somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তিয়াশা

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

০১
আমি আসলে অতটা ভালো লোক না। সকাল বেলা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রোজ এই কথাটাই আমি ভাবি। আর আমার বাসার থেকে একটু দূরে যে বস্তিটা আছে তার থেকে তখন মেলা খিস্তি শোনা যায়। এটা কি আমার মনের কথাগুলো কে সায় দিয়ে, না কি না দিয়ে সেটা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারলাম না।

ঘুম ভাঙ্গার পর মুখ-চোখ ধুয়ে নগদে এক গ্লাস জল গিলে ফেলি। অনেকে একদম বাসি মুখে খেতে বলে আমাকে। কিন্তু পারি না। বাসি মুখে কিচ্ছু খেতে পারি না, বমি এসে যায়। এমনকি চুমু পর্যন্ত খেতে পারব কি না সেই বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যাই হোক ঐ জল খাবার পরেই অফিসে যাবার জন্য বের হই। আমার একটা খাটারা টাইপের ৫০ সিসি মোটর সাইকেল আছে, নাম দিয়েছি “বাঘা!”। টুক টুক করে অফিসে যাই, সারা ঢাকা চক্কর দেই অনেক রাত পর্যন্ত। আমার বিশাল দেহখানা ঐটুকু বাইকে কেমন করে আটে তা নিয়ে শুনেছি বিস্তর গবেষণা হয় আমার চেনা-পরিচিতদের মাঝে।

আজকে সকালে উঠেও সব শেষ করে বের হয়ে বাঘাকে চাবি দিয়ে অফিসে আসতেই দেখি আমার ডেস্কের পাশে রবি ঝিমুচ্ছে। আমি আস্তে করে ওকে পাশ কাটিয়ে ডেস্কে বসে দেখে নিলাম কি কি কাজ আছে। তারপর রবির কানে বরাবরের মত টোকা মেরে দিলাম। রবিও যথারীতি কান ডলতে ডলতে আমার দিকে ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে একটা ফ্যাকাশে হাসি দিল। আমি একটা চোখ মেরে জিজ্ঞেস করলাম, “কি কলির কেষ্ট! সকাল বেলায় বৃন্দাবনে না গিয়ে এখানে হানা দিলে কেন?” রবি ওর লম্বা চুলের ভেতর হাত বুলিয়ে বলল, “দাদা! আমার ইদানিং ঘুম হচ্ছেনা।” আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “সে কি! এখানে তো দেখলাম দিব্যি ঘুমুচ্ছিলি!” রবি চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, “ও সে তো আমি টুকটাক ঘুমিয়েই নেই। বলি কি আমাকে এক-দুই দিনের জন্য তোমার বাসায় থাকার অনুমতি দাও। তোমার ওখানে আমার জব্বর সাউন্ড স্লিপ হয়।” রবিকে আমি আগামী ৬ মাস আমার বাসার ধারে-কাছে আসতে মানা করেছি। আমার কথা না শোনার পানিশমেন্ট। আমি আমার পিসি চালু করে ওর দিকে তাকালাম, “আচ্ছা, আজকে রাতে যাস। এক কাজ কর এখনি চাবি নিয়ে চলে যা। কিছু টাকা দিচ্ছি বাজার করে নিস। রাতে এসে খিচুড়ি খাব।” আমি আমার মানিব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে রবিকে দিলাম। রবি টাকা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা, তুমি যে একলা একলা থাক, তোমার খারাপ লাগে না? মাসিমা যাবার পর থেকে অনেক একলা হয়ে গেছ মনে হয় না?” আমি একটু থমকে গেলাম। ডেস্কে রাখা মা’র ছবির দিকে তাকাতেই মনের মধ্যে একগাদা স্মৃতি দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। আমি রবির দিকে না তাকিয়েই বললাম, “বাড়ি যা। রাতে দেখা হবে।” রবি আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে উঠে চলে গেল।

রবি যাবার কিছু পরেই অফিসের পিয়ন হাসান এসে জানালো বস ডাকছে। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে আরেকবার মা’র ছবির দিকে তাকালাম। মনে হল মা বলছে, “আজকেও স্যান্ডেল পড়ে এসেছিস? একটা কেডস পড়তেও তো পারিস, পাজির পাঝাড়া!”

০২
আমার বস, জামিল ভাই খুব ভালো মানুষ। এই রাগেন তো এই ঠান্ডা। আমি তার রুমে ঢুকতেই উনি ঈশারা করলেন বারান্দায় যাবার জন্য। বুঝলাম তার সিগারেট খেতে হবে। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই একটা দমকা বাতাস মুখে এসে লাগল। বছরের এই সময়টাতে বেশ বাতাস বয়। আর এখান থেকে ঢাকার অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সন্ধ্যার দিকে আরো ভালো লাগে। জামিল ভাই প্রায়ই সন্ধ্যার সময় এখানে বসে থাকেন।

খুক করে একটা কাশির শব্দ পেতেই ঘুরে দেখি জামিল ভাই, বরাবরের মত তার হাতে সিগারেট। আমার দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন, “সার্ভিসিং এর নতুন মেয়েটা গত দুই দিন ধরে আসছে না। ঘটনা কি?” আমি হাই তুলে বললাম, “আমি কিভাবে বলি?” জামিল ভাই সিগারেট ধরাতে গিয়ে থেমে গেলেন, “সবাই বলল ওর সাথে তোমার নাকি খুব কথা হচ্ছে।” আমি বললাম, “একদিন শুধু এখান থেকে শাহবাগ পৌছে দিয়েছি। আমাকে ও তিনটা প্রশ্ন করেছিল আমি কিচ্ছু বলিনি।” জামিল ভাই অবাক হয়ে তাকালেন, “কেন? কথা বলনি কেন?” আমি আকাশের দিকে তাকালাম, “জানি না।” জামিল ভাই গলা খাকারি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়েই বললেন, “যদি ওর বাসা চিনে থাক একটূ খোঁজ নাও। মেয়েটা ভালো কাজ পারে।” আমি হেসে ফেললাম, “কর্তার হুকুম যখন তাহলে তো পাকা ধানে মই দিতেই হবে। আচ্ছা দেখছি।”

