অনেক দিন ব্লগ থেকে দূরে ছিলাম। সেই বছরের প্রায় শুরু থেকে। আনন্দ, বেদনার জালে জড়িয়ে গিয়ে ব্লগের নেশাটা প্রায় ছুটেই গিয়েছে। রোজই ভাবি, কাল ইন-শা-আল্লাহ লিখবো। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনা। একে তো আমি চরম আলসে! কুড়েমির কারনেই আমার এই দশা।
ফেব্রুয়ারীর ৯ তারিখে ব্লগার মামুনের বাসায় দুপুরের আমাদের চরম আড্ডা ও খাওয়া-দাওয়া ছিলো। আড্ডাটার লোভে বাসা থেকে খেয়ে সেখানে গিয়েছিলাম। পরদিন সারাদিন জানার সাথে আড্ডা, আলাপ, মিটিং সব করে ঘরে ফিরে সামুতে একটি পোস্টও লিখে ফেললাম। ১২তারিখ সকালে মেয়ে ফোনে ভয়ে ভয়ে বলে " মা আপনি তাড়াতাড়ি খেয়ে নেন, দুপুরে ক্লিনিকে ভর্তী হতে হবে"। দিলাম ঝাড়ি! কিন্তু ঠিকই তার কথা মত ক্লিনিকে গেলাম। সার্জন আমায় হড়বড় করে বল্লো, " আপনার ব্লাডে ইনফেকশন আছে তাই এন্টিবায়োটিক শুরু করছি, আর রাত ১০টায় অপারেশন করবো। গলব্লাডার ছোট্ট অপারেশন, ভয়ের কিছুই নেই। আমি বললাম, আমার কিন্তু অনেক এন্টিবায়োটিক কাজ করেনা। কালচারটা করিয়ে নিন। ব্লাড টেষ্টে দেয়া হলো যখন আমি ক্লিনিকে ভর্তী হই, তখন আমার রক্তে সোডিয়াম, পটাসিয়ামের ইনব্যালেন্স ছিলো। একটি স্যালাইন পুশ করে ডাক্তার বললেন, " আমি রাত ১০টায় অপারেশন করবো"। এদিকে ক্লিনিকে ওটিতে অপারেশন-রত অন্য ডাক্তাররা আমার ব্লাড রিপোর্ট দেখে বলছিলো এমন ইনব্যালেন্সে কি করে রুগীকে অজ্ঞান করা হবে? এটা তো অসম্ভব! যিনি এনেস্থিয়া করবেন তিনি আমার পরিচিত। সেই ডাক্তার এলেন কেবিনে। বিভিন্ন প্রশ্ন করলেন, তারপর বললেন ওকে! রাতে অপারেশন হবে। আমি বললাম, কিসের অপারেশন? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ডাক্তার আমার দিকে তাকালেন। আমি বললাম, " আমার ইলেক্ট্রোলাইড রিপোর্ট দেখে কি করে বলছেন অপারেশন হবে। আমি তো অপারেশনের জন্য রেডী নই"। এমন সময় সার্জন এসে ঢুকলেন। ডাক্তার সার্জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, "রুগী তো এখন অপারেশনে রাজী নয়। সার্জন ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। মনে মনে বললাম, " যতই ভুরু কুঁচকে তোমার বিরক্তি দেখাওনা ক্যানো, বিনি পয়সায় তো আমার অপারেশন করবেনা, ঝুকি নিয়ে আমি ক্যানো অপারেশনে রাজী হবো"? মুখে বললাম, আমার সোডিয়াম, পটাসিয়াম নরম্যাল হোক তারপর আমি অপারেশন করাবো। মুখে কোনো কথা না বলে বিরক্তি মুখে ছড়িয়ে কাধ ঝাকিয়ে সার্জন রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। অবশেষে ১৩ তারিখ রাত ১০টা ৩০ মিনিটে ওটিতে ঢুকলাম। পোস্ট-অপারেটিভে