সকাল ১০ টায় পরীক্ষা শুরু হবে। ১০ টা বাজতে আর মাত্র ঘন্টাখানিক বাকি। এই এক ঘন্টায় ঢাকার রাস্তায় গন্তব্যে পৌছানো মোটামুটি অনিশ্চিতই বলা চলে। তাও আবার পরিবহনটা যখন বাস।
আজ এইচ এস সি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। প্রথম পরীক্ষা বাংলা ১ম পত্র। ছেলেটা তারাহুরো করে মা-বাবার পা ছুয়ে বাসা থেকে দৌড়ে বের হলো। মনে মনে একটাই ভয় কাজ করছে ঠিক সময়ে পৌছতে পারবে তো! আল্লাহর কাছে আজ তার একটাই চাওয়া যে করেই হোক কোয়েশ্চেন দেয়ার আগে যাতে ক্লাসে ঢুকতে পারে। এমনিতেই বাংলা পরীক্ষা, লিখতে হবে অনেক। সে আজ অবধি কোনদিনও বাংলা প্রশ্ন পুরো উত্তর করে আসতে পারে নি।
এই সময়টাতে বাসে উপচে পরা ভিড় থাকাটা স্বাভাবিক। তবে আজ কোনমতে উঠতে পারলেই হয়। পরের এক্সামগুলোতে সময় নিয়ে বের হতে হবে।
একটার পর একটা বাস সামনে দিয়ে যাচ্ছে। একেকটা একেক রুটের। কাংখিত বাসের দেখা মিলছে নাহ। ছেলেটার কপালে আজ খারাপই আছে।
এইদিকে সময়ও গড়িয়ে যাচ্ছে।
৯ টা ২০ বেজে গেছে বাসের অপেক্ষা করতে করতে। তবুও বাসের দেখা নেই। ওর আজ কাদতে ইচ্ছা করছে বাস স্টপেজে দারিয়ে।
"এমনি সময় একটা নয়, দুইটা নয়......কমপক্ষে পাঁচটা দারিয়ে থাকে আর আজ একটাও নেই। আল্লাহ আগে থেকেই জানে আজ আমার বাংলা এক্সাম আর আমি তিন ঘন্টায় পুরো প্রশ্ন আনসার করতে পারি নাহ। এইটা জেনেই আজ আমাকে বাঁশ দিবে। আমাকে বাঁশ দিতে উনার ভালো লাগে।"
৯ টা ৩০ বেজে গেছে। এতক্ষনে একটা এসেছে। ইতমধ্যেই এটার গেইটে লোক ঝুলছে। ওঠা একেবারেই অসম্ভব। তবুও ওকে ধাক্কাধাক্কি শুরু করতে হলো বাধ্য হয়ে। আর এই ধাক্কাধাক্কির প্রতিযোগিতায় ও একক প্রতিযোগী নয়।
"ভাই আমার ১০ টা থেকে এক্সাম, প্লিজ, কোনমতে একটু......প্লিজ আমার এক্সাম শুরু হয়ে যাবে"
লাভ নেই, এখানে যার যার কাছে নিজের ব্যাস্ততাটাই পছন্দের শীর্ষে। মানবতাটা অন্য সকল জায়গায় দেখানো গেলেও লোকাল বাসে দেখানো যায় নাহ। এইটাই রুল। এখানে কোন এথিকস ওর মোরালিটি চলে নাহ।
তবুও গেইটে ঝুলে থাকা মধ্যবয়সী এক অফিসগামী লোকের হাতের নিচ দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে প্রানপন চেষ্টা চালালো সে। এইদিকে বাসও ছেড়ে দিচ্ছে। লোকটার সাথে একরকম ধ্বস্তাধস্তি করতে হলো একটু জায়গা পাবার জন্য। কিন্তু হারই মানতে হলো ওকে। বাসটা গতি বাড়ানোতে লোকটার বাহুর ধাক্কাটা সামলানো সম্ভব হয় নি। ওকে রাস্তায় পড়ে যেতে হলো।
চলে যাচ্ছে বাসটা। ধরা সম্ভব হলো নাহ।
"শুধু লোকটার জন্য, লোকটা একটু চাপলেই আমি দাঁড়াতে পারতাম।"
অকপটেই গালি বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। ওর ইচ্ছে হচ্ছিলো লোকটাকে খুন করে তার শরীরটাকে ৬০০ টুকরা করতে। আর প্রতিটা টুকরো রাস্তার কুত্তা দিয়ে খাওয়াতে।
তবে লোকটার চেহারাটা ওর মনে গেথে রইলো। লম্বাটে মুখ, কপালের দিকে চুল নেই, মুখে বসন্তকালীর ছিদ্রের সমাহার।
