আজ আমাদের হাভানা দিবস। কিন্তু রাত থেকে যে আকাশের কান্না শুরু হয়েছে ভেরোডেরোয় এ কান্না থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সকাল থেকে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে মনটা বৃষ্টিময় করে আমরা তৈরি হলাম। গাড়ি আসবে আটটায়। দু একবার নীচে গিয়ে দেখে এলাম কিন্তু কোন ট্যাকিস দেখতে পেলাম না। এমন বাদল দিনে সব ঘর বন্দি। বাইরে শুধুই বৃষ্টির তান্ডব। মানুষ এমনিতেই কমে গিয়েছে আজ যেন সব শুনসান। কখনো তীব্র বেগের বাতাস ও বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে হোটেলের কর্মি এদিক ওদিক যাচ্ছে। হোটেলের খোলা গাড়িগুলি প্লাসিটিক দিয়ে ঢেকে দিয়েছে তাও ভিজে চুপসে দু একজন লোক চলাচল করছে। কোথাও যেতে না হলে এই তুমুল বৃষ্টিতে ভিজতাম। বৃষ্টির নাচন দেখে হৃদয় আমার নাচেরে ময়ুরের মতন নাচেরে। অথচ তৈরি আমরা বসে টেলিভিশন দেখছি ঘরে। নটা নাগাদ ঘরে ফোন বাজল। গাইড খবর দিল আমাদের ট্যাক্সিওলা নিচে অপেক্ষা করছে। ঝটপট নীচে লবীতে গিয়ে দুতিনজন মানুষ পেলাম। একজন এগিয়ে এসে জানতে চাইল আমরা হাভানা যাবো নাকি? হ্যাঁ বলায় সে পরিচয় দিল তার নাম এ্যলেক্স। ট্যাক্সি ড্রাইভার। এবং আজকের জন্য আমাদের গাইড সে।
মধ্য বয়স্ক ফর্সা এ্যালেক্সকে দেখে ইউরোপিয়ান মনে হয়। কিন্তু সে কিউবার স্থানীও লোক। সামনে পার্ক করা গাড়িটি দেখিয়ে বলল ঐটিই আমাদের আজকের বাহন। তুমুল বৃষ্টির মাঝে গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই বৃষ্টি ভিজে সারা হবো। আমাদের ইতস্থত চোখ দেখে সে জানাল, গাড়িটি আমি হোটেলের পিছনে নিয়ে যাই। ওখানে এসে উঠো। যা হোক একটু জায়গা ছাতা মাথায় পেরিয়ে গাড়িতে চড়া হলো রওনা হলাম আমরা হাবানার উদ্দেশে। কেইভে যাওয়ার দিন ছাতা সাথে ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেলাতে হয়নি। আর আজ তো ছাতা মাথায় গাড়িতে বসার পর কাঁচের বাইরে জলের গড়িয়ে যাওয়া দেখা ছাড়া বেশী কিছু দেখার অবস্থা রইল না।
তুমুল বৃষ্টি ছুটছে আমাদের গাড়ি ছুটছে। পথটা চেনা, বেশ ক’বার এই পথে যাওয়া হয়েছে এর মধ্যে। মাঝেমাঝেই অনেক জলের ¯্রােত রাস্তায়। দুপাশে জলের ডানা মেলে দিয়ে আমাদের গাড়ি যাচ্ছে। মাইল দশেক যাওয়ার পর বৃষ্টি থেমে গেলো এমন কি রোদের আভাষও দেখা যেতে লাগল আকাশে মেঘের ফাঁকে।
