সেখানে যাওয়ার প্রধান আকর্ষন ছিলো সম্রাট শাহজাহানের বিদুষি কন্যা জাহানারার কবরটি আবার দেখার। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের শাহজাদা দারাশুকো উপন্যাসটি পড়ার পরে এই পাদশাজাদীর সাদামাটা কবরটি আবার দেখার ইচ্ছে ছিলো। নিজামুদ্দিনে ঢোকার মুখেই অসংখ্য রেস্টুরেন্ট ও ফুলের দোকান। লাল, গোলাপি গোলাপের মালা, চাঁদোয়া, টুকরি ভরা ফুলের পাপড়ি নিয়ে সাজিয়ে বসে আছে। আমরা কোনো ফুল বা গিলাফ কিনলাম না। চারপাশে দোকানীদের হাকডাকে সিলেটের শাহজালাল সাহেবের দরগাহের কথা মনে পড়ে গেলো।
এর পর গেলাম শাহজাদী জাহানারার কবরের কাছে। সাদামাটা কবর। কবরের উপর কোনো শ্বেত পাথরের বাধাই নেই। কবরের মাথার কাছে শাহজাদীর নিজের রচিত ফার্সি বায়াত এপিটাফ হিসেবে আছে। আমি ফার্সি জানিনা, তবে এর বঙ্গানুবাদ কোথায় যেন পড়েছিলাম।
“গরীব গোরে দীপ জ্বেলোনা
ফুল দিওনা কেউ ভুলে
শ্যামা পোকার না পোড়ে পাখ
দাগা না পায় বুলবুলে”
কিন্তু গিয়ে দেখলাম কেউ এখন আর পাদশাজাদীর হুকুম মানেনা। একদিন যার হুকুমে দিল্লী কেঁপে উঠতো, মরনের পর তার শেষ আর্তিতেও কারো মন গলেনা। কেউ মনের ভুলে তাঁর সমাধীর উপর একটি লাল গিলাফ বিছিয়ে দিয়ে সবুজ ঘাসগুলোকে ঢেকে দিয়েছে। দিয়েছে কিছু গোলাপও। দুপাশে মির্জা গালিব ও আমির খসরুর সমাধি বলে জানালো গাইড। কে জানে কতটুকু সত্য! আশে পাশে ছিন্নমুল কিছু মহিলা তোবড়ানো হাড়িকুড়ি, পোটলা পুটলি নিয়ে শুয়ে বসে আছে। প্রচুর বাঙ্গালী ফকিরের দেখাও পেলাম সেখানে।
নিজামুদ্দীন থেকে বের হয়ে বেশ কিছুদুর হেটে গেলে হুমায়ুনের সমাধি। প্রধান গেট পার হয়ে হাটতে হাটতেই জান শেষ! একটু হাটি আর বাহাত্তুরে বুড়ির মত কোমর ধরে সোজা হয়ে কিছুক্ষন দাড়াই। সবুজ ঘাসের উপর কাঠবেড়ালির ছুটোছুটি, সত্যি চমৎকার!
প্রধান ফটক পেরুতেই দম শেষ, আর আমার বোতলের পানিও শেষ। এক বিদেশী মাঝ-বয়সি মহিলাকে দেখলাম আমার চাইতেও দ্বিগুন ফোলা পা নিয়ে লাঠি ভর দিয়ে হাটছেন। ইস! একটি লাঠির অভাব খুব অনুভব করলাম সে মুহুর্তে।
চারিদিকে সবুজের সমারোহ। বড় বড় গাছ, সবুজ ঘাস। ইচ্ছে করছিলো ক্লান্ত শরীরটাকে ঐ গাছের ছায়ায় সবুজ ঘাসে ঢেলে দিতে। কিন্তু কুম্ভকর্ণের কারনে তা আর সম্ভব হলোনা। আমায় প্রায় টানতে টানতে সে এগুতে লাগলো।
স্কুলের একদল ছাত্র-ছাত্রী এসেছিলো। ওদের সবার হাতেই পানির বোতল, ফ্লাক্স দেখে আমার গলা আরো শুখিয়ে গেলো। কুম্ভকর্ণ ওদের কাছে গিয়ে পানি চাইতেই ওরা একটি ভরা বোতল দিয়ে দিলো। আমি আলগোছে গলায় পানি ঢেলে বোতলটা ওদের ফেরত দিলাম। যদিও ওরা নিতে চাইছিলোনা। মূল সমাধী ভবনের কাছে গিয়ে মাথায় হাত। হোটেলের চাইতেও খাড়া সিঁড়ি। আমার পক্ষে কোনো মতেই উপরে ওঠা সম্ভব নয়। মুখ ভোঁতা করে বসে থাকলাম। কুম্ভকর্ণকে বললাম, তুমি দেখে এসো, আর পারলে মোবাইলে ছবিতুলে এনো। ঐ স্কুলের বাচ্ছাগুলো কলকলিয়ে নেমে আসছিলো। আমার থোম্বা মুখে বসে থাকতে দেখে আগের মেয়েটি একটি পানির বোতল আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বল্লো, “ আন্টিজি, ইয়ে আপ রাখ লিজিয়ে। বোতলটা হাতে নিয়ে মন-প্রান খুলে মেয়েটিকে দোয়া করলাম।
লাল বেলে পাথরে অপুর্ব সুন্দর নকশা করা ছোট তাজমহলের মত
সৌধ-ভবনটি। এটা হুমায়ুন পত্নী হামিদা বানু তৈরী শুরু করেন। পরে তার ভাগ্নী বেগা বেগম এটি শেষ করেন। অনেকেই বেগা বেগমকে উনার পত্নী বলে ভুল করেন। সম্রাট সাহজাহান এটার আদলেই তাজমহল বানান। হামিদা বানু, শাহজাহান পুত্র দারা, সুজার কবরও এখানে।
কুম্ভকর্ণ লঙ্কা বিজয়ের হাসি মুখে এটে হাজির হলে আমরা ফেরার পথ ধরলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:২৮