০১
-‘আরে চলো তো!’
-‘আজ থাক। বাদ দাও না! কাল বিয়ে করে একেবারে যাবো।’
-‘না, আজই যেতে হবে তোমাকে। জ্যু ইয়েসনে চমৎকার একটা চার্চ আছে। আমরা সেখানেই বিয়ে করবো। বুঝেছো?’
-‘কিন্তু এখানে যে সব রেডি করে রেখেছি আমি।’
-‘আমি কিচ্ছু শুনতে চাইনা। তুমি আমার সাথে এখনই রওনা হবে।’
বেশ কিছুক্ষণ জোড়াজুড়ির পর অবশেষে রাজি হতেই হলো ওর সাথে। অবশ্য আমি জানতাম যে রাজি না হয়ে আমার উপায় নেই। কারন ও যা বলবে তা করতে আমি বাধ্য। পাগলি একটা!
মেয়েটির নাম রেইনা ব্রুজা। আমেরিকান কোন মেয়ের নাম এমন হয়, তা আমার জানা ছিল না। যেমন অদ্ভুদ নাম, তেমনই অদ্ভুত স্বভাব মেয়েটার। শুধু নাম বা স্বভাব নয়, চেহারাতেও অন্যরকম একটা ভাব আছে। মেয়েটিকে খুবই ভাল লাগে আমার কাছে। খুবই ভালবাসি ওকে আমি। তাই তো ওর সব কথাতেই রাজি হয়ে যাই সবসময়।
মেয়েটার সাথে পরিচয় বেশী দিনের নয়, প্রায় একবছর বলা চলে। নেভাডা স্টেটস কলেজে একই সাথে বায়োলজিতে পড়াশোনা করছি আমরা। এর মধ্যেই আমরা দুজন দুজনের খুবই কাছে এসে গেছি। এবং এটাও ঠিক করেছি আগামীকাল আমাদের প্রথম দেখার একবর্ষ পূর্তির দিনে আমরা দুজন বিয়ে করবো। প্ল্যান ছিল রেইনার মা-বাবা না থাকায় বিয়ের সমস্ত কাজ শেষে আমরা ওর দূরসম্পর্কের এক আংকেলের বাসায় যাবো। কিন্তু ওর জোড়াজুড়িতে আজই ওর আংকেলের বাসায় রওনা হয়েছি আমরা।
খুব ছোটবেলায় মা-বাবা দুজনই মারা যায় রেইনার। তারপর থেকে মেয়েটি ওর এই দূরসম্পর্কের আংকেলের কাছেই বড় হয়েছে। লোকটার নাম ইথান করবেট। উনি আমেরিকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ। নেভাডার জ্যু ইয়েসন মাউন্টেনের পাশেই তার বাড়ি। সেখানেই যাচ্ছি আমরা।
‘তুমিই শবো?’ আমাকে রেইনার সাথে ঢুকতে দেখেই কেন যেন চমকে উঠলেন মিষ্টার ইথান করবেট। ইনিই রেইনার সেই দূরসম্পর্কের আংকেল।
‘শবো না আংকেল,’ হাসিমুখে বললাম আমি, ‘শুভ।’
‘ওহ সরি,’ ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বললেন তিনি। ‘শুভ! এখন ঠিক আছে?’
‘পারফেক্ট।’ হ্যান্ডসেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম আমি।
মৃদুভাবে হাতটা একবার ঝাঁকিয়ে দিলেন তিনি, ‘এসো, ভেতরে এসো।’
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে আঁধারের এক অদৃশ্য চাদরে ঢাকা পড়ছে চারদিক। সেই সাথে মৃদু কুয়াশাও দেখা যাচ্ছে। চমৎকার পরিবেশ। এমন সময়েই আমরা পা রাখলাম জ্যু ইয়েসন মাউন্টেনের পাশে আংকেল ইথানের বাড়ির ভেতরে।
আংকেল ইথানের বাড়িটা দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না আমি। বাড়ি না বলে এটাকে প্রাসাদ বলাই ভাল সম্ভবত। পুরনো দিনের পটভূমিতে তৈরী হলিউডের মুভিতে যেসব বিশাল বাড়ি দেখা যায়, সেরকম অনেকটা। তবে আধুনিক সব ব্যবস্থাই আছে এখানে।
আংকেল ইথান বিয়ে-থা করেননি এখনো। এতো বড় বাড়িতে একাই থাকেন উনি।
এর আগে কখনো আংকেলের সাথে সামনা সামনি দেখা হয়নি আমার। ফোনেই কথা হয়েছে সবসময়। প্রথম দেখাতেই তার চমকে উঠা দেখে তাই রীতিমত বিস্মিত আমি। তবে দ্রুতই নিজের মুখের ভাব পরিবর্তন করে বেশ ঘনিষ্টভঙ্গীতেই কথা বলতে লাগলেন দেখে ভাল লাগলো।
এগারোটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া সেরে আংকেলের স্টাডিতে গিয়ে বসলাম আমরা। বিয়ের মাত্র একরাত বাকি। কাল সকালেই বিয়ে। তাই সবকিছু দ্রুত আলোচনা করা দরকার।
‘তুমি তো এশিয়ান, তাই না?’ হাতে রাখা গ্লাসে মৃদু চুমুক দিয়ে আয়েসী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন আংকেল।
‘জ্বী,’ জবাব দিলাম আমি, ‘বাংলাদেশী। স্কলারশীপ পেয়ে স্টেটসে এসেছি।’
‘হুম,’ সবজান্তার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালেন তিনি। আরো একবার হাতের গ্লাসটাতে চুমুক দিলেন।
তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘দেশে কে কে আছে তোমার?’
