নোয়ারাই গ্রামে যে বাড়িতে আমরা ছিলাম, ঐ ভদ্রলোকেরা ছয় ভাই। সবাই লন্ডন প্রবাসী। ক’মাস আগেই উনি মা’কে নিয়ে দেশে এসে আটকে পড়েন। উনার মায়ের কথা এখনো মনে আছে। খুব সাহসী এবং স্নেহ-প্রবন মহিলা ছিলেন উনি। প্রথম দিনই আব্বাকে বললেন, “এত দিন আমার ছয় ছেলে ছিলো, এখন থেকে আমার সাত ছেলে, তুমি আমার ছেলে, এটা তোমার নিজের বাড়ি”। শহুরে মানুষ --সকালে ভাত খেতে পারেনা মনে করে উনার নির্দেশে আমাদের রুটি, পরোটা দেয়া হত। আব্বা আম্মার শত বারন উনি কানে নেন নি। বিশাল বাড়ী, আত্মীয়-স্বজন, আশ্রিত, কামলা, মুনিষ, অনেক মানুষ। সকাল দশটার দিকে ক্ষেতে ভাত পাঠানো হত, সেটা ছিল দেখার মত। বড় বড় দুইটা টুকরিতে ভাত ঢালা হত, তার উপরে গাদা খানিক আলু ভর্তা বা বেগুন ভর্তা আর পুড়ানো শুকনা মরিচ, কলাপাতা দিয়ে ঢেকে একজন কাঁধে করে ভার নিয়ে মাঠে যেত।
তেমনি এক সকালে ভাত বাড়া হচ্ছে, আমি সাগ্রহে বসে বসে দেখছি, এমন সময় অনেক মানুষের হইচই শোনা গেলো, কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা ছোকরা মুনিষ চেঁচাতে চেঁচাতে এল, “মাজন সাব মাজন সাব মিলিটারি আয়রো”। মুহুর্তে পুরো বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল। আব্বা বললেন, “আগে ব্যাপারটা বুঝি, তারপর ব্যাবস্থা নেয়া যাবে”। ঐ মুনিষকে সামনে ডেকে এনে যা জানা গেলো, মিলিটারি পাশের গ্রামে এসেছে, এ গ্রামের নদীতীরে সবসময় কেউ না কেউ পাহারায় থাকত, যাতে মিলিটারি দেখলেই খবর জানাতে পারে, স্পিডবোটে নদী পার হয়ে পাশের গ্রামে ঢুকেছে। ততক্ষণে গুলির শব্দও আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম। আব্বা সবাইকে বললেন, “ জিনিস-পত্রের মায়া করলে এখন হবে না, জান বাঁচাতে হবে, ঘর তালা দিয়ে সব বেরিয়ে পড়েন, আমি তো এদিকের পথঘাট চিনিনা, সুতরাং কোনদিকে যেতে হবে সেটা আপনারাই ভালো বুঝবেন”। বৃদ্ধা গৃহকর্তী এগিয়ে এলেন, বললেন, আল্লাহের নাম নিয়ে তোমরা বেড়িয়ে পড়, আমি এদিকটা সামাল দিবো”। হাজার কাকুতি মিনতি, অনুরধেও উনাকে টলানো গেল না। উনার এক কথা, ইনশাল্লাহ আমার কিছু হবেনা, তোমরা বেড়িয়ে পড়।
বেতের ঝুড়িতে ছোটবোনের দুধের সরঞ্জাম নিয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। গ্রামের মানুষ প্রাণভয়ে সবাই ছুটছে। ক্ষেতের আলপথ ধরে, কখনো বা ন্যাড়া ক্ষেতের উপর দিয়ে আমরা হাটছি। পিছনে ফেলে আসছি, চিৎকার, আগুনের লেলিহান শিখা। প্রচণ্ড গরমে ঘেমে নেয়ে হাফিয়ে উঠেছি সবাই, কিন্তু থামা চলবে না। দুপুরের দিকে একটি বাড়ির বাইরে পুকুর ঘাটে এসে থামলাম। আম্মা ওখানেই ধপ করে বসে পড়লেন। বাড়ির মানুষ ছুটে এলো। আম্মার হাত ধরে তুলে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল। আমরা প্রায় ২০/২৫ জন ছিলাম। সবাইকে পানি খেতে দিয়ে জানতে চাইল কোন দিকে মিলিটারি এসেছে। ঘণ্টা দুয়েক পর আমাদের ভাত খেতে দিল। আলু ভাজি, আর ডাল। গৃহকর্তা বারবার বলতে লাগল, “ আপনারা এত কষ্ট করে আমার বাড়ীতে এলেন, জীবনে আর কোন দিনও আসবেন না জানি, কিন্তু আপনাদের কোন সমাদর করতে পারলাম না”। মানুষ মানুষের জন্য-- কথাটা গ্রামের অশিক্ষিত মানুষ গুলো যেনো শহরের মানুষদের সে সময় বুঝিয়ে দিয়েছিল।
