শাশুরি তার হবু মেয়ে জামাইকে বলছে-
“দুধকলা বেশি করে খাও বাবা, নাতী কিন্তু আমার ফর্সা চাই”
“ফর্সা হতেই হবে, মা!! এমনি সুন্দর হলে হবে নাহ?”
“কি বলো বাবা!! ফর্সা ব্যাতিরেকে সুন্দর হয় কিভাবে? তুমি কি সাবানের বিজ্ঞাপনের বুলি আওড়াতে চাচ্ছো?
দেখো, বাপু, এই সাবান টাবান ঘষার মধ্যিখানে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারবো নাহ। তুমি দুধকলা খেয়ে প্রস্তুতি নিবে কি না তাই বলো?”
“নাহ, তা নয় বৈকি। আমি আসলে সুন্দর আর সৌন্দর্যের প্রকৃতি নিয়ে বলতে চাইছিলাম। সুন্দর তো আর সাবানের বিজ্ঞাপনের আড়ালে লুকিয়ে থাকে না। যাহোক, আমি আসলে বলতে চাইছিলাম সৌন্দর্য বস্তুর আবেদন আর উপযোগিতার উপরেই নির্ভর করে।
আপনি চাইলে আমি আপনার নিকট সুন্দর ও সৌন্দর্য নিয়ে কিছু পৌরানিক কাহিনী এবং সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে পারি। এতে বোধ করি আপনার ভেতরের সুন্দর আর সৌন্দর্য বিষয়ক প্রজ্ঞায় কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসবে”।
“আম্মা, আমি কি শুরু করবো?”
“আচ্ছা শুরু করছি তাহলে-
গ্রিক মিথলজিতে জাজমেন্ট অভ প্যারিস নামে একটা ঘটনা আছে। অলিম্পাস পর্বতের তিন দেবী হেরা, এথেনা আর আফ্রোদিতের মাঝে একবার কে বেশী সুন্দর এই নিয়ে বিরোধ লেগে গেলো। সেটার সমাধানের জন্য তারা দেবতাদের প্রধান জিউসের শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু জিউস এই বিচারের ভার ছেড়ে দিলেন ট্রয়ের রাজা প্রিয়ামের পুত্র প্যারিসের উপর।
হেরা, এথেনা আর আফ্রোদিতে তাই করলো। তারা প্যারিসের হাতে সোনালী রঙা একটা আপেল ধরিয়ে দিয়ে বললো ‘তিনের মধ্যে সবচেয়ে যে সুন্দর তার হাতে আপেলটা ফিরিয়ে দাও’।
এবার তারা নিজেদের মত করে প্যারিসকে প্রভাবিত করতে লাগলেন। হেরা বললো-“আমায় সবচেয়ে সুন্দরী খেতাব দিলে তোমায় পুরো ইউরোপের রাজা বানিয়ে দেবো”।
এথেনা বললো-“আমায় সেরা সুন্দরী বলে মেনে নিলে তুমি পাবে জ্ঞান আর যুদ্ধের কলাকৌশল”।
তবে সবচেয়ে আবেদনময়ী প্রস্তাবখানা এসেছিলো আফ্রোদিতের কাছ থেকে। সে বললো-“ধরার সবচেয়ে সুন্দরীর প্রেম তোমার হয়ে যাবে যদি আমায় সেই সুন্দরী রমনী হিসেবে মেনে নাও”।
জাজমেন্ট অভ প্যারিস
অবশেষে প্যারিস আপেলটা আফ্রোদিতের হাতেই তুলে দিয়েছিলো। আফ্রোদিতের আবেদন আর প্যারিসের নিকট সেটার উপযোগিতাই প্যারিসকে জগতের সবচাইতে সুন্দরীর প্রেমাভিসিক্ত করেছিলো।
সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে উপযোগিতার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সুমেরীয় সভ্যতার একটা ঘটনা বলি-
