গভীর রাত। রাত্রি সাড়ে এগারোটা বাজে। চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। সেই সাথে অন্ধকারের রাজত্ব। আমার জীবনের বেশীরভাগ ঘটনাই মনে হয় রাত্রিবেলা ঘটে। কিংবা কে জানে, রাত্রিবেলার ঘটনাই হয়তো আমার মনে বেশী দাগ কাটে।
ধইঞ্ছাপুরের এই অংশে রাত্রিবেলা হাটার মজাই আলাদা। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে মানুষগুলো সব ঘরে ফিরে যায়। বড়জোর রাত্রি দশটা পর্যন্ত হই-হট্টগোল থাকে। তারপর আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়ে সবকিছু। এগারোটা নাগাদ সব চুপচাপ। মাঝে মাঝে রিক্সার টুংটাং বেলের শব্দ, সম্মিলিত কুকুরের ডাক আর পাহারাদারদের বাঁশির তীক্ষ্ম শব্দ বাদ দিলে পুরোপুরি নিরব পরিবেশ। চারদিকে শান্তি-শান্তি ভাব বজায় থাকে।
বোহেমিয়ান জীবনের এই একটা মজা। কোন পিছুটান নেই, কারো শাসন সহ্য করতে হয় না, কেউ ফোন করে বলে না “এই, কি করছিস এখন”, কিংবা ফোনে বারবার মিসডকল করে কেউ বিরক্তও করে না। সম্পূর্ণ নিজের মনমতো চলা যায়। নিজেকে নিজের মতো ভাবা যায়। নিজের কল্পনার জগতে নির্দ্বিধায় হারিয়ে যাওয়া যায়।
হাটতে হাটতে কখন যে এতদূর এসে পড়েছি, খেয়ালই ছিল না। এবার ফিরে যাওয়া যাক। নাকি আরো কতদূর এগোব?
বুঝতে পারছি না। কনফিউশন সৃষ্টি হচ্ছে নিজের মধ্যে। এই জিনিসটা চরম ভাল লাগে আমার কাছে। কোন কিছু নিয়ে দ্বিধায় ভোগা! চরম একটা ফিলিংস। আমি এগিয়ে যাই আরো সামনে।
এতো রাতে সচরাচর কেউ বাইরে বের হয় না বললেই চলে। অথচ আমি একজনকে দেখতে পাচ্ছি। আমার ঠিক সামনেই, বেশ কিছুদূরে অবশ্য। হেটে হেটে এদিকেই আসছে। সঙ্গে একটা বাইক দেখা যাচ্ছে, ঠেলে নিয়ে আসছে। কি ব্যাপার? এতোরাতে বাইক ঠেলে নিয়ে কই যাচ্ছে লোকটা?
আমি কি এগিয়ে যাব তার দিকে? কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করব, “এই যে ভাই, এতোরাতে এটা নিয়ে কই যাচ্ছেন?”
আমার কথা শুনে যেন চমকে উঠবে সে। অবশ্য সাথে সাথেই সামলে নেবে নিজেকে। বেশ ভাবগম্ভীর গলায় বলে উঠবে, “অনেকদিন ধইরা বাইকটারে গোসল করাই না। আইজকা এইডারে গোসল করাইতে নিয়া যাই।”
আমি বেশ অবাক হই। এতোরাতে গোসল করাবে লোকটা বাইকটাকে? মনের কথাই যেন মুখ ফুটে বেড়িয়ে আসে আমার, “এতো রাতে গোসল করাবেন! ঠান্ডা লাগবে তো বেচারার! পরে যদি নিউমোনিয়া হয়ে যায় তখন?”
বুঝতে পারলাম চরম বিরক্ত হয়েছে লোকটা। বিরক্তির বহিপ্রকাশ ঘটল সঙ্গে সঙ্গেই, “ফাইজলামী করেন আমার লগে, না? এক্কেরে ফাইজলামী বাইর কইরা দিমু কইয়া দিলাম। সরেন রাস্তা থিকা!”
