সময় সকাল ৯টা , বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম ধানমন্ডি ২৭ নাম্বার রোডে । গন্তব্য উত্তরা , সজল এর সাথে দেখা করতে যাবো । আমার অনেক ভালো ফ্রেন্ড , ভালোর থেকেও অধিক ভালো । অনেক দিন দেখা হয়না সজল এর সাথে , আমি কখনো সজল এর সাথে দেখা করতে এর আগে উত্তরা আসিনি । সজলই সবসময় আমার সাথে দেখা করতে ধানমন্ডিতে আসতো । আমি ওকে বলেছি আমি আজ ওর সাথে দেখা করতে উত্তরা যাবো ।
আজ ওকে আমি একটা সারপ্রাইজ দেবো , যা ওর সাথে পরিচয় এর ৩ বছরেও দেওয়া হয়নি । একটি রুমাল , আর রুমালে লেখা ''এই রূমালটি শুধু আমাদের ভালোবাসার মাঝের ছোট ছোট ভুল গুলো মুছে ফেলার জন্য , আমি যে তোমাকেই ভালোবাসি '' । আর রুমালের মধ্যে একটি তাজা লাল গোলাপ মোড়ানো । যার প্রতিটা পাপড়িতে লিখেছি '' তোমাকেই ভালোবাসি '' ।
সজল উত্তরা তে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাশন ডিজাইন এ পড়াশোনা করছে । অনেক ভালো আবৃতি করতে পারে , আর ওর হাতের আঁকা ছবি গুলো দেখলে মনে হয় জীবন্ত প্রতিছবি । আর ও সবার থেকে একটু অন্য রকম সব দিক থেকে , কথা বার্তা , আচার-আচরন , পোশাক-আশাক , চলাফেরা । তবে একটু বেশি লাজুক ।
প্রায় ২০ বিশ মিনিট অপেক্ষার পর বাস আসলো , ভাগ্য ভাল ছিল তাই একটি সিট ও পেয়ে গেলাম । উঠেই সজলকে ফোন দিয়ে বললাম উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এর সামনে অপেক্ষা করতে । রাস্তায় মোটামুটি ভালোই জ্যাম আছে যেতে অনেক্ষন লেগে যাবে , এই ফাকে ওর আর আমার কিছু কথা বলি ,
আমি একটু ভিতু সবসময় , ঢাকাতে চলাফেরা করার অনেক বড় একটি সমস্যা রাস্তা পার হাওয়াতে । রোড সিগন্যাল এ থাকলেও আমি রাস্তা পার হতে ভয় পেতাম । এমনি আমি একদিন ভার্সিটির সামনে দারিয়ে , রাস্তার ওপারে ভার্সিটি । জ্যাম নেই কিন্তু কিছুক্ষণ পর পরই গাড়ি যাচ্ছে , আমিও রাস্তা পারহতে পারছিলাম না । এমন সময় উজ্জল শ্যামবর্ণের , মাঝারি শরীর , আমার থেকে ৪-৫ ইঞ্চি লম্বা একটি ছেলে এসে নামলো , কাধে ব্যাগ সাথে আর্ট পেপার । চুল গুলো তার ওগোছালো , চোখে সাদা চশমা । পঢ়নে জিন্স এবং সাদাকালো টি-শার্ট । একবার আমার দিকে তাকালো , আমিও তাকালাম ( চোখাচোখি ) । মুহূর্তেই ছেলেটি রাস্তা ওপারে চলে গেল , আমি তখনও দারিয়ে । এদিকে ক্লাস এর সময় হয়ে যাচ্ছে , ১০ মিনিট পরেই মেনেজমেন্ট টিউটোরিয়াল পরিক্ষা ।
বিষণ্ণ মনে দারিয়ে আছি , দেখলাম ওই ছেলেটি ওপারে একটি ছেলের সাথে কথা বলছে আর আমার দিকে আড় চোখে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে । ছেলেটি কথা শেষ করে আবার রাস্তা পার হয়ে এপারে চলে আসলো , মনে হলো আমার দিকেই আসছে । ছেলেটি আমার কাছে এসেই জিজ্ঞাসা করলো ,
