০১
যদি এমন হয় যে, রুদ্র একজন মানষিক রোগী, এবং সে একটার পর একটা খুন করেই যাচ্ছে? এভাবেই একদিন খুন করতে করতে সে দেখা পায় গল্পের নায়িকা বিন্দুর সাথে?
নাহ! এরকম অনেক গল্প আছে। এবারের গল্পটাকে অন্যভাবে সাজাতে হবে। এভাবে হবে না। সম্পূর্ণ নতুন প্লট লাগবে।
আচ্ছা, বাইপোলার ডিসঅর্ডার নিয়ে গল্প বানালে কেমন হয়? কিংবা বুলিমিয়া সিন্ড্রোম?
বারনাট সাইন সিন্ড্রোম, চাইল্ডহুড অবিসিডি, ডিসেসটার রিকভারী ট্রমা, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স এবিউস ম্যান বাই ওমেন, ইমোশনাল সাইকোলজিক্যাল ট্রমা, প্যানিক ডিসঅর্ডার, পোষ্ট ট্রমিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা এই ধরণের কিছু?
উহু! এগুলো নিয়ে অনেক গল্প আছে। আমার নিজেরই তো অনেক গল্প আছে এসবের উপরে। এসব বাদ। পাবলিক পছন্দ করবে না। একঘেয়েমীতে পড়ে যাবে। তাই একেবারে নতুন কিছু নিয়ে লিখতে হবে। সামথিং নিউ!
বা হাতের দু’আঙ্গুলে কপালটা চেপে ধরি আমি। মৃদু ব্যথা অনুভুত হচ্ছে। বুঝতে পারছি না এর কারন। ইদানিং নতুন কোন গল্প লিখতে গেলেই এই জিনিসটা হচ্ছে আমার। নতুন কিছু নিয়ে ভাবতে গেলেই মাথার ভেতরে হালকা মৃদু ব্যথা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এটা। অবশ্য কিছুক্ষণ পর যেভাবে এসেছিল সেভাবে চলেও যায়।
টেবিলের ড্রয়ার থেকে লাইটার আর সিগারেটের প্যাকেট বের করি আমি। প্যাকেট থেকে একটা শলা বের করে ধরিয়ে নিয়ে প্যাকেট আর লাইটারটা প্যান্টের পকেটে চালান করে দিই। তারপর বারান্দায় গিয়ে দাড়াই।
এখন আকাশ কালো। কালো আকাশের মাঝে জ্বলজ্বল করছে হাজার হাজার তারা। চাঁদটাকে অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। না দেখা গেলো, আমি তারাগুলোই দেখবো।
“আকাশের ঐ মিটিমিটি তারার সাথে কইবো কথা
নাই বা তুমি এলে......”
মৃদুস্বরে গেয়ে উঠি আমি। ভাল লাগছে আমার। তারায় ভরা আকাশ, মৃদুমন্দ হাওয়া, হাতের সিগারেট, নিচে খালি রাস্তায় বসা তিনটে কুকুর, সবই ভাল লাগছে আমার কাছে।
ব্যথাটা বাড়ছে। বাহাত থেকে সিগারেটটা ডানহাতে নিয়ে আবার দু’আঙ্গুলে চেপে ধরি কপালটা। অসহ্য আকার ধারন করছে এটা। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, ধীরে ধীরে ঘামে ভরে উঠছে শরীর। আর কিছুক্ষণ, তারপরই শেষ হয়ে যাবে এটা।
অস্থির হয়ে উঠছি আমি। ব্যথাটা মাথা থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে যেন। ধীরে ধীরে বসে পড়ি আমি বারান্দায়।
হাত থেকে সিগারেটটা পড়ে গেছে, কিন্তু তোলার শক্তিটা পাচ্ছি না। যেন কোন দানব আমার সারা শরীর খামছে ধরেছে, আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। হাতটা পর্যন্ত নিজের নিয়ন্ত্রনে নেই।
কি অশান্তি!
