২২ দিন ইন্ডিয়া ঘুরে বেশ অসুস্থ শরীরেই দেশে ফিরেছিলাম নভেম্বরের ৪ তারিখে। কোমর আর হাটুর ব্যাথায় কাতর আমি বিছানায় শুতেও পারিনা, হাটতেও পারিনা। ইন্ডিয়াতে কুম্ভকর্ণ আমাকে টেনে বেরিয়েছে। দেশে ফিরে শুরু হলো ডাক্তার আর প্যাথলজিতে ছুটাছুটি। তেমনি এক মুহুর্তে কুম্ভকর্ণ ফোন দিয়ে বল্লো, ” আসার সময় কাশির ওষূধ নিয়ে এসো”।
ওষূধ নিয়ে এলে শুনলাম, বুকে জ্বালা হওয়াতে ২টা এন্টাসিড ম্যাক্স খেয়েছেন। বিকেলে চায়ের সাথে মুড়ি খাওয়ার পরও বুকে জ্বালা হলো কেনো ভেবে পেলাম না। রাতে জ্বর এলো। পরদিন জ্বরের ওষুধ দিলাম। ১৫ তারিখ রাতে কাশির জন্য ঘুমোতে পারছিলেন না। রাত সাড়ে ৩টার দিকে আমি ২টা বালিশে শুতে বললাম। শ্বাষ কষ্ট হচ্ছিলো। মনে অন্য কোনো কিছু মনে হলোনা। ভাবলাম ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে অক্সিজেন, নেবুলাইজার দিলেই আরাম পাবে। এম্বুলেন্স ডেকে ক্লিনিকে নিয়ে অক্সিজেন, নেবুলাইজার দেয়া হলো। ৩বার নেবুলাইজার দেবার পরেও যখন আরাম হলোনা তখন ইসিজি করা হলো। ইসিজি রিপোর্টে কিছু গড়বড় দেখে ডিউটি ডাক্তার তাড়াতাড়ি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে পাঠিয়ে দিলো। তখন ঘড়িতে প্রায় সকাল সাড়ে ৬টা। ওখানে যাবার পর শ্বাষ কষ্ট আরো বেড়ে গেলো। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেবার পর ডাক্তার বেরিয়ে এসে যে বক্তব্য দিলেন তাতে নিজেকে মনে হলো বাজ পড়া তালগাছের মত। ততক্ষনে আমার দুই পুত্রসম দেবর, মেয়ের জামাইও এসে গিয়েছিলো। ডাক্তার বল্লো, ” আপনারা রুগীকে এখান পর্যন্ত জীবিত আনতে পেরেছেন সেটাই অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। বেশীরভাগ রুগী রাস্তাতেই শেষ হয়ে যায়, উনাদের করার কিছুই নেই। আল্লাহ যদি সহায় হন তবে হয়তো রুগী বেঁচে যেতে পারে। তবে রুগীকে এখুনি লাইফ সাপোর্টে নিতে হবে। যা ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে নেই। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে লাইফ সাপোর্ট নেই ব্যাপারটা বেশ আশ্চর্য মনে হলো।
এখন আলোচনা চলতে লাগলো, কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়। ওসমানী হাসপাতাল ( সরকারী) এ চিকিৎসা ভালো হলেও প্রসেসিং এ অনেক দেরী হবে। তাই প্রাইভেট হাসপাতাল যেখানে লাইফ সাপোর্ট আছে সেখানে নেয়াই স্থির হলো। নেয়া হলো ” এলাইড ক্রিটিকাল হাসপাতালে। চিকিৎসা শুরু করার পর ওখানকার ডাক্তাররাও হতাশাই ব্যাক্ত করলেন। আমি অবশ্য তখনও এতো কথা জানিনা। সবার অন্ধকার মুখ, আর মেয়ের অঝোর কান্না দেখে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছিলাম মাত্র।
