ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের কার্যকারিতার একটা প্রশ্ন বিশ্বের কোন কোন অঞ্চলে দেখা দিয়েছে। প্রতিবেশী ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ এর অন্যতম। এ বিষয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসও তার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেছেন। তবে বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংককে নিয়ে সম্প্রতি যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে, তার একটি কারণ নির্দেশ করা হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমসে। মুম্বই ডেট লাইনে পত্রিকাটির নিজস্ব সংবাদদাতা বিকাশ বাজাজ লিখেছেন, বিল ক্লিনটন ও টনি ব্লেয়ারের মতো বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এক সময় দারিদ্র্যবিমোচনের হাতিয়ার হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহারের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ এখন বাংলাদেশ, ভারত, নিকারাগুয়া এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক বৈরিতার মুখোমুখি হয়েছে
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে আলোচনায় সুর মিলিয়ে ক্ষুদ্র ঋণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ক্ষুদ্র ঋণদাতারা দারিদ্র্য দূর করার নামে গরিবের রক্ত চুষে নিচ্ছে। তিনি গ্রামীণ ব্যাংক ও তার প্রতিষ্ঠাতার বিষয়ে একটি তদন্ত অনুষ্ঠানের নির্দেশ দিয়েছেন।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির স্নাতক ডিগ্রিধারী ভারতীয় সাংবাদিক বিকাশ বাজাজ ২০০৫ সালে নিউ ইয়র্কে টাইমস দপ্তরে যোগ দেন। তিনি সাধারণত অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিষয়ে লিখে থাকেন। ‘ঋণদাতা, নোবেলে ভূষিত এখন সংগ্রামররত’ শীর্ষক নিবন্ধে মি. বাজাজ ভারতসহ কোন কোন দেশে কি কারণে বিতর্ক দেখা দিয়েছে সে বিষয়ে আলোকপাত করেন। তার ভাষায় এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের অসন্তোষের কারণ ভিন্ন।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তিনি গত ৬ই ডিসেম্বর লিখেছেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সঙ্গে ড. ইউনূসের তিক্ততার সূত্রপাত ঘটে ২০০৭ সালে। কারণ, ওই বছরে নোবেল বিজয়ী একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে সময়ে সামরিক বাহিনীর নিয়োগকৃত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ পরিচালনা করছিল। যদিও ড. ইউনূস পরে তার দল গঠনের সংকল্প পরিত্যাগ করেছিলেন কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা ও মি. ইউনূস এখনও পর্যন্ত সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তবে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বিরূপ মন্তব্যের পেছনে ছিল নরওয়ের একটি টিভির প্রামাণ্যচিত্র। সেটিতে দাবি করা হয়েছিল যে, এক দশক আগে নরওয়ের দেয়া ১০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ স্থানান্তরে অনিয়ম হয়েছিল। শেখ হাসিনা বলেছেন, কর এড়াতে ওই তহবিল হয়তো স্থানান্তর করা হয়েছিল। গ্রামীণ ব্যাংক অবশ্য ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা নরওয়ের কর্মকর্তাদের আপত্তির মুখে তহবিল যথাস্থানে রেখেছিল। নরওয়ে সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, গ্রামীণ কোন অন্যায় করেনি।
উল্লেখ্য, ড. ইউনূস ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকায় লিখেছেন, ২০০৭ সালে ‘কম্পারতামোজ’ নামের এক মেক্সিকান ব্যাংক লাতিন আমেরিকার প্রথম ক্ষুদ্র ঋণদাতা ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর গত বছরের আগস্ট মাসে বৃহত্তম ভারতীয় ক্ষুদ্র ঋণদাতা ব্যাংক ‘এসকেএস মাইক্রোফিন্যান্স’ জনগণের কাছ থেকে ৩৫ কোটি ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তুলেছে।
ড. ইউনূস মনে করেন, বিশ্বের অনেক অঞ্চলে ক্ষুদ্র ঋণের নামে বহু ধরনের অনিয়ম, অনাচার দেখা দিয়েছে। এসব প্রতিরোধ করার দায়িত্ব সরকারগুলোর। তিনি স্মরণ করেন যে, ১৯৯৭ সালে মার্কিন ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন (বর্তমানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যান্য নেতার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। তারা যূথবদ্ধ অঙ্গীকার করেছিলেন যে ২০০৫ সালের মধ্যে ১০ কোটি গরিব মানুষের জন্য ক্ষুদ্রঋণ ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করবেন। ড. ইউনূস বলেন তখন মনে হয়েছিল, এটা বস্তুত অসম্ভব একটা কাজ। কিন্তু ২০০৬ সালের মধ্যে আমরা তা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি। তিনি ক্ষুদ্রঋণ কর্মকাণ্ডকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে বিশ্ব নেতাদের পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
গতকাল নিউ ইয়র্ক টাইমসে একজন পাঠক মন্তব্য করেন যে, ড. ইউনূসের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। তিনি বারবার ক্ষুদ্র ঋণের অধিকতর সম্প্রসারণ ও মুনাফা অর্জনের বিষয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। মুনাফাখোররা দশ হাত মাটি খুঁড়ে হলেও একটি পেনি বের করতে ছাড়বে না। কিন্তু তাই বলে ড. ইউনূসের মিশনকে দায়ী করা চলে না।