শুক্রবার রাত থেকে রবিবার পর্যন্ত অসম্ভব জমজমাট থাকল এলাকা। স্থানী অনেকে এসেছিল মনে হয়। রাত হতেই আলোর নৃত্য আর জমাটি স্প্যানিস গান, বারবিকিউ আর পান চলছে প্রায় প্রতিটি হোটেলে, সাথে চলছে নাচ। নাচ গানের সুর এমন মোহনীয় আপনমনে শরীর দুলতে শুরু করে। চাঙ্গা লাগে। প্যাকেজগুলোতে খুব বেশী আকর্ষন করা হয় ড্রিংস ফ্রির। যত খুশি খাও। অনেকের এই ফ্রি ড্রিংসটাই সবচেয়ে বড় আকর্ষন। সাগরপাড়ে ক্রমাগত সার্ভ চলছে পানিও। তবে অবশ্যই তা পাবে যারা ঐ প্যাকেজের অর্ন্তভূক্ত। সাথে খাবারও থাকে ফ্রি। তবে সমস্যা হয় ফ্রি খাবারের জন্য অন্য কোথাও ঘুরতে গেলে খাবারের সময় শেষ হয়ে গেলে আলাদা ভাবেই খেতে হয়। যারা শুধু অবসর কাটাতে শুধু হোটেলে বা সাগর পাড়ে রিলাক্স করতে যায় তাদের জন্য এই প্যাকেজ সুবিধাজনক। দেখার জন্য বেড়িয়ে গেলে প্যাকেজ ট্যুর অনেক সময় দুপুরের খাবার অর্ন্তভূক্ত করে দেয়। অনেক সময় মিস হয়। সব কিছুই নির্ভর করে কোন কোম্পানির সাথে প্যাকেজ এবং তাদের দেয়া সুবিধাগুলো ভিত্তিক। নিজেদের ক্ষতি করে সাধারনত কোন প্যাকেজ দেয়না কোম্পানি।
একটি ফ্রি ট্যুর আমাদের প্লেন ভাড়া থেকে হোটেলে থাকার খরচের সাথে। ওরা আমাদের একটা জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাবে। কয়েকটি বিষয় থেকে আমাদের পছন্দ করতে বলা হয়েছিল।
একটা হাবানা ট্যুর, একটা পাহাড়ের ঝর্ণা থেকে বয়ে যাওয়া নদীর কাছে। সেখানে গোসল করা যাবে। আর একটা ক্রিস্টাল গুহায় ঘুরতে যাওয়া।
বাসে চল্লিশ, পঞ্চাস জন মানুষের সাথে দল বেঁধে হাবানা ঘুরতে যাওয়া পছন্দ হলো না। ঝর্ণায় গোসল করতে যাওয়া মনে হলো মাধবকু-ের স্মৃতি ফিরিয়ে আনবে। তিনটি প্যাকেজ থেকে শেষেরটি সার্বজনীন ভোটে গৃহিত হলো। কেইব আমার দেখা হয়েছে কয়েকটা, আমার সাথীরা দেখেনি কোন কেইব এপর্যন্ত। সবারই পছন্দ হলো। অন্য রকম কিছু দেখা হবে। চলা হোক নতুনের সাথে। সোমবার যাওয়ার সিদ্ধান্ত করা হলো। সকাল আটটায় বাসে চড়তে হবে হোটেলের লবি থেকে।
সকালে উঠে দেখলাম অন্য রকম কিউবা। ঝলমলে উজ্জ্বল রোদের পাত্তা নেই। ঘন অন্ধকার মুখ আকাশ চেপে আছে চারপাশ। পৃথিবী জোড়া বিষন্নতা যেন। আর কিসের শোকে এতো কাঁদছে বুঝতে পারলাম না। অঝরে আকাশের চোখ বেয়ে জল ঝরছে ঝরঝর। চেরাপুঞ্জীর তুমুল বৃষ্টি আজ কেন ধেয়ে এলো এখানে। দুদিন দেরী করলে বেশ হতো।
