মনটা ক'দিন ধরে থমকে আছে। ভীষণ একটা হোঁচট খেলাম যখন প্রথম খবরটি দেখলাম সামহোয়্যারইন ব্লগ আমাদের প্রিয় সামু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাও আবার অভিযোগ পর্ণ সাইটের।
কী ভয়াবহ একটা ব্যাপার। তিলতিল করে গড়ে উঠা একটি ব্লগ সাইট পায়ে পায়ে যুগ পেরিয়ে গেছে যার বয়স। লাখের বেশি পাঠক লেখকের মিলন মেলা। কতরকমের বিষয় নিয়ে এখানে লেখা হয়। আবিস্কার থেকে নতুন খবর। ইতিহাস থেকে জীবনি। দেশ বিদেশে থেকে কবিতা, গল্প ভ্রমণ চর্চা হয়। কত কত অজানা বিষয়ে জানা যায় এই ব্লগের লেখা পড়ে।
আর আছে ভাব ভালোবাসা লেখকদের মধ্যে সাহায্য সহযোগীতা। লেখা উন্নয়নের জন্য সহযোগীতা। বিপদ আপদে সাহায্যের আহ্বান থেকে, হাত বাড়িয়ে দেয়া। সব কিছুর উপরে সামু বাংলাদেশে সৃজনশীলতার আনেক বড় ভূমিকা রাখছে ।
অনেক ঘাত প্রতিঘাতে অনেক রকম বিপর্যয় কাটিয়ে বছরের পর বছর পেরিয়ে সামু চলে এসেছে এই পর্যন্ত।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং প্রথম ব্লগ বাড়ি।
যখন অনলাইনে বাংলা লেখা যেত না । বা কম্পিউটারে ওয়ার্ডে বাংলা লেখা শব্দগুলো অন্যরকম হয়ে যেত অনলাইনে দেয়ার সাথে সাথে তখন ইউনিকোডে কনভার্ট করার সুযোগ পেলাম প্রথমে সামুতে।
লেখার মানুষ আমি আজীবন বলা যায়। স্কুলে পড়ার সময় থেকে লিখতাম কবিতা, গান, গল্প। খাতা ভর্তি সে সব লেখা গোপন পরে থাকত।
এক সময় ছাপার হরফে প্রকাশ পেলো দেশের প্রথম সারির পত্রিকাগুলোতে। তারপর প্রকাশ হলো প্রথম বই। লেখার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হলো আরো। সে সময়ে নিয়মিত ছাপা হচ্ছে আমার লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় লিটিল ম্যাগাজিনে।
ঠিক যখন পরিচিতির সময় তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম লেখার জগৎ থেকে। দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে এলাম।
অনেকটা সময় লেখা প্রকাশ থেকে বিচ্ছিন্ন। যদিও লেখা চলছিল। জীবনে অনেক নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হলো অনেক বেশি কিছু জানার সুযোগ হলো। সব মিলিয়ে লেখার পরিধি বেড়ে গেল। কবিতার পাশাপাশি। গল্প থেকে উপন্যাস। প্রবন্ধ। ভ্রমণ। যাপিত জীবন এবং সময়ের অনেক বিষয় লেখার জন্য সারাক্ষণ মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
লিখছি কিন্তু দেশে পত্রিকায় পাঠানোর সুযোগ ছিল না সে সময়। দেশে তখনও ই পত্রিকা বা পত্রিকার অফিসগুলোতে ইন্টারনেট সংযোগ ছিল না।
আত্মিয় স্বজনদের কাছে ই মেলে লেখা পাঠিয়ে দিলে তারা পত্রিকায় পৌঁছে দিতেন। এক সময় এই যোগাযোগটাও কম হতে লাগল। লেখা পাঠাচ্ছি তা কি ছাপা হলো জানার সুযোগ ছিল না।
দুহাজার তিন চারের দিকে অস্ট্রেলিয়া থেকে বাসভূমি নামে একটি ওয়েব পত্রিকা প্রথম প্রকাশ হয়। তখন সেখানে লেখা দেয়া শুরু করি।
এরপর আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশ, লণ্ডন, টরন্টো সউদি আরব, ইণ্ডিয়া থেকে বাংলা ওয়েব পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু হয়। সব গুলোতে লেখা দিয়ে অনেক নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হই। দু হাজার পাঁচের দিকে যুগান্তর পত্রিকার সাথে আবার লেখা দেয়ার সংযোগ হলো।