খাওয়া দাওয়ার পর বড়দের সাথে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ফেলে আসা গ্রামের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। কুয়াশার মত ধোঁয়ার কুণ্ডলি নজরে পড়ল। তখনও মানুষ ছুটে চলছিল অজানার উদ্দেশ্যে। বিকালের দিকে দু’একজন সাহসী যুবক গ্রামের পরিস্থিতি দেখে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু কেউ তাদের কথায় সম্মত হয়নি। রাতটা ওখানেই গাদাগাদি করে বিছানা হল। মাটিতে শুয়ে কাটিয়ে দিলাম। খুব ভোরে দু’জন গ্রামে গিয়ে দেখে খবর নিয়ে এল, না,এখন মিলিটারি নেই, তবে কাল এসেছিল--গ্রামটা পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। এটা শুনে বৃদ্ধা মায়ের জন্য ভদ্রলোক অস্থির হয়ে উঠলেন। সকাল সকাল আমরা গ্রামে ফিরে চললাম। গ্রামে ঢুকেই মনে হল পুরো গ্রামটা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। কাঁচা ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই। খড়ের গাঁদা থেকে তখনো ধোঁয়া উড়ছিল। গোয়াল ঘরে বেঁধে রাখা অগ্নিদগ্ধ মৃত গরু-ছাগলও নজরে পড়ল। খুব কষ্ট হচ্ছিল, কি দোষ করেছিল এই নিরিহ মানুষ, পশুগুলো? ছোট্ট মনে এই প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল
মাকে জড়িয়ে ছেলের কান্না দেখে আমাদের কারো চোখই শুকনো ছিলনা।
এ বাড়িতেও মিলিটারি এসেছিল। এসেছিলো মানে, নিয়ে আসা হয়েছিলো। কয়েকজন রাজাকার মিলিটারিদের সাথে ছিলো। আর তারা ছিলো বাঙ্গালি(???) বৃদ্ধা বলেছেন, আমার ছেলেরা বিদেশে থাকে, আমি তোমাদের কথা কিছুই বুঝি না, তোমরা আমাকে মারতে চাইলে মারো। সাথের রাজাকারগুলো চিৎকার চেচামেচি করলেও ওরা কি বুঝেছিল কে জানে, ফিরে গিয়েছিলো। ঐ রাজাকারেরা যাওয়ার সময় গোয়াল ঘরে আগুন দিয়ে চলে যায়। গোয়ালে কিছুই ছিল না, সকালে রাখাল সব গরু নিয়ে মাঠে গিয়েছিল। তারপর কোথায় সব ছিটকে পড়েছিলো কে জানে। বৃদ্ধা আরও বললেন বিকেলের দিকে কয়েকজন লোককে চোখ, হাত বেধে কোমরে দড়ি দিয়ে ঐ রাজাকারেরা টানতে টানতে নদীর দিকে নিয়ে যেতে দেখেছেন তিনি। এ কথা শুনে সবাই আতংকিত হয়ে পড়লো। পাকিস্তানি সৈন্যরা বর্বর, নিষ্ঠুর। কিন্তু তাদের দোসর ঐ বাঙ্গালিগুলো??? ২/১ দিন পর আব্বা বললেন, এবার কাজে যোগ না দিলে চাকুরি থাকবে না। কিছু দিন আগেই অফিস আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু এখন হুমকি দেয়া হচ্ছে, যারা এখনো কাজে যোগ দেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমাদের রেখে আব্বা মৌলভীবাজার ফিরে যাতে চাইলেন। কিন্তু আম্মা বেঁকে বসলেন, উনার এক কথা- যা হবার তা হবে, এক সাথেই থাকব। অগত্যা কি করা- আমাদের নিয়েই ফিরে এলেন।
বাসায় ফেরার সময় দেখলাম শহরের বুকেও নতুন অনেক ক্ষত চিহ্ন। গলির মুখ থেকে ১০০ কদম পশ্চিম দিকে ছিল সোনালি ব্যাঙ্কের ট্রেজারি, এসে দেখলাম, বোমার আঘাতে ওটা বিদ্ধস্ত।ধংসস্তুপের ভিতর থেকে অনেকেই নাকি বস্তা ভরে অক্ষত টাকা আর ভাংতি পয়সা নিয়ে গিয়েছে। দেখলাম, মিছিরউল্লাহ মোক্তারের পরিবার ওখানেই আছেন। উনার স্ত্রী তো আম্মাকে রীতিমত ধমকই দিলেন, উনার স্বামী শান্তি কমিটিতে থাকতে আমরা কেনো এত দুশ্চিন্তা করছি, বাড়িওয়ালা হিসেবে ভাড়াটিয়ার প্রতি উনাদের কর্তব্য আছে না? আম্মা বললেন, আপা, এই যে আপনার বাসায় সবসময় মিলিটারি অফিসারেরা আসছে, খুকী ভার্সিটীতে, রানু, মেরীও তো এবার মেট্রিক দিবে, এটা কেমন দেখায় না? উনি উস্মার সঙ্গে বললেন, “ বাপীর আম্মা, আপনি এটা কি বললেন? আমার খুকীর কাছে তো অমুক মেজর বাংলা শিখছে”। তীব্র বিতৃষ্ণায় আম্মার মুখ কঠোর হয়ে গেল। উনি চুপ করে গেলেন।
