বছর তিনেক আগে কুলদা রয় আমাকে বলেছিলো, " দিদিভাই বেগম আখতারের একটি গান আমি অনেক খুঁজেও পাইনি। যদি পান তবে আমায় দিবেন প্লিজ!" গানটি যখন পেলাম তখন তার বানী, সুর গায়কী আমায় মুগ্ধ করলো। " জোছনা করেছে আড়ি, আসেনা আমার বাড়ি। গলি দিয়ে চলে যায় লুটিয়ে রুপোলি শাড়ি"। মুগ্ধ হয়ে আরো অনেক গান শুনলাম। যার কিছু আগেই শোনা ছিলো। তখন থেকেই এই গায়িকা সম্মন্ধে জানার আগ্রহ মনে জাগলো। বিভিন্ন ভাবে তার সম্পর্কে যা জানলাম তা আপনাদের সামনে উপস্থিত করলাম।
জোছনা করেছে আড়ি।
আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি
ভারতের উত্তর-প্রদেশের ভাদ্রাসা গ্রামে আইনজীবি আসগর হোসেন এর দ্বিতীয় স্ত্রী মুসতারী ১৯১৪ সালের ৭ই অক্টোবর জমজ কন্যা জন্ম দেন। বাবা আদর করে তাদের নাম রাখেন “জোহরা ও বিব্বি।
এক জন্মে কত বার জন্মাতে পারে কেউ? ফৈজাবাদের বিব্বিকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পেতেন, তার তিন জন্ম। ১৯১৪ সালে উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে জন্ম মেয়ের, তার মা মুশতারিকে কখনও স্বীকারই করেননি তাঁর স্বামী সৈয়দ অসগর হুসেন। স্বীকার করেননি, কারণ অসগর ব্রিফলেস ব্যারিস্টার হলেও সৈয়দ বংশের সন্তান; আর অসামান্য সুন্দরী হলেও মুশতারি সামান্য এক বণিকের মেয়ে, জাত নেই। ফলে, যমজ কন্যার জন্ম দিয়ে একা থাকতে হত মুশতারিকে। এক দিন তাঁর আড়ালে চার বছর বয়সী মেয়েদের হাতে বিষ মাখানো মিষ্টি দিয়ে গেল তাদের পিতৃকুলের লোক, মারা গেল এক মেয়ে, জোহরা। বেঁচে থাকল বিব্বি। তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল সৈয়দ বংশের ভাড়া করা গুণ্ডারা, তবু বেঁচে রইল মা-বেটি। হয়তো এই জন্মেই আরও দু’বার জন্মাতে হবে বলেই।
এই গল্প শুধু বিব্বির নয়, আখতারি বাই ফৈজাবাদীরও; কাকোরির বেগম ইশতিয়াক আহমদ আব্বাসি, বেগম আখতারেরও? কিন্তু, সে সবই পরের, পরের জন্মের কথা। সেই গল্পে পৌঁছতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে অনেকটা, যখন মুশতারি তাঁর বেঁচে থাকা মেয়ে বিব্বির হাত ছেড়ে গয়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলেন। ফৈজাবাদ থেকে না পালিয়ে আর উপায় ছিল না তাঁর। নিজে বাঁচতেন না, মেয়েটাকেও বাঁচাতে পারতেন না।