লাইফ সাপোর্টে দেবার কথাও আমি পরে শুনেছি। যাই হোক! ৭২ ঘন্টা না গেলে কিছুই বলা যাবেনা। শুরু হলো আমাদের অপেক্ষা, উৎকন্ঠার পালা। সেই সঙ্গে আল্লাকে ডাকার পালা। একমাত্র আল্লাহ-পাকই এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন। প্রথম ২ রাত সিসিইউ এর বাইরে আমার ছোট দেবর রাত কাটালো এবং ২ রাতই ডাক্তার নার্সদের সঙ্গে তার বচসা হলো। প্রথম রাতে সে যতবার সে সিসিইউতে উঁকি দিয়ে তার ভাইকে দেখতে গেলো ততবারই সব নার্সদের গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখলো। লাইফ সাপোর্টের রুগীর সামনে সব সময় একজন মনিটরিং করার জন্য থাকার কথা। সেখানে একজনও না জেগে ৪ জন নার্স ৩ জন আয়া, ২জন বয় সবাই এক যোগে ঘুমুচ্ছে দেখে তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট দিয়ে, প্রচুর চিৎকার চেঁচামেচি করে সে বিদায় নেয়। বড় দেবর, মেয়ে, মেয়ের জামাই ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করলে ডাক্তার জানালেন উনার নার্সরা এমন কাজ করতেই পারেনা। সিরিয়াস রুগী ফেলে তারা ঘুমানোর কথা ভাবতেই পারেনা। পরদিন রাতে তারা সিসিইউ’র দরজা রাত ১২টার পর বন্ধ করে রাখে। আমার দেবর যখন দরজা ধাক্কা দেয় তখন তারা খুবই খারাপ ব্যাবহার করে। এমন কি ডিউটি ডাক্তার মান্না অশ্লিল ভাষাও প্রয়োগ করে। ” বলে একজন বেশ্যার ঘরে ঢুকতে হলেও তার পারমিশন নিয়ে ঢুকতে হয়, আর আপনি সিসিইউ’তে এভাবে ঢুকে যাবেন কি করে”।
ব্যাপারটা অনেক দূর গড়ায়। আমার দেবর রগচটা। সে তার ভাইকে এখান থেকে নিয়ে ঢাকায় চলে যেতে চায়। কিন্তু তখন তাকে মুভ করা সম্ভব নয়। ঐ ডিউটি ডাক্তার ঘোষনা দেন উনি এই রুগীর ট্রিটমেন্ট করবেন না। রুগীর এটেডেন্সের মর্জিমাফিক চলতে উনি নারাজ। সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সঠিক। কিন্তু আমরা পড়লাম সংকটে। অবশেষে আমার কন্যা জামাতা যিনি নিজেও ২টি ক্লিনিকের এমডি, আর মাথা ঠান্ডা বড় দেবর ব্যাপারটাকে সামাল দেয়। এবং ছোট দেবরকে ক্লিনিকে আসা থেকে বিরত রাখে। ৭২ ঘন্টা পরে ১৮ তারিখ দুপুর ১২টায় আমার স্বামীর লাইফ সাপোর্ট খুলে দেয়া হয়। রাইস টিউব রাখা হয়। উনি আমার সাথে দেখা করে উত্তেজিত হয়ে ইশারায় জিজ্ঞাসা করেন উনাকে কোথায় আনা হয়েছে? হাত বাধা কেনো? উনার পার্লস রেট বেড়ে যাওয়ায় ডাক্তার আমাকে সরিয়ে দেয়। আর আমাদের উপর নিষেধ জারী হয় আমরা কেউ উনার সামনে যেতে পারবোনা। দূর থেকে শুধু দেখতে পারবো। ১৮ তারিখ রাতে উনাকে রাইস টিউব দিয়ে ২বার দুধ দেয়া হয়। ১৯ তারিখে উনি রাইস টিউব খুলে ফেলেন। তখন উনাকে স্যালাইন দেয়া ছাড়া