আজ সকালে খুব তাড়াহুড়া করে বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। প্যান্টের বেল্টটা পর্যন্ত পরে আসতে পারি নাই। অনেকদিন যাবত ভার্সিটির বাস মিস করাটা একটা বদভ্যাসে পরিনত হয়েছে। এই বদভ্যাসের দরুন অনেকদিন সকালের ক্লাস মিস করেছি। এটা অবশ্য অনেকটা ইচ্ছাকৃতও বটে। ক্লাস মিস না করলে যে আমি পড়াশুনা করে ফাটিয়ে ফেলতাম তা নাহ। তবে আজ সকালে ক্লাস টেস্ট ছিলো। গতকাল দুপুর থেকে শুরু করে সারাটা বিকাল এক বন্ধুকে ভার্সিটির লাইব্রেরিতে বেঁধে রেখে ইন্টারপোলেশনে সিদ্ধি লাভ করেছি। আজ সেটা জাহির না করলেই নয়।
সকালের তারাহুড়াতে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন জিনিসটাই সাথে নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। মানিব্যাগটা যদিও সাথে ছিলো, আমি জানতাম না সেটার মধ্যখানে শুধু একখানা বিশ টাকার নোটই ছিলো। অন্ততপক্ষে আরও কিছু আশা করেছিলাম। যাহোক, মানিব্যাগটা সাজ সকালেই ছ্যাকা দিলো। এটা বোধহয় খুব একটা ভালো ইঙ্গিত নাহ। ভার্সিটির বাসটা ধরতে পেরে বেঁচে গিয়েছিলাম। নইলে আজকে সকালের ক্লাস টেস্টে অধমের ইন্টারপোলেশনের বিদ্যা জাহির করার বিনীত চেষ্টা চাঙে উঠতো। (এমনিতেও চাঙেই উঠেছে)
আগামীকাল আবার সলিড মেকানিক্সে বিদ্যা জাহিরের একখানা সুযোগ রয়েছে। সেই বোধ ভেতরে রেখে আজকে আবারো লাইব্রেরিতে বেঁধে রাখলাম ঐ বন্ধুকে। দুপুরের পর সময় যে ঘোরার মত দৌর মেরে পালায় সেটা হয়তো কাজে ব্যাস্ত থাকলেই বোঝা যায়।
পাঁচটার পর আর লাইব্রেরিতে দেরী করলাম নাহ। কারন আমার মাথায় তখনও রয়েছে মানিব্যাগের প্রতারনার আবেগ। ভার্সিটির বাস মিস হলে কপালে খারাপ আছে।
বাসের মধ্যেই লেগে গেছে ক্ষুধা। এমনিতেই সারাদিন কিছু খাই নাই। রোজার মাস বাদে এইভাবে না খেয়ে থাকাটা আসলেই আনএথিক্যাল। তবে কিছু করার নেই। আজকের গেইমে আমার ক্ষুধা হেরে গেছে। আর জিতে গেছে অর্থের প্রয়োজনীয়তা।
বাসে থাকতেই স্টুডেন্টের ফোন, "ভাইয়া, কয়টায় আসবেন? একটু তারাতারি হলে ভালো হতো।"
আজকে ইচ্ছা ছিলো নাহ টিউশনিতে যাবার। তবে একেবারে আজই বেচারির এহেন তীব্র জ্ঞান পিপাসা আমাকে একটুখানি হলেও আলোড়িত করেছে। তাই ভাবলাম কতক্ষণই আর লাগবে ওকে পড়াতে। যাই একেবারে কাজ শেষ করেই বাসায় যাই।
ওকে পড়ানো শেষ করে বাসার দিকে রওনা হলাম। রিকশাতে গেলে ভাড়া ৩৫-৪০ টাকা। পায়ে হেটে গেলে অনেকক্ষণ লাগবে। তবে মানিব্যাগ যেহেতু আমাকে অনুমুতি দিচ্ছে নাহ, তাই আজ নিজের চাকা দুইটাই ইউজ করতে হবে। ভাবলাম হেটেই যখন যাবো তাহোলে টাকাটা দিয়ে কিছু কিনে নিয়ে খেতে খেতে যাই। বেশী কিছু মিলবে নাহ বিশ টাকায়। একবার ভাবি দীর্ঘমেয়াদি কিছু কিনবো, আরেকবার ভাবি স্বল্পমেয়াদী। দীর্ঘমেয়াদী মানে হলো বাদাম, বুট, সিমের বিচি টাইপের কিছু। একটা একটা করে চাবাতে থাকলে একেবারে বাসা পর্যন্ত। আইডিয়াটা মন্দ নাহ। স্বল্পমেয়াদী মানে হলো বিশ টাকা দিয়ে কিছু কিনে সেটা সাবার করে তারপর হাটা শুরু করা।
পকেট থেকে নোটটা বের করলাম। আজকে বিশ টাকার নোটটা এতো সুন্দর দেখাচ্ছিলো কেনো আল্লাহই জানেন। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর বিশ টাকার নোটের উপাধি পাবে এটা।
অনেক ভেবেচিন্তে হোটেলের সামনে গিয়ে দাড়ালাম সল্পমেয়াদী কিছু কিনবো বলে। তারপর সেটা হাতে নিয়ে অল্প অল্প করে দীর্ঘমেয়াদে খেতে খেতে বাসায় যাবো।
রাস্তার পাশের হোটেলে গেলে যেটা হয় আর কি, পিছন থেকে প্যান্ট ধরে টানতেছে। একে তো বেল্ট ছাড়া প্যান্ট এমনিতেই একটু ঢিলা, তার উপর এইভাবে টানাটা একেবারেই অযৌক্তিক।
দুইবার পেছনে না তাকিয়েই হাত সড়ালাম। তৃতীয়বার পেছনে ফিরে তাকালাম। ঠিক করলাম ওরে বলে ফেলবো, "আমি সারাদিনের না খাওয়া রে ভাই। তুই অন্যদিকে যা।"
আমি একটু বিরক্তি প্রকাশ করাতেই ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা। পিছু ছেড়ে দিলো। পাশের ওভার ব্রীজটার নিচে গিয়ে বসে রইলো।
একটা মুহুর্ত বিশ্বাস হলো আমি জিতে গেছি। পরক্ষনেই আবার কেনো জেনো মনে হলো এটা আমার জন্য একদিনের গল্প, ওর কাছে হয়তোবা প্রতিদিনের।
আমি একটু কড়া মানুষ। তাই এতকিছু খেয়াল না করে বিশটাকা দিয়ে পুরি কিনলাম দুইটা। সালাত দিয়ে প্যাকেটে মুড়িয়ে নিলাম।
অতঃপর ওর কাছে গেলাম। প্যাকেটটা হাতে দিতেই দাঁতগুলো বের করে দিলো।
কৃতজ্ঞতা কি জিনিস আমি চিনি নাহ। চেনার দরকারও নাই। শুধু জানি আজ ক্ষুধা শেষ। সারাদিনের আক্ষেপ এক হাসিতে মিটে গেছে।
আল্লাহ কিভাবে যে কখন শিক্ষা দেন তা একমাত্র তিনিই জানেন। আমি অধম শুধু চাই এই শিক্ষার ভরসায় পথ চলতে।