মুশতারি গয়ায় তাঁর এক দূর সম্পর্কের ভাইয়ের বাড়িতে উঠলেন। কড়ার হল, মা-মেয়ের থাকা খাওয়ার বিনিময়ে মুশতারি তাঁর ভাইয়ের গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজ করে দেবেন। আর, মেয়ের ভবিষ্যৎ? মায়ের ইচ্ছে, মেয়ে স্কুলে যাক, লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াক। মেয়ে কিছুতেই স্কুলে যাবে না। সে পড়বে না, গান শিখবে। মুশতারির প্রবল আপত্তি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আপত্তি টিকল না। মেয়ের জন্য ওস্তাদ এলেন। তালিম চলল। এক দিন বৃদ্ধ ওস্তাদ মীড় শেখাচ্ছিলেন, আর বিব্বিও বুঝতে পারছিল না, কী ভাবে এক সুর থেকে গলা গড়িয়ে যায় অন্য সুরে। বিরক্ত ওস্তাদ ইমদাত খান শেষ পর্যন্ত সরিয়ে রাখলেন সারেঙ্গির ছড়, তার পর নিজের হাতের পাতা বুলিয়ে দিলেন বিব্বির উরুর ওপর। বললেন, এই ভাবে সুর গড়িয়ে যায়। গা ঘিনঘিন করে উঠল বিব্বির। ছোট্ট মেয়ে, কিন্তু লোলচর্ম বৃদ্ধের হাতের মধ্যে যে লোভী পুরুষের স্পর্শ ছিল, তাকে চিনতে, ঘেন্না পেতে, ভুল হয়নি তার। তক্ষুনি উঠে পড়ল মেয়ে, জানিয়ে দিল, যে ওস্তাদ তার শরীরে হাত দেয়, তার কাছে কিছুতেই গান শিখবে না সে। শেষ পর্যন্ত বিদায় হলেন ওস্তাদ। নতুন ওস্তাদের কাছে গান শেখা চলল। তিনি কিছু দিনের জন্য বম্বে গেলেন, বিব্বির রেওয়াজের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন ওস্তাদ জামিরুদ্দিনের ওপর। এই ওস্তাদের হাত ধরেই এক দিন কলকাতায় এলেন মুশতারি আর বিব্বি। গান শুনতে। কলকাতায় চ্যারিটি শো— কে নেই শিল্পীদের তালিকায়? ১৪টা ভাষা জানা গওহর জান, মালকা জান, ছপ্পন ছুরি; খান সাহেবদের মধ্যে আগ্রা ঘরানার শ্রেষ্ঠ গায়ক আফতাব-এ-মৌসিকী ওস্তাদ ফৈয়জ খান, রজব আলি খান, কিরানার প্রাণপুরুষ আবদুল করিম খান, মাইহারের আল্লাউদ্দিন খান। সবাই চ্যারিটি শো-তে বিনে পয়সায় গাইবেন। আসরের দিন অবশ্য দেখা গেল, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শিল্পী বেনারসের সানাইবাদক আমন আলি বক্শ খান ছাড়া উপস্থিত নেই কেউই। এই আসরেই প্রথম শ্রোতাদের সামনে সানাই বাজাল আলি বক্শের কিশোর ভাইপো। তার নাম বিসমিল্লাহ খান। বিব্বির ঠিকে ওস্তাদ জামিরুদ্দিন লোক চৌকশ ছিলেন। আসরে ওস্তাদদের অনুপস্থিতিতে শ্রোতারা গরম হতে আরম্ভ করেছে দেখেই বুঝলেন, আয়োজকরা বেকায়দায় পড়বে এ বার। জামিরুদ্দিন মুশতারি আর বিব্বিকে বসিয়ে রেখে হাজির হলেন ব্যাক স্টেজে। এক উদ্যোক্তাকে পাকড়াও করে বললেন, ‘বলেন তো আমার ছাত্রীকে বসিয়ে দিই আসরে।’ ‘পারবে, এত বড় আসর সামলাতে?’ দ্বিধায় সেই উদ্যোক্তা। জামিরুদ্দিনের জিভের ডগায় তখন সাক্ষাৎ বাগদেবী ভর করেছেন— ‘পারবে না মানে! কোন ঘরের, কোন তালিমের মেয়ে, তা তো দেখবেন, জনাব!’ রাজি হয়ে গেলেন সেই উদ্যোক্তা। মা-মেয়ের কাছে দৌড়ে এলেন জামিরুদ্দিন। মা রাজি, মেয়ের মতামতের প্রশ্নই নেই। মেয়েকে নিয়ে স্টেজের দিকে হাঁটা দিয়েছেন জামিরুদ্দিন, এমন সময় মুশতারির দিকে ফিরে বললেন, ‘কিন্তু, বিব্বি নাম তো চলবে না।’ মুশতারি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘বলুন, ওর নাম আখতার। সৈয়দ আখতার।’ মুশতারি জানতেন, অসগর হুসেনের ছেলের নাম আখতার। জামিরুদ্দিন বললেন, ‘না, ওর নাম আখতারি। আখতারি বাই ফৈজাবাদি।’
