শান্তিনিকেতন, দিল্লী, আজমীর, জয়পুর, বোম্বে, গোয়া ঘুরে আসবেশ কয়েক বছর ধরে বেড়ানো বলতে যা বোঝায় তা হয়ে উঠেনি। প্রয়োজনে আব্বাকে দেখতে ঢাকা ছুটে গেছি। ব্যাস! এই পর্যন্ত!
গত রোজার ঈদের পরদিন আশেপাশে কোথাও নির্জন যায়গায় যাবার প্ল্যান করেও কুম্ভকর্ণ শেষ মুহুর্তে বেঁকে বসায় সেটা আর হয়ে ওঠেনি। রাগে আমার ব্রহ্মতালু জ্বলছিলো। শেষ পর্যন্ত নিজের ভুল বুঝতে পেরে কুম্ভকর্ণই উদ্যোগ নিলো।
শরীর, মন দুটোই খুব বিক্ষিপ্ত থাকায় স্থির হলো এবার বেড়িয়ে পড়বো। কোথায় যাওয়া যায় তাই নিয়ে ভাবনা চিন্তা হলো। কুম্ভকর্ণ’র ইচ্ছে মালোয়েশিয়া, নেপাল, ব্যাঙ্কক। আর আমার ইচ্ছে ভারত। হোকনা আগে যতবারই দেখা। তখন কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করেছি। এবার ঘুরবো আমার ইচ্ছায়। বিধাতার সাথে কুম্ভকর্ণের মুখেও মুচকি হাসি ফুটে উঠেছিলো বোধহয়। ঠিক হলো আমরা কলকাতা,দিল্লী, বোম্বে, আজমীর, গোয়া ঘুরতে যাবো।
কোরবানী ঈদের দুই দিন আগে ১৪ রওনা হলাম। ঢাকা থেকে বেনাপোল। রাত দশটার বাস ছাড়লো রাত ১টায়। গাবতলীর পশুর হাট পার হলো রাত সাড়ে তিনটায়। ভোর ছয়টায় ফেরিতে আমার ঘুম ভাংলো। সকাল সাতটা সাড়ে সাতটায় মাগুরায় একটি হোটেলে নাস্তার বিরতি। পরটা, ডিম ভাজি দিয়ে নাস্তা সেরে আবার ছুটে চলা। দুপুরে বেনাপোল পৌছে কাষ্টমস, ইমিগ্রেশন শেষ করে কলকাতায় পৌছোলাম বিকাল ৫টায়। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে চুর চুর। দুপুরে এক হোটেলে যাত্রা বিরতি হলেও বাস থেকে নামিনি বা কিছু খাইও নি। পেটে ছুঁচোর কেত্তন। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে হোটেলের সামনের দাওয়াত হোটেলে হালকা কিছু নাস্তা করে আশেপাশে অসংখ্য মানিচেঞ্জার অফিস আছে যেগুলো প্লেন, ট্রেন, বাসেরও টিকিট বুকিং দেয়, সেগুলোতে ঢু মেরে দিল্লীগামী রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকিট বুকিং দেয়া হলো। যদিও ওরা জনপ্রতি টিকিটে ৩০০ রুপি বেশী রাখলো। কিন্তু কিছু করার নেই। কারন পরদিন ঈদের ছুটি। তারপর দিনও বেশীর ভাগ দোকান পাট বন্ধ থাকবে। দুপুরে অফিস খুলে ওরা আমাদের টিকিট দিবে বল্লো। ডলারের রেট পছন্দ না হওয়ায় ঐ অফিসে আমাকে বসিয়ে “এখুনি আসছি” বলে ঘন্টাখানেকের জন্য কুম্ভকর্ণ হাওয়া হয়ে গেলেন। ঢোল হয়ে যাওয়া পা নিয়ে আমি বসে থাকলাম। একবার ইচ্ছে হলো রাস্তা পেরিয়ে হোটেলের রুমে চলে যাই। অনেক কিছু ভেবে নিজেকে রোধ করলাম। আমাদের যাত্রায় সর্ত্বই ছিলো এটা। বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে যতটুকু পারা যায় ঘুরবো। আর মোটেই ঝগড়া-ঝাটি, মাথা