থাকা কালিন আমার সুগার কি কারনে হঠাৎ হাই হয়ে গেলো। ডিউটি ডাক্তার সার্জনকে ফোনে জানালে তিনি ১০ সিসি ইনসুলিন আমার সেলাইনে পুশ করে দিতে বললেন। আমি ডায়াবেটিসের পেশেন্ট নই, ইনসুলিন দেয়া হয়েছে এটা আমাদের জানানো তাদের উচিত ছিলো। সকাল ৯টার দিকে আমায় কেবিনে আনা হলো। কুম্ভকর্ন লাল টকটকে প্রিন্টের একটি সার্ট পরে রুমে ঢুকলো। আমি আবছা ভাবে তাকে দেখলাম। আমার হাতে লাল গোলাপের কুড়িটি দিলো। তখনও আমি আচ্ছন্ন। ভালোবাসা দিবসের এই স্মৃতিটি মেয়ে আমার মোবাইলে ধরে রাখলো। বাবা, মেয়ে খুব আস্তে আস্তে কথা বলছিলো। ভেবেছিলো আমি ঘুমিয়ে আছি। হঠাৎ আমি জোরে মেয়েকে ডেকে বললাম, আমার কিছুই ভালো লাগছেনা, খুব অস্থির লাগছে। বমি বমি করছে। মেয়ে বল্লো, কাল থেকে কিছু খান নি, এ জন্য হতে পারে। হঠাৎ অনুভব করলাম, আমার পায়ের দিক থেকে আস্তে আস্তে অবশ হয়ে যাচ্ছে, আমার শরীর পাখীর পালকের মত হালকা হয়ে কোথায় যেনো ভেসে যাচ্ছে। আমি বললাম, ডাক্তার ডাকো। মেয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো। তার বাবা কিংকর্তব্য বিমুড় হয়ে বসে থাকলো। ডাক্তার এসে সুগার মেপে দেখে ২ পয়েন্টেরও নিচে। তার মানে আমার হাইপো হয়েছে। আর তখনই জানলাম আমায় ইনসুলিন দেয়া হয়েছিলো। চল্লো যমে মানুষে টানাটানি। কুম্ভকর্ণ বার বার বলছিলো, মিষ্টির রস খেতে দাও ঠিক হবে। কে শোনে তার কথা! গ্লুকোজ ডাইরেক্ট ঢুকিয়ে দিলো হাতের শিরায়। হাত ফুলে ঢোল! সুগার একটু বাড়ে, এক ঘন্টা পরে আবার ২/৩ এ নেমে আসে। এদিকে ফোনে ছেলে, আত্মিয়-স্বজন সবাই ডাক্তারের পিন্ডি চটকাতে শুরু করলো। ছেলে তো ডাক্তারের ঠিকানা চেয়ে বার বার ফোন করতে লাগলো। ( বন্ধুদের দিয়ে ঠ্যাঙ্গানি দেওয়াবে বলে) তাকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করা হলো। অবাক হয়ে গেলাম! সেই সার্জন কিন্তু অপারেশনের পরে একবারও আমাকে দেখতে আসেন নি। কল করা স্বত্তেও আসেন নি। অপারেশনের পরে একবার রুগীকে দেখে যায় প্রায় সব ডাক্তারই। কিন্তু উনি সেটাও করেন নি। একদিন পরে আবার আরেক উপসর্গ শুরু হলো। ব্লাড-প্রেশার কমতে শুরু করলো। কমতে কমতে ৬০/৪০ এ যখন এলো তখন আমার মায়ের শেষ সময়ের কথা মনে পড়েছিলো। ডিম, কফি, খাবার খেতে খেতে আমি ক্লান্ত! বিরক্ত হয়ে শেষে বললাম, " আমাকে বাসায় যেতে দাও। আমি চলাফেরা করলে, নিজের ঘরে সুস্থ থাকবো। একরাশ তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। কেলেন্ডারের পাতা তখন ফেব্রুয়ারীর ১৮ তারিখ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১৩ দুপুর ১:০১