‘বাবা আর মা।’ চটপট জবাব দিলাম আমি।
-‘তারা জানে তোমার বিয়ের কথা?’
-‘অবশ্যই। তাদের না বলে বিয়ে করবো নাকি?’
-‘হুম।’
চোপ হয়ে গেলেন উনি। মৃদুভাবে গ্লাসে চুমুক দেবার ফাঁকে ফাঁকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন আমাকে।
কিছুক্ষণ চোপ করে থাকার পর আবার শুরু করলেন তিনি। এ কথায় ও কথায় আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনে নিলেন। রাত দেড়টা পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে শুতে গেলাম আমরা।
০২
মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা একটা ভাব বিরাজ করছে এখানে। চুপচাপ একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। হাতে সিগারেট। সিগারেটের ধোঁয়া বাইরে কুয়াশার সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ভাল লাগার মতো একটা দৃশ্য। তবুও ভাল লাগছে না আমার।
মনটা কেন যেন খুঁত খুঁত করছে। ঠিক বুঝতে পারছিনা কি হচ্ছে আসলে। প্রথমে আমাকে দেখে আংকেলের চমকে উঠা, তারপর স্টাডিতে নিয়ে গিয়ে পুলিশের মতো জেরা করা, সবকিছু কেন যেন খাপছাড়া মনে হচ্ছে আমার কাছে। বিয়ে করার আগে কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হয়, এটা শুনেছিলাম। কিন্তু এভাবে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করা হবে, তা ভাবিনি।
‘তুমি এখানে কি করছো?’ হঠাত পেছন থেকে রেইনার ডাক শোনা গেল। ‘সারাদিন জার্নি করে এসেছো, ঘুমাবে না? সকাল দশটায় চার্চে পৌছাতে হবে।’
মেয়েটার দিকে তাকালাম আমি। আলো আঁধারিতে চমৎকার লাগছে ওকে। কালো ড্রেসিং গাউনটা ওর ফর্সা শরীরের সাথে দারুন মানিয়েছে। লম্বা কালো চুলগুলো দুপাশে ছড়িয়ে আছে। কালছে বেগুনি চোখদুটো শান্তভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এই চোখের দিকে তাকিয়ে যেকোন জায়গায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় আমার। প্রচন্ড ভালবাসি আমি মেয়েটিকে।
‘ভাল লাগছে না আমার,’ শান্তভাবে বললাম আমি, ‘তাই এখানে এসে দাঁড়ালাম।’
‘আংকেলের কথাতে মন খারাপ হয়েছে?’ আমার পাশে এসে দাড়াল রেইনা, ‘আসলে ও এমনই। যাকে পাবে তাকেই জেরা করবে এভাবে। তুমি কিছু মনে করো না প্লিজ।’
‘না আসলে,’ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম আমি, ‘আসলে এভাবে কেউ কখনো জেরা করেনি আমাকে। মনে হচ্ছিল আমি যেন খুনের আসামী, আর উনি পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন অফিসার। আমার জনম কুন্ডলি জানার জন্য একের পর এক যেভাবে প্রশ্ন করলেন, ভয় পেয়ে গেছিলাম আর কি।’
‘বললামই তো ও একটু এরকমই,’ আমার আরো কাছে ঘেষে আসলো ও, ‘প্লিজ ডোণ্ট মাইন্ড।’
‘আরে নাহ,’ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি, ‘মাইন্ড করবো কেন? একটু ঘাবড়ে গেছিলাম।’
এবার হাসি ফুটলো ওর মুখে। আরো কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো ও। আমার বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে রইল। আমিও পাল্টা আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলাম ওকে।
ভাল লাগছে আমার। শেষ রাতের অদ্ভুত সুন্দর আবহাওয়া, মৃদুমন্দ বাতাস, ব্রুজার শরীরের মিষ্টি গন্ধ, সব মিলিয়ে অপার্থিব আনন্দ হচ্ছে আমার।
‘এই,’ মাথাটা একটু তুলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে বলল ও।
‘বলো,’ একইভাবে জবাব দিলাম আমি।
‘কতটুকু ভালবাসো আমাকে তুমি?’ ওর চোখে মৃদু দুষ্টুমীর আভাস পাচ্ছি আমি।
‘অনেক, অনেক, অনেক,‘ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলাম আমি। ‘অনেক ভালবাসি তোমাকে। ভালবাসি তোমার চোখটাকে। অদ্ভুদ সুন্দর। যেন হারিয়ে যাবো আমি ওদুটোর মাঝে। ভালবাসি তোমার চুলগুলোকে। সারাক্ষন হাতে নিয়ে খেলতে ইচ্ছে করে। ভালবাসি তোমার ......’
‘তাই?’ আমাকে বাঁধা দিয়ে বলে উঠল রেইনা। চোখে স্পষ্ট দুষ্টুমীর আভাস। ‘দ্যান প্রুভ ইট। প্রুভ দ্যাট ইউ লাভ মি সো।’
‘ওকে বেবি,’ আমিও উৎসাহিত হয়ে উঠেছি, ‘লেট’স প্লে দ্য গেম অফ ...’
