অভিধান খুঁজে ‘অরিত্রী’ শব্দ পেলাম না। পেলাম অরিত্র। এর অর্থ নৌকার হাল, দাঁড়। দিলীপ অধিকারী মেয়ের নাম এটা রাখতে গেলেন কেন? ছেলেহীন সংসারে একদিন মেয়েই হাল ধরবে- এমনটাই কি ছিল বাসনা? হয়ত, হয়ত নয়। বাস্তবে অরিত্রী তাদের মা-বাবার স্বপ্নের দিশারি হতে চলেছিল। কিন্তু এই পোড়ার দেশে অনেক কিছুই যে হয় না! অরিত্রী অধিকারীও তাদের সংসার নৌকার হাল হতে পারেনি। বৃহৎ সংসারের অদৃশ্য পাঁকে ডুবে হারিয়ে গেছে অভিমানী মেয়েটি। যাদের তাকে টেনে তোলার কথা, তারা তাকে উল্টো চেপে ধরেছে। এ এক আশ্চর্য সংসার! এ সংসারে দিলীপ অধিকারীদের সংসার-নৌকা কূল পায় না, সামান্য বেখেয়ালে তারা খাবি খায়!
সংসারে ছেলে না থাকায় অরিত্রীর বাবা-মায়ের একটা আক্ষেপ ছিল। দুটো মেয়ে দিনে দিনে সেই আক্ষেপ ভুলিয়েছে তাদের। মেয়েদের দৃপ্ত পথচলায় গর্বে বুক ভরে যেত বাবা-মায়ের। বিজ্ঞানের সেরা স্টুডেন্ট হওয়ার দৌড়ে বেশ এগিয়ে ছিল অরিত্রী। ভিকারুননিসা স্কুলের মতো হাজার মেধাবীর ভিড়ে ১২তম স্থান দখল করা চাট্টিখানি কথা নয়। মেয়ে বলত, ‘বাবা, টাকা বেশি খরচ করো না, আমি বিদেশে পড়তে যাব, আমি বড় স্কলার হব।’ বিদেশ মানে তো ভিন দেশ, সেই রকম একটা বিদেশে অরিত্রী ঠিকই চলে গেল। এখন সেই ভিন দেশে স্রষ্টার কাছ থেকে সে নিশ্চয়ই পাঠ নেবে। বড়দের মধ্যে বড় স্কলার হবে। দুঃখ এই, পৃথিবীর আলো-হাওয়ায় অরিত্রী তার অর্জিত জ্ঞান বিলাতে পারবে না। তার জ্ঞান ভোগ করবে দেবতারা।
শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি বাঁকে এদেশে অরিত্রীদের জন্য তৈরি করা আছে বিষাক্ত পাঁক। খেয়াল করে না চললে পাঁকে পড়ে যাবে যে কেউ। ভিকারুননিসা নামের অভিজাত মহল নয়, সারা বাংলাদেশেই এমন অসংখ্য বিদ্যা বিলানোর প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের গা-গরমে থাকা যায় না। এদের বিরুদ্ধে আপনি একটা কথা বলবেন, অনিয়মের প্রতিবাদ করবেন? উপায় নেই। পাড়ার তাবৎ অধিকারীরা, অধিপতিরা ছুটে আসবেন। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের প্রধান কারবারি ওরফে গভর্নিং বডির প্রধানও রাজনৈতিক অধিপতি শ্রেণির। বাকি সহপ্রধানরাও একেকজন একেক কারবারের বড় বড় কারবারি। অরিত্রীর চলে যাওয়া যারা মেনে নিতে পারছে না, যারা হাত তুলছে প্রতিবাদের- তাদের ঠিকই থামিয়ে দিতে চায় এই নব্য বণিকেরা। রাস্তা থেকে বাহিনী দিয়ে প্রতিবাদীদের জোর করে সরিয়ে দেয়ার ছবি পত্রিকায় দেখা গেছে।
ফেসবুকে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী গিয়েছেন অরিত্রীর বিদ্যালয়ে। সেখানে আরও আরও অরিত্রীর বাবা-মা তাকে প্রশ্নের পর প্রশ্নের তীর ছুড়ে জর্জরিত করেছেন। একজন মা বলছেন: ‘‘মাননীয় মন্ত্রী, আমার মেয়ে ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাকে একজন শিক্ষক হুমকি দিয়ে বলেছে ‘তোমাকে আমি দেখে নেব, তোমার লাইফ শেষ করে দেব!’ আমার মেয়ে বাসায় গিয়ে নার্ভাস ব্রেক করেছে। আজ অরিত্রীর খবর শুনে সে বলেছে, ‘আমি আর ঐ স্কুলে যাব না, যদি জোর করে পাঠাও, তবে আমি সুইসাইড করব!’ মাননীয় মন্ত্রী, আপনিই বলুন আমি এখন কী করব?’’