যত বৃষ্টি ঝড় হোক নিয়মগুলো ঠিকঠাক মানতে হবে। হোটেলের লবীতে ট্যুর বাস হাজির। আমরাও নাস্তা শেষ করে তৈরী। শুধু ভাবছি কেউ আমরা ছাতা আনার কথা মনে করলাম না। এখন যে ভিজতে হবে। বাসে গেলেও বৃষ্টির ভিতর কিছুটা হাঁটতে হবে। যে তুমুল উচ্চাঙ্গ নৃত্য করছে লবি থেকে বাসে চড়তেই গোসল সারা হয়ে যাবে। আমাদের চিন্তার অবসান করে ক্লোজেটের ভিতর থেকে পাওয়া গেলো বড় বড় দুখানা ছাতা। হোটল কতৃপক্ষ জানে মাঝেমাঝেই ছাতা বিশেষ জরুরী এ সব এলাকায়। আর আমাদের মতন মনে না রাখা কাস্টমার বেশ ঝামেলায় পরে যাবে ঘুরতে যেতে। মনে মনে ধন্যবাদ দিয়ে, অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসসহ,ছাতা হাতে নীচে নেমে বাসে চড়ে বসলাম। তিন চারটি হোটেল থেকে আরও যাত্রী উঠিয়ে বাস চলল।
সব যাত্রী তোলা শেষ হলে বৃষ্টি ভেজা পথে মশৃণ গতিতে গাড়ি চলল কেউভ এলাকার দিকে। শহর এবং গ্রাম ছাড়িয়ে নানা রকম দৃশ্যের অবতারনার মধ্য দিয়ে। সবটাই ভিজা পধ তুমুল বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া।
একজন ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। একজন গাইড সুন্দর বর্ননায় কিউবার অনেক ইতিহাস। জীবন যাপন থেকে যে এলাকায় যাচ্ছি তার বর্ণনা দিয়ে গেলো। একটা বিষয় লক্ষ করলাম গাইড অনেক বিষয় এবং বিপ্লবের আগে পরের জীবন যাপনের বিষয়ে বললেও একবারের জন্যও চে গুয়েভারার নাম উল্লেখ করল না। বিষয়টা আমার মন খারাপ করে দিল। এবং একটা খটকা মনে লেগে রইল। নিজে থেকে কোন প্রশ্ন করার ইচ্ছাটা আর হলো না। অনেক যাত্রী গাইডকে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করছিল তার থেকে আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাচ্ছিলাম। আর ইতিহাস এবং ভৌগলিক বিষয়ে জ্ঞান তো মোটামুটি আছে। নতুন করে আবার শোনা ছাড়া জানার তেমন কিছু নেই।
আগ্রহ ক্রিস্টাল গুহার মধ্যেই সীমিত করলাম মেঘে ঢাকা আকাশের মতন। বয়ে যাওয়া বৃষ্টির মতন একটি ক্ষরন বুকে নিয়ে। বেলামার ক্রিস্টাল গুহায় যাত্রারা শুরু হলো, বৃষ্টির ভিতর।গাড়ি থেকে তোলা বাইরের প্রকৃতির ছবিগুলো বিষন্ন মন খারাপের মতন হলো।
মালিয়া মারিনা থেকে বেলেমার কেইভ মাটানজাস্ যেতে পঁয়চল্লিশ মিনিট লাগবে। পথে মাটানজাস,একটা কথা বলে রাখি বিভিন্ন জায়গাগুলোর নাম বা মানুষের নাম ভাষা অনুযায়ী উচ্চারণ ভিন্ন হয়। স্প্যানিস শব্দের ইংরেজী থেকে বাংলা করায় বা আমার উচ্চারণ আপনার উচ্চারণ থেকে অনেক পার্থক্য হতে পারে। যেমন বাংলায় আমরা চীন, রাশিয়া মিশর বলি ওদের দেশের মানুষ কিন্তু এ নামে ওদের দেশগুলো চিনেতে পারবে না। তবে এটা শুধু বাঙলির মুখে নয়। এমনটা অন্য ভাষার মানুষদেরও উচ্চারণ করতে দেখেছি।