গরম করবোনা। বাচ্চাদের অনুরোধ মনে পড়ে গেলো। আমার ইচ্ছে ছিলো আগে জোড়াসাঁকো ও শান্তিনিকেতন যাবার। কিন্তু কুম্ভকর্ণের যুক্তি “ কলকাতাতেই যদি তুমি কাহিল হয়ে যাও তবে দুরের জার্নি কি ভাবে করবে”? যুক্তি অকাট্য। তাই মেনে নিতেই হলো। ১৮ তারিখ বিকেল ৫টায় রাজধানীর টিকিট হলো। ১৬ তারিখ ঈদ। কুম্ভকর্ণ পাশের মসজিদে ঈদের জামাত পড়তে গেলো। গত বছর কোরবানীর ঈদও নিজ বাড়ীতেকরতে পারিনি। ছোট বোন হজ্বে যাওয়াতে আব্বার সাথে ঈদ করেছি। এবার কলকাতায়। দেশে ফোন করে খবর নিলাম। মেয়ের উপর কোরবানীর দায়িত্ব দিয়ে এসেছি। সেও এবার একা। তার শাশুড়ী ঢাকায় রেডিও থেরাপি নিচ্ছে। দুপুরে প্রিন্স হোটেলে আলু ভর্তা, ডাল ভর্তা, টাকি মাছ ভর্তা, আর চিতল মাছের মুইঠ্যা দিয়ে ঈদের খাবার সারলাম। বিকেলে গড়ের মাঠ ঘুরে এলাম। পরদিন কিছু জরুরী জিনিস কিনতে নিউমার্কেট গেলাম। পথের চারপাশে বাধা গরু, ছাগলের চিৎকার আর প্রচুর পুলিশের গাড়ী, পুলিশ পাহারায় নিউমার্কেটের অনেক আগেই রিক্সা ছেড়ে হেটে গিয়ে দেখি বেশীর ভাগ দোকানই বন্ধ। যে ২/৪টা দোকান খোলা সেখান থেকেই দরকারী জিনিস কিনে নিউমার্কেটের সামনে সাজানো ফলের দোকান থেকে কিছু তাজা আলুবোখারা, ও কিউয়ি কিনে হোটেলে ফিরে এলাম। ১৮ই অক্টোবর বিকেল ৫টায় ট্রেন। হোটেলের একটি বয়কে সঙ্গে নিয়ে বেলা সাড়ে
তিনটায় হাওড়া ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা। বয়টি আমাদের অনেক কাজ করে দিয়েছিলো। মোবাইলের সিম কার্ড কিনে দেওয়া থেকে শুরু করে ট্রেনে উঠে মালপত্র চেন দিয়ে বেধে তালা মারা পর্যন্ত। যাই হোক! হাওড়ায় পৌছে মনে হলো জন-সমুদ্রে পড়েছি। এনাউন্স হচ্ছে কোন ট্রেন কত নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াবে, ডিসপ্লে বোর্ডেও দেখাচ্ছে। আমাদের নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমার মনে হলো অনন্তকাল আমি দশমন বোঝা টেনে চলেছি। দম যখন প্রায় মুখের সামনে তখন দেখি ঐ বয়টি একটি ঠান্ডা পানির বোতল আমার সামনে ধরলো। কনকনে ঠান্ডা পানি চোঁ চোঁ করে আধ-বোতল গলায় ঢেলে এদিক ওদিক তাকালাম। বসার যদি কোনো ব্যাবস্থা করতে পারি। নাহ! নেই! অগত্যা কুম্ভকর্ণের শরীরেই ভর দিয়ে দাড়ালাম। ভাগ্যি ভালো। বেশীক্ষন দাঁড়াতে হয়নি ট্রেন এসে গেলে নির্দিষ্ট কুপে নির্দিষ্ট আসনে বসে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম দুজনেই। আর কিছুক্ষন আমার ভার বইতে হলে কুম্ভকর্ণের বারোটা বেজে যেতো নির্ঘাত!
ঈদের সকালের নাস্তা!
ঈদের দিন হোটেলের জানালা দিয়ে তোলা আতর বিক্রেতার ছবি।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:৪৬