যেতে যেতে পথের ছবি তুলতে পারছিলাম না। জানলার কাঁচ নামাতে না পারায়। যাক বৃষ্টি থেমে যাওয়ার সাথে আমাদের মনও ভালো হয়ে গেলো। একপাশে সমুদ্র একপাশে শহর। সমুদ্রের পাশ ঘেষেই রাস্তা হাভানা পর্যন্ত। বাতাস বেশ জুড়ে বইছে। মাঝেমাঝে সমুদের জল রাস্তায় উড়ে আসছে। এ এক অন্যরকম দূরন্ত রূপ। এ্যালেক্স আমাদের পথের সাথে আশেপাশে গ্রাম এবং তাদের কাজ সম্পর্কে বলছিল। এলেক্সর গাড়িটি জাপানী টয়োটা দেখে আমার মনটা খারাপা হলো তুমি। ভেবেছিলাম পুরানো কিউবান গাড়িতে চড়ব এ্যলেক্স খুব দুঃখ প্রকাশ করল এবং বলল। আসলে টিপটপ রাখাটা হাতি পালার মতনই অবস্থা। তাই কিছুদিন আগে সে এই গাড়িটি নিয়েছে। সময় এবং কাজ বাঁচাতে। কিউবায় বিদেশের গাড়ি আসা তো নিষিদ্ধ। ছিল তবে এখন কেনা যায়। অনেকে নতুন গাড়ি নিয়ে আসে ওর্ডার করে। তা ঠিক কেউভ বেড়াতে গিয়ে কিছু র্মাসেডিজও দেখেছি। এক সময় কিউবা আমেরিকার গাড়ি আমদানি বন্ধ করে দেয়। তবে আগের গাড়িগুলো এখনও চলছে রাস্তায় আইকন হয়ে। এটাও তাদের এক ধরনের বিশেষত্ব। শিল্প মাধ্যমে কিউবার আর্টিস্টরা পুরানো গাড়ির ছবি এঁকেছেন বহুত।
হালে অনেকে নতুন গাড়ি কিনেন। সে সাধ্যও মানুষের আছে। নতুন ঝকঝকে মার্সিডিজ, বিএম ডাব্লু থেকে টয়োটা, হুন্ডাই সবই দেখলাম। তবে রাস্তায় ভীড় কম। আর আছে ঘোড়ার গাড়ি। পর্যটকদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রচুর আয় করছে তারা। হোটেলে যারা কাজ করে তাদের আয় ব্যাংক কর্মকর্তার চেয়ে বেশী। বেতন বেশী নয় কিন্তু টিপসের মাধ্যমে তাদের আয় বেড়ে যায়। কানেডিয়ানরা টিপস দিতে ওস্তাদ। ইউরোপিয়ানরাও। তবে জার্মানে কখনো টিপস দিতে যাবেন না। এবং অস্ট্রেলিয়ায় টিপস দিলে ভয়ানক অপমানিত হবে। সে অপমান করবেন না। বিচিত্র ভাবনা এবং ব্যবহার জানা না থাকলে মুশকিল। যেমন আমাদের দেশে বুড়া আঙ্গুল কাউকে দেখিয়েছেন তো মরেছেন ব্যাপারটা ভীষণ অপমানের। কিন্তু এই বুড়া আঙ্গুল অহোরহ দেখে আপনি খুশি হয়ে যাবেন ইউরোপ আমেরিকায়। পাশের গাড়িটি যেতে দিয়েছেন। সে যেতে যেতে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যাবে। অর্থাৎ ধন্যবাদ জ্ঞাপন।
ভেরেডেরো ছাড়িয়ে প্রথম যে শহরটা পরল সেখানে বেশীরভাগ জেলেদের বাস । সমুদ্র এবং নদীতে মাছ পাওয়া যায় প্রচুর। প্রকৃতি আমাদের গ্রাম বাঙলার মতন। রিও ইয়ারিম এবং রিও সানওয়ান দুটি নদী হাভানা এবং ভেরোডেরোর মধ্যে প্রবাহিত। সমুদ্র যেমন ঘিরে আছে। নদীও তেমন প্রবাহিত মূলভূখন্ডের মধ্য দিয়ে। মিষ্টিপানিরও অভার নেই, নেই মাছের অভাব।
এরপরের শহরটা পার হলাম রাম তৈরির শহর। ইক্ষু থেকে যেমন চিনি তৈরী হয়। তেমন কিউবানরা তৈরি করে রামও ইক্ষুর রস থেকে। ওদের রাম খুব বিখ্যাত। শহরটা বেশ ঘন বসতির। আরো খানিক যাওয়ার পর বেকুনাইগুয়া সেতু দেখার জন্য থামা হলো। একটি শহরে থামা হলো। সেতুটি নদীর উপর নয় স্পেলেন্ডেড আর ইউমারি উপত্যকা গভীর গীরি খাদের ৩৬১ ফুট উঁচুতে তৈরি। হাভানা এবং মেটেনজা কে সংযুক্ত করেছে এই সেতু। এখানে দর্শনকারীদের জন্য ব্যবস্থ্যা রাখা হয়েছে। দর্শন মানেই আধুনিক ব্যবস্থা