আমাদের ইচ্ছা ছিল আজ হাবানা চলে যাবো। কিন্তু আমাদের ট্যুর গাইড ট্যাক্সি যোগাড় করতে পারল না। দোষটা অবশ্য ওর না আমরাই সিদ্ধান্ত শেষ মূহুর্তে নিয়েছি। পরের দিন অর্থাৎ বুধবার হাবানা যাওয়া ঠিক হলো। হাবানা যাওয়া হচ্ছেনা। খানিকটা উদ্বিগ্ন হচ্ছি আবহাওয়ার খবর দেখে। কারণ আগামীকাল বৃষ্টি দেখাচ্ছে তাই আজকের দিনটিতে হাবানা পর্ব শেষ করতে চাইছিলাম। যদিও আজকের দিনটিও গুমড়োমুখ হুতুমপ্যাঁচা হয়ে আছে। তবে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে না। কিন্তু আগে থেকে সিদ্ধান্ত না নেয়ায় অসুবিধা হলো। কিন্তু দেখা গেলো ইচ্ছে করলেই অনেক কিছু করা যায় না। আর কিউবায় সব কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। বিশেষ করে ভেকেসন সিজনে সব কিছুর চাহিদা বেশী। সে তুলনায় সাপ্লাই কম। ছুটির সময় অবশ্য সারা বৎসর জুড়েই এখানে। কারণ উত্তাপ, চির সবুজ এবং সুন্দর সুনীল নোনা জলের আকর্ষণ। আজ তেমন কিছু করার নেই তাই সকালটা একটু ঢিমে তেতালায় শুরু হলো। প্রতিদিন দৌড়ের উপর ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে হালকা আরামের দিনও দরকার বেড়াতে এসে।
ঘরে বসে ব্রেকফাস্ট সেরে বেড়িয়ে পরলাম। সকালের প্রিয় কফি পান করলাম প্রিয় এবং একমাত্র কফিশপ থেকে। হেঁটে হেঁটে পেয়ে গেলাম রেন্ট এ কারের দোকান। ভাবলাম একটা গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে বেড়াই যেদিক খুশি সেদিক। হাভানাও চলে যেতে পারি অথবা সান্তাক্লারা। গাড়ি নিয়ে ঘুরতে আমার সবচেয়ে মজা লাগে। যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে কোন বাঁধা নেই। কিন্তু দোকানি বলল পাবে না গাড়ি নাই। আমি যদি কালকের জন্য ঠিক করে রাখি আজ। না আগাম বুক করাও যাবে না। ভোরবেলা এসে চান্স নিবে। যদি তুমি লাকী হও গাড়ি পেয়ে যাবে। কোন নিশ্চয়তা নেই। তারমানে খুব ভোরে সূর্য উঠার আগে উঠেই লাইন দেয়ার জন্য ছুটতে হবে। এটা আমার সবচেয়ে অপছন্দের বিষয়। রাত জেগে সূর্য উঠা দেখব ঠিক আছে কিন্তু সূর্য উঠা দেখব বলে ভোরবেলা উঠব সেটি হবে না। গাড়ি ভাড়া করতে পারলে আরামে আয়েসে এবং কমদামে ঘুরাঘুরিটা করা যেত। হাভানাতে যাওয়া সারাদিন ঘুরানোর জন্য ১৫০ পেসো দিতে হবে ট্যাকসি ড্রাইভার সাহেবকে। যা আমাদের মূদ্রামূলে প্রায় দুইশ ডলারের কাছাকাছি। রেন্টে এ কারের মূল্যও সচরাচর আমাদের মূল্যমানের তিনগুণ। একদিনের জন্য পঁচাত্তর পেসো গুণতে হবে। ডলারে বদল করলে একশ ডলারের মতন খরচ হবে। আমরা যখন গ্রীষ্মের তুমুল ব্যাস্ততায় মোটে ত্রিশ পয়ত্রিশ ডলারে গাড়ি রেন্ট করতে পারি। সে তুলনায় কিউবায় অনেক বেশী দাম।