সুমেরীয় সভ্যতার সূর্যদেবতা উটু তার ভগ্নী ইনানাকে অনুরোধ করে মেঘপালকদের দেবতা দুমুজিকে বিয়ে করার জন্য। কিন্তু ইনানার পছন্দ হলো কৃষকদের দেবতা এনকিনানদাকে। দুমুজি এতে ক্ষিপ্র হয়ে যান। সে বলেন-“আমি ওর চেয়ে কম কিসে? আমি ওর চেয়ে ঢের গুন বেশী উপকার করি। ও তো কেবল শস্য আর মটরশুটি ফলায়”।
ইনানাঃ ভালোবাসা ও কামের দেবী।
ইনানা অবশেষে মেষপালকদের দেবতা দুমুজির গলাতেই মালা পরায়। কারন তার থেকেই মানুষ বেশী উপকৃত হয়।
এক্ষেত্রে কিন্তু ইনানা উপযোগিতাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলো।
এবার সৌন্দর্য নিয়ে দার্শনিক ও সাহিত্যিকদের অবস্থানটা একটু লক্ষ্য করি-
বরিস পাস্তেরনাক নামক এক রাশিয়ান কবি এক রমনীর সৌন্দর্যের স্তুতি করতে গিয়ে বলেছিলেন, “সৌন্দর্যের গভীরতল খুজে পাওয়া আর জীবনের ধাধার সমাধান করা সমান। সৌন্দর্যের গোপন আর জীবনের গোপন পৃথক কিছু নয়”।
এতে হতে বোঝা যায় যে কোন কিছুকে সুন্দর বলার সঠিক পটভূমি মুলত অজানাই থেকে যাবে। কেনো সুন্দর, কোন দিক থেকে সুন্দর, এই জাতীয় প্রশ্নের উত্তর না মিললেও বাহ্যিকভাবে আমরা বলে দিতে পারি দুই কিংবা অধিকের মাঝে কোনটা সুন্দর আর কে কার চেয়ে বেশি সুন্দর। এইদিক থেকে দেখলে ব্যাপারটা অনেকটা আপেক্ষিকও বটে।
তবে সক্রেটিস পূর্ববর্তি দার্শনিক হেরাক্লিটাস সৌন্দর্যকে বিশ্লেষণ করলেন এইভাবে যে সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে সেটার পরিমাপের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই বিমূর্ত চিন্তনেরও। এটা শুধু ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য এক ধরনের উপলব্ধি। এই উপলব্ধি অর্জন করা যায় দ্বান্দিকভাবে চিন্তা করে। জীবনের সারবস্তু এবং সৌন্দর্যের প্রকৃত উপলব্ধির অর্থ হলো অস্তিত্বের যতগুলো বৈপরীত্যমূলক বৈশিষ্ট্য রয়েছে তার উন্মোচন। যেমনঃ জন্ম-মৃত্যু, সংঘর্ষ-সংগতি।
দ্বান্দিক রীতির কথা যখন আসলই তাহলে এই রীতির একটা কাঠামো প্রদানকারী দার্শনিক হেগেলের কথা বলতেই হয়।
হেগেল
হেগেলিয়ান ডায়ালেক্ট
হেগেলের দ্বান্দিক রীতিটা প্রাচীন গ্রিসে প্রচলিত দ্বান্দিক রীতির চেয়ে ভিন্ন। হেগেল প্রস্তাব করেন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত তথাপি জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনটা স্তর রয়েছে-১)থিসিস, ২)অ্যান্টি থিসিস, ৩)সিন্থিসিস। থিসিস ও অ্যান্টিথিসিসের দ্বন্দ্ব এবং এর মাধ্যমে একটি সিন্থিসিসে পৌছানো। হেগেল দেখিয়েছেন যে প্রকৃতির মাঝে সবসময় একপ্রকার দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্বের কারনেই প্রতিটি বস্তু প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। অর্থাৎ বস্তু হচ্ছে অ্যাবসোলিউট আইডিয়া এর দ্বান্দিক প্রকাশ। হেগেলের এই দ্বন্দ্বমূলক ভাববাদ হতেই পরবর্তিতে কার্ল মার্ক্সের দ্বান্দিক বস্তুবাদের বিকাশ ঘটেছিলো”।
“মা, আপনি শুনছেন তো?”