এ সময় মাই বাংলা পেইজ নামে একটা ওয়েব আসে সেখানেও লেখা দেয়ার সুযোগ হয়। এবং তারপর পাশাপাশি ফেসবুকের খবর জানতে পারি। এবং ফেসবুকে তখন এক বন্ধু জানায় সামহোয়্যারইন ব্লগের খবর। মোটামুটি সব ওয়েব পেইজ গুলো থেমে গেছে একমাত্র সামহয়্যারইনব্লগ ছাড়া।
তখন ওয়ার্ডে বিজয়ে লেখা, লেখাগুলো ওয়েব পেইজে প্রকাশ হলে, সেখান থেকে কপি করে ফেসবুকে প্রকাশ করতাম। অথবা ছবির মতন স্কেন করা লেখা পোষ্ট করতে পারতাম। ফেসবুকে মন্তব্য বা কিছু লিখতে চাইলে ইংরেজীতে বা বাংলিশে লিখতে হতো।
আজকের ব্লগারদের কাছে হয়তো সে এক ইতিহাস। তারা ভাবতেও পারবেন না সেই কঠিন সময়।
আমার প্রথম লেখা সামুতে প্রকাশ হয় আমার বন্ধুর মাধ্যমে। সে আমার ফেসবুকের লেখা সামুতে প্রকাশ করে। ব্যাপক আলোচিত হয় সেই লেখাটি।
তখন আমি সামুতে একাউন্ট করে প্রথমপাতায় আসার অপেক্ষায় বসে আছি। কিন্তু ভালোলাগার বিষয় হলো সামুতে আমার বিজয় ফন্টের লেখাগুলো কনর্ভাট করার সুযোগ পেলাম। যা অনলাইনে সরাসরি আমি প্রকাশ করতে পারি।
খুব অল্পদিনের মধ্যে প্রথম পাতায় আমার লেখা আসল।
মোটামুটি প্রথম থেকে অনেকে আমার লেখা ভালোলাগার সাথে গ্রহণ করলেন। তবে আমি যেহেতু আগে থেকেই শুধু লিখে গেছি তাই লেখায় মন্তব্য করে পাঠক আকৃষ্ট করার বিষয়ে তেমন একটা সার্থক নই। ব্লগের লেখার এই যোগাযোগটি আমি নতুন ব্লগারদের মতন করতে পারিনি। আমি নিজের লেখাটি দিয়েই প্রায় চলে যেতাম। সময়টা্ও ছিল ভীষণ ব্যাস্ততার, বিদেশের জীবন যাত্রার। তবে পাঠক ঠিক খুঁজে নিয়েছেনঅআমার লেখা। অনেক অনুসারী আমার এখানে। যাদের সাথে আমার কোন সংযোগ নেই কিন্তু আমার লেখা পড়েন।
এই যে নিজের ভাবনা প্রকাশের একটা জায়গা। এই সুন্দর বিষয়টা বন্ধ হয়ে যাবে এটা আর সবার মতন আমিও কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।
খবরটা জানার পরই সামুতে তড়িঘড়ি লগইন করলাম। না ঢুকতে পারছি তো কিছু হয়নি। বুকের চাপটা কমে গেল। একটা ভালোবাসার জিনিস হারিয়ে গেলে যেমন লাগে তাকে ফিরে পাওয়ার খুশিতে আনন্দিত হলাম। কিন্তু কয়েকদিন ধরে দেখছি। আসলে কথা সত্য। বন্ধ করে দেয়ার অযুহাত সত্য। আমরা যারা বিদেশে আছি তারাই কেবল ঢুকতে পারছি। কিন্তু দেশের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা না থাকলে এই থাকাটার মূল্য কি। দেশে কিছু ঘটলে সাথে সাথে সামুতে ঢুকি। দেখি বিস্তারিত কেউ কি কিছু লিখেছেন কিনা বিষয়টা নিয়ে।অনেক লেখা আলোচনায় জানতে পারি ঘটনার সত্য অস্যত বিষয়গুলো। কঠিন সময়ে দেশের পক্ষে অনেক লেখা লিখেছেন সামুর ব্লগাররা।
অথচ এসব আনন্দ বেদনার অনুভূতি। এই অপরিচিত কিন্ত প্রিয় নামগুলি, কেমন হারিয়ে যাবে। ভাবতেই খুব খারাপ লাগছে।
আমি যখন সামুতে এসেছিলাম, সে সময়টা সামুর একটা উজ্জ্বল সময় ছিল। একটি লেখা দশ মিনিটও প্রথম পাতায় থাকার সুযোগ ছিল না। লেখার পর লেখা আসছে। ঝকঝকে তুখোড় তরুণরা সব নানা বিষয়ে লিখছেন। একটা লেখায় হাজার খানেক মন্তব্য।
লাইক নো লাইকের ছড়াছড়ি। একটা বিষয় নিয়ে মন্তব্য প্রতি মন্তব্যের ছড়াছড়ি। কবিতা গল্পের পাশাপাশি সেই সময় দেশের বিষয়ে অনেক বেশি লেখা হতো।