এমন অনেক অভিভাবকের অনেক প্রশ্ন। কেউ বলছেন, অনিয়মের অভিযোগ লিখে পাঠালে তা গায়েব করে ফেলেন অধ্যক্ষ, কেউ বলছেন, বাচ্চাদের অশ্লীল ভাষায় গালি গালাজ করা হয়। কেউ বলছেন, প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করতে হলে এমনকি কয়েক সপ্তাহও ঘোরা লাগে! সবশেষ একজন মা বললেন: ‘মাননীয় মন্ত্রী, এই যে বাচ্চারা স্কুল বিমুখ হচ্ছে এর দায় কার? নিশ্চয়ই স্কুলে ভালো কিছু পচ্ছে না তারা, আনন্দ পাচ্ছে না?’ প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী মহোদয় একটাই কথা বলেছেন: ‘তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
কী ব্যবস্থা নেয়া হবে মন্ত্রী মহোদয়? কী তদন্ত হবে, কারা তদন্ত করবে? শুনলাম স্কুল কমিটি একটা তদন্ত দল গঠন করেছে। কিন্তু সেখানে কোন অভিভাবক বা সংক্ষুব্ধ অভিভাবককে রাখা হয়নি। কমিটির বিরুদ্ধেই তো লোকের হাজার অভিযোগ, তারা কী তদন্ত করবে? সেই তদন্ত দল অরিত্রীর বাবা-মায়ের সাক্ষ্য সত্য মানবে নাকি মহামান্য প্রিন্সিপালের কথাই শিরোধার্য করবে? প্রিন্সিপাল সাহেবান তো এরই মধ্যে বলেছেন: ‘অরিত্রীকে টিসি দেয়ার কোন কথাই ওঠেনি!’ তাহলে কি অরিত্রীর বাবা-মা মিথ্যা বলছেন? তদন্ত দল কি পরীক্ষার হলে কী ঘটেছিল তা জানতে বাকি শিক্ষার্থীদের সাক্ষ্য নেবে? অরিত্রীর সঙ্গে একই কক্ষে থাকা এক শিক্ষার্থীর ভাষ্য জানা গেছে। সে বলেছে, অরিত্রী মোবাইল ফোনে নকল করেনি। সে কেবল ফোনটা সঙ্গে রেখেছিল। মোবাইল ফোন সঙ্গে রাখা অপরাধ, তবে স্কুল থেকে বের করে দেয়ার মতো অপরাধ কি?
অপরাধের মাত্রা বিবেচনার দরকার আছে। অরিত্রীর সঙ্গে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে যে অপরাধ হয়েছে তার মাত্রাটাও ঠিকঠাক বিচার করা দরকার। একটা স্কুলে অভিভাবকদের সঙ্গে এমন রূঢ় আচরণ হতে পারে, তা ভাবতেই গা গুলিয়ে ওঠে। এরা শিক্ষা দেবে কী, এদের তো ন্যূনতম সৌজন্য বোধের জ্ঞানটুকুও নেই। অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী মেয়ের অসহায় ক্রন্দন আর শিক্ষকদের পায়ে পায়ে লুটিয়ে পড়া দেখে শেষ পর্যন্ত নিজেই ক্ষমা চেয়েছেন দু’হাত জোড় করে। তার স্ত্রী অরিত্রীর মা নিজেও মহামতি প্রিন্সিপালের পা ধরতে গিয়েছিলেন! কিন্তু এমন পাষাণ হৃদয় কোনো শিক্ষকের হতে পারে, কোনো প্রিন্সিপালের হতে পারে তা তো তারা জানতেন না!