“হ্যাঁ, বলতে থাকো”।
“যাহোক আমরা সৌন্দর্য নিয়ে বলছিলাম। হেগেলের মতে সৌন্দর্য হলো বিশ্ব আত্মার বিবর্তনের একটা স্তর।এই স্তরে আত্মা সংগতিপূর্নভাবে বস্তুগত আকারের সংগে যুক্ত হয়। এই আকারের মধ্যে যা কিছু পূর্নাঙ্গ এবং পর্যাপ্ত তাই সুন্দর। অর্থাৎ হেগেলের সারকথা হলো সৌন্দর্যের বসবাস শিল্পের রাজ্যে। মূলত ভাববাদী দার্শনিকদের মতামতগুলো অনেকটা এইরকমই। জগতের সব জেনো মানুষের চিন্তা-ভাবনার মাঝেই লুকানো রয়েছে।
হেরাক্লিটাস যে রকম বলেছিলেন যে সৌন্দর্যের উপলব্ধির জন্য পরিমাপের প্রয়োজন হয় না, ডেমোক্রিটাস সেই পরিমাপের তত্ত্বকেই আরও বিকশিত করেন এবং সৌন্দর্যের পশ্চাতে সুখলাভের আকাঙ্ক্ষাকে দাড় করান। তার মতে জীবনের সুখ উপভোগ করতে হলে সুন্দরকেই উপভোগ করতে হয়।
সৌন্দর্যের মধ্যে সর্বপ্রথম গানিতিক ধারনার বিকাশ ঘটান পীথাগোরাসের অনুসারীরা। তারা লক্ষ্য করলেন যে যন্ত্রের তারের দৈর্ঘ্যের নির্দিষ্ট পাটিগনিতীয় অনুপাতের উপর সাংগীতিক বিরতি নির্ভরশীল। একই টান বজায় রেখে ২:১ অষ্টক, ৩:২ পঞ্চম, ৪:৩ চতুর্থ। পিথাগোরাসের অনুসারীদের মতে সৌন্দর্য সংগতিপূর্ন।
পিথাগোরিয়ান টিউনিং
এরিস্টটলও অনেকটা পীথাগোরাসের মত করেই বললেন। তার মতে সৌন্দর্য আকার ও ক্রম নির্ভর। সে আকার ও ক্রমকে ভিত্তি করে সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্য প্রদান করেন এবং বলেন যে এসকলই গনিতের সাহায্যে যাচাই করা সম্ভব। সুন্দর অতিশয় বৃহৎও হবে না, আবার অতিশয় ক্ষুদ্রও হবে নাহ। সুন্দর হতে হলে পরিমিত আকারের মধ্যে থাকতে হবে। আর এই পরিমিত আকারের মানদন্ড হলো মানুষ নিজেই।
আরেক গ্রিক বস্তুবাদী দার্শনিক এম্পিডোক্লেস যার মতে বিশ্ব গঠিত হয়েছে অগ্নি, বায়ু, মাটি ও জল দ্বারা এবং এই সবগুলো একত্রিত হয়েই উদ্ভব হয় সৌন্দর্যের। আর এদের বিভক্তি জন্ম দেয় অসুন্দর এবং বিশৃঙ্খলার। তার শিক্ষাতেই ধরা দিয়েছিলো সৃষ্টিতত্ত্ব আর নন্দনতত্ত্বের যোগসুত্রের প্রচ্ছন্ন ইশারা।
এবার সৌন্দর্য নিয়ে প্লেটোর সংলাপে আসি। তানাহলে সক্রেটিসের চিন্তাধারা বাদই রয়ে যাবে। সক্রেটিস এমন একজন দার্শনিক যিনি নিজে কিছুই রচনা করেন নি। অথচ তার শিষ্য প্লেটোর সমস্ত রচনাতেই নায়ক হয়ে রয়েছেন তিনি। প্লেটো তার সকল দার্শনিক চিন্তা ভাবনাকেই সংলাপরূপে প্রকাশ করেছেন।
সক্রেটিস
প্লেটোর এসকল সংলাপ থেকেই সক্রেটিসের চরিত্র ও স্বভাব সমন্ধে জানা যায়। সক্রেটিস প্রচলিত ধ্যান ধারনা থেকে শুরু করে কোন কিছুই বিনা প্রশ্নে গ্রহন করতেন নাহ।
প্লেটোর গ্রেটার হিপ্পিয়াস নামক রচনা থেকে দেখা যায় সক্রেটিস, হিপ্পিয়াসের সংগে সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা করছেন।
সক্রেটিসঃ সৌন্দর্য কি?
হিপ্পিয়াসঃ সত্যি বলতে সৌন্দর্য হলো এক অনিন্দ্যসুন্দর কুমারী।
সক্রেটিসঃ কেনো, একটি মাদি ঘোড়া কি সুন্দর নয়? সুন্দর বাঁশী, সুন্দর পাত্র, এইগুলো কি সৌন্দর্যের মধ্যে পরে নাহ?