এবারো বাঁধা পেলাম। কিন্তু বাঁধাটা রেইনার দিক থেকে আসেনি। এসেছে রুমের দরজার ওপাশ থেকে। কেউ নক করছে।
‘যাহ শালা,’ খাঁটি বাংলায় বলে উঠলাম আমি, ‘এইডা কিসু অইল? এই সময় কোন শালায় ডিস্টার্ব করে?’
‘কি বললে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে রেইনা।
‘নাথিং,’ ধীরে ধীরে ওর বাধন থেকে মুক্ত করলাম নিজেকে। ‘আমি দেখে আসছি কে এলো।’
দরজা খুলতেই দেখতে পেলাম ইথান আংকেল দাঁড়িয়ে আছেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আংকেল আপনি?’
‘মানে,’ ইতস্ততবোধ করছেন উনি, ‘ডিস্টার্ব করলাম না তো?’
‘আরে কি যে বলেন,’ মুখে অমায়িক হাসি ফুটিয়ে বললাম আমি, ‘ডিস্টার্ব হবে কেন? আমি আর রেইনা গল্প করছিলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে।’
‘কি ব্যাপার আংকেল?’ আমার পেছন থেকে রেইনা বলে উঠল, ‘কোন সমস্যা?’
‘না,’ ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বললেন আংকেল ইথান, ‘মানে শুভকে নিয়ে একটু পাহাড়ে ঘুরতে যেতে চেয়েছিলাম আর কি। ভোর হয়ে আসছে। এসময় পাহাড়ের দৃশ্য খুবই মনোরম মনে হয়। তোমরা যদি ব্যস্ত থাকো, তাহলে থাক না হয়।’
রেইনা কিছু বলার আগেই আমি বললাম, ‘কোন সমস্যা নেই আংকেল। আমি তৈরী হয়ে আসছি।’
‘ঠিক আছে সান,’ হাসিমুখে বললেন আংকেল, ‘আমি নিচে ওয়েট করছি তোমার জন্য।’
দরজা আটকে দিয়ে পেছনে ফিরলাম আমি। রেইনা চুলে আঙ্গুল বোলাচ্ছে।
‘সরি রেইনা,’ মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম আমি।
‘এটা কোন সমস্যা নয়,’ হাসিমুখে বলল ও, ‘যাও ঘুরে এসো। ভাল লাগবে। আংকেলের সাথে আরো ঘনিষ্ট হতে পারবে এই সুযোগে।’
এই বলে আমাকে জড়িয়ে ধরল রেইনা। বলল, ‘কতটুকু ভালবাসো তার প্রমানটা না হয় পরেই করো।’
মৃদু হেসে উঠলাম আমি। দুষ্টুমীর হাসি।
০৩
সবচেয়ে উচু পাহাড়টার কাছে এসে অবাক হয়ে গেলাম আমি। পাহাড়টা দেখে নয়, ইথান আংকেলকে পাহাড়ের পাদদেশে একটা বাড়িতে ঢুকতে দেখে।
‘কোথায় যাচ্ছেন আংকেল?’ পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘এসো,’ হেসে জবাব দিলেন আংকেল। কিন্তু হাসিটা কেমন যেন ম্লান বলে মনে হলো আমার। ‘নিজেই দেখতে পাবে।’
অগত্যা তার পিছু নিয়ে বাড়িটার ভেতর ঢুকলাম আমি।
পুরনো ছোট্ট একটা বাড়ি এটা। মাত্র তিনটে ছোট ছোট রুম আছে এতে। তার একটাতে গিয়ে বসলাম আমরা। রুমের ভেতর বইয়ের ছড়াছড়ি। মাঝখানে একটা ছোট টেবিল, দুপাশে দুটো চেয়ার। এককোণে একটা ছোট ফ্রিজ রাখা। সেখান থেকে গোটা দুই গ্লাস আর একটা বোতল বের করলেন তিনি।
গ্লাস দুটো ভরে একটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি। তারপর একটা চেয়ারে বসে অন্যটির দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আমি বিনাবাক্যব্যয়ে বসে পড়লাম। বুঝতে পারছি এটা হয়তো উনারই আরেকটা বাড়ি।
গ্লাসে ছোট একটা চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকালেন তিনি। চোখের দৃষ্টি যেন কেমন ঘোলাটে লাগছে। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম হতাশার দৃষ্টি এটা।
‘বিয়েটা কি এক সপ্তাহ পরে করলে হয় না মাই সান?’ যেন মিনতি করছেন, এমন ভঙ্গিতে বললেন আংকেল ইথান। ‘প্লিজ!’
-‘কেন আংকেল? কোন সমস্যা?’
আমার প্রশ্ন শুনে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। বললেন, ‘হ্যাঁ, ছোট একটা সমস্যা আছে। তাই তোমাকে অনুরোধ করছি আমি বিয়েটা এক সপ্তাহ পরে করো তোমরা।’
‘কি সমস্যা আংকেল?’ শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
বেশ কিছুক্ষণ চোপ করে থেকে মুখ খুললেন তিনি।
‘আজকে তোমরা বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছো, কিন্তু দিনটি শুভ নয়। আমার যতটুকু ধারনা, আজ তোমাদের মধ্যে একজন মারা যেতে পারো।’
‘কি বলছেন এসব?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি, ‘মানে কি এর?’