আমি তো অবাক! ফাইজলামী করলাম কই? সে যদি এতো রাতে বাইকটাকে গোসলে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে বাইকটার নিউমোনিয়া হতে দোষ কোথায়? আর এতে তার রাগ করারই বা কি ঘটল?? আজব না?
আমি চোপ করে থাকতে পারিনা। “ভাই, রাগ করছেন কেন? আমি তো এমনিই বললাম।” একেবারে বোকা বোকা চেহারা করে বললাম আমি।
আমার দিকে বিরক্তদৃষ্টিনিক্ষেপ করলো লোকটা। বোঝাই যাচ্ছে চরম অপমানিত বোধ করছে সে। আমার দিক থেকে সরিয়ে রাস্তার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল লোকটা। আমিও তার পিছু নিলাম।
বেশকিছুদূর হাটার পর আবার আমার দিকে তাকালো লোকটা। তার চোখে রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পেলাম আমি। বেশ ঠান্ডাসুরে বলে উঠল, “আমার পিছন পিছন আহেন ক্যান? নিজের রাস্তা মাপেন, যান।”
আমি আমার চেহারা আবারো যতটাসম্ভব বোকা বোকা বানিয়ে বললাম, “ভাই, রাস্তা মাপব, টেপ তো নাই। আপনার কাছে কি টেপ আছে? আমাকে ধার দেবেন?”
“আমার কাছে টেপ থাকব ক্যাম্নে?” বিরক্ত গলায় বলল লোকটা, “আমি কি টেপের বিজনেস করি? আফনে দেহি জালাইয়া মারলেন আমারে। যান এইহান থেইকা।” খেকিয়ে উঠলো লোকটা।
আমি আবার বললাম, “ভাই তাহলে আপনি কিসের বিজনেস করেন?”
এবার বোধহয় ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেলো তার। প্রথমে বাইকটাকে রাস্তার একপাশে দাড় করিয়ে রাখল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে পকেটে হাত ঢোকালো। কি ব্যাপার? ছুড়ি-টুড়ি বের করবে নাকি? কি বিপদ? তার সাথে মজা করতে গিয়ে কি স্ট্র্যাপড হিয়ে হাসপাতালে যাবো নাকি?
কিংবা যদি পিস্তল বের করে? একবার ট্রিগার টানলেই আমি শেষ! জনশূন্য জায়গা এটা। পাশেই জঙ্গলের মতো একটা জায়গা আছে। আমাকে মেরে ওখানে লুকিয়ে রাখলে সপ্তাহখানেকের মধ্যে কেউ জানতেও পারবে না। আমার হোস্টেল আর বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে যাবে। পুলিশ ডাকা হবে। কিন্তু কেউ জানবে না আমার কি হয়েছে। অন্যদিকে দুই-তিন সপ্তাহ পর যখন আমার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হবে, তখন আর কেউ তা চিনতেও পারবে না। বেওয়ারিশ হিসেবে আমার লাশ পড়ে থাকবে মর্গের টেবিলে। ওফ!
কিন্তু না, লোকটা ছুড়ি বা পিস্তল কোনটাই বের করেনি। তার পকেট থেকে বের হয়েছে একটা প্রাগৈতিহাসিক আমলের মোবাইল ফোন। ফোন বের করেই নাম্বার ডায়াল করতে শুরু করলো লোকটা। কাউকে ফোন করছে। একটু পর বোধহয় সংযোগ পাওয়া গেল। জোড়ে জোড়ে কথা বলতে লাগলো লোকটা।
“হ, আমি কদ্দুস কইতাছি। হালার পো হালা, কই তরা? এইদিকে বা* এক হারাম** আমার পিছে লাগছে। ...... কি? হ, হ জ্বালাইয়া মারল বা*। তারতারি আয়। ......... হ, ঐ যেইহানে বইয়া হিরু খাই, ঐহানে। ...... হ, তারতারি।”
ফোনটা পকেটে রেখেই আমার দিকে তাকালো লোকটা। বহুদিন না মাজা দাঁতগুলো বের করে কেলিয়ে উঠল। তারপর বলল, “হালা, এহন বুজবা প্যাচ কারে কয়। আমারে জ্বালাইবার আইছো না?”