মাটানজাস শহরের মধ্যিখানে গাড়ি থামল। বৃষ্টি জোড়ে পরছে না তবে প্রবল বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি ভেজা চারপাশে। শুনশান নিরবতা। এমন বাদল দিনে বাহিরে কে যায়রে। অথচ আমার একদল মানুষ বিভিন্নদেশে এক সাথে বেরিয়ে পরেছি। এবার বাস ছেড়ে পথেও নামতে হলো। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পাতা থেকে টুপটাপ ঝরছে পানি। বাস থেকে নেমে গেলাম ছাতা ছাড়াই। চারপাশটা খালি হাতে ঘুরতে চাই আর প্রয়োজনে সাটার টিপে চারপাশের চিহ্ন সাথে দিয়ে যেতে চাই। গাইড সময় দিয়েছে আধঘন্টা। খাবার খাও ঘুরে বেড়াও। চারপাশ দেখো যা কাজ এর মধ্যে সেরে আসো। অচেনা জায়গায় আধঘন্টা সময় দুই মিনিটও না। ঘুরে দাঁড়াবার আগেই ফুরিয়ে যায়।
গাড়ির উল্টা পাশে ছোট একটা পার্ক মাঝখানে স্ট্যাচু। এটি হলো কিউবার জাতীয় নায়ক হোসে মার্তি র মূর্তি একটি স্তম্ভর উপর এবং সামনে একটু নীচু বেদীতে, দুহাত উপরে তুলে শিকল ভেঙ্গে ফেলার ভঙ্গিতে একজন মহিলার দারুণ সুন্দর মূর্তি। চারপাশে অনেক গাছ। তবে দুপাশে দুটো পামগাছ মূর্তির পিছন দিকে আর একটি বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ এক কোনায় আমাকে আকৃষ্ট করল। দেশী গাছের দেখা পেয়ে অনেকটা দেশের মতন মনে হলো। একটি গাছ ওখানে আমাকে মুগ্ধ করার জন্য দাঁড়িয়েছিল। বিশাল গাছটি অনেকটা জারুল গাছের মতন। তবে আগা গোড়া লাল হয়ে আছে ফুলে ফুলে। অদ্ভুত সুন্দর লাগল এই গাছটি আমার। ঝরা ফুলে গাছের নীচটা মনে হচ্ছে লাল কার্পেট বিছানো। কিছু ফুল পারার জন্য খানিক লাফাঝাপ দিলাম যা আমি সব সময় করে থাকি! তবে ধরা দিল না।
সময় কমের জন্য আমার সাথিরাও চাচ্ছিল আসপাশটা দ্রুত একটা চক্কর দিয়ে আসতে। আমরা ভেজা রাস্তায়, না ভিজে হাঁটার চেষ্টা করলাম। বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় বেশ মানুষ বের হয়ে এদিক ওদিক যাচ্ছে। কিছু মানুষ পার্কে পাতা বেঞ্চিতে এসে বসল। প্রতিটি রাস্তায় পার্ক করা পুরানো সব রঙে রঙিন গাড়ি। বাড়িগুলোর রঙও অনেক রঙিন। সবুজ গোলাপী, নীল হলুদ। এবং নানা কারুকার্যময়। তবে দুতলার বেশী কোন বাড়ি নেই। চারপাশ যতটা সম্ভব চক্কর দিয়ে এসে একটা খাবার দোকান পেলাম সেখানে ঢুকে পরলাম। বাইরে থেকে যেমন জীর্ণ মনে হচ্ছিল তেমন নয় ভিতরটা বেশ পরিচ্ছন্ন এবং আধুনিক। হালকা নাস্তা এবং কফি খেয়ে বাসে গিয়ে চড়লাম।
এই এলাকাটা অন্য রকম। রাস্তার পাশে ঘন বাড়িঘরের সারি। রাস্তা এতটাই চিকন মনে হয় অন্য একটা বড় গাড়ি এলে পার হতে পারবে না দুজন রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে থাকবে। ঠিক বর্তমানের ঢাকার বড় কয়েকটা রাস্তা বাদে আর বাদবাকি শহরের রাস্তা গুলোর যেমন হাল। তবে পার্থক্য এখানে কোন ভীড় নাই। সারি সারি দালান কোঠা দুপাশে আর রাস্তার সারি। এই দালান কোঠাগুলো আবার বনেদি মনে হয়। যথেষ্ট কারুকাজ সম্বলিত। এক সময় এদের বেশ প্রতিপত্তি ছিল বোঝা যায়। এখন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তবে যত্নের অভাবে জরাজির্ণ।