বিব্বির দ্বিতীয় জন্ম হল। আসর মাত করে দিল সেই এগারো বছরের মেয়ে। তখন কলকাতার রইসদের তারিফ পাওয়া ছিল হিন্দুস্থানের গাইয়ে বাজিয়েদের চূড়ান্ত শিলমোহর। খবরের কাগজওয়ালারা উচ্ছ্বসিত, ঘোষিত হল এক নতুন তারার জন্ম। মেগাফোন সংস্থার বড়কর্তা জে এন ঘোষ চুক্তি করলেন আখতারির সঙ্গে। রিপন ষ্ট্রিটে ফ্ল্যাট হল, গাড়ি হল, নতুন ডিস্ক বেরোল, কিন্তু আখতারির গান আর তেমন হিট করল না। ঘোষবাবুর কপালে ভাঁজ। মেয়ের মাকে সোজা জানিয়ে দিলেন, আর একটা রেকর্ড বের করবেন তিনি, সেটা চললে ভাল, নচেৎ চুক্তি বাতিল। মুশতারির মাথায় বজ্রাঘাত। তার সারা জীবন দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে কেটেছে। এই প্রথম মেয়ের কল্যাণে সুখের মুখ দেখেছেন তিনি। কোনও ভাবেই সে সুখকে হাত ফসকে হারিয়ে যেতে দেবেন না। ঘোষবাবুর কাছে কয়েকটা দিন সময় চেয়ে নিলেন মুশতারি, তার পর মেয়েকে নিয়ে সোজা বেরিলি। সেখানে তাঁর গুরু, পীর আজিজ মিয়া থাকেন। এই পীরের ঘর নাকি বাকসিদ্ধ, চারশো বছরেরও বেশি সময় ধরে। পীর সব শুনলেন, তার পর আখতারিকে বললেন, ‘কলকাতায় গিয়ে যে গানটা গাইবি, সেই পাতাটা আমার সামনে খুলে ধর তো বেটি।’ আখতারি খাতা খুলল, সেই পাতায় হাত রাখলেন আজিজ মিয়া। বললেন, ‘শোহরত তুমহারি কদম চুমেগি, দৌলত তুমহারি বান্দি হো কর ঘুমেগি’। ‘দিওয়ামুশতারি আর দেরি করলেন না। ট্রেন ধরে কলকাতা, সোজা ঘোষবাবুর অফিসে, রেকর্ডিং করাতে। আখতারি গাইল—" দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো দিওয়ানা বনা দে’। বাকিটা ইতিহাস। কতটা ঝলমলে ইতিহাস, সেই রেকর্ডিংয়ের প্রায় চল্লিশ বছর পরে তার প্রমাণ দিয়েছিলেন আমির খান সাহেব। আমির খানের তখন ভারতজোড়া নাম। কটকের এক জলসায় বেগম আখতার আর আমির খান সাহেব দু’জনেই হাজির। আয়োজকদের ইচ্ছে, খান সাহেব প্রথমে গেয়ে নিন, তার পর সারা রাত বেগম সাহিবার গান হবে। বেগম নারাজ, জেনেশুনে খান সাহেবের আগে গাওয়ার মতো গুনাহ তিনি কী ভাবে করবেন। শেষে আমির খান যা বললেন, অবিস্মরণীয়। বললেন, ‘যখন আখতারি বাইয়ের সারা ভারত জুড়ে নাম, তখন তো এই গওয়াইয়া আমির খান পয়দাই হননি। আমাকে তখন কে চিনত! আমি তো তোমার রোটিতে অভিনয় আর ‘দিওয়ানা বনানা হো’ শুনেই দিওয়ানা হয়ে গিয়েছিলাম আর পাঁচ জনের মতো। তুম তো হানেমে হামারি সিনিয়র হো। গাও ভাই হামারে বাদমে দিল খোলকে।’
দিওয়ানা বানানা হো তো...
