিন্তু কিছুই করার নেই। ধীরে ধীরে বেড থেকে নেমে পড়লাম আমি। পাশের চেয়ারের উপর আমার টিশার্টটা রাখা আছে, দ্রুত পড়ে নিলাম সেটা। তারপর এগিয়ে গেলাম জানালার দিকে।

‘কি করছো শুভ?’ ডাকটা কানে যাওয়া মাত্রই চমকে গেলাম আমি। দ্রুত পেছন দিকে তাকিয়ে আরো ভড়কে গেলাম।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ফারিয়া!

‘তুত-তুমি?’ ভয়ের চোটে কথা বেধে যাচ্ছে আমার, ‘তুমি মারা যাওনি?’

‘আমি মারা যাবো কেন?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো ফারিয়া, ‘কিসব আজেবাজে কথা বলছো?’

ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি আমি ওর দিকে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার। নিজের হাতে খুন করেছি আমি ওকে। অথচ এখন আমারই সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও!

‘দ্বীপ যে একটু আগে বললো,’ দ্রুত বললাম আমি, ‘দু-দুটো খুন? কে কে খুন হয়েছে?’

‘স্মৃতি আর সুপ্তি,’ ধীরে ধীরে বলে উঠলো ও, ‘রায়হানের কাজ।’

‘মানে কি?’ অবাক হয়ে গেলাম আমি।

‘বলছি,’ দ্রুত আমার এক হাত ধরলো ফারিয়া, টেনে এনে আবার বেডের উপর বসালো, ‘তুমি তো বাথরুমে গিয়েছিলে। সেখানে তোমার পিছু নিয়ে একটা পিস্তল হাতে ঢোকে রায়হান। সেটা দেখে ফেলে স্মৃতি আর সুপ্তি। বাথরুমের ভেতর রায়হান তোমাকে মারতে উদ্ধত হয়, ঠিক তখনই বাঁধা দেয় ওরা দুজন। ফলে ওদের দুজনকে খুন করে ও। তখন তুমি চেষ্টা করেছিলে ওর উপর ঝাপিয়ে পড়তে, তখন তোমার উপরও গুলি করার চেষ্টা করে ও। কিন্তু তুমি পিছলে পড়ে যাও বাথরুমের মধ্যে, ফলে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ততক্ষনে আমরা সবাই পৌছে গিয়েছিলাম সেখানে। সবাই মিলে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে ওকে। তারপর তোমাদের দুজনকে নিয়ে এসেছে এখানে।’

‘কিন্তু,’ প্রশ্ন করলাম আমি, ‘আমাকে কেন খুন করতে চাইবে ও?’

‘কারন,’ দরজার কাছ থেকে বলে উঠলো দ্বীপ, ‘তুই ওকে খুন করতে চেয়েছিলি। তোর ডিজঅর্ডারের কথা কানে গিয়েছিল ওর। তাছাড়া, তুই যে ফারিয়াকে ভালবাসিস, এটাও সম্ভবত জানতে পেরেছিল ও।’

‘ওওও,’ মৃদুস্বরে বললাম আমি।

‘তুই থাক এখানে,’ আমার দিকে তাকিয়ে বললো দ্বীপ, ‘রেষ্ট দরকার তোর। আমি আর ডাক্তার সাহেব যাচ্ছি থানায়। রায়হানকে পাশের কেবিনে অজ্ঞান করে রাখা হয়েছে। যতক্ষন না আমরা ফিরে আসি, ফারিয়া থাকবে বাইরে। তাছাড়া ক্লিনিকের অন্য স্টাফরাও থাকবে।’

‘হুম,’ মাথা নাড়লাম আমি।

‘ফারিয়া,’ ডেকে উঠলো দ্বীপ, ‘এসো। শুভকে রেষ্ট নিতে দাও।’

উঠে দাঁড়ালো মেয়েটা। ধীরে ধীরে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে।

*******

অন্ধকার, ঘোর অন্ধকার এই কেবিনে।

অজ্ঞান হয়ে আছে ও। মাথাটা ডানদিকে কাত হয়ে আছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। পকেট থেকে স্যালাইনের লাইনটা বের করে দুহাতে জড়িয়ে নিয়েছি। বেশী সময় লাগবে না আশা করি।