দালান গুলোর ভিতর অফিস ব্যাংক। এবং নানা রকম ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, থিয়েটার এবং মানুষের ঘর বাড়ি।
গাড়ি অল্প সময়ে আমাদের গন্তব্যে নিয়ে গেলো। খোলামেলা গ্রামের মতন জায়গা। তার মাঝে একটা ছোটখাট বিল্ডিং। অন্যপাশে একখানা ঘর সপিং সেন্টার। খোলা চারপাশটা বেশ গাছগাছালিতে ঘেরা। খানিক বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে দোকান ঘর থেকে ঘুরে এলাম। গুহায় যে ক্রিষ্টাল দেখতে যাবো তার টুকরো টাকরা বা ক্রিস্টালের তৈরি গহনা এখানে বিক্রি হতে দেখলামনা। সাধারনত অন্য সব জায়গায় যেমন হয়। ফলের জুস, পানি, খাবার, স্যুভিনিয়র, কাপড় এ সব বিক্রি করছে।
বিল্ডিং এর একটা ঘরে ঢুকিয়ে আমাদের কালো চশমা চোখে পরিয়ে দিয়ে একটা টিভির সামনে বসিয়ে দিল। গুহার ভিতরটা কেমন হবে তার বর্ননাসহ ছবি দেখালো। পুরো সাত কিলোমিটার বিস্তিৃত কেইভ। সেখানে নীচে নেমে হেঁটে উপরে উঠে আসতে হবে। তাই অনেককে সাবধান বানী দিয়ে দিল আগে থেকে ছবি দেখিয়ে।
ক্যামেরা নিয়ে যাওয়ার জন্য ক্যামেরা প্রতি বা মোবাইল ফোনের জন্য পাঁচ ডলার দিতে হবে। ক্যামেরার টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকলাম শুরুর দিকের প্রথম ঘরটায়। একজন এগিয়ে এসে একটা লকার দেখিয়ে ওখানে ব্যাগ রেখে যেতে বলল। সাথে হালকা একটা জ্যাকেট ছিল বলল, এটাও রেখে যাও নীচে অনেক গরম হবে।
একটু অবাক হলাম। অন্য একটা কেইভে নীচে ঠান্ডাছিল । জিনিসপত্র জমা করে ঝাড়া হাতপা,লকারের চাবি পকেটে পুরে,ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে ঘরের মাঝখান দিয়ে যে সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে সেখান দিয়ে গুহার মধ্যে নামতে থাকলাম।
প্রথমে সিঁড়িগুলো কিছু ধাপ নেমে এসে একটা বিশাল খোলা জায়গা বড় একটা ঘরের মতন মনে হলো । সিঁড়ির চারপাশে রেলিং ঘেরা। পর্যটকের ভীড় লেগে গেলো সেখানে। প্রাথমিক অভিভুত অবস্থা। মাটির নীচে কি অপরূপ খিলান দাঁড়িয়ে আছে চারপাশ জুড়ে । আমরা কে যে কোথায় গেলাম বিচ্ছিন্ন হয়ে। সবাই নিজের মতন দেখা এবং ছবি তুলায় ব্যাস্ত। হালকা আলোয় ছবি তুলতে বেশ সমস্যা হচ্ছিল। ক্যমেরা কিছুতেই ক্লিক হয়না। মেজাজটা খারাপ হলো ক্যামেরা না এনে মোবাইল আনলে মনে হয় ভালো করতাম। মোবাইল যে কোন অবস্থায় ঝটপট ছবি তুলে ফেলে। এই ক্যামেরা আবার অনেক বেশী স্যানসেটিভ। বেশী আলোতে ইনি বেশী ভালো কাজ দেখান। আমার একটা সনি ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল যা অসম্ভব ভালো ছবি তুলত এমন অবস্থায়। বৃষ্টি থেকে রাতের আকাশের চাঁদ ধরা খুব সহজ ছিল তাকে দিয়ে। কিন্তু উনি ইন্তেকাল করেছেন এ্যক্সিডেন্টে। ও রকম একটা ক্যামেরার জন্য আফসোস হলো!