গাড়ি ভাড়া করার অসুবিধা হলো। যদি টায়ার পাাংচার হয়ে যায় বা র্স্টাট না নেয় তবে সারাবো কোথায় আনন্দ পুরো মাটি হয়ে যাবে। ফোন করলে টোট্রাক কতক্ষণে আসবে এসব বিষয়ে কোন ধারনা পাওয়া গেলো না। অনেক সময় থাকলে এসব করা যায় কিন্তু অল্প সময়ের সবটাই যদি ঝামেলায় জড়িয়ে শেষ হয় তবে মুসকিল। এছাড়া জিপিএস নাই। কোথায় কি ভাবে যাবো তা জানা নেই। একটা সময় ছিল জিপিএস ছাড়া হাতের রেখার মতন মুখস্ত করেছি রাস্তাঘাট। পারি দিয়ে চলে গিয়েছি হাজার হাজার মাইল। হয়ত বা একটা মানচিত্র বই সাথে ছিল। ফোন আছে কিন্ত অন্যদেশে ব্যবহারের উপায় নাই। ইন্টারনেটসহ সাতদিনের একটা প্যাকেজ নিতে ৭০/৮০ ডলার, ট্যাক্সসহ পরবে ১০০ ডলারের কাছাকাছি। ইন্টারনেট পাওয়া যাবে কয়েক মিগাবাইট। সমুদ্রে একবিন্দু মুক্তার মতন। অল্প সময়েই তা ফুরিয়ে যাবে। আর ফোন তো এখন হোমফোনের মতন একটা না । সবার হাতে হাতে জনপ্রতি কয়েকটা। সবার চাহিদা মিটাতে গেলে শ পাঁচেক ডলার শুধু ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্যই দিতে হবে। কিউবায় আবার ইন্টারনেটের ব্যবস্থা খুব খারাপ। আমরা যেমন কফিশপ রেস্টুরেন্টে বসলে ফ্রি ওয়াইফাই পেয়ে যাই বা হোটেলে ওয়াইফাই থাকে। এখানে তেমন ব্যবস্থা না। কিউবায় দুচারটা পাঁচতারা হোটেলে ওয়াইফাই আছে বাদবাকি আলাদা কার্ড কিনতে হয়। আমরা এ পর্যন্ত বেশ কিছু কার্ড কিনে ফেলেছি হোটেলে। দু ডলারের একটা কার্ডের সময় সীমা একঘন্টা। এক ঘন্টার সময় কখনো পাঁচ মিনিট কখনো পনের বিশ মিনিট সৌভাগ্যবশত কখনো এক ঘন্টার একঘন্টা পুরোটা পাওয়া যায়।
আমি দুটো কার্ড ব্যবহারের পর ক্ষ্যান্ত দিয়েছি। বেড়াতে এসে ইন্টারনেটে চোখ দিয়ে বসে থাকার কোন মানে নাই। যতদূর দৃষ্টি মেলে দেয়া যায় দিগন্তে। দেখা যায় অনিন্দ্য প্রকৃতি। চারপাশের সবকিছু বোঝার জন্যও দেখতে হবে অনেক বেশী।
সকালে নাস্তা করে যখন হাঁটছি তখন মেয়ে বলল, তোমার রঙ এতো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে খুব ফর্সা হয়ে গেছো কিউবা এসে। আমি বললাম, রঙটা গরমে খুলেছে, কারণ আমাদের শরীর অভ্যস্থ উষ্ণ আবহাওয়ায়। ক্যানাডার শীতল আবহাওয়ায় স্রিঙ্ক করে, কুঁকড়ে যায় চামড়া আর ম্লান দেখায়। (পুরাই আমার নিজের থিউরি) পুরানো অনেকের সাথে দেখা হওয়ার পর প্রথম প্রশ্ন শুনেছি, আমার রঙ কেনো ম্লান হয়ে গেছে বিদেশে সাদাদের দেশে এসে আমি কালো হয়ে গেছি। তা থেকে এই থিয়রি আবিস্কার। ( যদিও সাদা কালোয় আমার কিছু যায় আসে না)