যেমন করে এসেছিল, ঠিক তেমন করেই চলে গেলো ব্যথাটা। একেবারে হঠাত করে, যেন এই ছিল, এই নেই হয়ে গেলো।
জোড়ে জোরে দু’বার শ্বাস টানলাম আমি। সিগারেটটা হাতে নিয়েই বুঝলাম, ঘামে ভিজে গেছে। ভিজে গেছে আমার শরীরে থাকা টি-শার্টটাও।
ধীরে ধীরে উঠে দাড়ালাম আমি। মৃদু বাতাস আমার ঘাম শুষে নিচ্ছে একটু একটু করে। মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে পকেটে হাত দিলাম আমি। সিগারেটের প্যাকেট থেকে আরেকটা শলা বের করে ধরিয়ে নিলাম আমি।
কাল ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ব্যথাটা অসহ্য হয়ে উঠছে দিন দিন। এভাবে আর এটাকে রাখা সম্ভব না। একটা প্রতিকার করা উচিৎ এর।
০২
সেলফোনটা বেজে উঠতেই একটা ঝাঁকি খেলাম আমি। কিংবা বলা যায়, হঠাত ঝাঁকি খাওয়ার সাথে সাথে সেলফোনটা বেজে উঠলো। চোখে এখনো ঘুমের আবেশ রয়ে গেছে।
স্ক্রিনটা চোখের সামনে ধরতেই স্বর্ণার নামটা দেখতে পেলাম। রিসিভ করলাম আমি।
-‘হ্যালো?’
-‘ঘুমাচ্ছিলে?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘এই অবেলায় ঘুম?’
-‘মাথাটা আবার ব্যথা করছিল।’
-‘ওওও। শোন, ডাক্তারের সাথে কথা হয়েছে আমার। তোমার সব রিপোর্ট চেক করেছেন তিনি।’
-‘কি হয়েছে আমার?’
-‘তেমনকিছু না। ঘাবড়াবার কিছু নেই।’
-‘হুম।’
-‘কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি আমি। এই ধরো, পনেরো মিনিট।’
-‘ওকে, চলে এসো।’
ফোনটা রেখে শরীরটাকে একটা মোচর দিলাম আমি। ঘুমের আবেশ কাটানোর জন্য যা করে থাকি সবসময়। দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেলাম। হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতে হবে।
হঠাত একটা শব্দ কানে আসতেই থেমে গেলাম আমি।
কারো হাটার শব্দ! সেইসাথে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলছে কে যেন!
স্বর্ণা কি এরইমধ্যে এসে গেলো নাকি?
নাহ! এ স্বর্ণা নয়। কারন যেখানে নিজেই ফোনে জানিয়ে দিয়েছে ও আসবে, সেখানে ও আর যাই করুক, পা টিপে টিপে হাটবে না। এ অন্য কেউ।
ধীরে ধীরে বাথরুমের দরজা দিয়ে তাকালাম আমি। যা ভেবেছিলাম। অন্য কেউ!
দুটো কালমতোন লোককে দেখা যাচ্ছে। একজন ধীরে ধীরে বারান্দার দিকে যাচ্ছে, অন্যজন আমার বেডের দিকে।
প্রথমে আমার বেডের চারদিকে একটা চক্কর কাটলো কালো লোকটা। তারপর বালিশটাকে উল্টে দিয়ে নিচে কি যেন দেখলো। মাথাটাকে একবার ঝাঁকিয়ে আবার বালিশটাকে আগের জায়গায় রেখে দিলো সে। এবার তার চোখ আমার টেবিলের দিকে।
দ্রত মাথা খাটাচ্ছি আমি। কারা এরা?
নিজের অতীতকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছি আমি। একসময় যে জীবনে ছিলাম, সেখান থেকে বেড়িয়ে এসেছি অনেকদিন হলো। নতুন কোন ঝামেলায়ও জড়াইনি নিজেকে। তাহলে? কোন গুন্ডা-মাস্তান? আমার জানামতে গত একবছরের মধ্যে এমন কোন কাজ আমি করিনি যে, এভাবে কোন গুন্ডা বা মাস্তান আমার বাসায় এসে তল্লাশী করবে। পুলিশ? আমি তো কোন কেসের আসামী নই। আর তাছাড়া, পুলিশ এলে তো দরজায় নক করার কথা!
দরজা!
ভাল কথা, এরা দরজা খুললো কিভাবে? দরজা খোলার কোন শব্দ তো আমার কানে আসে নি! অন্য কোনভাবে আমার বাসায় ঢোকা সম্ভব নয়। তবে?
নাহ! এতোকিছু ভেবে লাভ নেই। কালো লোকদুটোর একজন আমার বেডরুমে আছে, অন্যজন বারান্দায়। এই সুযোগ!