সক্রেটিস এরকম আরও দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন হিপ্পিয়াসের নিকট এবং সৌন্দর্যের ব্যাখায় আপেক্ষিকতার উপর দৃষ্টিআকর্ষন করেন।
সক্রেটিসঃ মানুষের মধ্যে যিনি সবচাইতে সুন্দর, তাকে দেবতাদের সাথে তুলনায় আনলে বানরতুল্য বলে মনে হবে।
হিপ্পিয়াসঃ এরকম পরম সৌন্দর্য তো স্বর্ণের বৈশিষ্ট্য।
সক্রেটিসঃ ভাস্কর ফিদিয়াস, দেবী অ্যাথিনির একটা অপূর্ব মূর্তি গরেছেন। সেটা কিন্তু স্বর্ণের নয়। মাটির একটি পাত্রের সংগে তুচ্ছ চামচই সুন্দর দেখায়, স্বর্ণের নয়।
সক্রেটিস আর হিপ্পিয়াসের বিতর্ক থেকে সুন্দরের চূড়ান্ত সংজ্ঞা না মিললেও একটা সামগ্রিক ও দ্বান্দিক বিশ্লেষণ পাওয়া গেছে”।
“আম্মা, বিরক্ত হয়ে গেছেন বুঝি?”
“নাহ,তুমি শেষ করো”।
“আচ্ছা, এবার তাহলে ইমানুয়েল কান্টের কথা বলি। কান্ট এনলাইটেনমেন্টের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক।
ইমানুয়েল কান্ট
কান্ট সৌন্দর্য বিচার করার ধারনাকে চারটা ভাগে বিভক্ত করেন।
১)সৌন্দর্যের বিচার মানুষের অনুভূতির উপর ভিত্তি করে হয়, উদ্দেশ্য কিংবা বিষয়গত সংবেদনের উপর ভিত্তি করে নয়। (এটাই জ্ঞানের বিচারের সাথে সৌন্দর্যের বিচারের অন্যতম তফাৎ। জ্ঞানের বিচারে বিষয়গত বা বস্তুগত সংবেদনই মুখ্য)
২)সৌন্দর্যের বিচার সর্বদাই সার্বজনীন হবার দাবী রাখে। অর্থাৎ, একটা বস্তু সৌন্দর্যের বিচারে উত্তীর্ন হবার মানে এই যে তা সকলের বিচারেই সুন্দর।
৩)সৌন্দর্যের বিচার আগে থেকেই কোন সমাপ্তি কিংবা অভিপ্রায় ধরে নেয় না।
৪)কিছু ক্ষেত্রে সৌন্দর্যের বিচারে প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গ চলে আসে। যেমন-বিচারকে সার্বজনীন করতে আমি বস্তুটাকে গ্রহন করলাম। এতে আমার তৃপ্তি একটা প্রয়োজনের সাথে জড়িত হয়ে রইলো”।
.......(দীর্ঘশ্বাস)
“শেষ?”
“প্রায় শেষ আম্মা। শুধু উপসংহারটা বাকি”।
“যাদের কথা এতক্ষণ ধরে বললাম তারা কেউই এখন বেঁচে নেই। তবুও তাদের দেখানো পথেই আমি সৌন্দর্যের স্বরূপ খুজে বেরাই। নিজের মাঝে যদিও তেমনটা পাই না, তবে চলতে ফিরতে সুন্দরের সম্মুখীন হই না বললেও অন্যায় হবে। আমার কাছে সুন্দর সেটাই যেটা দেখে মনের ভেতর অসংখ্য সুখকর অনুভূতি পুঞ্জীভূত হয়। এই সুখকর অনুভূতির জন্য গায়ের বর্ন থেকে উজ্জল আলো প্রস্ফুটিত হবার কোন দরকার আমি হেগেলের ভাববাদেও খুজে পাই না, মার্ক্সের বস্তুবাদেও খুজে পাই না। আর আপনি সেই আমাকে বিয়ের আগেই দুধ কলা খেয়ে প্রস্তুতি নেবার কথা বলছেন! আমি আমার দর্শন থেকে একচুলও নড়বো না। আগে যাও সকালে এক আধটা কলা খেতাম এখন আপনার কথা শুনে ঠিক করেছি জীবনে আর কোনদিন কলা খাবো না। একান্তই যদি খেতে হয় তবে প্রাকৃতিকভাবে সন্তান উৎপাদনক্ষমতা হারানোর পরেই খাবো”।
“কি হলো আম্মা? চুপ করে রইলেন কেনো?”
“মেয়ের বিয়ে দেবেন কি না ভাবছেন”?