সুন্দর করে সাজানো ইমারত, বাগান। খাওয়া, কেনা কাটা, গান বাজনার সু ব্যবস্থা। খোলা পাহাড়ি নিরব জায়গায় দৃষ্টি মেলে দিয়ে দেখা যায় সবুজের সমারোহ। বেশ কিছু দর্শনার্থির ভীড়, তার সাথে সামিল হলাম আমরাও। ছাদ ঢাকা খোলা খানিক উঁচু জায়গাটায়। কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলে কিছু দোকানপাট। চা নাস্তার ব্যবস্থা চেয়ার টেবিল পাতা দোকান। আমার সকালের কফি আজ পান হয়নি। আমি তাই এক কাপ কফি নিয়ে বাইরে চলে এলাম। দারুণ গান আর নাচ হচ্ছে। যার ইচ্ছে নাচে যোগ দিয়ে দিচ্ছে। কিছু বাদক, গায়ক এক পাশে গান করে যাচ্ছে।
সামেনে খোলা জায়গা থেকে চোখ মেলে দিলেই কিউবার সবচেয়ে বড় ব্রীজ দেখা যায়। ব্রীজের রাস্তা সামনের সবুজ পাহাড়ের ভিতরে চলে গেছে। দৃষ্টিসীমা শেষ হয় পাহাড়ের গায়ে যেখানে আকাশে হেলান দিয়ে রয়েছে। মেঘলা আকাশের কারণে খানিক নীল খানিক সবুজ এবং কোথাও মেঘেদল অলস ভঙ্গিতে নড়চড়া করছে। চারপাশের সবুজ পাহাড় ঘেরা নয়নাভিরাম জায়গাটা আজ বৃষ্টির জন্য ধূয়াটে ঘোলাটে রঙ ধরে আছে। উজ্জ্বল রোদের দিন হলে যে কি ভালো লাগত এখানে বসে থাকতে তাই ভাবছিলাম, ছবির মতন দৃশ্যটি দেখে। বৃষ্টি থেমে ছিল। আবার শুরু হলো। আমরা কিছু ছবি তুলে ভিতরে চলে এলাম। সেখানে সাজানো দোকানপাটে খানিক ঘুরে। রওনা হয়ে গেলাম আবার হাভানার পথে।
এখানে একটা অদ্ভুত গাছ দেখলাম। বিশাল বড় আলুর গাছ। মাটির নীচে নয় গাছে আলু ধরে আমের মতন! গাছের বড় বড় পাতা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ছিল। এ্যালেক্সকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কি গাছ? সে বর্নণা দিল। ক্যারেবিয়ান অঞ্চলের গাছ। ও কখনো খায়নি কিন্তু অন্যরা খুব পছন্দ করে খায়, এই গাছে ধরা আলু। গাছটার বিশাল গোলগোল পাতা ছাড়া এ মূহুর্তে আর কিছু দেখতে পেলাম না। ফুল বা ফল।
কিউবার মানুস হ্যাসপেনিক। কিউবার প্রকৃতি যেমন অনেকটা বাংলাদেশের সাথে মিলে যায় সবুজ উষ্ণ এবং বেশীর ভাগ সমতল নদীবিধৌত। মানুষের মাঝেও তেমন মিল মনে হলো। সাদা এবং কালো এবং উভয়ের সমন¦য়ে বাদামী। ম্যাক্সিকো, ভ্যনিজুয়েলা, ফ্লোরিডা, ব্রাজিল আর্জেন্টিনা, ক্যারেবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ খুব দূরে নয়। মানুষের আনাগোনা। ইতিহাসের বিবরণে স্প্যানিস, ইতালির অধিপত্য সব কিছুর প্রভাব মানুষের চেহারায় দেখা যায়। গৌড় থেকে মিশ কালো ভিন্ন রঙের মানুষ মিলে মিশে একাকার। ভাগ করতে চাইলে অনেক গভীরে যেতে হবে। চেহারা আসল ডিএনে খুঁজতে। এবং পাওয়া যাবে বৈচিত্রময় গল্প আমি নিশ্চিত। সময় নিয়ে এই গল্পগুলো আবিস্কারের জন্য কখনো যেতে পারলে বেশ হবে। কিন্তু অল্প এক দু বেলায় আর কতটুকু জানা যায়!