দ্রুত লোকটার পেছনে চলে এলাম আমি। লোকটা এখন আমার টেবিলের ড্রয়ার নিয়ে ব্যস্ত, এই সুযোগে একটানে বিছানার চাদরটা তুলে নিয়ে তার উপরে ছুড়ে দিলাম সেটা। সেইসাথে দুটো লাথি।
লাথি খেয়ে লোকটা মেঝেতে পড়ে গেছে। দ্রুত উঠে বসতে চাইছে। কিন্তু আর কোন প্রতিক্রিয়া দেখানোর সুযোগ দিতে আমি রাজি নই। একের পর এক লাথি হাকাতে থাকলাম লোকটাকে লক্ষ্য করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চাদরটাতে লাল রঙের ছোপ ছোপ দাগ দেখা গেলো। এবার লাথিতে ক্ষান্ত দিলাম আমি।
চাদরটা সরিয়ে লোকটার মুখের দিকে ভালোভাবে তাকালাম আমি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে যেন লোকটার চেহারা। ঠোঁট কেটে গেছে অনেকখানি। কপালের কাছে কিছুটা ফুলে উঠেছে।
হঠাত পেছনে মৃদু শব্দ হতেই চট করে মনে পড়লো আমার, আরেকজন ছিল!
দ্রুত উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু তার আগেই মাথার পেছনদিকে ধপ ধপ করে উঠলো। কিছু একটা দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়েছে সম্ভবত।
স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, চোখের সামনের দৃশ্যটা কালো হয়ে আসছে দ্রুত।
০৩
‘গত চারমাসে এবার দিয়ে তেরোবার এধরনের ঘটনা ঘটেছে,’ স্বর্ণার উদ্বিগ্ন কন্ঠ শুনতে পেলাম আমি।
চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করলাম আমি। সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা দেখাচ্ছে। বেশ কয়েকবার চোখের পাতা ঝাপটানোর পর দৃষ্টি কিছুটা পরিষ্কার হলো মনে হলো।
কিন্তু এ কি! কোথায় আমি!
‘সময়টা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে,’ আবার উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলো স্বর্ণা, ‘প্রথম মাসে একবার, পরের মাসে তিনবার, গতমাসে ছয়বার। আর এমাসের এই দশদিনের মধ্যেই তিনবার একই কাহিনীর সম্মুখীন হলো ও।’
কিসের কথা বলছে স্বর্ণা? মাথাটাকে দুবার এপাশ ও পাশ করলাম আমি। খুব সম্ভবত আমি এখন কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে। কিন্তু কেন?
চারদিকে নজর বুলালাম আমি। ছোট্ট একটা রুমের মধ্যে রাখা হয়েছে আমাকে। একটা বেড, একপাশে ছোট্ট একটা টেবিল, একটা প্লাস্টিকের চেয়ার, এছাড়া আর কোন আসবাব দেখা যাচ্ছে না এখানে।
বেডের দিকে নজর বুলালাম আমি। মাথার দিকে একটা স্ট্যান্ড দেখা যাচ্ছে। তার একপাশে একটা স্যালাইনের সিলিন্ডার দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে একটা পাইপ এসে আমার বা হাতের সাথে সুই দিয়ে সংযুক্ত। অন্যপাশে একটা ব্লাড ব্যাগ দেখা যাচ্ছে, সেটাও একইভাবে আমার ডান হাতে এসে সংযোগ স্থাপন করেছে।
ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করলাম আমি। মাথাটা দপদপ করছে কেন যেন। কিন্তু এটা এখন চিন্তার বিষয় নয়। আমি এখানে কেন, এটা আগে জানতে হবে আমাকে।
আমার নড়াচড়া সম্ভবত স্বর্ণার চোখে পড়ে গেছে। সে এদিকে তাকিয়েই দ্রুত আমার পাশে এসে বসলো। বললো, ‘শুয়ে থাকো তুমি। রেষ্ট নাও।’
‘কি হয়েছে আমার?’ অনেক কষ্টে উচ্চারন করলাম আমি, ‘আমি এখানে কেন?’
