২৫শে অক্টোবর রাত ১০ টা। বসে আছি বারান্দায়। হেমন্তের বাতাস শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে আমার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। দূরে উড়ে যাচ্ছে পাখির পেটে করে মানুষের দল দেশ হতে দেশান্তরে কেউ বা ফিরে আসছে আপন জনের কাছে। হলুদ বাতির রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে কোন ডানপিটের দল। ওদেরকে দেখে মনে পড়ে গেলো ভার্সিটি লাইফের কথা। প্রায়ই বন্ধুরা মিলে সোডিয়াম লাইটের আলোয় চষে বেড়াতাম পুরো শহর। রাতের ঢাকা যেন প্রেমিকার মত আমাদের টানতো। সে জীবন আর আসবে না। যা চলে যায় তা আর কখনোই ফিরে আসেনা। সার্টিফিকেট অর্জনের সাথে সাথে যেন বিক্রি করে দিয়েছিলাম জীবনের সকল আহলাদ। হঠাৎ ফোনের আওয়াজে ভাবনার দল উড়ে চলে গেল। একটি এসএমএস এসেছে। নিশ্চয়ই ফোন কোম্পানির কোন অফার হবে। এদের জ্বালায় শান্তি মত কোন কিছু ভাবায় যায় না। এই নস্টালজিক সময়টাকে লন্ডভন্ড করে দিলো। মুখে বিরক্তি নিয়ে একটি সিগারেট ধরাতে ধরাতে এসএমএস ওপেন করলাম। মৃত্তিকার এসএমএস। ছোট্ট একটি টেক্সট “কাল বিকেল চারটায় মিরপুর সাড়ে ১১ এর বনলতায়”। এমন কিছু আশা করেছিলাম অনেকদিন ধরে মৃত্তিকার সাথে দেখা হয় না। আমাদের সম্পর্ক প্রায় পাঁচ বছরের। সময়ের সাথে সাথে সম্পর্ক গুলোও বদলে যায়। একসময় রাত দিন ফোনে কথা বলতাম। তা কমতে কমতে এখন মাঝে মাঝে এসএমএস এর পর্যায়ে চলে এসেছে। কিন্তু দুজনের প্রতি দুজনের বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসের জায়গায় একটুও চিড় ধরেনি।
বিকেল চারটায় বনলতায় বসে আছি। মৃত্তিকা এখনো আসেনি। হয়তো রাস্তায় জ্যাম বা বাসায় কোন কাজ পড়ে যাওয়ায় দেরি হচ্ছে। গত সপ্তাহে কেনা নীল পাঞ্জাবী ও সাদা জিন্স পরে এসেছি। নীল পাঞ্জাবীতে নাকি আমাকে ওর ভীষণ ভালো লাগে। চার বছর আগেও একই ক্যাফেতে আমাকে কিছু বলবে বলে আসতে বলে ও আর আসে নাই। আমি সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বসে ছিলাম। আজকেও তাই ঘটল। আমি কয়েক পর্ব কফি খেয়ে সাত টায় বাসায় চলে আসি। ঐদিনও তাকে কিছু বলিনি আজও কিছু বলার প্রশ্নই আসে না।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কেমন যেনো লাগছিলো। ফোনটি হাতে নিয়ে মৃত্তিকাকে ফোন করলাম। প্রথম রিং এ ফোন ধরলো না। পরের বার ওপাশ থেকে ফোন ধরল।
- কে? শোভন।
- হ্যাঁ। আপনি কে?
- আমি মৃত্তিকার কাজিন। আপনি কি একটু বাসায় আসতে পারবেন?
- কেন? মৃত্তিকা কোথায়?
- আপনার জন্য একটা চিঠি আছে আমার কাছে । আপনাকে জানানোর সময় হয়নি। কালকে মৃত্তিকা আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেছে । কাল রাতেই ওকে দাফন করা হয়েছে আজিমপুর কবরস্থানে।
হেমন্তের শুভ্র সকালের শীতল বাতাস যেন আমার হৃদয় কেড়ে নিলো নিমিষে। হাজারটা ছুরি এসে বিদ্ধ হল আমার বুকে। মৃত্তিকা আর নেই। চোখ ধেয়ে বয়ে চলেছে জলের স্রোত ধারা। কেউ যেন এসে পায়ের তলার মাটি ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে কাঁপিয়ে দিলো। হন্যে হয়ে ছুটে গেলাম মৃত্তিকার বাসার দিকে। পথ যেন ফুরাচ্ছে না। বুকটা যেন বিশাল নিঃসঙ্গ ফাঁকা। চিঠিটি হাতে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি ওর কবরের স্থান জেনে। চিঠিটি নাকি ওর টেবিলের ড্রয়ারে ছিলো। তড়িঘড়ি করে রাস্তায় এসে চিঠিটি খুলে দেখি ওর শেষ এসেএমএস এর মত ছোট্ট করে লেখা “ভালোবাসি ! তোমার মৃত্তিকা!!”।
চিঠিটি বেশ পুরানো। বুকের মধ্যে আছড়ে পড়ল কাল বৈশাখ। চার বছর আগেই কি তুমি ঠিক এ কথাটিই বলতে চেয়েছিলে? উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে চললাম আজিমপুরের দিকে। আমি আসছি মৃত্তিকা। আমি আসছি তোমার কাছে। একটু অপেক্ষা কর। একটু অপেক্ষা কর আমার জন্য। আমিও তোমাকে ভালোবাসি মৃত্তিকা।