মুগ্ধতার অস্থির রেশ কাটিয়ে একটু স্থির হওয়ার পর মনে হলো ক্যামেরায় অনেক রকম ওপশন আছে সে ভাবে সেট করতে হবে। রাতের অবস্থায় দেয়ার পর কিছু ছবি তুলতে পারলাম শেষ পর্যন্ত।
ধীরে ধীরে নামতে লাগলাম সিঁড়ি বেয়ে। এক সময় দেখি পাশ থেকে কেউ একজন বলছে, সাবধানে। সিড়ি খুব মশৃণ নয়। আর পানি জমা আছে। পিচ্ছিল হতে পারে কোথাও। তাঠিক সাবধানেই হাটতে হচ্ছে। তবে তাড়া নেই দৌড়ে গিয়ে বুড়ি ছুঁয়ে চলে আসতে চাইনা আমি। আমি ধীরেই হাঁটব এবং দেখব প্রাণ ভরে। গাইডের সাথে হাসি বিনিময় করে আমি এগুলাম। হুম অনেকে অনেকটা এগিয়ে চলে গেছেন ইতোমধ্যে।
আমরা হাঁটছি, দেখছি নীচে নামতে নামতে। মাঝে মাঝেই গাইড আমাদের থামিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা করছে। জায়গাগুলোর।
পৃথিবী বড়ই রহস্যময়। বিচিত্র ভান্ডার নিয়ে বসে আছে। এই বিচিত্র গুহা নিজেই মানুষকে ডেকে বলে যেন দেখো আমার মাঝে অজানা রহস্য আছে তাকে আবিস্কার করে বিষ্মিত হও তোমরা। ১৮৬১ সালে চুনাপাথর খননকারি কিছু শ্রমিক ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম করছিল ওখানে। হঠাৎ একজনের হাত থেকে একটা কাজের হাতিয়ার পরে যায় পাথরের ফাঁক দিয়ে নীচে। গেলো তো গেলোই অন্তহীন গহ্বরে হারিয়ে গেলো জিনিসটা। কৌতুহলি হয়ে খুঁজে না পেয়ে ভিতরের শূন্যতা উপলব্ধি করা হলো। জায়গাটার ভিন্নতা বোঝা গেলো। এবং ক্রমে সোন্তস প্যারাগু, নামের একজন লোক এই রহস্য আবিষ্কারে লাগল যতক্ষণনা রহস্য উন্মোচন হলো ততক্ষণ চলল কাজ এবং নিরিক্ষণ। সমতল ভূমির নীচে খিলান, গম্বুজ, প্রকৃতির তৈরি অসাধারন স্ফটিক ঝিলিমিলি রূপার আভরণ দেয়া সুবিশাল প্রাসাদের খবর মানুষের কাছে পৌঁছে দিলো প্যারাগু। আবিস্কারের আনন্দে রত্নভান্ডার খুঁজে পাওয়ার খবর, যেন ছিছিম ফাঁক বলে যাদুর ঘরের দরজা খুলে বের করে দিলো, লুকিয়ে থাকা রত্ন ভান্ডার পৃথিবীর মানুষের জন্য। এবং শুধু খবর দিয়েই বসে থাকলো না। ভিতরে সাজনো প্রকৃতির স্বপ্নপুরির কাছে সহজে পৌঁছানো জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে সুন্দর ভাবে ভিতরে প্রবেশ করার জন্য ধাপে ধাপে সিঁড়ি কেটে যত্ন করে এক অত্যাশ্চর্য জগৎ সহজে দেখার সুযোগ করা হলো। অনেক বাঁধা নিষেধ উপেক্ষা করে অল্প কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে কাজ করে অসাধ্য সাধন করেছে প্যারাগু।
আমেরিকান একজন দখল করার জন্য টাকা সেধে কাজ এবং কৃতিত্ব নেয়ার চেষ্টা নানা রকম লোভের প্রস্তবনা করেছিল। কিন্তু প্যারাগু নিজের আবিস্কারে অটল থেকে শেষ করেছে কাজ। একটু একটু করে মোম আর মশাল জ্বেলে ভিতরে প্রবেশ করে খুঁড়ে খুঁড়ে তৈরি করেছে পথ নীচে নামার। প্রায় চারশ ফুট নীচে সিঁড়ির ধাপগুলো চলে গেছে। সেখানে এখন বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে সারাক্ষণ। আলোর পথ বেয়ে দেখতে নামা যায় রহস্যময় ভান্ডার সিঁড়ি বেয়ে। পুরো একটা ঘর ঠিক মাটির নীচে, আপন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। শ্রমিকের কাজের জিনিসটা ভিতরে পরে গিয়ে, মানুষকে পথ দেখিয়ে দিল যেন ভিতরের সৌন্দর্য আবিস্কারের। উপরের অংশে ঘর বানিয়ে, অনেকটা জায়গা জুড়ে গাছপালার সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। রাস্তা করা হয়েছে সহজে গাড়ি কেইভের গেইটে আসার জন্য।