কিন্তু, সে গল্প তো অনেক পরের। তখন তিনি বেগম সাহিবা। আমাদের কাহিনির নায়িকা তো এখনও আখতারি। হঠাৎ এক দিন কলকাতা থেকে হারিয়ে গেল সে। একেবারে উধাও। কোথায় গেল আখতারি?
বিহারের এক রাজার দরবারে গান শোনাতে গেল সে। সেই রাজা কুদর্শন, কিন্তু সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে তাঁর প্রচুর খ্যাতি। তাঁর দরবারে গান হল আখতারির। তখন তার বয়েস ১৩। গানের শেষে নিজের তাবুতে ফিরে এসেছে আখতারি, এমন সময় রাজবাড়ি থেকে ফের ডাক পড়ল তার। সারা রাত ফিরল না সে। ভোররাতে দারোয়ান এসে পৌঁছে দিয়ে গেল আখতারির সংজ্ঞাহীন, রক্তাক্ত দেহ। সঙ্গীতপ্রিয় রাজা ধর্ষণ করেছেন তাকে। ছ’দিন জ্ঞান ফিরল না আখতারির। তত দিনে মুশতারি তাকে নিয়ে লখনউ চলে এসেছেন। সেখানেই ন’মাস পরে মেয়ের জন্ম দিল আখতারি। তখন তার ১৪ বছর বয়স। মেয়ের নাম রাখা হল শামিমা। আখতারির সৌন্দর্যের এক ফোঁটাও পায়নি সেই মেয়ে। তার ধর্ষক বাপের মতোই কালো, কুৎসিত। মেয়েকে কলঙ্ক থেকে বাঁচাতে এক অসম্ভব কাজ করলেন মুশতারি। ১৫ বছর ধরে স্বামীসঙ্গহীন মুশতারি সবাইকে বললেন, শামিমা তার মেয়ে। আখতারির এই ‘ছোট বোন’, আখতারির একমাত্র সন্তান শামিমা সারা জীবন আখতারির সঙ্গে ছিল— জীবনের একেবারে গোড়ার অসহ্য আঘাতের জ্যান্ত প্রমাণ হিসেবে।
এই লখনউয়েই তবায়েফের জীবন শুরু করে আখতারি। তখন তার অনেক টাকা। তার বাবা, জাস্টিস অসগর হুসেনের বাড়িও এই লখনউতেই। আখতারি বাড়ি হাঁকালেন একেবারে তার বাড়ির উল্টো দিকে, নাম দিলেন আখতারি মঞ্জিল। নিয়মিত আসর বসত আখতারি মঞ্জিলে, লখনউ-র সব রহিসরা আসতেন। লাল পার্শিয়ান কার্পেটে মোড়া আসর, মহার্ঘ্য ঝাড়বাতির দ্যুতি ঠিকরে পড়ে বেলজিয়ামে তৈরি আয়নার কাচে। এক দিন সন্ধেবেলা
ঢুকলেন এক সুদর্শন যুবক। তাঁকে দেখেই লাফিয়ে উঠলেন মুশতারি। মজলিসের ঘরে ঢুকতে না দিয়ে তাঁকে নিয়ে বসালেন একেবারে শোওয়ার ঘরে। তার পর ডেকে পাঠালেন আখতারিকে। বললেন, এই ভদ্রলোককে চিনিস? এ তোর ভাই, সৈয়দ আখতার হুসেন। অসগর হুসেন সাহেবের ছেলে। তোর গান শুনতে এসেছেন। বারাবহাঁকির নবাবপুত্র ইনায়াত হাবিবুল্লার বিয়ের রিসেপশন উপলক্ষে আখতারির মুজরা। জারদৌসির কাজ করা লাল শিফন শাড়ি, সঙ্গে চোখ ঝলসানো গয়নায় আসরে বসলেন তিনি, গৃহকর্তা তখন এক অভ্যাগতর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন অন্যদের। একেবারে শেষে সবচেয়ে সম্মাননীয় অতিথি, লখনউ আদালতের বিচারপতি, জাস্টিস অসগর হুসেন। নিজের পরিবার পরিবৃত বিচারক বসে আখতারি বাইয়ের গান শুনলেন। বাড়ির মেয়েরা সব ঝরোখার পিছনে, আসরে শুধু পুরুষরা, আর আখতারি। কী আশ্চর্য, নিজের জন্মদাতাকে প্রথম বার দেখেও আখতারির এক বারও ইচ্ছে করল না, নিজের পরিচয় দেয়। সে তবায়েফ, নিজের গানটুকু করল বুকের সব রক্ত দিয়ে। আসরের শ্রোতারা বহু দিন পর্যন্ত আখতারির এই গানের তারিফ করতেন। সাধে কি ফৈয়জ খান সাহেব বলেছিলেন, দিলে চোট না লাগলে গজল গাওয়া যায় না!
