জার্মানী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ইউরোপের অন্যতম গুরত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে নয় বরং একটি উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর অর্থনীতি হিসেবে গত ২০০০ খ্রীষ্টাব্দের আগষ্ট মাস থেকে ইউরোপের বাইরের দেশগুলো হতে উচ্চ প্রযুক্তিতে দক্ষ শ্রমিক আমদানী করছে। জার্মান সরকার অনুমুদিত গ্রীণকার্ড প্রকল্পের আওতায় বিদেশী তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদেরকে জার্মানীতে কাজের সুযোগ করে দেয়ার সংবাদ সম্পর্কে বাংলাদেশসহ আশেপাশের দেশগুলোতে বেশ আশার আলো ও স্বপ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায় ২০,০০০ প্রযুক্তি শ্রমিক আমদানীর প্রস্তাব করা হলেও প্রকৃত পক্ষে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা অপরিবর্তিত হারে বেড়ে চলছে জার্মানীতে। শুধু তথ্যপ্রযুক্তি খাতেই ৭৫,০০০ পদ শূণ্য রয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক বিদেশী প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জার্মানীতে এসে পৌঁছেছেন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠণে কার্মরত রয়েছেন। বাকীরা জার্মনীর উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পথে। তারপরও জার্মান অর্থনীতিতে প্রযুক্তি শ্রমিকের ঘাটতি রয়ে যাবে বলে অবহিত মহল উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
জার্মানীর সবচেয়ে জনপ্রিয় অর্থ ও বণিজ্য বিষয়ক দৈনিক পত্রিকা বাণিজ্যপত্রে (Handeslblatt) এ বিষয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কাগজটি জার্মান তথ্যপ্রযুক্তি বণিক সমিতির উদ্ধৃতি দিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, জার্মানীর ক্রমবর্ধমান দক্ষ প্রযুক্তি শ্রমিকের স্বল্পতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতি হুমকি হতে পারে। প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, বর্তমানে জার্মানীতে সমগ্র প্রযুক্তি খাতে সর্বমোট ৪৪৪,০০০ পদ শূণ্য রয়েছে।তাই জার্মানী পূর্ব থেকেই আশু সমস্যা সমাধানের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। জার্মানীর আরও একটি গুরত্বপূর্ণ শিল্পখাত, কলকারখানার যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক বণিক সমিতি জানিয়েছে যে, বর্তমানে তাদের খাতেও ১০,০০০ প্রকৌশলীর পদ শূণ্য রয়েছে। এ সংখ্যা বরাবরের তুলনায় দ্বিগুণ।
এই অপ্রত্যাশিত দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতির কারণ বিভিন্ন মহল বিভিন্নভাবে ব্যখা করে থাকেন। এ জন্য গতবছর ভূতপূর্ব জার্মান শিক্ষামন্ত্রী Juergen Ruetgers ও তার ”খ্রীষ্ঠান গণতান্ত্রিক পরিষদ” দলকে কঠিন সমালোচনা মেনে নিতে হয়েছে। বলা হয়েছে যে, তিনি শিক্ষা মন্ত্রী হিসাবে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও শিক্ষার মান উন্নয়ণে অবহেলার জন্য তিনি ও তার সরকার বহুলাংশে দায়ী। আবার কেউ কেউ বলছে যে, বিগত বছরগুলোতে জার্মান ছাত্রছাত্রীরা প্রযুক্তি ও প্রকৌশলশাস্ত্র অধ্যয়নে উৎসাহ পায়নি। তার ফলে আজ জার্মানীতে আজ দক্ষ প্রযুক্তি শ্রমিকের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এর প্রকৃত কারণ দুটোর সংমিশ্রনের ফসল বলে আমার মনে হয়।