আবার কিছুক্ষণ নিরবতা। ভেতরে ভেতরে আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে।
ব্যাটা কি আমাকে আহাম্মক পেয়েছে নাকি? তোর ভাতিজির সাথে আমার মতো বাংলাদেশীর বিয়ে দিবি না, এটা সোজাসুজি বলে দিলেই তো হয়। শুধু শুধু নাটক করার কি আছে? এই শালা আমেরিকানরা আসলেই কেমন যেন!
দীর্ঘক্ষণ পর মুখ খুললেন তিনি। ‘তোমাকে কিছু কথা বলবো। আমাকে কথা দিতে হবে যে রেইনাকে তা জানাবে না কখনো। প্লিজ।’
‘বলুন,’ যতটা সম্ভব মাথা শান্তভাবে বললাম আমি।
‘আগে কথা দাও,’ হঠাত আমার দুহাত ধরে বললেন তিনি, ‘রেইনাকে এসব বিষয়ে কিছু বলবে না।’
মহা বিপদ দেখি! পাগলে পাল্লায় পড়লাম না তো! কে জানে!
‘ঠিক আছে,’ এবারো শান্তগলায় বললাম আমি, ‘যদি সব শুনে আমার মনে হয় যে রেইনাকে বলার দরকার নেই, তাহলে বলবো না ওকে। আপনি বলুন।’
গ্লাসটা খালি করে আবার ভরে নিলেন তিনি। সেটাতে এক চুমুক দিয়ে তারপর আমার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘তোমরা সবাই জানো যে আমি একজন
জ্যোতির্বিদ। এছাড়া আমার আরো একটা পরিচয় আছে। আমি শখের বসে শয়তানের উপর অনেক পড়াশোনা করেছি। আর সেই জ্ঞান থেকে একটা কথা বলছি। তুমি আর রেইনা, তোমরা কেউই সাধারন মানুষ নও। তোমরা বাকিদের চেয়ে ভিন্ন।’
-‘মানে?’
-‘বলছি শোন। শয়তান, পিশাচ, ভ্যাম্পায়ার এসব বিশ্বাস করো?’
এ কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলাম আমি। কল্পনাও করিনি এই মুহূর্তে এই প্রশ্ন শুনতে হবে। ধীরে ধীরে বললাম আমি, ‘শয়তান আছে, এটা বিশ্বাস করি। অন্যগুলোর ব্যপারে অবিশ্বাস আছে আমার।’
যেন এটাই আশা করছিলেন তিনি, এমনভাবে তাকালেন আমার দিকে। ‘মজার কথা কি জানো? তুমি আর রেইনা, দুজনই ঐ গোত্রের।’
সবে গ্লাসটা মুখে তুলেছিলাম আমি। কিন্তু আংকেলের কথা শুনে নামিয়ে নিলাম সেটা। ‘কি বলছেন এসব?’
‘হ্যাঁ,’ গম্ভীরগলায় জবাব দিলেন তিনি, ‘আমি ঠিকই বলছি। রেইনার ব্যাপারটা আমি ওর জন্মের পর থেকেই জানি। তোমারটা জানতাম না। নিশ্চয়ই খেয়াল করেছো, আজ তোমাকে ওর সাথে দেখে চমকে উঠি আমি। কারন, তুমি নিজেও এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। যাকে বলে অমানব বা ডেসিয়েরটু (desierto)।’
‘মানে কি?’ চরম অবিশ্বাসে খেঁকিয়ে উঠলাম আমি। ‘আপনি বলতে চাইছেন আমি বা রেইনা, কেউই মানুষ নই? মানুষরুপী পিশাচ বা ঐজাতীয় কিছু?’
‘হ্যাঁ,’ আগেরমতোই জবাব দিলেন তিনি, ‘ঠিক ধরেছো।’
‘পাগল না কি?’ গলা উচু হয়ে গেছে আমার, ‘এসব কথা কে বলেছে আপনাকে? নাকি গাজা খেয়েছেন আপনি?’
‘দেখো সান,’ আগেরমতোই শান্ত নিরুত্তাপ গলায় উত্তর দিলেন তিনি, ‘আমি যা বলছি তা একশতভাগ শিওর হয়েই বলছি। আমার কথা বিশ্বাস করতে পারো।’
‘কিভাবে?’ রাগ উঠে গেছে আমার। ‘কিভাবে সম্ভব এটা? আর তাছাড়া এতোদিন ধরে কেউ ধরতে পারলো না, আপনি এক দেখাতেই ধরে ফেললেন ? এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে বলছেন?’
এবার চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালেন তিনি। পাশে থাকা বইয়ের স্তুপ ঘেটে দুটো বই বের করলেন। তারপর আবার চেয়ারে এসে বসে বই দুটো মেলে ধরলেন আমার সামনে।
'আমি এখন তোমাকে পুরোটা ব্যাখ্যা করবো।’ নিরুত্তাপ গলায় বললেন তিনি। ‘মন দিয়ে শুনবে। মনে কোন খটকা বাধলে তখন বলো। ঠিক আছে?’
