লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে রসিক ট্রাভেলাররা 'উল্লুকের মুল্লুক' ডাকতে শুনেছি। ছোটবেলায় দাদির কাছে গল্প শুনতাম তার বাপদাদার আমলে আমাদের এলাকা থেকে নাকি লোকজন বর্মায় কাজ করে ফেরার সময় উল্লুকের আক্রমণে মারা যেত। তখন থেকে উল্লুক দেখার সাধটা মনে মনে পুষেছিলাম। তাইতো সেদিন দলবেঁধে গিয়েছি উল্লুকের মুল্লুক দেখতে। ভাগ্য ভাল না হলে উল্লুক দেখা যাবেনা সেটিও জানা ছিল। চট্টগ্রাম থেকে উদয়ন এক্সপ্রেসে শ্রীমঙ্গল, সেখানে ঢাকা থেকে আসা দলের সাথে কমলগঞ্জ এর লাউয়াছড়া বনাঞ্চলে পৌঁছি লোকাল বাসে। পথে হেলপার ক্রমাগত হাঁকছিল, "ভালো....ভালো.....ভালো....." শুধু বুঝতে পারছিলামনা কাকে সে ভালো বলতেছিল। পরে ক্লিয়ার হয় সে ভালো>বাড়>বাড়াও এটিই বলতেছিল ড্রাইভারের উদ্যেশ্যে!
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রবেশদ্বারে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে আমরা টিকেট সংগ্রহ করি (প্রাপ্তবয়স্ক ৳ ২০, অপ্রাপ্তবয়স্ক বা ছাত্র ৳ ১০, বিদেশী নাগরিক $ ৫)। পার্কে ঢুকতেই দেখি দু'পাশের বিশাল গাছের সারি, অনেক উঁচু থেকে গাছগুলোর মাথা চুইয়ে আলোর রেখা নিচে নেমে আসছে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ভ্রমণকারীদের জন্য তিনটা পায়ে হাঁটার পথ বা ট্রেইল আছে। প্রথমটা আধ ঘন্টার ট্রেইল, পরেরটা এক ঘন্টার এবং অন্যটা তিন ঘন্টার। আমরা যেহেতু ট্রেকার, তিন ঘন্টারটাই বেছে নিই। তবে কর্তৃপক্ষ সেখানে পর্যটকদের পর্যাপ্ত তথ্য দিতে খুব একটা উৎসাহী মনে হলনা। প্রবেশপথে কয়টা সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়েই যেন তারা তাদের দায়িত্ব শেষ করেছন। ট্রেইলগুলো সাইনবোর্ডের ম্যাপে দেখালেও বাস্তবে খুঁজে নেয়া কঠিন, কোথাও খোন দিক নির্দেশনাও চোখে পড়েনি। তথ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করলে তারা জানায় তাদের কাছে কোন ম্যাপ নেই, শুধু গাইড আছে আর আছে উল্লুকের জীবনচক্র নামের একটা বই। আমরা আবার ত্যারা ট্র্যাকার, গাইড নিবনা সাথে (তিন ঘন্টায় নয়শো টাকা গুনতেও রাজি ছিলামনা)। আমাদের দলের সাথে জিপিএস ছিল, সাইনবোর্ড থেকে ট্রেইলের ম্যাপকে ক্যামেরায় ছবি করে নিয়েছি। জিপিএস আর ম্যাপ এর উপর নির্ভর করে আমাদের বনের পথ ধরে যাত্রা শুরু হয়।
চুপিসারে এগুচ্ছিলাম যাতে বণ্যপ্রাণীরা ঘাবড়ে না যায়, নানারকম পাখির ডাক শুনছি। মাঝে মাঝে উল্লুকের চিৎকারে সবাই এদিকসেদিক খোঁজাখুঁজি করি, কোথাও তাদের দেখিনা। একসময় বুঝতে পারি ম্যাপের সাথে আমাদের ট্রেইলটার কোন মিল নেই। তারমানে আমরা এগুচ্ছিলাম অপ্রচলিত ট্রেইল ধরে। সরু ট্রেইলটা একসময় গিয়ে নামে শুখনো ছড়াপথে। নাম না জানা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, বেত, ফুল অর্কিড আমাদের পথের দুপাশে। ও! বলা হয়নি এর মাঝে আমাদের দলের সবাইকে বেশ কয়েকটা করে জোঁক ধরেছে। আর একটু এগুতেই আমাদের পথের দু'ধারে, কখনো পথটাই আগলিয়ে যেখানে সেখানে কাটা বাঁশ পড়ে থাকতে দেখি, বুঝতে বাকি থাকেনা চোরেরাই এসব করেছে। সংরক্ষিত বন থেকে কিভাবে বাঁশ-গাছ চুরি হয় সেটা আমরা ভাবলেও বনবিভাগ মনে হয় ভাবেনা!
ঘন বনের মাঝে আমরা হাঁটছি, ঝিঁঝিঁ আর বিচিত্র সব কীটপতঙ্গের শব্দ সবসময় আমাদের সাথি হয়েছিল। একসময় পথের আর কোন চিন্হ না পেয়ে আমরা জিপিএস এ দেখে দেখে নিজেরাই একটা পথ খুঁজে নিই, ছোট পাহাড়ে চড়ার পর সূর্যের দেখা পাই। বিশালাকৃতির গাছ, সাথে জড়ানো লতাগুলোও একেকটা মাঝারি গাছের সমান। এমন নিবিড় প্রাকৃতিক বনের ভেতর দিয়ে কখনো যাইনি বলে নিজেকে টারজান টারজান লাগতেছিল তখন। এর কিছু পরেই আমাদের রাহাত ভাই ঘোষনা দেন একশমিটার পেরোলেই রেললাইন, আমাদের ট্রেকিং ও শেষের দিকে। রেললাইনে আসার পর সবাই কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিই, এরমাঝে চমৎকার গতিতে আমাদের পাশদিয়ে বিকট আওয়াজ তুলে যান্ত্রিক অজগর চলে যায়। রেললাইন ধরে হেঁটে একসময় আমরা আমাদের স্টার্টিং পয়েন্টে চলে আসি, শেষ হয় আমাদের লাউয়াছড়া ন্যাশনল পার্ক ট্রেকিং।
পুরো ট্রেইলটা আমরা শেষ করেছিলাম সাড়ে চার ঘন্টায়। ছড়া পথটা অসাধারণ ছিল যদিও পানি ছিলনা। উল্লুকের দেখা পাইনি কিন্তু বানর দেখেছিলাম। ছবি তুলতে গেলে এক ভেংচিতে ঝোপের আড়ালে পালিয়ে যায় সে। শুধু জোঁকের কামড় বাদ দিলে পুরো ট্র্রেইলটা ছিল অসাধারণ সুন্দর আর প্রকৃতি ছিল উপভোগ্য।
(শ্রীমঙ্গল পৌঁছেই ফেসবুকে ফটোগ্রাফার-ব্লগার 'ফয়সাল আকরাম ইথার' ভাইয়ের স্ট্যাটাস দেখি তিনিও শ্রীমঙ্গলে, লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কে ঢুকেই উনাকে দেখি, ফেসবুকে উনার ছবি দেখেই চিনে ফেলি। অল্প কথা হয় কারণ আমাকে দলের সাথে থাকতে হচ্ছিল আর উনি কম্পোজিসন নিয়ে ব্যস্ত.....)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:৩৭