শিল্প ও প্রযুক্তিতে বিশ্বব্যাপী জার্মানীর প্রথম সারির অবস্থান বজায় রাখায় তাদের প্রচেষ্টার কথা Siemens, Mercedes, BMW, Porsche নামের গুটি কয়েক কোম্পানীর দিকে তাকালেই তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। আধুনিক বাণিজ্যের বিশ্বায়নের ফলে শিল্পোন্নত দেশগুলোর বাজারের পরিধিই বৃদ্ধি পায়নি বরং তাদের উৎপাদনে পৃথিবীর জনসম্পদ ব্যাবহারও সুলভ ও সহজলভ্য হয়েছে। জার্মান গ্রীণকার্ড প্রকল্প ঘেষণার সাথে সাথে ভূতপূর্ব জার্মান শিক্ষামন্ত্রী Juergen Ruetgers ও তার রক্ষণশীল ”খ্রীষ্ঠান গণতান্ত্রিক পরিষদ” দল আজকের বিশ্ববাণিজ্যের বৈশিষ্টকে উপেক্ষা করে প্রকাশ্যে উহার ঘোর বিরোধিতা করে ব্যাপক প্রচার অভিযান চালিয়েছিলেন। অবশ্য সে ক্ষেত্রে তিনি জার্মান শিক্ষাব্যবস্থায় তার ব্যাক্তিগত ব্যর্থতা ধামাচাপা দেয়া ও বিদেশীদের প্রশ্নে তার দলের রক্ষণশীল নীতি প্রচারের চেষ্টা করেছেন বলে বিভিন্ন জার্মান সংবাদমাধ্যম মত প্রকাশ করেছে। একবিংশ শতাব্দীতে তাদের কতিপয় নীতি সময় অনোপযোগী ও জার্মান অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে।
জার্মানী রপ্তানী ভিত্তিক ও প্রযুক্তি নির্ভর অর্থনীতি হিসেবে সময়ের সঙ্কেত বুঝতে পেরে গ্রীণকার্ড প্রকল্প চালু করেছে বিশ্ববাণিজ্যে প্রথম সারিতে তাদের অবস্থান বজায় রাখতে। এ প্রকল্প জার্মান বণিক সমাজে প্রসংশিত হয়েছে। তারা তথ্যপ্রযুক্তির পাশাপাশি অন্যান্য খাতে উহার পরিবর্ধনের সুপারিশ করেছেন।
বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞদের অবস্থান কোথায়?
আধুনিক যুগের অতি উন্নত যোগাযোগ ব্যাবস্থার ফলে বাংলাদেশেও জার্মান গ্রীণকার্ড প্রকল্পের সংবাদ পৌঁছে গেছে বিদ্যূৎগতিতে। কিন্তু এ প্রকল্পের আওতায় যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশীদের ভাগ্য পরিবর্তন করা সম্ভব হয়েছে তা বলা যাবে না। কিউবা থেকে আরম্ভ করে দঃক্ষিণ আফ্রিকাসহ পৃথিবীর বহু দেশের দক্ষ প্রযুক্তি শ্রমিক জার্মান গ্রীণকার্ড প্রকল্পের আওতায় উঁচু পারিশ্রমিকে নিয়োজিত রয়েছে। তবে একক দেশ হিসেবে ভারত ও পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশ প্রথম সারিতে রয়েছে। তার অন্যতম মূল কারণ হচ্ছে তাঁদের অতি উঁচু মানের যোগ্যতার পাশাপাশি ৫-১০ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জার্মান ভাষার প্রাথমিক জ্ঞান।
বাংলাদেশ থেকে সরাসরি জার্মান কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ নিয়ে গ্রীণকার্ডের আওতায় কেউ এসেছে বলে আমার জানা নেই। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন আসে যে, পৃথিবীর সকল দেশ থেকে শত শত বিদেশী জার্মান গ্রণকার্ড প্রকল্পে আওতায় জার্মানীতে এসে ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারলেও বাংলাদেশীদের ভাগ্য কেন প্রসন্ন হচ্ছে না?