‘সবই জানতে পারবেন,’ গম্ভীরস্বরে কে যেন বলে উঠলো।
আমি ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলাম। স্বর্ণার পেছনে ডাক্তারের পোষাক পড়ে একজন দাঁড়িয়ে আছে। মৃদু হাসি তার মুখে। এগিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললো, ‘কিন্তু তার আগে আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন। আমি ডাক্তার রেজাউল ইসলাম। আমি নার্সকে বলে দিচ্ছি, সে ইঞ্জেকশন দিয়ে দেবে। আপনি ঘুমান প্লিজ। পরে কথা হবে আপনার সাথে।’
মৃদু হেসে পেছন ফিরলেন ডাক্তার। স্বর্ণা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঘুমাও তুমি। আমি আছি এখানেই।’
এই বলে উঠে দাড়ালো ও। ডাক্তারের পেছনে হাটতে লাগলো।
চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম আমি। কি হয়েছিল আমার?
লোকদুটোর কথা মনে পড়লো আমার। বারান্দায় যে ছিল, সে পেছন থেকে বাড়ি মেরেছিল সম্ভবত। তারপর আর কিছু মনে নেই আমার। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তখন হয়তো আরো কিছু করেছিল সে।
কে এই লোকগুলো? কি চায় এরা? আমাকে মারতে চাইছে কেন?
চিন্তাটাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করলাম আমি। এরা কি আমার অতীতের কেউ? তারা কি কোনভাবে জেনে গেছে যে আমি বেঁচে আছি? তাই কি আমাকে শেষ করে দিতে চাইছে? হতেও পারে। এরপর থেকে সাবধানে থাকতে হবে আমাকে।
একটু পরই এক নার্স এসে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে উপরে রাখা স্যালাইনের সিলিন্ডারের মধ্যে কিছু একটা ইঞ্জেক্ট করে চলে গেলেন।
আবার চোখের সামনে অন্ধকারের কালো চাদরটা নেমে এলো। এবার ধীরে ধীরে।
০৪
‘ইন্টেগ্রেশন ডিজঅর্ডার?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।
আমার কথা শুনে মাথা ঝাকালেন ডাক্তার রেজাউল করিম।
দুটো দিন কেটে গেছে ইতোমধ্যেই। আমরা এখন বসে আছি ডাক্তার রেজাউল করিমের চেম্বারে। আমরা বলতে আমি আর স্বর্ণা।
‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাকানো শেষ করে বলে উঠলেন ডাক্তার, ‘ইন্টেগ্রেশন ডিজঅর্ডার! রেয়ার একটা মানসিক রোগ।’
দ্রুত মাথা ঘামাতে লাগলাম আমি। ইন্টেগ্রেশন ডিজঅর্ডারের সিম্পটমগুলো ভাবতে লাগলাম।
সাইকোলজিকাল থ্রিলার লেখার জন্য মাঝে মাঝেই বিভিন্ন মানসিক রোগ সম্পর্কে পড়াশোনা করতে হয় আমাকে। সেই সুবাদে ইন্টেগ্রেশন ডিজঅর্ডার নিয়েও মোটামুটি ভালই জানি। এই রোগ হলে রোগীর মাথাব্যাথা হতে থাকে। অসহ্য মাথা ব্যথা। তবে সেটা প্রবলেম না। প্রবলেম হচ্ছে এই, সেই সাথে বিভ্রমের শিকার হয় সে।
‘ইন্টেগ্রেশন ডিজঅর্ডারের সিম্পটমগুলো হচ্ছে,’ বলতে শুরু করলেন ডাক্তার।
‘জানি,’ ডাক্তারের কথার মাঝখানে বাঁধা দিলাম আমি, ‘হ্যালোসিনেশনে ভোগে রোগী। নিজের ভেতর অজানা ভয় থাকে তার। সেই ভয় একসময় দানা বাধে ক্রোধে। মাঝে মাঝেই সে তার কাল্পনিক শত্রুদের দেখতে পায়। সেই কাল্পনিক শত্রুরা তাকে মারতে আসে। কাল্পনিক শত্রুরা তার উপর কোন কারনে প্রতিশোধ নিতে চায়। সে বাঁধা প্রদান করার চেষ্টা করে। কিন্তু আদতে তেমনকিছুই ঘটেনা। সোজা করে বলতে গেলে, শুধু শুধু বাতাসের সাথে মারামারি করে সে।’