একটি দৈনিক পত্রিকায় উঠে আসা দিলীপ অধিকারীর মুখে সেদিনের ঘটনার বিবরণ শুনলে যে কারো গা শিউরে উঠবে! তিনি জানান- ‘‘স্কুলে আমাদের পদে পদে অপমান করা হয়। প্রথমে ভাইস প্রিন্সিপালের রুমে যাই। চেয়ারে বসতে গেলে তিনি বলেন, ‘এগুলো শিক্ষকদের চেয়ার, পাশে বেঞ্চ আছে সেখানে বসেন’। বেঞ্চে ময়লা থাকা সত্ত্বেও আমরা সেখানে বসি। এরপর অরিত্রীর কথা ওঠাতে তিনি ক্ষেপে গিয়ে বলেন, ‘কেমন মেয়ে মানুষ করেছেন, পরীক্ষায় নকল করে? আমরা ওর ব্যাপারে গভর্নিং বডির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি; পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না।’ আমরা মেয়ের হয়ে ক্ষমা চাই। কিন্তু তিনি কোনো কিছুই শুনতে রাজি হননি। প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। এরপর অরিত্রীকে সঙ্গে নিয়ে প্রিন্সিপালের রুমে যাই। সেখানে যাওয়া মাত্রই প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বলেন, ‘ও আপনিই অরিত্রীর বাবা! ওর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাকে পরীক্ষা দিতে দেয়া হবে না। কেস ফাইল করা হয়েছে। কালকে এসে টিসি নিয়ে যাবেন। আমি তখন ম্যাডামের কাছে মেয়ের হয়ে ক্ষমা চাই। এর মধ্যেই অরিত্রী ম্যাডামের পা ধরে কান্না করে ক্ষমা চায়। মেয়ের জন্য প্রিন্সিপালের পা ধরতে যায় আমার স্ত্রীও। কিন্তু তিনি কিছুতেই ক্ষমা করতে রাজি হননি।’’
ক্ষমা। এই একটি অতি সহজ কিন্তু মহৎ গুণ সবার আগে থাকার কথা ছিল এই শিক্ষকদেরই। কিন্তু এদেশের, আর এ জাতির দুর্ভাগ্য- শিক্ষক আছে এখানে হাজারে হাজারে কিন্তু ‘ক্ষমা’ নাই কোথাও! এখানে ক্ষমার বদলে আছে অপমান আর লাঞ্ছনা; আছে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার তোড়জোড়। এখানে শিক্ষা হয় বাণিজ্যের নাম আর শিক্ষক বনে যান বণিক। এখানে অরিত্রীরা স্বপ্ন বুনবে কী, নিজের বোনা স্বপ্নই হারিয়ে ফেলে। এখানে প্রিন্সিপালেরা হন রাজ-রাজড়ার চেয়ে বড় কিছু। ধরা তাদের কাছে সরা হয়ে যায়। তাই ক্ষমা নামক গুণের তাদের দরকার হয় না। ক্ষমার বদলে তারা বরং এমন দু’একজন অরিত্রীকে, তাদের মা-বাবাকে পায়ে পায়ে লুটানোতেই সুখ লাভ করেন, তৃপ্তি পান। তাদের এই সুখের সংসারে ভাগীদার হয় রাজনীতির ঘরের রাজন্যরা। অতএব কে তাদের কী বলবে?
এ দুর্ভাগা দেশ হতে মঙ্গলময় কবে এইসব ব্যবসা তাড়াবেন, আর কবে এইসব শিক্ষক নামের বণিকগিরি বন্ধ হবে- তা কেউ জানে না। এখন জাতিকেই চেষ্টা করতে হবে, শিক্ষা আর ব্যবসা বোঝার, শিক্ষক আর বণিক চেনার। ভালো স্কুল মানেই ভালো শিক্ষা নয়, নামী স্কুল মানেই দামি বিদ্যা নয়- জাতিকে এটা বুঝতে হবে। অরিত্রীর চলে যাওয়া কেবল যাওয়া নয়, অনেক কিছু দিয়ে যাওয়াও বটে। সে চলে গেছে কিন্তু বলে গেছে অনেক। সে বলে গেছে প্রতিবাদ করতে হবে, অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ। শিক্ষামন্ত্রীকে ঘিরে ধরা অভিভাবকদের কাছ থেকে সে কিছুটা সাড়া পাওয়া গেছে। প্রতিবাদের ভাষা সেখানে কিছুটা মুখর হয়েছে। কিন্তু আমাদের আরও বেশি বেশি প্রতিবাদ করতে হবে। আরও সরব হতে হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অরিত্রীর ত্যাগের মূল্য আমাদের দিতে হবে। সব স্কুলের সব অরিত্রীদের জন্য এ প্রতিবাদ ছড়িয়ে দিতে হবে। জানাতে হবে দাবি ন্যায় বিচারের। অরিত্রীর বাবা-মায়ের কোল খালি করার অন্যায়ের প্রতিকার চাইতে হবে। বিচার চাইতে হবে, শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানাতে হবে। রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে হবে সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচারের। উন্নয়নের পেছনে ছুটে চলা বাংলাদেশকে নৈতিক উন্নয়নের কাজেও মনোনিবেশ করা দরকার— একথা সমস্বরে জানাতে হবে। নৈতিকতার পরাজয় হলে উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৫৫