আজকের সরকার ক্ষমতায় আসার পিছনে বিরাট ভূমিকা আছে, সেই সময়ের সামুর লেখকদের।
রাজাকার যারা মোটামুটি সব ক্ষেত্রে মিলে মিশে গিয়েছিল, তাদের মুখোশ খুলে পরিচিত করানোর বিশাল দায়িত্ব পালন করেছেন, সেই সময়ের তুখোড় লেখকরা। সেই ধারাবাহিকতা এখনও আছে।
পক্ষের দল যেমন ছিলো বিপক্ষের দলও ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী।
ছাগু শব্দের ব্যবহার তুমুল ভাবে ব্যবহার হতো সেই সময়। মনে হয় সামুর লেখা থেকেই এই "ছাগু" শব্দটির আবিস্কার। যা রাজাকার বা তাদের অনুগামীদের জন্য ব্যবহার হয়।
মনে হতো যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের, শিবির তাড়ানোর মতন ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলত, লেখার মাধ্যমে।
কতৃপক্ষ তখনও নিরপেক্ষ ভাবে সবাইকে লেখার সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা করতেন। সবারই লেখার অধিকার আছে এই মনোভাব পোষন করে। কিন্তু ছাগু দল প্রায় অভিযোগ করত মুক্তমনা লেখকদের নিয়ে। এই সব কারণে অনেক ব্লগারদের ব্লক করে রাখা হয়। এক পর্যায়ে অনেক লেখক চলেও যান ব্লগ ছেড়ে। নতুন ব্লগ তৈরি হয়। কিন্তু কোন ব্লগই সামু ব্লগের মতন এত দীর্ঘকাল এত পাঠক লেখক নিয়ে চলে নাই।
বর্তমান সময়ে । সামু অনেক থিতু অতি সাধারন বলা যায়। এখন এখানে লেখার চর্চাই হয়। ঝগড়া ফ্যাঁসাদ নেই বলা যায়।
যারা কোনদিন লেখার কথা চিন্তা করে নাই। সামুতে এসে অনেকে ভালো লিখতে শুরু করেছে। অন্তত আর কোন রকমের নেশার চেয়ে পড়া এবং লেখার মধ্যে থাকার নেশাটা অনেক ভালো। মুক্তচিন্তা প্রকাশের একটা জায়গা।
অথচ এই বিশাল একটা তৈরি ক্ষেত্র যেখানে মেধা মননের চর্চা চলছে। এই সুন্দর জগৎটা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তাও আবার অভিযোগ করা হয়েছে এটা পর্ণ সাইট।
বুঝতে পারলাম না কিসের ভিত্তিতে যাচাই হলো? শাস্তি দেওয়ার আগে তো বিষয়টা দেখা দরকার। কারো অভিযুগ নিয়ে রায় দেয়া ঠিক না।
মাঝে মাঝে কোন কোন গাড়ল ব্লগার কারো লেখায় পর্ণ ধরনের ছবি পোষ্ট করেছে। কিন্তু মডারেটরা এখন অনেক অভিজ্ঞ এবং সাথে সাথে এ্যাকশন নিয়ে নানা রকম ক্রাইমকে সঠিক ভাবে মোকাবেলা করছেন। সাথে পাঠক লেখকরাও সচেতন। যারা ক্ষতিকারক তাদের চেহারা তারা ধরে ফেলেন সহজে । কাজেই বারে বারে নতুন নামে হাজির হয়েও তারা এখন আর পাত্তা পায় না।
লাখ খানেক মানুষের মাঝে একজন দুজনের হঠাৎ পোষ্টকরা বিষয় দিয়ে বিবেচনা করে বিশাল অংশের মানুষকে বঞ্চিত করাটা কিছুতেই যুক্তি সংগত মনে করি না।
মুক্ত চিন্তার অনেক বিষয় বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে অথচ এই বিষয়ে আরো বেশি সুযোগ দেয়া দরকার।
দেশে অনেক দূর্নীতি হয় আইন থাকার পরও। সব কি বন্ধ করা সম্ভব ? কিন্তু র্দূনীতি পরায়নদের ধরে তাদের শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়। যারা লেখার মাধ্যমে খারাপ কিছু ছড়ানোর চেষ্টা করে তাদের বরঞ্চ চেনার সুযোগ থাকবে এখানে লেখালেখির মাধ্যমে।
আশা করছি যারা এই ব্লগ বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা বিষয়টি নিয়ে আবারও ভাববেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১:০৩