অপরূপ প্রথমটুকু হালকা হলুদআভার প্রাসাদের মতন অনেকটা । মনে হয় যেন কোন প্রাচীন রাজার বাড়ির ভিতর প্রবেশ করছি। আলোর ব্যবস্থা এমন ভাবে করা হয়েছে তা খুব ম্লান নয় আবার বেশী উজ্জ্বল নয় কিন্তু পুরো জায়গার সবটুকু দেখতে পাওয়ার মতন যথেষ্ট। অনেক বড় বড় লম্বা খিলান দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন ভঙ্গিমায়। কখনো যেন তুষারে আবৃত। কোথাও একটার পর একটা কারুকার্য খচিত স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে ঝালরের মতন। হাজার বীম, হাজার আলো বিভাজন, করিডোরের মতন লম্বা টানা লবি কিছুটা অমশৃণ চলে গেছে দূরে। প্রাচীর এবং সিলিং হরিদ্রাভ থাম বিশাল দেয়াল থরে থরে সাজানো। কাদামাটি এবং বিন্দু বিন্দু জল ঝরে জমাট বেঁধে চীনামাটির বাসনের মত চেহারা বিশাল এলাকা চুনাপাথর, বিরল জীবাশ্মের দেহাবেশেষ, ঝিনুক, গাছের শিকড়ে গড়া। প্রধম ধাপে তেইসটি সিঁড়ি পেরিয়ে বেশ খোলা ঘুরানো একটা জায়গায় নামলাম। সেন্ট পির্টাস এর গম্বাুজ নাম দেয়া হয়েছে এই অংশের।
সামনে এগিয়ে যেতে প্রশস্ত পথ করিডোরের মতন হয়ে গেলো সেখান থেকে বেশ অনেকটা পথ আধো আলো আঁধারিতে পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে, মনে হলো যেন একটি ফুলের উদ্যানে প্রবেশ করলাম।
গোলাপ বাগানোর ছায়া: প্রকৃতির নিজের গড়া ক্রিষ্টাল গোলাপ প্রাসাদ। স্বচ্ছ শুভ্র, পীত, গোলাপী সবুজ বেগুনী আভার ছড়াছড়ি চারপাশে। কোথাও গুচ্ছো গুচ্ছো হীরক দ্যুতির ফুল ঝুলে আছে মনে হয় পুরো ছাদ জুড়ে। ফুল পাতার লতানো শরীর জড়িয়ে আছে দেয়াল জুড়ে। মনে হয় যেন ফুলের মেলা সুন্দর বাগানে। অট্টালিকার চারপাশ ঘিরে।
ভাবমূর্তির স্ফটিক খামখেয়ালী আদল: পানির ফোটায় ফোটায় গড়া পাথর কত বছর ধরে গড়ে চলেছে নিজস্ব অপরূপ ভুবন। চুন, র্কাবোনেট প্রাকৃতিক খনিজ নিজের শৈল্পিক দক্ষতায় আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে ফোটা ফোটা জল গড়িয়ে তা ধারন করে গড়েছে নানা চেহারা। আপন মনে ভেবে নেয়া যায় নানান মূর্তির গড়ন। রহস্যময়ীরা যেন গল্প করছে, বসে আছে নানা ভঙ্গিমায়। পাথরের মতন কঠিন কথাটা বলা বড় সহজ। কিন্তু পাথর কি সত্যি কঠিন। পাথর ক্রিষ্টাল পানির সংমিশ্রণে জলের ঘন আরক। তার সৌন্দর্য যতই অবলোকন করছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। কী বিচিত্র ভঙ্গীমায় প্রকাশ করছে নিজেকে যতই দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি বিষ্মত হচ্ছি। যতই গভীরে প্রবেশ করছি ততই ধন রত্নের ভান্ডার যেন আরো বেশী সমৃদ্ধ হচ্ছে। অসামান্য চিত্র অলঙ্কার এবং পাথরের সুক্ষ নকসার ছয়ফুট উচ্চতার ফ্ল্যাট স্টেলেকটাইট ডিজাইন দেয়াল, প্রয়োজনীয় জানালা, যেন রুচিসম্মত ভাবে সজ্জিত একটি কক্ষ।
এক সময় মনে হলে পৃথিবীর নিজের গড়া ক্রিষ্টালের ঘরের মাঝে বাস করছি আমি।
নামছি হাঁটছি দেখছি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি দল থেকে। ছবি তুলছি। দর্শক সবাই নিজেদের মতন ব্যাস্ত। বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ। কিন্তু গাইড বেচারা। ঘুরে ঘুরে সবাইকে নজর রাখছে। মাঝে মাঝে এক সাথে থামিয়ে তথ্য প্রদান করছে।
এক জায়গায় সবাইকে থামতে বলল। এবং জানতে চাইল তোমরা কি আমার বয়স কত বলতে পারো? সবাই হাসল দু একজন বলল পঁচিশ, ত্রিশ। সে বলল না আমার বয়স ষাট কিন্তু আমি চির তরুণ। কেন জানো। আমি দিনে দশবারো বার এই গুহায় নামি তাই। আর ঐযে দেয়ালের কোনায় তাকিয়ে দেখো পানি পরছে শূন্য থেকে তোমরা ঐ পানি গায়ে মাখো তোমরাও চির যৌবনে থেকে যাবে আমার মতন। এবার দেখলাম ঠিক পাথরে বাঁধাই করা ছোট একটা চৌবাচ্চার মতন জায়গায় পানি জমছে। একে একে সবাই যৌবন ধরে রাখার পানিতে হাত ছোঁয়াল। ঠান্ডা এবং পরিস্কার পানি। চির তরুণ থাকার জন্য মেখে নিলাম!