‘রাইট,’ আমার সাথে একমত হলেন ডাক্তার, ‘ঠিক বলেছেন আপনি। আর স্বর্ণার সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি, আপনার অতীত একটু ভয়াবহ ছিল। জীবনের অনেকটা সময় মারামারি, কাটাকাটি, এসবেই দিন কেটেছে আপনার। সেখান থেকে কোন এক কারনে ফিরে এসেছেন আপনি। ধীরে ধীরে নিজেকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে তুলে এনেছেন আপনি। আমার মনে হচ্ছে, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পর আপনার ভেতরে একটা ভয় কাজ করছে।’
‘কেমন ভয়?’ প্রশ্ন করলাম আমি।
‘ভয়টা হচ্ছে আপনার অতীত,’ স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিলেন ডাক্তার, ‘নিজের অতীতকে ভয় পান আপনি। যেখানে আপনার অসংখ্য শত্রু রয়েছে। আপনি ভয় পান, সেই শত্রুরা আপনার কোন ক্ষতি করবে। আপনি ভয় পান, তারা আপনার বর্তমানকে বদলে দেবে। তাই নিজের মনের ভেতর কাল্পনিক শত্রু তৈরী করে তাদের মেরে ফেলতে চান।’
চুপ করে বসে আছি আমি। কিছু বলছি না। ভাবছি আসলে।
‘তাছাড়া আরো একটা ব্যপার আছে,’ ডাক্তারের কথায় তার দিকে ফিরে তাকালাম আমি, ‘ব্যপারটা হচ্ছে এই, আপনি একজন সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার লেখক। মানুষের বিভিন্ন মানসিক অবস্থা নিয়ে লিখতে ভালোবাসেন। যা লেখেন, তা নিজে বিশ্বাস করে তারপরই লেখেন বলে আমার ধারণা। তাই সেই লেখাগুলোতে সবসময় নিজের জীবনের ছাপ দেখতে পছন্দ করেন আপনি। এ থেকে ধারণা করতে পারি, সচেতনভাবেই হোক বা অবচেতনভাবেই, গল্পগুলোতে প্রায়ই নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট থাকেন। ঠিক কি না?’
‘হ্যাঁ,’ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম আমি।
‘এটাই,’ একইসাথে মাথা নাড়াতে থাকলেন ডাক্তার, ‘এটাই মূল কারন বলে আমার ধারণা। একদিক দিয়ে আপনি নিজের অতীতকে ভুলতে চাইছেন, অন্যদিকে নিজের অতীতকে আঁকড়ে ধরে রাখছেন আপনার গল্পের মাধ্যমে। যার ফলে আপনার ব্রেইন দ্বিধায় পড়ে গেছে। আপনার ব্রেইন বুঝতে পারছে না, সে এই স্মৃতিগুলোকে লুকিয়ে রাখবে, নাকি প্রকাশ করে দেবে। যার ফলে ব্যালেন্স ঠিক রাখা কষ্টকর হয়ে পড়েছে তার জন্য। তাই সে একটা সহজ পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। একদিকে আপনার অতীতগুলোকে ভুলিয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে হ্যালোসিনেশনের মাধ্যমে তা ফিরিয়ে আনছে।’
স্বর্ণার দিকে তাকালাম আমি। বেচারীর চেহারা শুকনো শুকনো লাগছে। তারপরও সে একটা হাত দিয়ে আমার একহাত ধরে মৃদু সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে।
‘একারনেই,’ আবার শুরু করলেন ডাক্তার, ‘একারনেই সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। স্বর্ণার কাছ থেকে জানতে পারলাম, গত চারমাসে এবার দিয়ে মোট তেরোবার একই ঘটনার শিকার হয়েছেন আপনি। কিন্তু আপনার মনে আছে মাত্র একটি ঘটনা। সর্বশেষ যেটা ঘটেছে, সেটা। অন্যগুলো আপনার ব্রেইন স্বযত্নে সরিয়ে দিয়েছে আপনার স্মৃতি থেকে, যাতে আপনার কাছে স্বাভাবিক দৃষ্টিকোন থেকে কোন সমস্যা মনে না হয়। বুঝতে পেরেছেন?’
‘হ্যাঁ,’ বুঝতে পেরেছি আমি।
‘এখন আমরা কি করতে পারি ডাক্তার?’ পাশ থেকে প্রশ্ন করলো স্বর্ণা।
‘আপাতত,’ একটা কাগজে খস খস করে কিছু লিখলেন ডাক্তার, ‘এগুলো খেতে থাকুন। আর কিছুদিন সাইকো থ্রিলার লেখা বন্ধ করে দিন। অন্য জেনর নিয়ে লিখতে পারেন, তবে থ্রিলার বাদ। এককথায়, ভায়োলেন্স থাকা চলবে না। বুঝতে পেরেছেন?’
