ভিন্নমাত্রার এক আয়োজন করেছে, টরন্টো ফিল্ম ফোরাম পয়তাল্লিশ বছরের বিজয় দিবস উযাপনের । উনত্রিশ বছরের এক আমেরিকান তরুণ যুদ্ধ কবলিত বাংলাদেশের মানুষকে সাহায্য করার জন্য চলে গিয়েছিল আমেরিকা থেকে ১৯৭১ সনে বাংলাদেশে। লিয়ার লেভিন নামের সেই তরুণের বয়স এখন সত্তরের বেশী। উনাকে সম্মান জানানোর আয়োজন করা হয়।
দুঃসাহসী সেই তরুণ এখনো দ্রীপ্ত; চেতনায় চিন্তায় চলা ফেরায়। বয়স হয়ে গেলেও বয়সের ভাড়ে নুহ্য নন তিনি। তার কাছ থেকে শোনা হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যা দেখেছেন, যে চিত্রগুলো ধারন করেছেন, যা এখন কালের সাক্ষী বাংলাদেশের ইতিহাস। সেই ভয়াবহ সময়ের গল্প। যে গল্পের অনেকটা তার কাছ থেকে চিত্র সংগ্রহ করে ”মুক্তির গানে” প্রকাশ করেছিলেন তারেক মাসুদ আর ক্যাথরিনা মাসুদ।
নিউ ইয়র্ক থেকে উড়ে এসেছেন, লিয়ার লেভিন এবং তার স্ত্রী র্যাকুয়েল লেভিন। কনকনে শীত ফ্রোজেন রেইন উপেক্ষা করে প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছেন রয়্যাল লিজিয়ন হলে। সারাদিনের অনুষ্ঠান সেখানে ।
র্জজ হ্যারিসন, রবি শংকরের কনসার্ট শোনে বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষদের সাহায্য করার জন্য মন উতলা হয়ে যায় লিয়ার লেভিনের এছাড়া বাংলাদেশ সম্পর্কে উনার জানা ছিল সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে ত্রান সংগ্রহের জন্য বিজ্ঞাপনে তিনি ছিলেন।িনিজের ইচ্ছা দমন করতে না পারে, গর্ভবতি স্ত্রীকে রেখে তিনি বিশাল ক্যামেরা হাতে ছুটে চলে যান যুদ্ধরত বাংলাদেশে।
তার ক্যামেরায় তোলা ছবি বাংলাদেশের জন্ম লগ্নে মানুষের কষ্টের স্মৃতি ইতিহাস হয়ে যায়। ভারত বাংলাদেশের সীমান্তে অবস্থান করে তুলেন অসংখ্য ছবি। ভাড়ি ক্যামেরা বয়ে বেড়িয়েছেন, মুক্তাঞ্চল থেকে যুদ্ধরত দেশের ভিতর। একদিকে পাকিস্থানি বাহিনীর তার চলাফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা। শুধু তিনি আমেরিকান বলে তাকে কিছু করতে পারছে না। তারপরও তিনি আহত হয়েছিলেন গুলি লেগে।
এবং মর্মযাতনা ছিল তার দেশ অস্ত্র দিচ্ছে পাকিস্থানকে বাঙালিকে মারতে। অন্য দিকে ভারতও তাকে থাকতে দিতে চাচ্ছে না। অথচ তিনি চাচ্ছেন অসহায় মানুষদের সাহায্য করতে। সৌভাগ্য বসত কিছু তরুণ তরণি গান গেয়ে যারা উৎসাহ যোগাত মুক্তিযোদ্ধাদের। শরণার্থির ভীড়ে প্রাণের সঞ্চার করতে যেত তারা গান গেয়ে। আর সংগ্রহ করত অর্থ। মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা দলের সাথে মিশে তিনিও বিভিন্ন জায়গায় যেতে শুরু করেন। পাকিস্থানিদের রক্ত চক্ষু এড়িয়ে।
সারাদিন ব্যাপী অনেক মানুষ প্রচণ্ড বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে নিঃশব্দ মগ্নতায় শুনছিলেন যুদ্ধদিনের কথা। এবং দেখছিলেন কালের সাক্ষী সেই সব ফুটেজ থেকে তৈরী করা ছবিগুলো। ”নাইন মান্থ টু ফ্রিডম” ”স্টপ জেনোসাইড” মুক্তির গান”” জয় বাংলা”, মিশে গিয়েছিলেন ১৯৭১ সনের সময়ের সাথে। চোখ ভিজে উঠছিল। শরীরের রোম খাড়া হয়ে যাচ্ছিল ভয়ঙ্কর সেই চিত্রের প্রতিফলনে।
