লাথি দিয়ে দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকবার পরেই আমি দেখলাম সালেক সিলিং ফ্যানের সাথে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছে। বিদ্যুৎ গতিতে আমি ছুটে গিয়ে ওর পা জড়িয়ে ধরলাম। বুঝলাম এখনও বেঁচে আছে। গলা ফাটিয়ে আমি চিৎকার করতে থাকলাম, “সনেট, শাফিন বাইরে বসে খিল্লি না করে ভেতরে আয়! এই শালারা কানে কালা হয়েছিস?” সবাই দুদ্দার করে চলে আসাতে আমার একটু সুবিধাই হল। সবাই মিলে সালেককে নামিয়ে রাখতেই আমি ছুটে গেলাম ডাক্তারকে ডাকতে। বের হতে হতে শুনলাম শাফিন ফিচেল মার্কা একটা হাসি দিতে দিতে বলছে, “আরে! মরা কি এত্ত সহজ!
আসলেই তো মরা কি এত্ত সহজ! সালেক রাগারাগি করে যখন হলে ফিরে এসেছিল তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তারপরেও একটা সিগারেট শেষ করে আসতে আসতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক ডাক্তার চলে আসার পরে আমার আর কোন চিন্তা ছিল না। কিন্তু শাফিনের সেই কথা, মরা কি এত্ত সহজ- এই কথাটা আমার মাথায় খুব ঘুরপাক খাচ্ছিল। আর বারবার মাথায় প্রশ্ন ঠুকছিল, আসলেই মরা কি এত্ত সহজ!
আমিও মরতে চেয়েছিলাম। মরে পচে যেতে চেয়েছিলাম। যেন কেউ টের না পায় কেন এই মৃত্যু। আসলে ঐ সময় আমার করার কিছু ছিল না। যখন নিজের রক্ত করে বেঈমানি তখন আর কি করার থাকে। আমার মনে পড়ে গেলো সেই রাতের কথা যখন আমি আমার মা’র হাত ধরে ছুটছি, অন্ধকারে। সকাল হলেই মানুষজন আমাদের খুঁজবে। কিন্তু তারা বুঝবে না যে আমাদের কোন দোষ নেই। যার দোষ সে তো গায়েব হয়ে গিয়েছে। অনেক কষ্ট করে মাকে নিয়ে আমি ঢাকা চলে এসেছিলাম। আজ এখানে, কাল ওখানে। এর গালি খেয়ে ওর গালি খেয়ে একটু বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে আমি ছুটে চলছিলাম।
কাজ খুঁজছিলাম পাগলের মত। এমনকি ৫০টাকার কাজ পেলেও না করছিলাম না। মার শরীরের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। ডাক্তার দেখানোর টাকাও ছিল না। আমি ঢাকার এক মাথা থেকে আরেক মাথা ছুটেছি শুধু কাজের আশায়। একটু টাকার জন্য আমি নাওয়া-খাওয়া সব ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার সব কষ্টে জল পড়ল। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি মা’র বরফ ঠান্ডা দেহ আমার পাশে। আহারে! কখন যে ঘুমের মাঝেই মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে আমি টেরই পাইনি। মা আমাকে ঐ সময়টাতে প্রায়ই বলত, “তোকে আমি মুক্তি দিয়ে যাব।” কিন্তু আজও আমার মা’র কাছে প্রশ্ন, মা! এ তুমি কেমন মুক্তি আমাকে দিয়ে গেলে?
মা চলে যাবার পরেই আমি আবার হলে ফিরে আসি। আমার অনার্স তখনও শেষ হয়নি। সব বন্ধুদের মাঝে আমি সারাদিন লুকিয়ে থাকতাম। কি করা! এক জান্তব বিষাক্ত নিঃসঙ্গতা আমাকে আস্তে আস্তে খেয়ে ফেলছিল। দুই-একটা টিউশনি করাতাম। এর ওর গীটার নিয়ে একটা দুটা গান গেয়ে দিতাম। ক্লাশে যাবার কোন ইচ্ছাই ছিল না। আমি খেয়াল করে দেখেছিলাম মা চলে যাবার পর সবকিছুই আমার কাছে অর্থহীন হয়ে গেছে। কিন্তু বেঁচে থাকতে হলে তো টাকা দরকার।
হঠাৎ করেই আমি কাজ পাওয়া শুরু করলাম। ছোট ছোট কাজ। তাতেই আমার হাত খরচ হয়ে যেত। হায়রে! এই কাজগুলো যদি আরেকটু আগে পেতাম তাহলে মা মনে হয় বেঁচেই থাকত। আস্তে আস্তে কিছু কাজের মধ্য দিয়ে আমার নাম একটু-আধটু ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। কিন্তু আমার ভেতরে সবসময় প্রচন্ড এক হতাশা কাজ করত। নিজেকে গুঁটিয়ে ফেলা শুরু করলাম। কোথাও যেতাম না। কাজ থাকলে তবেই বের হতাম। এমন করে করেই অনার্স ফাইনাল দিলাম, টেনেটুনে পাশ করে গেলাম। কিন্তু হতাশা আমার পিছু ছাড়ছিল না। কারো সাথে আমি তখন ভালো করে কথা বলতে পারছিলাম না। নিজের উপরেই একটা জান্তব রাগ কাজ করত।
এসময়টাতে আমার মাঝে খুব বড় করে মৃত্যুচিন্তা দেখা দেয়। মাঝে মাঝে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় আমি টের পেতাম আমার শরীর বরফের মত ঠান্ডা হয়ে আসছে। কি এক বিষাদ আমাকে টানতে টানতে মাটিতে নামিয়ে নিয়ে আসছিল। আবার কখনও উপরে ছেড়ে দিত। পিংক ফ্লয়েড এর গান শুনতে শুনতে আমি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টায় থাকতাম। কিন্তু কিসের কি!
