১৫ই ডিসেম্বর সিলেট শহর মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয়-সেনাদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে পড়ে। বাসার সামনের বাগানে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম ট্রাকে করে হই-হল্লা, হাতে অস্ত্র উচিয়ে গান গাইতে গাইতে তারা যাচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ৬ মাস আমরা মৌ্লভীবাজারে কাটালেও শেষের ৩ মাস ছিলাম সিলেট শহরে আমার এক ফুফুর বাসায়। আমাদের কোন গ্রামের বাড়ী ছিলোনা। যখন মৌ্লভীবাজারে আমাদের বাড়ীওয়ালা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের বাড়িতে পাক আর্মির সরগম তখন আব্বা আমাদের ঢাকা পাঠিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে সিলেট নিয়ে আসেন। ভাবনা পরিকল্পনা ছিল ঢাকা থেকে আমরা নানার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর যাবো। কিন্তু সিলেটে এসে দেখা গেল ফ্লাইট বন্ধ। ট্রেন লাইন তো অনেক আগেই নষ্ট। অগত্যা আমাদের ফুফুর বাসায় রেখে আব্বা মৌ্লভীবাজারে ফিরে যান। এসব কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি।
শুনেছিলাম শহরের এক প্রান্তে দুবলীর হাওরে ভারতীয় হেলিকপ্টার নেমেছে। মুক্তিবাহিনীর মর্টার-শেলের আঘাতে হাওয়াপাড়ায় দুটি বাড়িতে নাকি বিশাল পুকুরের মত গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। আব্বা বলেছিলেন দেশ স্বাধীন হলে আমাদের দেখাতে নিয়ে যাবেন। ভাইয়া কখনো নিজে আব্বাকে কিছু বলতো না, সব সময় আমাকেই ওর মুখপাত্র হতে হতো। এখনও তাই হল। আমার পিঠে খোচা দিয়ে ফিসফিস করে বল্লো, “এই, আব্বাকে বলনা আমাদের স্বাধীনতা দেখাতে নিয়ে যেতে”। তোতা-পাখির মত সে কথা আউড়ে যেতেই আব্বা সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “ঠিক আছে, কাল তোমাদের নিয়ে বের হবো”।
আমরা তো অস্থির হয়ে গেলাম কখন আমরা স্বাধীনতা দেখতে যাবো। রাতে শুয়ে শুয়ে দু ভাইবোনে সে কথাই জল্পনা কল্পনা করছিলাম। হঠাৎ শুনলাম আব্বা বলছেন, “এবার মিছিরউল্লাহ মোক্তার (আমাদের বাড়িওয়ালা) ঠ্যালাটা টের পাবে”। আম্মা ঝাজিয়ে উঠলেন, “আপনার কি তার জন্য দরদ লাগছে”? আব্বা একটি দীর্ঘশ্বাষ ছেড়ে বললেন, “না দরদ লাগবে কেনো, যেমন কর্ম তেমনই তো ফল ভোগ করা লাগে। এটাই নিয়ম”। কিন্তু এটাই যে নিয়ম নয় তা যুদ্ধ-পরবর্তী এই ৩৯ বছর ধরেই দেখছি।
“আচ্ছা আব্বা, যুদ্ধ তো শেষ, এখন আমরা আমাদের বাসায় যেতে পারবোনা”?
“অবশ্যই যেতে পারবো। কয়েকদিনের মাঝেই আমরা নিজেদের বাড়ি-ঘরে ফিরে যাবো”। আব্বা বললেন। চিন্তিত স্বরে আম্মা বললেন, বাড়ি-ঘরে গিয়ে কি কিছু পাবো? লুটপাট হয়েছে কিনা কে জানে!! ( ফিরে গিয়ে আমরা শুন্য ঘরই পেয়েছিলাম। সব কিছু লুট হয়ে গিয়েছিলো)
আমার পাশ থেকে ভাইয়া আস্তে করে বল্লো, ‘যুদ্ধ শেষ। এখন আবার আমরা মাংস খেতে পারবো”। আব্বা হেসে ওর পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন, “ হ্যা, বড় মিয়া আবার তুমি মাংস খেতে পারবে”।
১৬ই ডিসেম্বর সকালে একঘেয়ে খিচুড়ি কোনমতে গিলে আমরা বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। রাস্তায় বেরিয়ে দেখি মানুষ আর মানুষ। মনে হচ্ছে ঈদের মেলা বসেছে। মাঝে মাঝে বিরাট কনভয় আস্তে আস্তে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। তাতে অস্ত্র হাতে ভারতীয় মিলিটারি। কিছু হুড খোলা জীপে অস্ত্র হাতে লোকজন। আব্বা বললেন," ঐ দেখ মুক্তিযোদ্ধা"। অবাক হয়ে দেখলাম কন্ঠার হাড় বের করা, অবিন্যস্ত কাপড় পড়া ক্লান্ত কিন্তু খুশীতে ঝলমল মুখগুলো।তারা হাসিমুখে চিৎকার করে গান গাইছে। “ জয় বাংলা বাংলার জয়”। পুর্ব দিগন্তে সুর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল, জোয়ার এসেছে কাল সমুদ্রে রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল...
আস্তে করে আব্বাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আব্বা স্বাধীনতা কই”? আব্বা বাম হাতে আমাকে উনার কোমরের কাছে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে কত কথা বললেন, যার অর্থ কিছুই বুঝলাম না, আর কিছু কথা উড়ে চলে গেলো জন-সমুদ্রের গর্জনে। কানে মন্ত্রের মত গুনগুন করতে লাগলো একটি কথা- "আমরা বিজয় অর্জন করেছি। আমরা আর মাথা নত করে থাকবনা। আমরা বিজয়ি জাতি"।
এতো কলরব, এতো হইচই তারপরও প্রতিটি মানুষের চোখে-মুখে আনন্দ ঝলমল করছে। আব্বা, আম্মার মুখেও দেখলাম অনাগত সুখ-স্বপ্নের পেলব ছায়া। সবাই আনন্দে আত্মহারা। ভুলে গেলাম দীর্ঘ নয়টি মাসের বিভিষিকার কথা, যখন তখন গুলির শব্দ, বোমার শব্দের কথা, গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়ানোর কথা। অজানা অচেনা মানুষের বাড়িতে সংকুচিত অন্ন ভক্ষনের কথা। এক সাগর রক্তের কথা। আর কোন চিন্তা নেই, ভয় নেই। যেন কোন অলিক যাদু-মন্ত্রে সবাই মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছে। সবার অন্তরাত্মা গাইছে, “ আমি কেবলি স্বপন করেছি বপন আকাশে...।