সেখান থেকে নেমে গেলাম আরো নীচে। এবং একটি হাতির দেয়াল দেয়া ঘরে যেন প্রবেশ করলাম এবার। মাঝে ক্রিষ্টালের টেবিল পাতা আছে।
আমি সবার পিছনে পরে যাচ্ছিলাম বরাবর। দুচোখ ভরে দেখে এবং ছবি তুলে হাঁটার জন্য। আবার কবে আসব আবার কবে দেখব দেখার সুযোগ হবে, দেখে যাই প্রাণ ভরে যতটুকু সময় লাগে লাগুক। হাতির ঘরে দেখলাম আমার লোকজন অপেক্ষা করছে আমার জন্য জানিতো, তুমি এখানে ছবি উঠাতে চাইবে। স্মৃতির পাতা খুলে ছবি দেখেই তো বাকি জীবন স্মরণ করব কেমন ছিল সময়।
ভালোলাগল ওদের অপেক্ষা। ছবি তুলে হাঁটতে গিয়ে আবারও আমি পিছিয়ে গেলাম দল থেকে। ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছে গুহা। কখনো মনে হয় মাথা সোজা করলেই মাথায় লেগে যাবে। ছাদের ক্রিষ্টাল ঝাড়বাতি। কখনো পাশে একদম সরু রাস্তা। কোন রকমে পেরুতে হচ্ছে। । স্বেত শুভ্র পাথরের রঙ যেন খানিক অন্য রকম হয়ে গেছে এখানে। বেগুনি এবং সবুজের আভাস বেশী সাফায়ার এবং পান্নার মতন লাগছে।
আমার পিছন থেকে এক জোড়া দম্পতি আসছে দেখলাম। ওদের ছেলেটা এগিয়ে গিয়ে ফিরে আসছে বারবার মা বাবার খোঁজে এই বয়সটাই এমন ছাড়তে গিয়েও ছাড়তে পারে না। ছেলেটা বাবা মার দেখা পেয়েই আবার এগিয়ে চলে গেলো। আমিযে রূপবতী একা ঘরটা নিজের করে নিয়েছিলাম ওরা এসে সেখানে দাঁড়িয়ে গেলো। এতই সুন্দর একে উপেক্ষা করে চলে যাওয়ার উপায় নাই। ওরা দুজনে নিজেদের সেলফি উঠানোর চেষ্টা করছিল। আমি ওদের ছবি তুলে দিলাম। ওরাও আমার ছবি তুলে দিল। ওরা এগিয়ে গেলো। অনেকটা পথ আামি একা হাঁটছি। হঠাৎ দেখি গাইড আমার কাছে এসে জানতে চাইল তোমার পিছনে আর কেউ আসছে কি? আমি বললাম তাতো জানি না। তবে তুমি আমার ক্যামেরাটা ধরো, আমার কিছু ছবি তুলে দাও।
সে কিছু ছবি তুলে দিল। বলল ফিরার পথে আরো ছবি তুলো এবার চলো শেষ পর্যন্ত। আরো কিছুটা দূরে গুহার শেষ, সেখানে নদীর ধারা দেখতে পেলাম। সবাই ফিরে গেছে। বয়স্ক কয়েকজন গাইডের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। এবার ফিরার পালা। এখানে অনেক বেশী অন্ধকার। ক্যামেরা কিছুতেই ছবি তুলতে চাইল না। একজন মহিলা এগিয়ে এসে বলল, তোমাকে ছবি তুলে দিব।
দিলে তো খুব ভালো কিন্তু ক্যামেরা কাজ করতে চাচ্ছে না। দাও দেখি চেষ্টা করে। ক্যামেরা মান ইজ্জতের বারোটা না বাজিয়ে ভালোই ছবি উঠাল ওর হাতে। সবাই মিলে ফিরতে লাগলাম। একটা জায়গায় এসে দেয়ালের অন্য পাশ দিয়ে ফেরার পথ কিছুটা অন্য রকম আদলের।