উপায় থাকেনা। ২০ তারিখে উনি আমাকে ডেকে পাঠান। আমি যেয়ে উনাকে প্রথমেই বলি, ” আগে চুপ করে আমার কথা শোনো। তুমি উত্তেজিত হলে আমাদের তোমার কাছে আসতে দিবেনা। জীবনে তো অনেক রুগী নিয়ে দেশে বিদেশে সেবা করে বেড়িয়েছো। লাইফ সাপোর্ট কখন দেয় তা নিশ্চয় জানো? মাথা কাত করে সুবোধ বালকের মত সায় দিলেন, যে জানেন। আমি বললাম, তোমাকে ঐ লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিলো। এখন তুমি বুঝো তোমার অবস্থা কতটা খারাপ হয়েছিলো। আর কোনো কিছু খুলবেনা। যদি খুলো তবে আমরা কেউ সামনে আসবোনা।
২১ নভেম্বর সকালে উনাকে আইসিইউ কেবিনে দেয়া হলো। মুখে নরম খাবারও দেয়া হলো। প্রথমে পানি, পরে স্যুপ, পরে জাউ। গলা ব্যাথার কারনে কিছুই তেমন খেতে পারছিলেন না। প্রতিদিন উনার রক্তে ক্রিয়েটিনাইন ও সুগার পরীক্ষা করা হতো। প্রথম দিকে দুটোই মারাত্ত্বক রকম বাড়ানো ছিলো। আস্তে আস্তে কমতে থাকে। ২২ তারিখেই উনি সেভ করে গোসল করে ফ্রেস হয়ে নিলেন। ২৩ তারিখে উনাকে রিলিজ করে দেয়া হলো। ৩ সপ্তাহ বেড রেষ্ট এবং ৬ সপ্তাহ পরে ঢাকায় যেয়ে এনজিওগ্রাম করাতে হবে। ফেরার পথে ইকোকাডিওগ্রাফি করানো হলো। রিপোর্ট তেমন ভালো নয়। উনার হার্ট ৪০ ভাগ কাজ করছে। বিশ্রাম, ও ওষুধে বাকি ৬০ ভাগের কতটুকু উন্নতি হবে তা আল্লাহ-তায়ালাই ভালো জানেন। তবে আমরা আশাবাদী। আল্লাহ এতো বড় ঝড়ের মোকাবিলা করার শক্তি যখন দিয়েছেন তখন ইন শা আল্লাহ আরো বড় ঝড় মোকাবিলা করার শক্তি ও সাহসও নিশ্চয় তিনি যোগাবেন। বিপদে মাথা ঠান্ডা রেখে বিপদকে মোকাবিলা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
বিপদে বন্ধুর পরিচয়। কথাটির প্রমান পেলাম এই বিপদের সময়। প্রথম রাতে একলা ঘরে ফিরে নিজেকে যখন অসহায় মনে হচ্ছিলো তখন ব্লগ বন্ধু জুনের কাছে ফোন করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। কান্নার তোড়ে যেটুকু কথা জুন বুঝতে পেরেছে তা নিয়েই সেই মাঝ রাতে সামুতে পোস্ট দিয়েছে। জানা রাতেই ফোন করেছে। পরদিন শ্রাবন সন্ধ্যা সহ আস্তে আস্তে সিলেটের প্রায় সকল ব্লগার ভাই বোনেরা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমায় সাহস যুগিয়েছে, স্বান্তনা দিয়েছে। জানা, জুন সহ আরো ব্লগাররা নিয়মিত ফোনে, এফবিতে খোঁজ খবর নিয়েছে। সুদুর অষ্ট্রেলিয়া থেকে নাআমি, আমেরিকা থেকে আলিয়া, আরো অনেকেই খোঁজ নিয়েছেন। এদের ঋণ আমি কোনো ভাবেই শোধ করতে পারবোনা। আর কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষাও আমার জানা নেই। আবার প্রমান হলো- " মানুষ মানুষের জন্য"!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:২৬