আর এক রাজদরবারে গাইতে গিয়ে আলাপ হল রাজার কনিষ্ঠ সন্তান বালির সঙ্গে। অসম্ভব সুপুরুষ, ভদ্র এক জন মানুষ, আর চোখের কোণে কোথাও যেন লগ্ন হয়ে থাকে বিষাদ। ঘনিষ্ঠতা ক্রমে বাড়তে থাকে দু’জনের। আখতারি জানতে পারেন, সৎ মা আর ভাইদের ষড়েযন্ত্রে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে পারেন বালি। এক চাঁদনি রাতে, সরোবরের জলে চাঁদের সাঁতার দেখতে দেখতে দু’জনে বিয়ে করার সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন। তার আগে বালি আখতারির জন্য বানিয়ে দিয়েছেন হারমোনিয়াম। বিয়ে হল। এক দিন আখতারি সোহাগ করে বালিকে বললেন, ‘আমায় হারমোনিয়াম বাজানো শেখাও, আমি পরের আসরে এই যন্ত্র বাজিয়ে গাইব।’ বিরক্ত মুখে বালি বললেন, ‘আসর? তুমি কি ভাবছ, তুমি আগের মতো মুজরা করে বেড়াবে?’ আখতারি অবাক। ‘বিয়ের আগে যে কথা হল, আমি আগের মতোই গান গাইতে পারব? গান না গাইলে সারা দিন কী করব আমি?’ বালি জবাব দেন, ‘কেন, ভাল শাড়ি পরো, গয়না পরো, খাও— অভিজাত পরিবারের বউরা যেমন ভাবে থাকে, তেমন থাকো।’ বলেই বাড়ি থেকে চলে যান বালি। ফেরেন তিন দিন পর। এই তিন দিন নিজেকে বোঝান আখতারি, না হয় প্রেমাস্পদের জন্য গান ছেড়েই দেবেন তিনি। বালি ফিরলে বলেন, ‘ঠিক আছে, গান গাইব না, কিন্তু তুমি তা হলে আমার কাছে থাকো। এ ভাবে আমায় ছেড়ে এত দিনের জন্য চলে যেও না।’ রেগে যান বালি। ‘বিয়ে করার মানে কি বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকা? আমার নিজের জীবন নেই?’ আবার অনেক দিনের জন্য বেরিয়ে যান বালি। আখতারিও তাঁর গয়নাগাটি নিয়ে ফিরে আসেন লখনউ-এ। বুকের ভিতর রক্তপাত হতে থাকে, কিন্তু ফেরেন না আর বালির কাছে। এক দিন এক মুজরা আরম্ভ হল নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় দু’ঘণ্টা পরে। আখতারি শুনলেন, উপস্থিত অভিজাত পুরুষরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন, বালি নামে এক নবাবজাদা খুন হয়েছেন কাল রাতে, তার শেষকৃত্যে যোগ দিতেই দেরি হয়ে গেল।
সেই আসরেও আখতারি বাইয়ের গান হল।