‘হ্যাঁ,’ মাথা নাড়ালাম আমি।
আরো কিছুক্ষণ এটা-সেটা নিয়ে আলাপ হলো ডাক্তারের সাথে। তারপর বেড়িয়ে এলাম চেম্বার থেকে।
তারপরের দিন ছুটি দিয়ে দেয়া হলো আমাকে।
০৫
চারদিকে পানির মেলা বসেছে যেন। যতদূর চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। তার মাঝে ছোট ছোট কিছু নৌকা দেখা যাচ্ছে। একদিকে থেকে আরেকদিকে যাচ্ছে ওগুলো।
বিকেলের সূর্যটা নিজের বিদায়ের কথা জানান দিতেই যেন রোদের আঁচ কমিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। আর কিছুক্ষণ, তারপরই সূর্যটা বিদায় নেবে আজকের মতো। পুরো পৃথিবীজুড়ে নেমে আসবে আঁধার। নিকষ কালো আঁধার।
একমাসের মতো হলো লেখালেখি থেকে দূরে সরে আছি। সাইকো থ্রিলার তো বটেই, থ্রিলারও লিখছি না। মাথায় প্লট গিজ গিজ করলেও সেগুলো নিয়ে আপাতত ভাবছি না কিছুই। কারন, ডাক্তারের বারণ। ভায়োলেন্স কিছু নিয়ে ভাবা যাবে না।
এর মধ্যে অবশ্য চেষ্টা করেছি প্রেম-কাহিনী বা সামাজিক কাহিনী লেখার, কিন্তু হচ্ছে না। কিছুতেই মাথায় আসছে না। সমস্যায় আছি এ নিয়ে। গত একবছরে প্রতি দুইদিনে একটা করে গল্প লেখার অভ্যেস গড়ে তুলেছিলাম, কিন্তু গত একমাসে নিজের উপরই বিরক্তি ধরে গেছে।
তবে একয়দিনে যা আবিস্কার করলাম আমি, তা হচ্ছে, সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার লেখা থেকে যতই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছি, ততই যেন নতুন নতুন প্লট মাথায় এসে জমা হচ্ছে। এ এক মহা সমস্যা আমার জন্য।
স্বর্ণার কাছ থেকে সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত সবকিছুই জানতে পেরেছি আমি। সেদিন আমার বাসায় এসে ও দেখে আমি মেঝেতে পড়ে আছি। আমার হাতে ছিল রক্তে ভেজা বিছানার চাদর। আমার মাথার পেছনদিক থেকে রক্ত বেরুচ্ছিল। হয়তো কোন কারনে মেঝেতে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত লাগে আমার, যার ফলে এই অবস্থা হয়েছিল আমার। স্বর্ণাই পরে আমাকে হাসপাতালে এডমিট করেছিল।
স্বর্ণার কাছ থেকে আরো কিছু জানতে পেরেছি আমি। ঐ ঘটনার আগেও নাকি আরো বারোবার এরকম হয়েছিল আমার। তবে কোনবারই এবারের মতো আঘাত পাইনি আমি। অবশ্য একটা ঘটনা ছাড়া। একবার নাকি আমি ওর এক ফ্রেন্ডের হাজবেন্ডকে আমার কাল্পনিক শত্রু ভেবে পিটিয়েছিলাম। পরে যা আমার মনে নেই। অবশ্য সব কিছু শোনার পর তিনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
স্বর্ণা আমাকে প্রতিদিনই সতর্ক করে দিচ্ছে, যাতে আমি এসব ব্যপার নিয়ে না ভাবি। ভায়োলেন্স সম্পূর্ণ নিষেধ আমার জন্য। শুধু লেখালেখির ক্ষেত্রে নয়, ভায়োলেন্স আছে, এমন মুভি দেখাও নিষেধ আমার জন্য। আমার বাসার থ্রিলারধর্মী বইগুলোকে সরিয়ে সেখানে একগাদা প্রেমের উপন্যাস এনে দিয়েছে ও। তাও যেন আমি সুস্থ থাকি।
আসলে মেয়েটা আমাকে অনেক ভালোবাসে। ও চায় না আমার কিছু হোক। আমিও চেষ্টা করছি একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে। জানি না কতটুকু পারছি, তবে আমাকে পারতেই হবে। ভায়োলেন্স হারাম আমার জন্য।
পকেটে থাকা সেলফোনটা বেজে উঠতেই সেটা বের করে চোখের সামনে তুলে ধরলাম। স্বর্ণার ফোন।
-‘হ্যাঁ, বলো।’
-‘কোথায় তুমি?’