ছেলেঃ- আপনাকে অনেক্ষন ধরে খেয়াল করছি আপনি এখানে দারিয়ে আছেন , কোন সমস্যা থাকলে বলেন ।
আমিঃ- না মানে তেমন কিছুই না , রাস্তা পার হতে পারছিনা ।
( ছেলেটি আমার কথা শুনে মনে হলো অবাক )
ছেলেঃ- এই কথা ( হা হা করে হেসে ) ,চলুন আমি আপনাকে সাহায্য করছি আপনার কোন আপত্তি না থাকলে ।
আমিঃ- না আমি একাই পারবো ।
ছেলেঃ- পারবেন ? তাহলে আমি যাই ।
( মনে মনে ভাবলাম একাই পারবো কথাটা বলে ভুলই করলাম )
আমিঃ- এই যে শুনুন , ঠিক আছে আমাকে একটু হেল্প করুন ।
ছেলেঃ- ওকে চলুন । আর আর আপনি এতো রাস্তা পার হতে ভয় পান কেন ? ফিউচারে অনেক সমস্যায় পরবেন । এখানে কোন সাব্জেক্ট এ পড়ছেন ? ( জিজ্ঞাসা করলো )
আমি কিছুই বললাম না , রাস্তা পার হয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ক্লাস এর আর ৩ মিনিট আছে । আমি উনাকে বললাম , ক্লাস এর দেরি হয়ে গেছে আমি যায় । এই বলে আমি ভার্সিটিতে ঢুকে গেলাম । ( এর পরে ছেলেটার রি-একশন কি ছিল জানিনা, কারন থাঙ্কস ও বলিনি )
বাস বনানী চলে এসেছে , বনানী বাস স্ট্যান্ড থেকে আমার এক ক্লাস ফ্রেন্ড জিসান উঠলো । ওর সাথে দেখা হয়ে ভালোই হলো , কারন জিসান এরই বাল্য কালের বন্ধু সজল । জিসান এর মাধ্যমেই সজল এর সম্পর্কে জানা । জিসান আমাকে বাসের মধ্যে দেখেই জিজ্ঞাসা করলো -
জিসানঃ কিরে তুই বাসে , কোথায় যাবি ?
আমিঃ আবার কোথায় !! সজলের সাথে দেখা করতে ।
জিসানঃ (অবাক হয়ে) কিরে তুই সজল এর সাথে দেখা করতে যাবি মানে !! এর আগে এমন তো কখনো শুনিনি ।
আমিঃ হুম , শুনিছনি ; আজ শুনলি । আর আজকেই প্রথম ওর সাথে দেখা করতে আমি নিজ থেকে উত্তরা যাচ্ছি ওকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য । তুই কোথায় যাবি ?
জিসানঃ তাই নাকি কি সারপ্রাইজ , আর আমি উত্তরা ল্যাব এইড হসপিটাল এ যাবো , একজন রিলেটিভ ওখানে এডমিট হয়েছে । তুই কোথায় নামবি ?
আমিঃ ওহ । আছে সারপ্রাইজ , এখন বলা যাবে না । সজল কে বলেছি হাউজ বিল্ডিং এর সামনে আসতে , ওখানেই নামবো ।
জিসানঃ ওহ ঠিক আছে এখন শুনবো না । আমিও হাউজ বিল্ডিং এর সামনে নামবো ।
আমিঃ ঠিক আছে তাহলে একসাথে নামা যাবে ।
আমরা খুটিনাটি বলছি আর বাস বনানী ফ্লাই ওভার পার হয়ে আবার উত্তরার দিকে চলতে লাগলো ...
রাস্তা পারাপারের ওই ঘটনার ৪ দিন পর ...
ওই দিন কোন রকম রাস্তা পার হয়ে ক্লাস গেলাম , একটা ক্লাস করেই লাইবেরি তে গিয়েছিলাম । লাইবেরিতে ঢুকেই জিসান এর সাথে দেখা হলো -
আমিঃ কিরে জিসান , ক্লাস এ দেখলাম না কেন ? কোথায় ছিলি ?