এখানে রাগ করে কোন লাভ হবে না। তারচেয়ে বুড়ো কি বলে শোনা যাক।
‘ঠিক আছে,’ শান্তগলায় বললাম আমি, ‘শুরু করুন।’
আংকেল ইথান শুরু করলেন।
০৪
‘রেইনার জন্ম হয় ২৯শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সালে। সকাল সাতটা ছয় মিনিটে।
ওর জন্মটা একটু অদ্ভুদই বলতে গেলে। ওর জন্ম হয়েছিল জাহাজে, প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে। আমরা সবাই, মানে রেইনার বাবা, মা আর আমি নিউজিল্যান্ড থেকে পেরুতে ফিরছিলাম। রেইনার মা প্রেগনেন্ট ছিল জানতাম। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি রেইনার জন্ম হবার কথা ছিল না। সাতমাসের মতো চলছিল রেইনার মায়ের। হঠাত করেই তার পেইন উঠে আর রেইনার জন্ম হয়।
রেইনাকে জন্ম দিতে গিয়ে রেইনার মা মারা যায়। ওর জন্মের মাত্র একশ এগারো দিনের মাথায় ওর বাবাও হঠাত করে মারা যায়। তারপর থেকে রেইনা আমার কাছেই আছে।
তুমি হয়তো ভাবতে পারো এ থেকে কিভাবে বোঝা সম্ভব ও আসলে স্বাভাবিক মানুষ নয়। কারনটা বলছি।
১৯৯২ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী ছিল পূর্ণিমা। সে হিসেবে ২৯শে ফেব্রুয়ারি ছিল কৃষ্ণপক্ষের বারোতম দিন। তার মাত্র চারদিন পর ৪ঠা মার্চ ছিল অমাবস্যা। ২৫শে ফেব্রুয়ারী ছিল কৃষ্ণা প্রথমার শেষ দিন। তারমানে ২৯শে ফেব্রুয়ারী দিনটি ছিল কৃষ্ণা দ্বিতীয়ার চতুর্থ দিন।
২৯শে ফেব্রুয়ারী রেইনা জন্মাবার পরেই ওর মা মারা গেলো। তার ঠিক একশ এগারো দিন পর মারা গেলো রেইনার বাবা। ১৯শে জুন। সেদিন ছিল কৃষ্ণপক্ষের এবং কৃষ্ণা প্রথমার চতুর্থদিন। কারন তার বারোদিন পর ১লা জুলাই ছিল অমাবস্যা। ১৫ই জুন ছিল পূর্ণিমা।
এবার আসি তোমার দিকে।
তোমার জন্ম তারিখ ১০শে নভেম্বর ১৯৯১। ৬ই নভেম্বর ছিল অমাবস্যা। সে হিসেবে ১০ই নভেম্বর ছিল শুক্লপক্ষের চতুর্থদিন। একইভাবে শুক্লা প্রথমার চতুর্থদিন।
আর তাছাড়া, তোমার জন্মটা হয়েছিল সন্ধ্যা সাতটা ছয় মিনিটে। সে হিসেবে তোমার আর রেইনার জন্মদিনের মধ্যে পার্থক্য ঠিক একশ এগারো দিন। এখন এ থেকে কিছু বুঝতে পারছো?’
মাথা চুলকালাম আমি। কিছুই বুঝতে পারছি না। কিসের শুক্লপক্ষ আর কিসের কৃষ্ণপক্ষ! কিসের মধ্যে কি?
আমার মুখের ভাব দেখেই হয়তো যা বোঝার বুঝে নিলেন ইথান আংকেল। আবার শুরু করলেন তারপর।
‘এক চান্দ্রমাসের মান ২৯.৫৩ দিন। ২৯.৫৩ কে পূর্ণসংখ্যাতে রুপান্তরিত করলে হয় ৩০। এই ৩০ দিনকে ৩০ টি সমান ভাগে ভাগ করে, এক একটি অংশকে বলা হয় তিথি। তিথি হলো ১ চান্দ্রদিন। এবার প্রশ্নটা হলো, কেন?