কদিন পরেই নির্দেশ এল স্কুলে যেতে হবে। শুনে তো আমি মহা খুশী। কত দিন পরে বন্ধুদের সাথে দেখা হবে। স্কুলে যাওয়ার পথে কত যে ধংসস্তুপ দেখলাম। একসারি সোনার দোকান ছিল। ওখানকার দুটি মেয়ে আমার সাথে পড়ত, তাদের দোকান, বাসা কিছুই খুঁজে পেলাম না। পোড়া খুঁটিগুলো সেই বিভৎসতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্কুলে শিক্ষক, ছাত্রি দু’টোর সংখাও খুব কম। পড়াশুনার কোন বালাই নেই। আমাদের দিয়ে অনাগত অনুষ্ঠানের মহড়া করানো হচ্ছিল। কবে, কোথায় অনুষ্ঠান যানিনা। একটি ছড়া গান শিখানো হচ্ছিল, কিছু কিছু মনে আছে—
ইন্দি বিন্দি সিন্ধি খেলা করে,
গাছের আড়াল থেকে শুনিবারে,
একদিন নাঁকি সুরে গাইলো কে গান
তাই শুনে ইন্দি বিন্দির উড়ে গেলো প্রাণ......
এসব ছড়া গানের আগামাথা না বুঝলেও গাইতে হত। কিছুদিনের মধ্যেই স্কুলের আকর্ষণ হারিয়ে ফেললাম।তবুও ঘর থেকে বেরুতে পারব, এই ভেবেই স্কুলে যেতাম।
আজ যখন সেই সময়ের স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছি, তখন একটি স্মৃতি খুব করে মনের জানালায় উঁকি দিচ্ছে। এ ঘটনা আমি কখনই বিস্মৃত হইনি। বিকেল হলেই আমি ছোট্ট ফুটফুটে পরীর মত বোনটিকে কোলে করে বাইরে যেতাম। গলির মোড়ে একদিন এক মাঝ-বয়সী মিলিটারি আমার সামনে এসে হাত বাড়ালো, আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখি বোন তার কোলে। অনেক আদর করে আমার কোলে ফিরিয়ে দিল। ভয়ে আমি আম্মাকে কিছু বলিনি। পরদিন দেখি লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে বোনকে কোলে নিল। আমাদের দু’জনের হাতেই লেবেঞ্চুস ধরিয়ে দিলো। এ ভাবেই কিছু দিন গেল। দু’বোনের লেবেঞ্চুস আমি একাই সাবাড় করে ঘরে ফিরি। একদিন বোনকে কোলে নিয়ে লোকটি অনেক আদর করে ফিরিয়ে দেয়ার সময় অনেক গুলো লেবেঞ্চুস, বিস্কিট আমার হাতে দিলো। চলে যাওয়ার সময় বারবার পিছু ফিরে তাকাচ্ছিল। আমার তখন কেনো যেনো মনে হচ্ছিল লোকটা কাবুলীওয়ালা, আর বোনটি মিনি।
কোলে বোন, আর হাত ভর্তি এসব জিনিস, ঘরে ফিরব কি করে? একবার মনে হলো ছুড়ে ফেলে দেই পুকুরে। কিন্তু প্রাণে ধরে তা পারলাম না। বাসায় ফিরে আম্মাকে বলতেই হল। আম্মা বললেন, “তোমার তো ভয় ডর বলতে কিছুই নেই জানি, কিন্তু তুমি কোন আক্কেলে ঐ জানোয়ারের কোলে বোনকে দিলে? যদি নিয়ে চলে যেত”? আমি বললাম, না আম্মা, ওটা তো ভালো মিলিটারি, কাবুলিওয়ালার মত। ঝাঁঝিয়ে উঠে আম্মা বললেন এই বয়সে গুচ্ছের বই গিলে বসে আছ, কিন্তু ঘটে তো বুদ্ধির ছিটেফোঁটাও নেই।পরবর্তিতে ব্ল্যাকলিষ্টে থাকা আমার আব্বাকেও এই রকম এক মিলিটারি বাঁচিয়ে দিয়েছিল। পরে তার কথাও উল্লেখ করব। এই দু’জন পাকসেনার কথা আমাদের সবসময় মনে হয়েছে, আজও হয়।
স্মৃতি ১৯৭১ (৩)