জিসানঃ হুম , প্রথম ক্লাস টা করতে পারলাম না । বাইরের একটা ফ্রেন্ড এসেছে ওকে ভার্সিটি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলাম , ও কিছু ছবি আঁকালো আমাদের ভার্সিটির ।
আমিঃ ওহ ! পরের ক্লাস করবি ? করলে চল ।
জিসানঃ না , আজ কে আর কোন ক্লাস করবো না । তাছাড়া আজ আর কোন ইম্পরট্যান্ট ক্লাস নেই ।
আমিঃ তা ঠিক বলেছিস । পরের ক্লাসটা না করলেও চলবে ।
জিসানঃ হ্যাঁ ! তাহলে চল বাইরে যায় । আমার ফ্রেন্ড বাইরে ছবি আঁকাচ্ছে চল গিয়ে দেখি । তুই তো ছবি আকানো অনেক পছন্দ করিস ।
আমিঃ তাহলে চল যায় , দেখি তোর ফ্রেন্ড কেমন ছবি আঁকে ।
বাইরে এসে দেখলাম একটি ছেলে ছবি আঁকাচ্ছে , কয়েকজন তাকে ভিড় করে দারিয়ে আছে ।
জিসানঃ সজল এদিকে দেখ , আমার ক্লাস ফ্রেন্ড সজনী । তোর ছবি আঁকানো দেখার জন্য ক্লাস না করে চলে এলো ।
( আমি ছেলেটাকে দেখে অবাক , মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছি )
সজলঃ হাই ( আমার দিকে তাকিয়ে ) ।
আমিঃ হাই । আপনার ছবি আঁকানো দেখতে এলাম , জিসান বলছিল আপনি ভালো ছবি আকান ।
সজলঃ ধন্নবাদ । একটু ভালো আকার চেষ্টা করি এই আরকি একটু । ( হাসি মুখে )
আমিঃ আপনাকে পরিচিত মনে হচ্ছে , কোথায় যেন দেখেছি ।
সজলঃ হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন , আপনি অনেক ভিতু , রাস্তা পার হতে পারেন না । এবার বুঝুন কোথায় দেখেছেন ?
আমিঃ ওহ হ্যাঁ মনে পড়ছে , ওই দিন জন্য অনেক ধন্নবাদ আপনাকে ।
আজ ধন্নবাদ দিচ্ছেন বলেই হা হা করে হেসে দিল সজল , আর সেই দিন থেকেই সজল আমার অনেক ভালো বন্ধু , শুধু বন্ধু না আমার একটি আত্তা । আর বন্ধুত্বের মাঝে নীবির সম্পর্ক ভালোবাসা যা আজ পর্যন্ত বলা হয়নি একজন আরেকজন কে । কিন্তু আমরা দুজনেই জানি আমরা একজন আরেক জন কে অনেক ভালোবাসি ।
বাস হাউজ বিল্ডিং এ এসে থামলো , আমি আর জিসান বাস থেকে নেমেই সজল কে ফোন দিলাম ।
আমিঃ কোথায় তুমি ? আমি হাউজ বিল্ডিং এর সামনে এসে গেছি ।
সজলঃ হাউজ বিল্ডিং এর এর অপজিট সাইট এ , তুমি এপারে চলে আসো । পার হতে পারবে তো ? ( হাসতে হাসতে ) ।
আমিঃ কি যে বলো , আমি এখন অনেক সাহসী , পারবো । ( জিসান আছে আমার সাথে এটা ওকে বললাম না )
এপার থেকেই ওকে দেখতে পেলাম । রীতিমত আমি অবাক সজল আজ পাঞ্জাবি পরেছে জা কিনা ওর সবচেয়ে বিরক্তিকর পোশাক । তবে পাঞ্জাবি পড়ে যে ওকে এতো ভালো লাগছিল ও হয়তো এটা জানেনা । আমি রাস্তা পার হচ্ছি , আজ গাড়ি গুলো যেন একটু বেশিই জোরে চালাচ্ছে । রাস্তার প্রথম অর্ধেক পার হলাম । শেষ অর্ধেক টুকু পার হচ্ছি ... কেমন যেন ভয় ভয় কাল করছে মনের ভিতর । ও যদি আমার ভালোবাসার রুমাল , গোলাপ ফিরিয়ে দেয় । হটাত মাথা ঘুরে উঠলো , রাস্তার মাঝ খানে দারিয়ে পড়লাম । এটা দেখে সজল আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো । পিছন দিকে দেখলাম একটি গাড়ি দ্রত আমার দিকে আসছে ... .
.
.
.
যখন আমার জ্ঞান ফিরলো তখন আমাকে সবাই মিলে একটি গারিতে তুলতে লাগলো হসপিটাল এ নেওয়ার জন্য । আমি তখন চিৎকার করে সজল কে ডাকতে থাকলাম । কিন্তু ওই দিন আর সজল আমার ডাকে সারা দেয়নি , আমাকে বাচাতে গিয়ে ওর নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে ... :'(
(কাল্পনিক)