-‘বাইরে।’
-‘দ্রুত তোমার বাসায় আসো। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।’
-‘আমার আসতে একটু সময় লাগবে। এই, ত্রিশ মিনিটের মতো। চাবী আছে তো তোমার কাছে, না?’
-‘হ্যাঁ, আছে।’
-‘গুড। বাসায় যাও, আসছি আমি।’
ফোনটা কেটে দিয়ে উঠে দাড়ালামা আমি। বাসায় যেতে হবে।
০৬
আবার হ্যালোসিনেশন!
কিন্তু কেন? আমি তো ভায়োলেন্স থেকে দূরে সরে আছি গত এক মাস ধরে। তাহলে এটা কি?
স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি আমি! কোন ভুল নেই, নিশ্চিত হ্যালোসিনেশন! এটা বাস্তব নয়! বাস্তব হতে পারে না!
ঘরের দরজা খুলেই দেখতে পেলাম দৃশ্যটা। স্বর্ণাকে ঘিরে দুটো লোক দাড়িয়ে আছে। একজনের হাতে একটা ছুড়ি, অন্যজনের হাতে একটা পিস্তল। স্বর্ণাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সম্ভবত ওর হাতদুটো বাঁধা। বিস্ফারিত চোখে তাকাচ্ছে অস্ত্রগুলোর দিকে। একবার ছুড়িটার দিকে, আরেকবার পিস্তলটার দিকে।
মাথাটাকে যতোটা সম্ভব ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছি আমি। রেগে যাওয়া যাবে না। ডাক্তার নিষেধ করেছে।
নো ভায়োলেন্স!
চুপচাপ দেখতে হবে। পুরোটাই আমার ভ্রম। উত্তেজিত হয়ে কিছু করা যাবে না। চুপচাপ দেখে যেতে হবে।
দরজাটা আটকিয়ে দিয়ে শান্তভঙ্গীতে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলাম আমি। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লাম। আমার এমন শান্তভঙ্গী দেখে সম্ভবত কিছুটা অবাক হয়ে গেলো লোকদুটো। অবাক হয়েছে স্বর্ণাও।
আচ্ছা, এটা কি সত্যিই স্বর্ণা? নাকি আমার হ্যালোসিনেশন?
নাহ! এটা সত্যি হতে পারে না। এটা নিশ্চিত হ্যালোসিনেশন। আমার মস্তিস্ক আমাকে নিয়ে খেলছে। আমার অতীত আমাকে ব্যঙ্গ করছে। হ্যাঁ, তাই হবে।
‘কুখ্যাত সন্ত্রাসী শুভ,’ হঠাত করে মুখ খুললো ছুড়ি ধরা লোকটি, ‘একেবারে চুপচাপ যে?’
মাথা নাড়লাম আমি। যত দ্রুত এই ভ্রম কেটে যায় ততই ভাল। হ্যালোসিনেশন সহ্য হচ্ছে না আমার।
‘শুভ,’ চিৎকার করে উঠলো স্বর্ণা, ‘শুভ! ওরা আমাকে মেরে ফেলবে! প্লিজ, কিছু একটা করো।’
চুপচাপ বসে আছি আমি। কিছুই করবো না আমি। এটা হ্যালোসিনেশন, বাস্তব নয়। স্বর্ণা নিজেই আমাকে গত এক মাস ধরে বলছে, এসব থেকে দূরে থাকতে। এই মেয়েটা আমার মস্তিষ্কের সৃষ্টি। এটা স্বর্ণা নয়।
‘মনে হয় ড্যাম হইয়া গেছে হালায়,’ পিস্তলধরা লোকটা বলে উঠলো, ‘দিমু নাকি ঠুস কইরা?’