তাহলে আজকের দিন সমুদ্র মন্থনে কাটানো যাক। সময় তো শুয়ে বসে পার করা যাবে না। সারাদিনের জন্য সমুদ্রকে সঙ্গী করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সারাদিন জলের সাথে থাকব বলে। ঘরে ফিরে চলে গেলাম সাগরপাড়ে স্নানে । আজ যত খুশি সাগরের জল ছূুঁবো। লবন জল মাখব। আর নারিকেল বনের গান শুনব। আজ সাগরপাড় একদমই ফাঁকা। দু চারজন বসে আছে। জলের ভিতর দুজন মানুষ। সাগর একটু বেশী উত্তাল আজ। আজকি পানিতে নামব একটু দ্বিধায় পরে গেলাম। ঠিক আছে চেয়ারে শুয়ে থেকে ওজন নেয়া যাক শরীর জুড়ে।
কিন্তু জলের সাথে আমার চির ভালোবাসা। ওকে কাছে পেয়ে ওর হাত না ধরলে কি আমার ভালোলাগে। উত্তাল ঢেউ বা বাতাস ভুলে এক সময় টুক করে জলে নেমে গেলাম। আসে পাশে যে কেউ নেই ভ্রক্ষেপ হলে না। বিশাল জলরাশি আর আমি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলাম।
ইচ্ছে মতন ঝাঁপাঝাঁপি করলাম জলে আর বালুতটে। কয়েক ঘন্টা ব্যাপী। কুড়ালাম অনেক ঝিনুক। অবশ্যই মুক্তো হীন খোলস। মুক্তা ভরা সব তো আগেই কুড়িয়ে নিয়ে যায় ব্যবসায়ীরা। আজ আন্যরূপ আকাশের, উজ্জ্বল আলো নেই বৃষ্টিও নেই। কাছে সবুজ আর দূরে গভীর নীলের মায়া ছড়ানো আকাশ পর্যন্ত। ঢেউ ছুটে আসছে আর আমি তার সাথে পাল্লা দিয়ে ঢেউ তুলছি জলে।
আলো আর জলের সাথে গল্প করে গানের সাথে নেচে রোদে পুড়ে বালুর প্রলেপ শরীরে মেখে হোটেল মুখি রওনা হলাম। খানিক দূরে যেতে ভেজা কাপড়ে, তোয়ালে প্যঁচানো হাঁটারত আমার কাছে এসে দাঁড়াল হোটেলের গাড়ি, সুন্দর হেসে গাড়িতে উঠে বসতে আমন্ত্রণ জানাল। হোটেলে এসে আবার স্নান সেরে পরিচ্ছন্ন হয়ে ভীষণ ব্যাস্ত হলাম খাওয়ার জন্য প্রচণ্ড ক্ষিদা লেগেছে। ঘন্টা কয়েক সাঁতার কেটে। আগেরদিন রাতে আমরা জাজ ক্যাফেতে খেয়েছিলাম। অত্যস্ত সুস্বাদু এবং আন্তরিক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে অনেক বেশী খাবার আমরা ওর্ডার করে ফেলেছিলাম।
তবে খাবারটা ব্যবহারে মতনই সুন্দর ছিল। প্যাকেট খাবার নিয়ে এসে রেখেছিলাম ফ্রিজে তুলে। আজ সারাদিন সে খাবার খেয়েই কেটে গেছে সবার। সাঁতার টাতার কেটে হুতুমোমুখো আকাশের চেহারায় আর বাইরে যেতে ইচ্ছে হলো না। তাছাড়া ফ্রিজে খাবার আছে মাইক্রোভে গরম করে বেশ খেয়ে নিলাম। সন্ধ্যা থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হলো আবার আজ। মাঝরাতে দেখলাম বৃষ্টির তুমুল নৃত্য চলছে। সাথে বাতাসের কোরাস সঙ্গীত। আমরা দাবা আর কার্ড খেলে, গল্প আর আড্ডায় কাটিয়ে দিলাম অর্ধেক রাত। কাল সকালে আমরা হাভানা যাবো। বৃষ্টি থাকলে ঘুরাফেরা অসুবিধা হয়ে যাবে। তাও মনে শান্তি পেলাম এই ভেবে যাক ভাড়া গাড়িতে যাবো গাড়ি নিয়ে যতদূর সম্ভব ঘুরে দেখা যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:৪২