অসাধারন লিয়ার লেভিনকে ভাবছিলাম। একজন বিদেশি হয়ে কেন নিজেকে সেই ভয়াবহ সময়ে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তার বক্তব্য থেকে জানা গেলো শিশু কিশোর বয়সে ইহুদি হওয়ার কারনে যে নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে তিনি গিয়েছেন। মাত্র তের বছর বয়সে ছয় বার তার নাক ভেঙ্গেছে বুলির কারণে। সে যন্ত্রনা তাকে মানবতাবাদি করে তুলেছে। শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শিখিয়েছে। নির্যাতিতের পক্ষে দাঁড়াতে চেয়েছেন।
একটা কথা বারবার মনে হচ্ছিল বাংলাদেশে এখন অনেক টিভি চ্যানেল। কত রকমের বাহারী অনুষ্ঠান হয়। অথচ এসব ছবিগুলো কখনো কি দেখানো হয়। সারাদিন রাত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভিত্তিক এই ছবিগুলো চলা দরকার কোন চ্যানেলে। ভুলে ভরা অনেক গল্প মুছে দেয়ার জন্য। দেশের স্বাধীনতার সাথে বিজয়ের সাথে জন্ম যন্ত্রনার সাথে চিন্তার একাত্ব নিয়ে বেড়ে উঠা দরকার প্রতিটি নাগরিকের। শুধু বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস আর মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত মানুষ নয়। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নয়। সব নাগরিকের একাত্ব থাকা জরুরী দেশের জন্ম যন্ত্রণার সাথে।
মনে হলো রাজাকার, আলবদর আল শামস পাকিস্থনি চিন্তা ভাবনার মানুষ তখনও ছিল এখনও আছে। বিজয় দিবসে ষোলকোটি মানুষ ষোল রকম চিন্তা চেতনায় উযাপন করে । অথচ দেশেপ্রেমের জন্য এক ভাবনা এক ঐক্য চেতনা সবার মনে গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নেয়া দরকার।
এমন একজন মানুষের সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য ফিল্ম ফোরামকে ধন্যবাদ। তিনি যখনঅআমাকে বলেন, ”কীপ ইয়র রাইটিং আপ” তখন সেটা অনেক বড় অনুপ্রেরণা হয়ে যায়।
এখানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ ঘটেছিল অনুষ্ঠানে।
বিদেশে থাকা মানুষ সব সময় চেষ্টা করেন দেশটাকে বুকের মধ্যে রাখতে। ভিনদেশে বড় হয়ে উঠা পরপর্তি প্রজন্মকে নিজের দেশ কৃষ্টি, সংস্কৃতি ইতিহাস জানাতে। সে জন্য সব অনুষ্ঠানে বাচ্চাদের যুক্ত করা হয়। এ অনুষ্ঠানেও ছিল বাচ্চাদের অংশ গ্রহণ। তাদের দেশ ভিত্তিক রচনা এবং চিত্র আঁকার আয়োজন ছিল। তাদের সপ্রতিভ বুদ্ধিদ্রীপ্ত প্রশ্ন ছিল লিয়ার লেভিনের প্রতি। সব মিলিয়ে একটি সুন্দর দিন কাটল।
সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে অনেক উপহার সামগ্রীতে ভরে উঠে লিয়ার লেভিন এবং স্ত্রীর দু হাত তার চেয়ে বেশী উষ্ণতা ছিল মানুষের প্রাণের ভালোবাসায় তাদের হৃদয় ছূঁয়ে দেয়া। তিনি বলেন বাংলাদেশের মানুষের সাথে একাত্মতা অনুভব করেন তিনি সব সময়। পৃথিবীর বুকে একটি সুন্দর উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে দেখতে চান ।
স্বাধীনতার কবিতা এবং স্বাধীন বাংলা বেতারের গানের পরিবেশনা ছিল অনুষ্ঠানে।
সব শেষে লিয়ার লেভিনের সাথে জয়বাংলা উচ্চারণ প্রতিধ্বনীত হয়েছিল অন্তর থেকে এবং সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি গাইতে গাইতে বাড়ির পথ ধরেন আগত সবাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:১৫