অমাবস্যা কে আদি তিথি বা ১ম দিন ধরা হয়। যখন চন্দ্র ও সূর্য্যের একই সরলরেখায় মিলন হয় তখন অমাবস্যা হয় । সুতরাং তিথি= ১ চান্দ্রদিন।
অমাবস্যার পরের দিন প্রতিপদ বা প্রথমা এবং শুরু শুক্লপক্ষ। সুতরাং অমাবস্যার পরের দিন শুক্লপক্ষের প্রতিপদ বা প্রথমা। চন্দ্র, সূর্য্যের সাপেক্ষে ১২ ডিগ্রী কৌণিক দূরত্ব (angular distance) অতিক্রম করলেই প্রতিপদ বা প্রথমার শেষ এবং শুক্লা দ্বিতীয়ার আরম্ভ।
পক্ষ ২টি। শুক্লপক্ষ এবং কৃষ্ণপক্ষ। পক্ষ সাধারণত ১৫ দিনের। অমাবস্যা থেকে পরের ১৫ দিন পর পূর্ণিমা। এই ১৫ দিন শুক্লপক্ষ । আবার পূর্ণিমা থেকে পরের ১৫ দিন পর অমাবস্যা। এই ১৫ দিন কৃষ্ণপক্ষ। সুতরাং ১ চান্দ্রমাসের ১ম ১৫ দিন শুক্লপক্ষীয় এবং ২য় ১৫ দিন কৃষ্ণপক্ষীয়। তিথি, যে কোন দিনাঙ্কের যে কোন সময়ে শুরু হতে পারে; দিনে অথবা রাত্রিতে।
সাধারণত পঞ্জিকার যে কোন দিনাঙ্কের সূর্যোদয়ের সময় যে তিথি চলছে সেটাই সেই সৌরদিনের তিথি হিসাবে গণ্য হবে। তিথির মান ২০ থেকে ২৭ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। এর কারণ চন্দ্রের জটিল গতি। চন্দ্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করে এক কক্ষপথে ঘুরে চলেছে, এটা আমরা সবাই জানি। কক্ষপথটি কিন্তু উপবৃত্তাকার (Elliptical)| যার ফলে চন্দ্রের গতি সেই কক্ষপথে সব জায়গায় সমান নয়। কখনো ধীরে, কখনো জোরে।--আর সেই জন্যেই তিথির মান ২০ থেকে ২৭ ঘণ্টা পর্যন্ত হয়।
তুমি আর রেইনা দুজনই সাতটা ছয় মিনিটে জন্মেছো। একজন সকালে, একজন সন্ধ্যায়। ঘড়ির হিসেব ষাট মিনিটে। তবে এটাকে আমরা অন্যভাবেও বলতে পারি ইচ্ছে করলে। সকাল সাতটা ছয় মিনিটকে আমরা সকাল ছয়টা ছেষট্টি মিনিটও বলতে পারি ইচ্ছে করলে। সন্ধ্যা সাতটা ছয় মিনিটকেও একইভাবে সন্ধ্যা ছয়টা ছেষট্টি মিনিট বলতে পারি। তাহলে কি পাওয়া গেল? ৬:৬৬। মানে তিনটা ছয়। শয়তানের প্রতীক চিহ্ন বলা হয় একে।
এছাড়া তোমাদের দুজনের চোখের মণির রং কালচে বেগুনী। খুব ভালোভাবে না তাকালে যা ধরা পড়ে না। এগুলো হচ্ছে অমানব বা ডেসিয়েরটু (desierto) হবার প্রমান।
মজার কথা কি জানো? এইরকম পারফেক্ট মিল সচরাচর দেখা যায় না। প্রতি ছয়শত ছেষট্টি বছর পর পর এরকম দুটো বাচ্চা পৃথিবীতে জন্ম নিতে দেখা যায়। আর সেই হিসেবে তোমরাই সেই দুজন।
এছাড়া আরো কিছু সমস্যা আছে। আমরা জানি যে ২৯শে ফেব্রুয়ারী চার বছরে একবার আসে। কিন্তু এটা শুধুই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুসারে। মজার কথা কি জানো? আমার লাইনে যারা আছে, তাদের মধ্যে বেশীরভাগই এটাকে তেমন একটা মানে না। আমি নিজেও বাহ্যিক প্রয়োজন ছাড়া এই ক্যালেন্ডার খুব একটা মানি না বললেই চলে।
কাজের সুত্রে অনেকদিন আমাকে পেরুর বিভিন্ন জঙ্গলে থাকতে হয়েছে। রেইনার জন্মের পর অবশ্য ওখান থেকে চলে আসি। আসলে ওখান থেকেই আমার এই বিষয়ের উপর আগ্রহ জন্মায়। ওখানকার আদিবাসীরা দিনগণনার জন্য একটা অদ্ভুদ ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতো। যার সাথে তুমি জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের হুবহু মিল পাবে। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ছিল সুইডিশ সাম্রাজ্যের ক্যালেন্ডার। মানে যে সময় ওটা ফিনল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত ছিল আর কি।
মজার কথা কি জানো? জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে কিন্তু ফেব্রুয়ারী মাস আটাশ বা ঊনত্রিশ দিনে ছিল না। ত্রিশ বা একত্রিশ দিনে মাস গণনা করা হতো সেখানে। সাধারন বছরে ফেব্রুয়ারী ত্রিশ দিনে, আর লিপইয়ারে একত্রিশ দিনে হিসেব করতো ওরা।
ওরা ১৭০০ সাল থেকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার শুরু করে এবং পরবর্তী ৪০ বৎসর জন্য লিপ দিন গুলি বাতিলের পরিকল্পনা করা হয়। যদিও ফেব্রুয়ারী ১৭০০ সালে অধিবর্ষ দিনটি বাদ দেওয়া হয়েছিল কিন্তু, পরের বছরই গ্রেট নর্দার্ন যুদ্ধ শুরু হয়, সুইডিশদের পক্ষে এই সময় ক্যালেন্ডার পরিবর্তে মনোনিবেশ করা সম্ভব হয়নি, ফলে পরবর্তী দুইবার অধিবর্ষে অতিরিক্ত দিনগুলো অপসারণ করা সম্ভব হয়নি এবং ১৭০৪ এবং ১৭০৮ সালে পূর্বের মত অধিবর্ষ পালন করা হয়।
বিভ্রান্তি এবং আরো ভুল এড়ানোর জন্য, ১৭১২ সাল থেকে পুনরায় জুলিয়ান পঞ্জিকা ব্যবহার শুরু করা হয়, এই বছর ফেব্রুয়ারী মাসে অধিবর্ষ দিনটি ছাড়াও অতিরিক্ত একটি দিন যোগ করা হয় এবং ঐ বছর ফেব্রুয়ারী মাসে ৩০ দিন ছিল। এই তারিখটি জুলিয়ান পঞ্জিকা মধ্যে ফেব্রুয়ারী ২৯ এবং গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে মার্চ ১১ তারিখ নির্দেশ করে। সুইডিশদের গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকাতে পরিবর্তন সম্পন্ন হয় ১৭৫৩ সালে, ঐ বছর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ ১১ দিন বাদ দিয়ে এটি সম্পন্ন করা হয়।
এখন বর্তমানে আসি। আমি কিন্তু এখনো আমার এই “স্পেশাল” কাজগুলো প্রাচীন জুলিয়ান ক্যালেন্ডারই ব্যবহার করি। তোমার জন্ম হয়েছে সন্ধ্যায়। রেইনার জন্ম সকালে। যার ফলে তোমরা দুজন দুজনের শত্রু। তোমরা দুজন কোনভাবেই এক হতে পারবে না কখনো। এটাই নিয়ম।
আর জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ২০১৪ সালের ২০শে জুন, মানে আজ তোমাদের দুজনের জন্যই ভয়াবহ রকমের বিপদজনক।’
আমি হতভম্ভ হয়ে গেছি। এ কি সত্যি? না কি ভুলভাল বকছেন আংকেল ইথান? কি করবো বুঝতে পারছি না আমি। মাথায় কিছু খেলছে না আমার।
‘বিপদটা কিভাবে হবে?’ অনেকক্ষণ চোপ করে থাকার পর জিজ্ঞেস করলাম আমি, ‘মানে, ঠিক কি ঘটতে পারে আন্দাজ করতে পারেন?’