যাহোক, সেদিন ওর এক্সাম হলে পৌছতে মিনিট বিশেকের মত লেইট হয়েছিলো। তবে মোটামুটি দিতে পেরেছিলো সবই।
বছর দশেক পর,
ছেলেটা এখন চাকুরীরত ভীষন ব্যাস্ত মানুষ।
এরই মাঝে একদিন এক ভিক্ষুকের সাথে দেখা হলো রাস্তায়। লম্বাটে মুখ, কপালের দিকে চুল নেই, মুখে বসন্তকালীন ছিদ্রের সমাহার। ভিক্ষুকটাকে দেখে কেনো জেনো মনে হয় কোথায় দেখা হয়েছিলো। পা দুটো নেই, ওভারব্রিজের উপরে এক পাশে হেলান দিয়ে বসে আছে, সামনে একটা কাপড় বিছানো। কাপড়ের উপর ছড়ানো ছিটানো কতগুলো কয়েন, দু টাকা-পাঁচ টাকা- আর দশ টাকার নোট।
কিছুতেই মনে করতে পারছে নাহ কোথায় দেখেছিলো তাকে। তবে ওর কাছে মনে হচ্ছে এই মুখটা ও জীবনে আরও একবার হলেও দেখেছে। কিন্তু কবে, কোথায়, কেনো এমন মনে হচ্ছে?
ও অনেক চেষ্টা করেও কিছুই মনে করতে পারলো নাহ।
একদিন কলিগদের সাথে গল্প করতে গিয়ে নিজের এইচ এস সি এক্সামের প্রসঙ্গ ওঠে। যখন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া লোকটার বর্ননা দেয়া শুরু করলো তখনই ভিক্ষুকের চেহারাটা ভেসে উঠলো নিজের মনে। নিজের মন কি তাহলে ভুল বলছে? এই ভিক্ষুক কেনো আমাকে ধাক্কা দিতে যাবে?
ও সেদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তারাতারি চলে আসলো। গন্তব্য ওভারব্রিজ। উদ্দেশ্য ভিক্ষুকটার সাথে দেখা করা। তবে আফসোস, সেদিন আর আগের জায়গায় খুজে পেলো নাহ ভিক্ষুকটাকে। পাশের অন্য ভিক্ষুকদেরকে জিগ্যেস করলো, কেউই কোন সঠিক উত্তর দিতে পারলো নাহ। জানতে পারলো বেশ কয়েকদিন ধরেই এখানে আর আসছে নাহ লোকটা।
মাথায় এক বোঝা কনফিউশন আর টেনশন নিয়ে সেদিন বাসায় ফিরে আসলো।
ও সেদিন আর লোকটাকে খুজে পায় নি।
কখনও পাবেও নাহ আর সত্যটাও জানবে নাহ। কারন লোকটা আর পৃথিবীতে নেই।
ওর ভাগ্যরচিত বিধাতার সেই হিসেব ওর অজানাই রয়ে যাবে।
(সেদিন ওর মিস করা বাসটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলো। আহত নিহতের লিস্ট অনেক বড় ছিলো। এবং সেখানে গেইটে যে কয়জন ঝুলে ছিলো তাদেরই প্রাধান্য রয়েছে। এদেরই একজন সেই লম্বাটে মুখ, কপালের দিকে চুল নেই, মুখে বসন্তের দাগওয়ালা লোকটা। তার দুটা পা হারাতে হয়েছিলো। তার জীবনের সাথে আর কি হয়েছে তা জানা যায় নি তবে চাকুরী চলে যাওয়াতেই পরিবারে ভরণপোষণের জন্য পথে বসতে হয়েছিলো।)
বিধাতার সবকাজেই কারন থাকে। আমরা হয়তো আবেগবশত কারনের তোয়াক্কা করি নাহ। বিধাতা তবুও দয়াময়। আক্ষেপের সুতো লম্বা করে জীবনে সুখী হওয়া যায় নাহ। জীবন আসলেই অনেক ক্ষুদ্র। আক্ষেপের ভাবনা নিয়ে চলতে গেলে সময় কোনদিক দিয়ে কেটে যাবে টের পাওয়া যাবে না।
আমাদের অজান্তেই আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে রয়েছে বিধাতার সূক্ষ্ম হিসেব। আর এই হিসেব বোঝার ক্ষমতা আমাদের দেয়া হয় নাই। তবে তার হিসেবের উপসংহার সর্বদাই আমদের মঙ্গলের তরে।