পরপর দুটো প্যাচ লাগালাম ওর গলায়, তারপর দুহাতে দু প্রান্ত ধরে জোড়ে টান। কিছুক্ষণ কিছুই হলো না, তারপরই একটু কেঁপে উঠলো ও। হাত দুটো গলার কাছে নিতে চেষ্টা করলো। কিন্তু আমার দুই পা আগেই চেপে ধরেছে সেগুলো বেডের সাথে। ওর কাঁপুনি বেড়েই চলেছে। বুঝতে পারছি, একটুখানি বাতাসের জন্য আকুলিবিকুলি করছে ওর ফুসফুস।

তারপর হঠাত করেই যেন ঢিল পড়লো ওর পেশীতে, নেতিয়ে পড়েছে। তবুও দুহাতে চেপে ধরে রাখলাম লাইনটা। ঘেমে নেয়ে গেছি একেবারেই।

কিছুক্ষণ পর আমার পেশীতেও ঢিল পড়লো। ওকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। স্যালাইনের লাইনটা খুলে ফেললাম ওর গলা থেকে। তারপর সেটা চালান করে দিলাম পকেটে।

পেছনে ফিরতেই হঠাত রুমের ডিম লাইটটা জ্বলে উঠলো কেন যেন। এতোক্ষন অন্ধকারে ছিলাম, তাই এই অল্প আলোতেও চোখে ধাধা লেগে যাওয়ার জোগাড় হলো আমার। দ্রুত একহাত চোখের উপর আনলাম। তারপর তাকালাম সামনের দিকে।

দেয়ালের সুইচবোর্ডের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রায়হান!

দ্রুত পেছনে তাকালাম আমি। বেডের উপর বিশ একুশ বছর বয়েসী একটা ছেলে শুয়ে আছে, যাকে চিনিনা আমি। তাহলে কি আমি ভুল রুমে ঢুকে ভুল মানুষকে খুন করলাম!

‘কি রে?’ শান্তভঙ্গিতে বলে উঠলো রায়হান, ‘এই রুমে কি করছিস তুই? এদিকে আমি তোর রুমে গিয়ে খুঁজে এলাম।’

ধীরে ধীরে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো ও। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ধীরে ধীরে পকেটে হাত ঢোকালাম আমি।

‘স্মৃতি আর সুপ্তি,’ অসম্ভব ঠান্ডা শোনালো আমার কন্ঠ, ‘কি দোষ ছিল ওদের? ওদেরকে কেন?’

‘তা জেনে তোর লাভ কি?’ মৃদু হাসি ফুটে উঠলো ওর মুখে, ‘একটু পর তো মারাই যাবি।’

‘তাই না?’ ভ্রু কুঁচকে বললাম আমি।

‘তাই তো,’ নিজের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলো ও।

কিন্তু ওকে আর সুযোগ দিতে রাজি নই আমি।

আগাম কোন সংকেত না দিয়ে বা হাতের একটা আপারকাট মেরে দিলাম ওর থুতনীতে, ইতোমধ্যে ডান হাতে স্যালাইনের লাইনটা বেড়িয়ে এসেছে আমার। দ্রুত দুহাতে পেচিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিলাম ওর গলা বরাবর। লাইনটা ছুঁড়ে দিয়েই উল্টো ঘুরে মেঝের দিকে ঝুঁকে এলাম আমি। হ্যাঁচকা টান খেয়ে আমার পিঠের উপর উঠে এলো ও।

দুহাতে লাইনটা যতটা জোড়ে সম্ভব টেনে ধরেছি আমি। ওর শরীরের সাথে পাল্লা দিয়ে থরথর করে কাঁপছে আমার পেশী। ঘামের পরিমাণ বেড়ে গেছে যেন।

পুরো তিন মিনিট পর পেশীতে ঢিল দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালাম আমি। অবলম্বন হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো ও। ওর দিকে ঝুঁকে ওর পালস চেক করার পর বুঝলাম, মারা গেছে ও। এবার সত্যিই মারা গেছে। কোন ভুল নেই।

এবার আমি আমার কেবিনে ফেরত যেতে পারি।

কেবিনে ফিরতেই দেখতে পেলাম, ফারিয়া বসে আছে আমার বেডে। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো ও, তারপর আমার দিকে এগিয়ে এলো।

‘কোথায় গিয়েছিলে?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করলো ও।

‘বাথরুমে,’ সংক্ষেপে উত্তর দিলাম আমি, তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘দ্বীপ কোথায়?’

‘এখনো আসেনি,’ আমাকে ধরে বেডে বসালো ও, ‘শরীরের অবস্থা এখন কেমন?’