জামিল ভাইয়ের ওখান থেকে বেরিয়ে আসার পর আমি একটু ভাবলাম। মেয়েটির নাম তিয়াশা। তেমন আহামরি দেখতেও নয়। অফিসে তো আরো মেয়ে আছে, ওদের মত নয়। আমাদের এই অফিসে সবাই খুব হৈ হৈ করে কাজ করে। ও একমাস ধরে এসেছে। নিজের মত কাজ করে যায়। আমার সাথে কথা বলতে এসেছিলো, আমি কথা বলিনি। আসলে মা চলে যাবার পর থেকেই ইচ্ছে না হলে কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না। ওর বাসা কোথায় যেন বলেছিল? পরীবাগ মনে হয়। আজ অফিস ছুটি হলে যাব ভাবলাম। কিন্তু কেন যাব তার কারণ বুঝলাম না।

০৩
মোট ৬ বার কল দেয়ার পরে তিয়াশা ফোনটা ধরলো। আমি বললাম,
- কি ফোন কই থাকে?
- কেন ফোন দিয়েছেন?
- না। অফিসে আসছেন না। তাই আর কি।
- তাতে আপনার কি?
- আমার কিছুই না।
- হুম!
- আপনার বাসাটা জানি কই?
- কেন?
- বাসায় বেড়াতে আসতাম। আসলে আমার বেড়াতে যাওয়ার কোন জায়গা নেই তো
- (একটু চুপ থেকে) আচ্ছা। মেসেজ করে দিচ্ছি।

মেসেজ পাবার পর দশ মিনিট ভাবলাম। যাব কি যাব না। একটা কি আকর্ষণ টের পাচ্ছিলাম। বাঘা কে নিয়ে ওর বাসায় চলেই এলাম। ৮ তলা বাসার শেষ ফ্লোরটাতে থাকে তিয়াশা। দরজার সামনে দেখি একটা দড়ি ঝোলানো। তার পাশে সুন্দর করে লেখা- টানুন। দিলাম টান। ভেতরে টং টং করে কিছু একটা শব্দ পাওয়া গেল। তারপরে পায়ের আওয়াজ। তারপর দরজা খোলার শব্দ, আর তারপরে তিয়াশার মুখ। মুখে একটা স্মিত হাসি দিয়ে বলল, “চলে আসুন।” আমি বাসায় ঢুকে আর কোন প্রাণের চিহ্ন পেলাম না। একটু অবাক হয়েই বললাম, “আর কেউ নেই? মানে থাকে না?” তিয়াশা ঈশারায় আমাকে সোফাতে বসতে বলে কিছু না বলেই ভেতরে চলে গেল। আমি পুরো ঘরটা দেখলাম। না, আসলেই মেয়েটা অন্যরকম। প্রচুর বই, শো পিস, একটা বেহালা আর একটা বড় জানালা। আচ্ছা ও কি এই জানালার ধারে রাত জেগে বসে থাকে? কে জানে!

দুই হাতে দুই মগ হাতে তিয়াশা রুমে ঢুকতেই নাকে কফির গন্ধ এসে আলতো করে টোকা দিল। আমাকে কফি দেয়ার পর তিয়াশা বলল, “না নেই। কেউ থাকে না। আব্বু-আম্মু দুইজন কার ক্র্যাশে মারা গেছেন। শুধু আমি আছি।” আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, “অফিসে গেলেন না যে?” তিয়াশা কফির কাপটা সামনে রাখা টেবিলের উপর রেখে বলল, “গত ১০ বছর ধরে এই দুদিন আমি বাসা থেকে বের হই না।” আমি চেয়ে আছি দেখে ও বলল, “আজ আমার জন্মদিন।” আমি একটু অবাক হলাম। আমি বুঝলাম আমি কিছু একটা পেয়েছি। যার অপেক্ষায় অনেকে জন্ম-জন্মান্তর পার করে দেয়। আমি কফির কাপ রেখে দিলাম। তারপর একদম সরাসরি বললাম, “শুভ জন্মদিন।” তিয়াশা একটা ছোট হাসি দিয়ে বলল, “গিফট কই?” আমি গলা খাকারি দিয়ে বললাম,

“ মেঘলা দিনে দুপুরবেলা যেই পড়েছে মনে
চিরকালীন ভালোবাসার বাঘ বেরুলো মনে...
আমি দেখতে পেলাম, কাছে গেলাম, মুখে বললামঃ খা
আঁখির আঠায় জড়িয়েছে বাঘ, নড়ে বসছে না।”

তিয়াশা বলল, “শক্তি চট্টপাধ্যায় এর কবিতা! আপনি পড়েন?” আমি বললাম, “ পড়ি। এবার তোমাকে পড়তে চাই। হাজার বছর ধরে।”
তিয়াশা কফির কাপটা তুলেছিল মাত্র আর সেটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল মেঝেতে পড়ে। আমি দেখলাম কি এক কুয়াশায় আমি তিয়াশার মাঝে মিশে যাচ্ছি। আহা! আমি তো আর একলা থাকলাম না!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৩
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×