একদিন দোকান থেকে আমি ক্ষুর কিনে আনলাম। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বারবার দোকানদার জিজ্ঞেস করছিল ক্ষুর দিয়ে আমি কি কাজ করব। আমি কোনমতে বলেছিলাম যে নাটকের কাজে এই ক্ষুরটা লাগবে। অবিশ্বাসী দোকানদার আমাকে অবিশ্বাস করেই ক্ষুরটা দিয়েছিল। আমি আমার ব্যাগে সবসময় ক্ষুর নিয়ে ঘুরতাম। আর মাঝে মাঝেই বাথরুমে ক্ষুর নিয়ে বসে থাকতাম। কিন্তু কখনও হাতে একটা পোচ দিতে পারিনি। একটা ভয় কাজ করত। আমার এই ব্যাপারটা ধরা পড়ে যায় আমার বন্ধু শাহিদের কাছে। শাহিদ দেখেছিল যে আমি ক্ষুর নিয়ে রুমে বসে আছি। চেঁচামেচি করে আমার কাছ থেকে ও ক্ষুরটা কেড়ে নিয়ে যায়। আমার সামনেই ও ঐ ক্ষুরটা লেকের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল।
কিন্তু এই ঘটনার পর থেকেই আমার মাথায় আত্মহত্যার ব্যাপারটা বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। একদিন রাতে অনেকক্ষণ ধরে গান-বাজনা করার পর হঠাৎ করেই আমি উঠে চলে আসলে শাহিদের প্রচন্ড রকমের সন্দেহ হয়। আর ও রুমে এসে দেখে যে আমি হাতে ব্লেড নিয়ে বসে আছি। এবার চেঁচামেচি না করে ও আমার কাছে এসে বসতেই আমি হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেই। শাহিদ শুধু বলেছিল, “একলা থাকবি না। দরকার পড়লে কাজের সাথেই দোস্তি করে একসাথে থাকবি।” সেখান থেকেই আমার পরিবর্তন শুরু হয়। আস্তে আস্তে আমি পড়ালেখা ছেড়ে দেই (সে এক অন্য ব্যাপার), মাস্টার্সটা আর করা হয়নি। কিন্তু কাজে মাথা গুঁজে দেয়ার ফলে আমি বেশ আনন্দেই থাকতাম। যাবার জায়গা নেই কোথাও, তাই আমি হলেই চলে আসতাম। আমার যা কিছু জমত তাই খরচ করে ফেলতাম কিন্তু ভালো ছিলাম। কিন্তু নিজেকে আমি খুন করতে পারিনি। সালেক কি করে পারলো অমন একটা চিন্তা করতে আমি বুঝতে পারছিলাম না।
সালেক ঘুমাচ্ছিল বলে ওকে আর জাগাইনি। শাফিনকে নিয়ে বসে ছিলাম। শাফিনের দিকে আধ খাওয়া গোল্ডলিফটা দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম, “কেস কি?” শাফিন এক বুক ধোঁয়া টেনে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে হা হা করে হেঁসে উঠলো। আমি অবাক ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। শাফিন হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কেস যাই হোক রে বাপজি, মরা অত্ত সহজ ব্যাপার না। আমার নানীর বয়স এখন ৯৫। বুড়ির এখনও আরো বেঁচে থাকার শখ। আসলে নিজেই নিজেকে মারা খুব কঠিন কাজ। ” আমি মাথা নামিয়ে মনে মনে ভাবছিলাম, “আসলেই। খুব কঠিন কাজ। নিজেই নিজেকে মেরে ফেলে খুব কঠিন।”
আসলে হতাশার মাঝে বেঁচে থাকা একটা খুবই চ্যালেঞ্জের কাজ। যে বেঁচে যায় সেই জানে এইটুকু সময়ের কথা। আর কেউ জানে না, জানবেও না। মরা অত্ত সহজ ব্যাপার না!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৫:২৬