রামপুরের নবাব রেজা আলির বিয়ের প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিলেন আখতারি। আহত নবাব আখতারির নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেন। অভিযোগ, আখতারি রামপুর থেকে বহুমূল্য গয়না নিয়ে পালিয়েছেন। লখনউ-র রাস্তায় রামপুরের নবাবের পুলিশ যখন আখতারিকে প্রায় গ্রেফতার করে ফেলেছে, বাঁচাতে এগিয়ে এলেন এক ব্যারিস্টার। ইশতিয়াক আহমদ আব্বাসি। কাকোরির নবাব। বহু দিন ধরেই তিনি আখতারির প্রেমে হাবুডুবু। প্রথমটায় বিয়ে করতে রাজি ছিলেন না আখতারি। শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। ১৯৪৪ সাল। বিয়ের পর গান ছেড়ে দিলেন তিনি। মুজরার প্রশ্নই নেই। প্রাণপণে অভিজাত পরিবারের বউ হয়ে ওঠার চেষ্টা আরম্ভ করলেন। তবু, আব্বাসির পরিবার তাঁকে মানল না। আব্বাসিসাহেব আখতারিকে নিয়ে আলাদা সংসার পাতলেন।
সন্তান ধারণ করলেন আখতারি। গর্ভপাত হল। এক বার নয়, সাত বার। ডাক্তার জানিয়ে দিলেন, আখতারির পক্ষে আর মা হওয়া সম্ভব নয়। মানসিক অবসাদ গ্রাস করল তাঁকে। ডাক্তার বললেন, একমাত্র গানই বাঁচিয়ে রাখতে পারে তাঁকে। আব্বাসি সাহেব অমত করলেন না, কিন্তু শর্ত, বাইরে গাওয়া চলবে না। সেই শর্ত অবশ্য রাখলেন না আখতারি। এক দিন আব্বাসি সাহেবের সঙ্গে ঝগড়া হল। তিনি কোর্টে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই রেডিয়ো স্টেশনে ফোন করলেন আখতারি। সেখানে ছিলেন তাঁর বহুপরিচিত এল কে মালহোত্রা। আখতারি বললেন, আব্বাসিসাহেবের বাড়ি ফেরার আগে যে কয়েক ঘণ্টা সময়, তার মধ্যে কি রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব? বিস্মিত এল কে সম্মতি জানালেন। পোশাক বদলে স্টুডিয়োয় রেকর্ডিং সেরে বাড়ি ফিরলেন আখতারি। আব্বাসি সাহেবের ফেরার আগেই।
বাড়ি ফিরেই নতুন দুশ্চিন্তা। রেডিয়োয় তাঁর নাম ঘোষণা মানেই আব্বাসি সাহেবের নামটাও জড়িয়ে যাওয়া। সেই অভিজাত পুরুষের অসম্মান। স্বামীর প্রতি গভীর প্রেম ছিল আখতারির, আর ছিল কৃতজ্ঞতাবোধ। একটা অসম্মানের জীবন থেকে বেগমের মর্যাদা দেওয়ার কৃতজ্ঞতা। তড়িঘড়ি এল কে মালহোত্রাকে ফোন করলেন আখতারি। বললেন, কোনও ভাবেই যেন তাঁর নাম ঘোষণা না করা হয়। এল কে হাসলেন, বললেন, ‘আমি জানি। আপনি বলার আগেই আমি নির্দেশ দিয়েছি, এই গান যেন বেগম আখতার নামে প্রচারিত হয়।’
বিব্বির তৃতীয় জন্ম হল।
"কোয়েলিয়া গান থামা এবার/ তোর ঐ কুহুতান ভালো লাগেনা আর"।
কোয়েলিয়া গান থামা এবার।
*** সুত্রঃ বিভিন্ন পত্রিকা ও নেট।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১:৫৮