‘অনুমান নয়,’ মাথা নেড়ে বললেন আংকেল, ‘আমি জানি কিভাবে কি হবে।’
‘কিভাবে?’ উত্তেজিত হয়ে উঠেছি আমি। ‘কি হবে?’
কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর জবাব দিলেন তিনি, ‘শুনতে খারাপ শোনা যাবে। তোমাদের দুজনের বিয়ের পর তোমরা যখন মিলিত হবে, তখন থেকে এটা শুরু হতে থাকবে। সঙ্গম শেষে তোমরা দুজনই শক্তিশালী হয়ে যাবে। তখন আর নিজেদের উপর তোমাদের কোন নিয়ন্ত্রন থাকবে না। যেহেতু এসময় আর কোন অমানব পৃথিবীতে নেই, সেহেতু তোমরা দুজন একে অপরকে মারা জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কে বাঁচবে আর কে মরবে তা বলা সম্ভব নয়। তবে রেইনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশী।’
‘মৃত্যুটা কিভাবে হবে বলতে পারেন?’ গম্ভীরগলায় প্রশ্ন করি আমি।
‘হ্যাঁ, পারি।’ বই ঘাটতে শুরু করলেন আংকেল ইথান, ‘এখন তোমরা দুজনই অমানবের নিম্নস্তরে আছো। সঙ্গমের পর দুজনই দ্বিতীয় স্তরে উঠে যাবে। তারপর একে অন্যকে হত্যা করে তৃতীয় বা সর্বোচ্চ স্তরে পৌছে যাবে। মৃত্যুটা হবে জঘন্যভাবে। একে অন্যকে মেরে মৃতদেহের চোখ খাবে। এটাই লেখা আছে এখানে।’
কি জঘন্ন! এটাও কি সম্ভব? রেইনাকে আমি ভালবাসি। ওকে আমি কিভাবে হত্যা করবো? একইভাবে বলতে গেলে রেইনার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। রেইনাও আমাকে যথেষ্ট ভালবাসে। পাগলিটা আমাকে খুন করবে! অবিশ্বাস্য!
হঠাত আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো। রাইনের জন্মের একশো এগারো দিন পর ওর বাবার মৃত্যু হয়। দিনটি ছিল ১৯শে জুন। আর আমাদের বিয়ে আজ। বিশে জুন। খটকা বেধে গেলো না?
ইথান আংকেলকে এটা জিজ্ঞেস করতেই উনি বললেন, ‘এখানে তারিখগুলো হিসেব করা হয়েছে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে। এটা মনে রেখো জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারী মাস ত্রিশ বা একত্রিশ দিনে হয়ে থাকে। ২০১৪ অধিবর্ষ বা লিপইয়ার নয়। সুতরাং ফেব্রুয়ারি মাস হিসেব করতে হবে ত্রিশদিনে। তারমানে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুসারে একশ এগারোতম দিন দাঁড়ায় জুনের বিশ তারিখে। বুঝেছো?’
‘হুম,’ মাথা নাড়ালাম আমি। ‘বুঝেছি। এখন আমাকে কি করতে বলেন?’
গলা খাঁকারি দিলেন আংকেল, ‘আমি বলি কি, বিয়েটা তোমরা কাল করো বা এক সপ্তাহ পরে করো। তাহলেই আর কোন সমস্যা হবার কথা নয়।’
‘ঠিক আছে।’ আগেরচেয়ে অনেক ঠান্ডা গলায় বললাম আমি, ‘তাই হবে। আমি রেইনাকে ম্যানেজ করে নেবো।’
‘ধন্যবাদ’ আমার দুহাত ধরে বারবার ঝাঁকাতে লাগলেন আংকেল। বুঝতে পারছি অনেক খুশি হয়েছেন উনি।
‘আচ্ছা আংকেল,’ হঠাত আরেকটা কথা উঁকি দিল আমার মাথায়, ‘রেইনা ব্রুজা- এই নামটার মানে কি?’