জানার সুযোগ আছে বই পড়ে। তবে বাস্তবে মানুষের সাথে কথা বলে তাদের আদি নিবাশের খবর জানার মজা অন্য রকম। যেমন আমাদের ড্রাইভারে কে দেখেই মনে হয়েছিল ইউরোপের এবং জানা গেলো তার পূর্বপুরুষ পর্তগীজ থেকে এখানে এসেছিল। যদিও সে খুব জোড় দিয়ে বলার চেষ্টা করছিল সে কিউবার মানুষ। তার জন্ম কিউবায় সন্দেহ নাই কিন্তু সে ধারন করছে বিভিন্ন ধারার প্রবাহ তার শরীরে। তৈরী হয়েছে নানা জায়গার মিশ্রণে। এ্যালেক্স খুব ভালো ইংরেজি বলে এবং তার উচ্চারণে কানাডার টান পেলাম। এবং সে জানাল সে কানাডায় ছিল এবং কাজ করেছে দশ বছর একটি কোম্পানিতে। কিউবায় প্রথম জীবনে ছিল একজন শিক্ষক এখন ট্যুর গাইড এবং ট্যাক্সি ড্রাইভার। সেই সাথে খামারের মালিক। তার একশটা গরু আছে এছাড়া ছাগল হাঁস মোরগ আছে বিস্তর জমি। মানুষের জীবন কত বিচিত্র। কতরকমের কাজ,জীবন যাপন এক জীবনে তারা করে। এ্যালেক্সর সাথে কথা বলে বর্তমান অবস্থা জীবনযাত্রা বোঝার চেষ্টা করছিলাম কিউবার। বিপ্লবের পর সাম্যবাদের নিয়ম কঠিন ভাবে পালিত হয় ফিদেলে কাস্ট্রোর শাসন আমলে। অনেক কিছু রাউল কাস্ট্রো এখন সহজ করে দিচ্ছে জানাল।
ফিদেল কাস্ট্র যৌথ পরিবারে বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাউল এবং পরিবারের সবার সাথে অবসর দিন যাপন করছে। আমাদের গাইড এলেক্স জানাল চে গোয়েভারা স্ত্রী কখনো কিউবায় কখনও আর্জেনটিনায় থাকে। তাদের ছেলে মেয়েরা কিউবায় সাধারন জীবন যাপন করছে। চে’ র ছেলে আর্নেস্তোর সাথে পারিবারি ভাবে যোগাযোগ ছিল। আমি বললাম তা হলে চলো আর্নেস্তোকে দেখে আসি। আগে যোগাযোগ করতে হতো। এখন সে মোটর লাইকেলের কিউবা ট্যুর চালু করেছে তা নিয়ে ব্যস্ত।
চের গুয়েভারার বড় সন্তান মেয়ে আলেদা গুয়েভারা বাবার মতন ডাক্তার হয়েছেন। বাবার ছবি বিক্রি করে কিউবা এখন অর্থ আদায় করছে। শুধু তাই নয় চের ছবি এবং নাম এখন বিশ্ব জুড়ে একটি ব্যান্ড হিসাবে বিখ্যাত বানিজ্যের জন্য। ব্রিটেন, ফ্রান্স তাদের মদের বোতলে বিপ্লবী চের ছবি, নাম ব্যবহার করে তার মর্যাদাহানী করছে বলে মনে করেন। বিশ্ব ব্যাপী পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ট গৌড়ব উজ্জ্বল নাম এখন ব্যান্ড হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব অপব্যবহার লজ্জাজনক ভাবতেও ক্লান্তি লাগে। বলে চে গুয়েভারা আর্ন্তজাতিক সম্মেলনে কিছুদিন আগে নিজের মনোভাব জানান। টাকা নয় সম্মানটাই বড় মনে করেন চের কন্যা চের মতনই। তিনি চেষ্টা করছেন চের সব ছবি সংরক্ষণের।
রাস্তা চলেছে ছিমছাম একা একা। সমুদ্র খেলা করছে ঢেউয়ের মাতনে এক পাশে। মাঝে মাঝে দূরন্ত ঢেউর লবন জল ছূঁয়ে দিচ্ছে আমাদের গাড়ি। সাগর আজ অশান্ত, বাতাসে উড়ছে জলরাশি। অন্যপাশে সবুজ বিস্তুিৃর্ণ গ্রাম। কলা, নারিকেল, পাম কৃষ্ণচূড়ার গাছ ইক্ষু ক্ষেত সবুজ বাংলার মতন গ্রামগুলো ছাড়িয়ে। গল্পে আর অবলোকনে আমরা এসে পৌঁছালাম হাভানায়।
হাভানা অনেক বড় শহর। আমরা প্রথমে গেলাম ওল্ড হাভানায়। ইতিহাস এবং প্রাচিন স্মৃতি লেগে আছে হাভানার ধূলিকণায়। পুরানো শহরে ঢুকতে বিশাল একটি পাম সারির সাজানো রাস্তা। পাশে নদী এবং ঠিক ওপর পারে চে গুয়েভারার আবাস হলুদ রঙের বাড়িটি দেখা গেলো। তার পাশে বড়সর স্ট্যেচু যিশুর। গাড়ি পার্কিংয়ে রেখে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। এখানে পুরো রোদ্দুর উজ্জ্বল একটি মায়াময় দিন।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৬ ভোর ৫:৫১