এই বলে কিছু ‘চ’ বর্গীয় শব্দ উচ্চারন করলো লোকটা। আমি এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি, বেশ বড়সড় বিপদেই পড়ে গেছি। এখন নিজের পিঠ বাচানো দরকার। মজা করতে গিয়ে এমন সমস্যার সম্মুখীন হবো, ভাবতে পারিনি। কি করা যায়? কি করা যায়?
হুম। পেয়েছি। এখান থেকে বাঁচার এখন একটাই উপায়। দৌড়ানো। আমি আর কিছু না বলে উল্টো ঘুরেই দৌড় আরম্ভ করলাম। কিন্তু বেশিদূর যাওয়া আমার পক্ষ্যে সম্ভব হলো না। কারন, আমি দৌড় শুরু করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার কোমড় জাপটে ধরে আমাকে নিয়ে মাটিতে পড়ে গেল লোকটা। সেইসঙ্গে মুখ দিয়ে যেন বাছা বাছা খিস্তি বেরুচ্ছে।
“ঐ হালারপো, কই যাস? এতক্ষণ এতো তো খুব মজা নিলি, এহন পলাইয়া যাবি? তা হইব না। এহন দেহি তুই ক্যাম্নে যাস। চু****, আমারে ডিসটাব করস? হালা, এইবার তরে আমি খাইছি।”
এ পর্যন্ত মনে হয় ঠিকই ছিল, কিন্তু তারপরই অকথ্য ভাষার বৃষ্টি শুরু হলো যেন। সেই সঙ্গে আমার মুখের উপর তার শক্ত হাতের কিল-ঘুষি। সেলাইমেশিনের সুচের মতো বারবার তার হাত নামতে নামল আমার মুখ, কপাল, বুকের উপর। অসহ্য ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলাম আমি।
বেশকিছুক্ষন পর থামল লোকটা। একেবারে ঘেমে নেয়ে গেছে। উঠে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। আমার এদিকে অবস্থা খারাপ। ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে, কপাল কেটে গেছে। বুকের উপর যেন হামানদিস্তা চালিয়েছে লোকটা।
এবার অন্য পকেটে হাত ঢোকাল লোকটা। যখন বের করে আনল, দেখতে পেলাম তখন তার হাতে শোভা পাচ্ছে চকচকে একটা ছয় ব্লেডের ছুড়ি। ছুড়িটা আমার দিকে নাচিয়ে বলল লোকটা, “ভাবছিলাম সবাই আইলে তরে পিডাইয়া তক্তা বানামু। তা হালা তুই করবার দিলি না। এহন একাই তর ব্যবস্তা করন লাগব আমার। এইডা দেখছোত? এক্কেরে হান্দাইয়া দিমু তর পেডের বিতরে।”
এগিয়ে আসছে লোকটা আমার দিকে। হাতের চকচকে ছুড়িটা যেন হা করে আছে আমার শরীরে ঢোকার জন্য। আর মাত্র কিছুক্ষণ, তারপরই সব শেষ।
শেষ হয়ে যাবে আমার বোহেমিয়ান জীবন।
*******
ধীরেসুস্থে আমার দিকে এগিয়ে এলো লোকটা। সাথে করে বাইকটা অনেক কষ্টে ঠেলে নিয়ে আসছে। আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ভাই, এখানে সবচেয়ে কাছের প্যাট্রোল-পাম্পটা কোনদিকে বলতে পারেন?”
আমি সানন্দে রাজি হলাম। বললাম, “এইতো কাছেই। চলুন, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”