এখানে সমস্যা একটাই। তা হলো যোগ্যতা। হয়তো কেউ কেউ বলবেন যে, বাংলদেশে তো আজকাল কত কম্পিউটা স্কুল হয়েছে, কত প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে তা হলে আমাদের যোগ্যতার অভাব কোথায়? প্রশ্নটা অবশ্য আমারও। কিন্তু এখানে আন্তর্জাতিক মানের যোগ্যতার কথা বলা হচ্ছে – বলা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার কথা। যারা বাংলাদেশের বাইরে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তিখাতে নিয়োজিত রয়েছেন তারা হয়ত বিষয়টা আরো একটু ভালভাবে অনুধাবন করতে পারবেন যে, কম্পিউটারে শুধু টাইপ করতে পারলেই বিশ্বপ্রযুক্তি বাজারে ঠাই পাওয়া যাবে না।
জার্মানীতে বর্তমানে প্রোগ্রামিং ভাষার মধ্যে JAVA, C/C++, Delphi, Visual C++, Visual Basic, PL/SQL, ডাটাব্যাজের মধ্যে Oracle, SAP, DB2, MS SQL Server, MySQL, MS Access, ওয়েবের মধ্যে HTML/DHTML, XML, ColdFusion, Java Script, VB Script, IIS and Apache Web Server, নেটওয়ার্ক ও সিস্টেম এডমিনিস্ট্রেটিংয়ে ও ভাল সুযোগ রয়েয়ে। তবে লেভেল হতে হবে অতি উঁচু।
জার্মান গ্রীণকার্ড প্রকল্পের যোগ্যতার অন্যতম গুরত্বপূর্ণ দিক হলো যে, প্রার্থীকে হয় কোন বিশ্ববিদ্যায় থেকে প্রযুক্তি বিষয়ে পাশ করা অথবা নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান অন্ততঃ বাৎসরিক ২৭ লক্ষ টাকা বেতন দিতে প্রস্তুত। ২৭ লক্ষ টাকা আমাদরে দেশের তুলনায় শুনতে বেশ মোটা অঙ্ক মনে হলেও জার্মানীতে প্রযুক্তি শিল্পে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য বিষয় নয়। কারণ, প্রকৃত যোগ্যতা থাকলে প্রতি ঘন্টায় ৬ হাজার টাকা আয় করা কঠিন কিছু নয়। তবে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, প্রার্থীকে প্রথমে কোন প্রতিষ্ঠান থেকে একটা চাকরীর নিঃশ্চয়তা পেতে হবে। আরো একটি প্রাসঙ্গিক গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলো জার্মান ভাষা। যদিও প্রযুক্তি শিল্পে প্রায় সকল কাজই ইংরেজী ভাষায় সম্পাদন করা সম্ভব তবুও জার্মান সহকর্মীদের সাথে আলাপ রসিকতা ও বন্ধুত্ব তৈরী করতে হলে, বাজার সদাই করতে হলে বা বাসে ট্রেনে চলাফেরা করতে হলে জার্মান ভাষা শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। কম হউক, তবুও কিছু জার্মান শেখা জরুরী। তাতে চাকরীর সম্ভাবনাও ভাল হয়। কারণ, কেউ যদি সহকর্মীদের সাথে সফলভাবে যোগাযোগ করতে না পারে তা হলে উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটা স্বাভাবিক বলে নিয়োগকারী তাতে অধিক আগ্রহী না হলে অবাক হবার কিছু নেই।
জার্মানীসহ বিশ্ববাজারে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষ প্রযুক্তি শ্রমিকের চাহিদা অব্যহত রয়েছে বটে তবে সে সুযোগ থেকে লাভবান হতে হলে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মত দক্ষতা অবশ্যই অর্জন করতে হবে। এ জন্য দেশের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন। দেশে এখন যেভাবে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে তাতে দিকনির্দেশনা ঠিক থাকলেও তার গতি ও মান উন্নয়ন এখনই একান্তভাবে প্রয়োজন। প্রয়োজন তথ্যপ্রযুক্তির মত সম্ভাবনাময় শিল্পকে রাজনৈতিক দল মত নির্বিশেষে সুষ্ঠভাবে ও সুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে আপন ধারায় এ যুগের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে গড়ে উঠতে দেয়া।