মোট উনিশটা ধাপ পেরিয়ে গেছি শেষ পর্যন্ত। নীচে এবং লম্বায় হেঁটে। সবাই চলে গেছে তাই হাঁটতে হচ্ছে তাড়াতাড়ি একটু। ফেরার সময় উপরে উঠার পালা। এতক্ষণে নিজের দিকে নজর হলো, গরম লাগছে ঘাম হচ্ছে। জামা কাপড় ভিজে গেছে ঘামে। যত গুহার মুখে এগুতে লাগলাম তত মনে হলো শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পা মনে হয় আর চলতে চাচ্ছে না। মনে হলো খানিক বসে জিরিয়ে নেই কিন্তু সময় নেই, সবাই অপেক্ষায় আছে এখনই বাস রওনা দিবে। গাইড আরেক দল নিয়ে নামবে। সবারই তাগদা আছে।
আমার জন্য মিনিট পাঁচ দেরি করবে তার বেশী নয়। পৃথিবীর মানুষের কাছে কিউবার এই ক্রিস্টাল কেইভ দারুণ আকর্ষনের বিষয়। কিউবা এসে কেইভ না দেখে ফিরে যাওয়া মানে অনেকটাই দেখা হলো না। মাটির নীচে এক রহস্যময় পৃথিবী দেখার স্মৃতি নিয়ে ফিরে চললাম।
দুপুর গড়িয়ে ফিরে আসা হলো ভেরেডেরো মেরিনা এলাকায়। হোটেলে না ফিরে একবারে খাওয়ার জন্য চলে গেলাম। বেশ বড়সর একটা দোকান সি ফুডের আজ সেখানে খাবো। সবাই মোটামোটি এক রকমই ইচ্ছা প্রকাশ করলাম।
প্রচ- ক্ষিদা নিয়ে বড় সর পানির উপর ভাসা রেস্তেরায় ঢুকে তার বৈঠা ডিজানে বানান চেয়ার, নৌকার ডেকরেশনে মুগ্ধ হলাম। কিন্তু আমাদের অর্ভ্যথনার জন্য তেমন কেউ এগিয়ে এসে আমাদের মুগ্ধ করল না। খানিক বসে থেকে নিজেরাই ম্যেনু নিয়ে খাবার পছন্দ করলাম। ফ্রেস লবস্টার আর ভাত এবং লেম্ব স্টেকের ওর্ডার করা হলো। যথারীতি প্রায় আধঘন্টার বেশী অপেক্ষার পর খাদ্য এলো। সানকি ভর্তি ভাত এবং তার উপর বিশাল লবস্টার সাজানো। স্টেকের চেয়ে সিফুডের দোকানে মাছ বেশ সুস্বাদু লাগল। কিন্তু ভাতের ভিতর চামুচ ঢুকিয়ে খটখট আওয়াজ বাজতে লাগল। বের করে দেখলাম ঝিনুক। আহ। বিশাল ঝিনুক মহা আহ্লাদে অনেককে খেতে দেখেছি। কিন্তু আমি জীবনে খাইনি। ভাত যে সাদা হবে না ঝিনুক দিয়ে রান্না হবে তা ম্যেনুতে লেখাছিল না। ওয়েটার টাও বলেনি কিছু। মহিলাটার আদবকায়দা তেমন নমনিয় ছিলনা। এখন নতুন করে খাবার আনতে বলে আরো এক ঘণ্টা বসে থাকতে হবে। বরঞ্চ যাহোক এমন খাবার তো মানুষ খায় এই খাবার একদিন খেয়ে মরে যাবোনা ভেবে খেয়ে ফেললাম। ঝিনুকের খোসা বাছা ছাড়া মন্দ লাগেনি। আর ফ্রেস সাগরের লবস্টার সত্যি সুস্বাদু ছিল। তবে সার্ভিং মহিলাটার ব্যবহারে আমরা সবাই অনেক বিরক্ত ছিলাম। আর এই রেস্তোরায় দাম ছিল খাবার অনুপাতে অনেক বেশী। সব কিছু মিলিয়ে আজকের অভিজ্ঞতা অন্য রকম হলো।
চলবে----
আজ শুধুই লেখা ছবি যোগ করব পরে সময়ের অসুবিধা।
আশা করি যারা ছবির জন্য উতলা তাদের মন জুড়াবে
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৩:০৮