‘অনেকটাই সুস্থ মনে হচ্ছে নিজেকে,’ ধীরে ধীরে উত্তর দিলাম আমি।

‘ভাল,’ মৃদু হাসি ফুটে উঠলো ওর মুখে, ‘পুরোপুরি সুস্থ হতে বেশী সময় লাগবে না।’

‘আচ্ছা ফারিয়া,’ মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলাম আমি, ‘তুমি তো প্রথমদিকে রায়হানকে পছন্দ করতে না বলে জানতাম, স্কুল কলেজেও তোমাকে ডিস্টার্ব করতো বলে শুনেছি। তারপরও কেন ওকে ভালবাসলে তুমি?’

‘এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল,’ মৃদুস্বরে বললো ও।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়লাম আমি। বুঝতে পেরেছি।

ভুল তো সবাই-ই করে!

নিরবতা নেমে এসেছে রুমের ভেতর। না আমি কিছু বলছি, না ফারিয়া। আসলে কি বলবো, বুঝতে পারছি না। একমনে নিজের নখ কামড়ে যাচ্ছে ও, আর আমি নিচের দিকে তাকিয়ে ভাবছি।

এখন, এই মুহূর্তে যদি আমি ফারিয়াকে প্রপোজ করি!

মাথা নেড়ে ভাবনাটা সরিয়ে দিলাম আমি। এখন সঠিক সময় নয়। পরে কখনো করা যাবে। কিন্তু পরে যদি দেরী হয়ে যায়? রায়হানের মতো অন্য কেউ যদি আগেই ওকে আবারও ছিনিয়ে নেয় আমার কাছ থেকে? তাহলে কি করবো আমি?

নাহ! আর দেরী করা সম্ভব নয়। যা করার এখনই, নাহলে কখনোই নয়।

মনস্থির করে ফেলেছি আমি। এখন, এই মুহূর্তে প্রপোজ করবো আমি ওকে। আর দেরী সহ্য হচ্ছে না আমার। এখনই ওকে আমার মনের কথা জানানো প্রয়োজন। দ্রুত মাথা তুলে ওর দিকে তাকালাম আমি।

কিন্তু এ কি? কোথায় ফারিয়া? অথচ একটু আগেই তো এখানেই ছিল! গেলো কোথায়?

‘ইউ আর আন্ডার এরেষ্ট,’ ভারী একটা কন্ঠ শুনে চমকে গেলাম আমি। দ্রুত দরজার দিকে তাকালাম। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন বিশালদেহী এক পুলিশ অফিসার। তার পাশে আরো কয়েকজন কনস্টেবলকে দেখা যাচ্ছে।

‘আমার অপরাধ?’ মৃদুকন্ঠে প্রশ্ন করলাম আমি।

‘ডাবল মার্ডার,’ ধীরে ধীরে পকেট থেকে হ্যান্ডকাফ বের করে এগিয়ে এলো সে আমার দিকে, ‘রায়হান আর ফারিয়াকে খুন করার অপরাধে গ্রেফতার করা হচ্ছে আপনাকে।’

‘মানে কি?’ হড়বড় করে বললাম আমি, ‘মারা তো গিয়েছে স্মৃতি আর সুপ্তি!’

‘ওরা কেন মারা যাবে?’ দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে দ্বীপ, ‘মারা গেছে রায়হান আর ফারিয়া। তুই খুন করেছিস ওদেরকে।’

‘মানে কি?’ অবাক হয়ে বললাম আমি, ‘এই একটু আগেও তো ফারিয়া আমার পাশে বসেছিল। আর বেশ কিছুক্ষণ আগেও তো তোর সাথে রুমের বাইরে গেলো ও। আর তুই বলছিস...’

হঠাত করেই থেমে গেলাম আমি। কারন, দ্বীপের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে দুটো মেয়ে।

স্মৃতি আর সুপ্তি!

তারমানে কি মারা যায়নি ওরা? তারমানে কি এতোক্ষন যা করেছি আমি, যা দেখেছি আমি, সবই আমার হ্যালোসিনেশন? তারমানে কি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টের জেন্টস টয়লেটে যা ঘটেছিল, পুরোটাই সত্যি?

এর মানে কি, আমি উন্মাদ হয়ে গেছি?

মাথার বামপাশের শিরাটা মৃদু কাঁপছে আমার। স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারছি তা। ধীরে ধীরে কাঁপুনিটা বেড়েই চলেছে। তারসাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে একটা চিনচিনে ব্যাথা।
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×