‘দাড়া,’ বাঁধা দিলো অপরজন, ‘আগে মেয়েটাকে মেরে নিই।’
‘তার আগে,’ প্রথমজন বলে উঠলো, ‘একটা গুলি কইরা দেই মালডারে? হাত নিশপিশ করতাছে। পেটের মধ্যে, একটামাত্র গুলি করমু। মরতে তো হইবোই এইডারে। পেটের মধ্যে গুলি করলে মরতে সময় লাগবো।’
অপরজনের তোয়াক্কা না করেই গুলি করলো পিস্তলধারী। পিস্তলের মাথা সাইলেন্সার থাকায় শব্দ হলো না বললেই চলে।
পরমুহূর্তে মেঝেতে পড়ে গেলাম আমি। বামপাশে বুকের একটু নিচে একটা ছিদ্র তৈরী হয়েছে দেখতে পাচ্ছি! সেখান দিয়ে লাল রক্ত বেড়িয়ে আসছে!
সেখানে হাত দিয়ে চমকে উঠলাম আমি। উষ্ণ রক্তে ভিজে উঠলো আমার হাত। তাহলে কি এটা বাস্তব? নাকি এখনো হ্যালোসিনেশন হচ্ছে আমার?
‘দুররর,’ দ্বিতীয়জনের মুখে আক্ষেপ প্রকাশ পেলো যেন, ‘মিস করলি তো। বুকের মধ্যে গিয়ে লেগেছে বুলেট। ভেবেছিলাম এই শালার সামনে মেয়েটাকে... কিন্তু তা হতে দিলি না শালারপো।’
ধীরে ধীরে তাদের দিকে তাকালাম আমি। প্রথমজন অপরাধীদের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমজন ছুড়িটার ডগায় আঙ্গুল দিয়ে ধার পরীক্ষা করছে যেন।
স্বর্ণার দিকে তাকালাম আমি। কাঁদছে ও। কাতর নয়নে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। দুটো চোখে অসম্ভব মায়া, আর অপরিসীম দুঃখ বিরাজ করছে। এসবই কি হ্যালোসিনেশন?
মনস্থির করে ফেললাম। গোল্লায় যাক সবকিছু। হ্যালোসিনেশন হোক, আর যাই হোক, নিকুচি করি আমি।
উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু প্রথমজনের পিস্তলের আরেকটা গুলি আমার সেই ইচ্ছের মাঝখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। বা হাতে ডান কাধ ধরে আবার মেঝেতে পড়ে গেলাম আমি। চোখ দিয়ে পানি বেড়িয়ে আসতে চাইছে আমার।
‘শালা,’ থুহ করে একগাদা থুতু ছিটালো দ্বিতীয়জন, ‘রমেজ ভাইয়ের বারোটা বাজিয়েছিলি। দেখ এখন কেমন লাগে। মর এখন। সাথে তোর ভালোবাসার মানুষটাকেও নিয়ে যা।’
ছুড়িটাকে স্বর্ণার গলায় ধরলো সে, অন্যজন পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে আমার মাথার দিকে।
স্বর্ণার দিকে তাকালাম আমি। কাঁদছে ও।
‘ঐ,’ অনেক কষ্টে মুখ খুললাম আমি, ‘ওকে মারিস না। প্লিজ। ওকে ছেড়ে দে। ওর কোন দোষ নেই।’
খেক খেক করে বিশ্রীভাবে হেসে উঠলো দুজনই। আমি আবার মাথা নাড়লাম।
‘প্লিজ, ওকে মারিস না। দোষ আমি করেছিলাম। প্লিজ, প্লিজ।’
দুপাশে মাথা নাড়ালো ছুড়িধারী। তারপর একটা টানে ছুড়িটা দিয়ে স্বর্ণার গলায় পোঁচ বসালো।
‘না,’ চিৎকার করে উঠলাম আমি।
গলগল করে রক্ত বেড়িয়ে আসছে স্বর্ণার গলা বেয়ে। সেইসাথে মেঝেতে পড়ে গেলো ও। কাৎরাচ্ছে ও। মারা যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ওর চোখের দিকে তাকালাম আমি। দু’টো চোখে অপরিসীম মায়া, সেইসাথে যুক্ত হয়েছে অভিযোগ, কিছুটা অভিমান!
আমার জন্য!
চোখ দিয়ে পানি বেড়িয়ে এসেছে আমার। অনেক কষ্টে উচ্চারন করলাম, ‘সরি স্বর্ণা!’
আমি আসলেই দুঃখিত!