মৃদু হাসলেন আংকেল। ‘এর মানে হচ্ছে ডাইনীর রাণী। রেইনা শব্দের অর্থ হচ্ছে রাণী, আর ব্রুজা অর্থ ডাইনী।’
হাসি নাকি সংক্রামক ব্যধি। কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম সেটা।
এমনসময় আংকেলের পকেটে থাকা সেলফোনটা বেজে উঠল। কল রিসিভ করে কথা বলতে আরম্ভ করলেন উনি।
বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রেখে দিলেন আংকেল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সরি সান। এখনই আমাকে লাসভেগাস যেতে হচ্ছে। প্লিজ ডোণ্ট মাইন্ড। চল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাই। রেইনাকে বলতে হবে।
সকাল সাতটার সময় আংকেল ইথানের বাসায় পৌছেছি আমরা। তখনও রেইনা ঘুমিয়েছিল। আমি তাড়াতাড়ি রেইনাকে ডেকে তুলেছি। আংকেল তড়িঘড়ি করে রেডি হলেন। আমি আংকেলকে এগিয়ে গিয়ে এসে দেখি রেইনা তৈরী হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি আমিও তৈরী হয়ে নিলাম। চার্চে যেতে হবে।
০৫
‘দেখলে তো আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি?’ দুষ্টুমীর ছলে বলে উঠলাম আমি। আমার কথা শুনে মেয়েটা খিল খিল করে হেসে উঠলো।
আমার বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে ও। ওর শরীরের গন্ধ আসছে নাকে। ভাল লাগছে আমার। খুবই ভাল লাগছে।
‘আংকেল এখনো আসছে না কেন?’ কিছুক্ষণ পর উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করলো রেইনা।
‘চলে আসবে।’ শান্তকন্ঠে বললাম আমি। ‘তুমি এতো চিন্তা করো না তো। চুপ করে শুয়ে থাকো।’
‘উমমম,’ আদুরে গলায় বলে উঠলো রেইনা।
এমনসময় রেইনার ফোনটা বেজে উঠলো হঠাত করেই। উঠে গিয়ে ফোন রিসিভ করলো ও।
‘কি? কোথায়?’ চিৎকার বেড়িয়ে এলো রেইনার মুখ থেকে। ‘আমরা এখনই আসছি।’
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমি রেইনার দিকে। আমার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল ও।
‘শুভ, তাড়াতাড়ি কাপড় পড়ে নাও। হাসপাতালে যেতে হবে।’
‘কেন?’ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি আমি। ‘কি হয়েছে?’
‘আংকেল,’ কেঁদে ফেললো রাইনা। ‘আংকেল এক্সিডেন্ট করেছে।’
০৬
ব্রিলিয়ান্ট মানুষদেরও অনেক ভুল হয়!
আংকেল ইথানের কথাগুলো ঠিকই ছিল। কিন্তু হিসেবে ভুল করে ফেলেছিলেন তিনি। ছোট্ট, কিন্তু মারাত্বক একটা ভুল।
রেইনার বাবা আসলে ১৯শে জুন মারা যাননি। তিনি মারা গিয়েছেন ১৭ই জুন। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেবে ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারী মাস ছিল একত্রিশ দিনে। সেই হিসেবে ২৯শে ফেব্রুয়ারী থেকে ১৭ই জুন হয় একশো এগারো দিন। একইভাবে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার মতে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাস হবে ত্রিশ দিনে। এখানেও একই হিসেব প্রযোজ্য। ২৯শে ফেব্রুয়ারি থেকে হিসেব করলে একশো এগারোতম দিন হবে ১৮ই জুন। ২০শে জুন নয়।
আমাদের উপর যে বিপদটা উনি আশা করেছিলেন, তা কেটে গেছে দুদিন আগেই। আরেকটু সতর্কতার সাথে হিসেব করলেই তাকে আর এই পরিনতি মেনে নিতে হতো না। আমারো আর কষ্ট করতে হতো না।
অমানব বা ডেসিয়েরটু (desierto) যাই বলা হোক না কেন, আমাদের একটা অলিখিত নিয়ম আছে। যেটা আমাদের রক্তে মিশে আছে। আর তাহলো, নিজের পরিচয় সবসময় গোপন রাখতে হয় আমাদের। যদি কেউ ভুলক্রমেও জেনে ফেলে, তবে তাকে মরতে হবে।
রেইনা যে মানুষ নয়, আমি চাইনা কখনো এটা জানুক ও। আমাকে বলে ভুল করেছিল ইথান আংকেল। আমি আর সেই ভুল করবো না। আর ইথান আংকেলও যাতে কখনও বলতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা আগেই করে ফেলেছি।
আমি আর রেইনা ফিরে এসেছি আবার আমাদের নিজেদের শহরে। নিজেদের একটা জগত তৈরী করবো আমরা। যে জগতে বাস করবো শুধু আমি আর রেইনা। আর কেউ না।
ওহ, ভাল কথা, রেইনা আর এখন রেইনা ব্রুজা নেই। ব্রুজা কেটে আরিয়ান বসিয়ে নিয়েছে ও। এখন ও আর ডাইনীর রানী নয়। ও এখন আমার রাণী।
আমি রেইনাকে খুবই ভালবাসি। চিরদিনই বাসবো।